আমার গ্রাম
ছেলেবেলার কথা মনে এলেই, মনে পড়ে আমার গ্রাম, আমার শৈশব। শৈশব কেটেছে গ্রামে। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার একটি গ্রাম, ঝিকিড়া। শান্ত, নিরিবিলি, পাখি ডাকা, ছায়াঢাকা একটি গ্রাম বলতে যা বোঝায়, তাই। মেঠোপথ, অদূরে মহাসড়ক-ছুটে চলেছে বগুড়া-নগরবাড়ি মহাসড়ক নামে। এখন আর এই সড়কটি উত্তরবঙ্গ থেকে রাজধানীতে যাওয়ার মূল সড়ক নয়। অথচ যমুনা সেতু তৈরির আগে, আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে ছুটে চলা এই একরোখা পথটিই ছিল রাজধানীতে পৌঁছার একমাত্র পথ। উত্তরবঙ্গের সব জেলার মানুষই এই পথে আসতেন যমুনা নদীর তীরের নগরবাড়ি ঘাটে। তারপর ফেরি পার হয়ে- আলো ঝলমল রাজধানীর দিকে। আতশবাজি ফানুস ওড়ানো রাজধানী আমাকে কখনোই টানে না। আজও মন পড়ে থাকে গ্রামে। মনের ভেতর গুনগুন করে ওঠে, ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ, আমার মন ভোলায় রে।’ আজও মন হারিয়ে যায়। আমাদের গ্রামের পথ লাল না, আমাদের গ্রামের কোনো পোশাকি ঔজ্জ্বল্য নেই, নেই কোনো বিশেষত্ব। তবু আমার আপন, আমার নিজের গ্রাম ঝিকিড়া।
গ্রামের বাড়িগুলো ছিল ছড়ানো ছিটানো। আমাদের বাড়ি ছিল একদম মাঝে। সব বাড়িতেই নানারকম গাছগাছালি। ফুল, ফল আর কাঠের। বাঁশঝাঁড়ও ছিল বেশ কয়েকটি। উপজেলা সদরের মাঝে হলেও, ঝিকিড়া ছিল মূলত গ্রাম। একদম নিরিবিলি, লক্ষ্মী মেয়ের মতো। আদুরে ঘোমটা দেওয়া বউয়ের মতো। কোন হৈ চৈ এখানে স্পর্শ করতো না। আমাদের বাড়ির চারপাশে ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি। আমরা ছিলাম একদম দ্বীপের মতো। সকালে ঘুম ভাঙতো কাসা আর শঙ্খের শব্দে। সন্ধেও হতো সেভাবেই। আমাদের বাড়ির একপাশের কয়েকটি বাড়িতে যারা থাকতেন, তাদের পেশা ছিল ঢোল বাজানো। বিয়ে বাড়ি থেকে পূজার মণ্ডপ; সবখানেই ঢোল বাজাতে তাদের ডাক পড়তো। সেই বাড়িটা আমাদের কাছে ঢুলী বাড়ি নামেই পরিচিত ছিল। আর তাই আমাদের ঘুমাতে যাওয়া অথবা সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার প্রতিদিনের তালিকায় যোগ হতো ঢাক ও ঢোলের শব্দ। এখনো কান পাতলে আমি সেই ঢাক ও ঢোলের শব্দ শুনতে পাই। এখনো পূজার মণ্ডপে ঢোলের শব্দে আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ঝিকিড়ায় ফেলে আসা দিনগুলো।
গ্রামে তখনো পাকা সড়ক হয়নি। মেঠোপথ, ধুলো ওড়া। সামান্য বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি। উপজেলা অফিসের খুব কাছে হলেও, পাকা পথ তৈরি হয়েছে মাত্র সেদিন। গ্রামের শুরু ছিল মার্চেন্ট স্কুলের পেছন থেকে, স্কুল পেরিয়ে এলেই পাকা সড়ক শেষ, শুরু হয়েছে মেঠোপথ। একটু এগিয়ে এসে হাতের বামে চলে যাওয়া যেতো মহাসড়কে, আর হাতের ডানে মেঠোপথ নিয়ে যেত ঝিকিড়া গ্রামের পথে। এখানে, এই তিন মাথায় ছিল একটা ছোট ফাঁকা জায়গা। তখন আমরা মাঠই বলতাম। সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল এক মহীরুহ। সেই বয়সী বটের ঝিলিমিলি পাতা ছিল আমাদের খেলার সঙ্গী। তার ডালে, পাতায় বসে থাকতো, নানা রঙের পাখি। তারা বটের লাল টুকটুকে ফলগুলো খেতো, গাছে অনেকগুলো কোটরও ছিল, আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, তা থেকে একদিন স্কুল ফিরতি পথে আমি একটি পাখির ছানা কুড়িয়ে এনেছিলাম। তাকে বাঁচাতে পারিনি, মা ছাড়া, মায়ের ওম ছাড়া বাঁচবে কী করে, ওর তো তখনো পালকই গজায়নি। স্কুলে যাওয়ার পথে আমি এই বটগাছের নিচেই অপেক্ষা করতাম, অন্যগ্রাম থেকে আসা বন্ধুদের জন্য। আবার স্কুল ফিরতি পথে এখান থেকেই আমরা আলাদা হয়ে যেতাম। যে যার পথে চলে যেতাম। বটগাছটা পেরিয়ে এলেই, হাতের ডানে পড়তো এক বিশাল তেঁতুল গাছ। কি ঘন হয়ে নেমে এসেছিল তার ঝিরিঝিরি পাতা! কি অদ্ভুত তার নির্জনতা! আমরা ভয়ে অস্থির হয়ে থাকতাম। মনে হতো এ গাছে ভূত আছে। গাছের নিচেই ছিল ছোট্ট একটা খাল। তাতে পড়ে থাকতো পাকা তেঁতুল। আমরা ভয়েই কোনোদিন ওই তেঁতুল তুলিনি। মনে হতো, তেঁতুল তুলতে গেলেই, ভূত এসে কামড়ে দেবে। স্কুল ফেরার সময়টা ছিল সবচেয়ে আতঙ্কের। একা একা যেদিন ফিরতে হতো, ভরদুপুরে, উহ! কি যে ভয়, ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মনে হতো এই বুঝি সব ভূত একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর। বটগাছটি পার হলেই, হাতের বইগুলো জামার মধ্যে ঢোকাতাম। তারপর জামাটা শক্ত করে গেঁড়ো দিয়ে দিতাম এক ছুট। এক দৌড়ে বাড়ি। সঙ্গে বন্ধুরা থাকলেও একই নিয়ম। শুধু বড় কেউ থাকলে আমরা তার হাত ধরে হেঁটে পার হয়ে যেতাম জায়গাটা। তেঁতুলতলা নামে পরিচিত এই জায়গাটা পার হয়ে হাতের বামে বাঁক ঘুরলেই ছিল একটা কালি মন্দির। যদিও ছেলেবেলা থেকেই পূজা, অর্চনা দেখে অভ্যস্থ, তবু কেন যেন মধ্যদুপুরে ওই গা ছমছমে তেঁতুলতলা পার হয়ে আসার পর যখন দেখতাম. জিব বের করে কালি আমার দিকে তাকিয়ে আছে, হাতে অস্ত্র। তখন ভয়টা আরও বেড়ে যেত। এই মন্দিরটা পার হয়ে একটু এগিয়ে হাতের বামের পথে ছিল আমাদের বাড়ি। বাড়িতে ঢোকার আগে রাস্তার দুপাশে ছিল দুটো খাল। এখানে বড়শি দিয়ে আমরা বর্ষায় মাছ ধরতাম।
আমাদের বাড়িটা ছিল আধাপাকা। ইটের গাঁথুনি, আর ওপরে ছিল টিনের চাল। বারান্দাটা ছিল টিনের। এখানে, এই বারান্দার বাঁশের ফাঁকে ফাঁকে কতো যে চড়ুই পাখি বাসা বাঁধতো, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আর সেই ঢুলি বাড়িতে ছিল- বিরাট এক দেশি বড়ই (কুল) গাছ। চড়ুই পাখির দল দিনের বেলা, সন্ধ্যে বেলা ওখানেই হল্লা করতো, খুনসুটিতে মেতে থাকতো। শুধু বিশেষ বিশেষ সময়ে ওরা আমাদের বাড়ির টিনের চালায় বাসা বানাতো। তাতে বাচ্চা হতো। কিন্তু কেন যেন, প্রায় দিনই ঘুম ভাঙার পর দেখতাম, চড়ুই ছানাগুলো চালা থেকে মাটিতে পড়ে আছে। সেগুলোর বেশিরভাগই থাকতো মৃত। আমি আর আমার ছোট বোন, ওই চড়ুইছানাগুলোকে হাতে করে নিয়ে যেতাম, বাড়ির পেছনের মাঠে, ওখানে ওদের কবর দিতাম। আমাদের বাড়িতে দুটো কদম ফুলের গাছ ছিল, এখনো আছে। ওদের বয়স আমার চেয়ে একটু বেশি। তবে আমরা বেড়ে উঠেছি প্রায় একসঙ্গে। ভরা বর্ষায় এ দুটো গাছে কি অদ্ভুত সুন্দর কদম ফুল ফুটে থাকতো, তা চেয়ে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। গ্রামে আর যাওয়া হয় না, বাড়িটা আছে, ওখানে আমার এক চাচা থাকেন, কদম গাছদুটোও আছে। তবে ওরা এখন শত্রু পরিবেষ্টিত। অনেক বড় হয়ে ওরা এখন আকাশ ছুঁতে চায়। আর এই আকাশ ছুঁতে চাওয়াই ওদের বিপদ ডেকে আনছে। প্রতিবেশীরা ওদের প্রতি বিরক্ত। কারণ ভরা বর্ষায় ওরা এখন আরও বেশি ফুল ফোটায়, সেগুলো যখন ঝরে পড়ে, আশপাশের বাড়ির ছাদে, টিনের চালে, তখন নাকি পরিবেশ নোংরা হয়ে ওঠে। কদম ফুলের ঝরে পড়ার শব্দে- শিশুরা ভয় পায়। তাই ওদের কেটে ফেলার জন্য আমার বাবার কাছে চাপ আসে, আসছে। আমার বয়সী দুটো গাছ, ওরা না থাকলে কি আমি থাকব? দেখা হয় না, কথা হয় না, তবু তো ওদের স্মৃতি আমার মন থেকে একটুও দূরে সরে যায়নি। ওরা তো আমার কথা ভেবেই আজও ফুল ফুটিয়ে যায়। আমার ছেলে বড় হচ্ছে, ওর বয়সী কোনো গাছ তো আমি পৃথিবীতে লাগাইনি। যা দেখে ও একদিন গর্ব করবে বলবে, আমার বয়সী গাছ।
আমাদের বাড়ির পেছনে ফাঁকা জায়গা। একটা ফসলি জমির মাঠ। ধান, পাট সবই সেখানে লাগাতো জমির মালিক। যখন সেখানে ফসল লাগানো থাকতো না, তখন তা ছিল আমাদের খেলার মাঠ। ওই মাঠের পরেই ছিল একটি পোড়া বাড়ি। বেশ বড়সড়ো ফাঁকা একটা জায়গা নিয়ে বাড়িটা। বাড়ি বলতে ওখানে শুধু টিনের চালার একটি বড় ঘর। আর বাইরে একটি পানি তোলার কুয়ো। বাড়িটতে কেউ থাকতো না। কাউকে কোনোদিন দেখেছি বলেও মনে পরে না। ওখানে আমরা ভয়ে কেউ যেতাম না। কারণ ওটাও ছিল, ভূতের বাড়ি। আমাদের বিশ্বাস দৃঢ় হতো, কারণ কোনো রাখাল ছেলেকেও ওই বাড়িতে কোনোদিন যেতে দেখিনি। মাঠে গরু চরালেও, তারা বিশ্রামের জন্য আমাদের বাড়ির পাশেই এসে বসতো। কখনোই ওই বাড়িটাতে যেত না। আমাদের বাড়ির পেছনের ছিল গার্ডসাহেব দাদার বাড়ি। উনি রেলওয়েতে চাকরি করতেন। ওনার নাম আমি জানি না। ওনাকে আমরা গার্ডসাহেব দাদা বলেই ডাকতাম। তার বাড়িতে ছিল নানা রকম ফলের গাছ। জলপাই, জাম, কামরাঙ্গা গাছগুলো ছিল আমাদের নখদর্পনে। আমরা চুপিচুপি ওখান থেকে ফল পেড়ে আনতাম। দাদার বাড়িতে, দাদিকে কাজে সহায়তা করার জন্য ছিলেন একজন বৃদ্ধা। তাকে সবাই জাফরের দাদি বলে ডাকতো। আমরাও দাদি বলতাম। উনি যদি টের পেতেন, আমরা বাগানে ঢুকেছি, তাহলে চিৎকার চেঁচামেচিতে পাড়া অস্থির করে তুলতেন। আমরাও ভয়ে ভয়ে থাকতাম। তবে বড় হওয়ার পর বুঝেছি, উনি আমাদের খুব স্নেহ করতেন। ঝিকিড়া ছেড়ে আসার পর, যতবারই গিয়েছি গ্রামে জাফরের দাদির সঙ্গে দেখা হয়েছে, আমরা না গেলে আব্বা যখন যেতেন, তাকেও তিনি আমাদের কথা জিজ্ঞেস করতেন। অনেক পরে শুনেছি, উনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
গার্ডসাহেব দাদার বাড়িতে একটা পুকুর ছিল, ওই পুকুরে আমরা গোছল করতে যেতাম। তবে সেও মাঝে মাঝে লুকিয়ে যেতে হতো। কারণ দাদার এক ছেলে, পুকুরে মাছ চাষ করতেন। আমরা পুকুরে নামলে তিনিও শুরু করতেন চিৎকার, চেঁচামেচি। দাদার নাতিরা ছিল আমাদের বন্ধু। ওরা খবর দিতো, সেই চাচা কখন বাজারে যাবেন, উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেই আমরা নেমে পড়তাম পুকুরে। গার্ডসাহেব দাদার বাড়িটাই ছিল আমাদের গ্রামের শেষ সীমা। এটা পেরিয়ে আরও কিছু পথ, সে পথ ছিল আলপথ। তা ধরে এগিয়ে গেলে চোখে পড়তো একটি নদী। তখন নদীই ভাবতাম। কিন্তু পরে জেনেছি, ওটা নদী নয়, ফুলজোড় নদী থেকে বেরিয়ে আসা নদীর একটি মৃত শাখা। কিন্তু ওই নদীটাই তখন ছিল আমার বাধা। আমি ভাবতাম, ওই নদী পেরিয়ে গেলেই আকাশটাকে ধরা যাবে। নদীর ওপারে থাকা গ্রামটার শেষে নেমে এসেছে আকাশ। কিন্তু আমার সে স্বপ্ন কোনোদিনই পূরণ হয়নি নদীটার জন্য। আজ নদীটা মৃত- ওখানে কোনো পানি নেই। নদীর বুকেই কোথাও কোথাও উঠে পড়েছে বাড়িঘর। আজ অনায়াসেই নদীটা পেরিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু আমার আকাশ ছোঁবার স্বপ্ন পূরণ হয় না। কারণ, আকাশ তো আমার জন্য হাত বাড়িয়ে ওই গ্রামের শেষে বসে নেই। সেও আমার মতো বড় হয়ে গেছে।
একসময় প্রায়ই যাওয়া হতো আমার গ্রামে। আজ অনেক দিন যাওয়া হয় না। যাদের কাছে, যাব তারা আজ গ্রাম থেকে দূরে। সেই বাড়িগুলো নেই, সেই বাড়িতে থাকা মানুষগুলো নেই। নেই সেই গাছগুলো, সেই বাঁশঝাড়, সেই খাল, নদী। স্মৃতির জানালায় এখন শুধু পড়ে আছে আমার সহোদর দুই কদম গাছ। আর সেই ঝাঁকবাঁধা দুষ্টু চড়ুইয়ের দল। না, সেই ভয় ধরানো তেঁতুল গাছ বা আমাদের বন্ধু সেই বুড়ো বট, তারা কেউ নেই। শহর গ্রাস করছে এখন গ্রামকে। একসময় গ্রাম চলে আসতো শহরের কাছে, আজ শহরই ছুটে চলেছে গ্রামের দিকে। সভ্যতার নামে এখন চারদিকে- শুধু স্মৃতি মুছে ফেলার তোড়জোর। তারই থাবায় পরে চিরতরে হারিয়ে গেছে ঝিলিমিলি পাতার সেই বটগাছ। যেখানে মাথা তুলে সভ্যতার অস্তিত্ব ঘোষণা করছে একটি পাকা মার্কেট। আর ভয় ধরানো সেই তেঁতুল গাছ, আমার স্মৃতিতে থাকা তার গায়ের ব্যস মনে করিয়ে দেয়, তার বয়স তখনই কম করে হলেও হবে পঞ্চাশের অধিক। সেও হারিয়ে গেছে সভ্যতাকে জায়গা করে দিতে। তার ডালে আশ্রয় নেওয়া বক, ঝড়ে যাদের ছানারা কখনো কখনো মরে পড়ে থাকতো মাটিতে, সেই ছানারা যারা রাতের আঁধারে ভয় পেয়ে মানুষের গলায় কেঁদে উঠে আমাদের ভয় বাড়িয়ে দিত। ভূতের শিশুরা কেঁদে উঠছে ভেবে আমরা ভয়ে লুকিয়ে পড়তাম মায়ের উষ্ণতার কাছে। চলবে…