আপনি কাকে ভালোবাসেন
সবার জীবনে প্রেম আসে, তাই তো সবাই ভালবাসে।
প্রথম যারে লাগে ভালো, যায় না ভোলা কভু তারে।
বাংলা চলচ্চিত্রের খুবই জনপ্রিয় গান। বাংলা চলচ্চিত্রের বিভিন্ন গান একসময় মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। চলচ্চিত্রের সোনালি সময়, সেই সাদাকালোর যুগের পরে, নব্বইয়ের দশকেও, এই রেশ ছিল। চলচ্চিত্র দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে দলবেঁধে যেত মানুষ। নতুন কোনো চলচ্চিত্র এলে আমরা বন্ধুরাও চলে যেতাম। সেইসব চলচ্চিত্রের কোনো কোনো গান, আমাদের কণ্ঠে উঠে আসতো। গুনগুন করেই শুধু নয়, গানগুলো হাটে-মাঠেও শোনা যেত, মাইকে, লোকের মুখে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। সোনালি সেই অতীতের জন্য দীর্ঘশ্বাস না, ওপরের গানটি হঠাৎ করেই মনের মধ্যে গুনগুন করে উঠলো।
চলতি পথে, হাঁটার সময়ে এলোমেলো নানান ভাবনা মাথায় ভর করে। সেগুলোর মাঝেই গানটি উঁকি মারে। তাই হাঁটতে হাঁটতেই গুনগুন করছিলাম। এই একটি লাইনই বারবার। পরের লাইনগুলো মনে নেই। যদিও এখন মনে না থাকাও বড় কোনো সমস্যা নয়। হাত বাড়ালেই ইউটিউব থেকে শুনে নেওয়া যায় যেকোনো গান। এই মনে না পড়ার মাঝেই, এই গুনগুনিয়ে গাইবার মাঝেই মন চলে যায় দিনাজপুরে। তখন আমার কৈশোর উত্তীর্ণ বয়স। স্কুলের গণ্ডি পার হইনি। স্কুল ফাইনালের অল্প সময় বাকি।
দিনাজপুর থেকেই শুরু করেছিলাম আমার স্কুলের পাঠ। তারপর নানা জায়গায়। মাঝের কয়েক বছর পরে, বেশ কয়েকটা স্কুল পাল্টে ভর্তি হই দিনাজপুর পৌরসভা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ক্লাস নাইনে। আমরা থাকতাম বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আবাসিক এলাকায়। বালুবাড়ি পাওয়ার হাউস, নামেই পরিচিত। আবাসিক এই কম্পাউন্ডের দেয়ালের সঙ্গে লাগানো আমার স্কুল। ঘরের জানালার শিক বেয়ে ওপরে উঠে দাঁড়ালে ক্লাস রুম দেখা যেত। স্কুলে কোনো কারণে না গেলে জানালায় দাঁড়িয়েও কথা বলা যেত বন্ধুদের সঙ্গে।
পুরো কম্পাউন্ড ভর্তি ছেলে-মেয়ে। ছোট-বড় সবার সঙ্গেই কথা হতো। তবে স্কুল থেকে ফিরে, বিকেলে কম্পাউন্ডের ভেতরে থাকতাম না। চলে যেতাম সাইকেল নিয়ে। বাইরের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা শেষে সন্ধ্যায় ফিরতাম।
বাউন্ডারির ভেতরে যারা থাকে, তাদের মনে বদ্ধ জীবনের দম আটকানো পরিবেশ হয়তো খোঁচা দেয়। তাই আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সব সময়ই কোনো না কোনো ঘটনা, কোনো না কোনো রটনা ঘুরেফিরে আলোচনায় থাকেই। আমাদের কলোনিও এই স্বাভাবিকতার বাইরে ছিল না। তাই আমাদেরও ঘটনা-রটনার অভাব হয়নি কখনো। কেন জানি, আমিও থেকেছি এইসব আলোচনার বিষয় হিসেবে। মাঝে মাঝেই আমাকে নিয়েও আলোচনা থাকতো। এই সময়, মানে নবম-দশম শ্রেণীতে পড়ার এ দু’বছরে আমার নামে দেয়াল লিখন হয়েছে, হাতে লেখা পোস্টার টানানো হয়েছে। (এই অংশের বর্ণনা পরের কোনো পর্বে)।
জানি না কেন, তবে ওই সময় আমার প্রতি সবার আগ্রহ একটু বেশিই মনে হয়েছে। সেটা স্কুলেই হোক আর কলোনির ভেতরেই হোক। ক্লাসে ভালো ছাত্র হিসেবে সুনাম কোনোদিনই ছিল না। বছরে তখন তিনটা পরীক্ষা হতো। প্রথম সাময়িকী, দ্বিতীয় সাময়িকী বা ষান্মাষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা। প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় কখনো সব বিষয়ে পাস করেছি? মনে করতে পারি না। কোনো না কোনো বিষয়ে ফেল করতামই। এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকতো গণিত। তাই প্রতিবারই পরীক্ষা দিয়ে টেনশনে থাকতে হতো, পাস করব কি না এই ভেবে। তবে বার্ষিক পরীক্ষায় কখনো আটকে যাইনি। তখন একবারেই উতরে যেতাম। যদিও তা হতো টেনেটুনে। এজন্য স্কুলে শিক্ষকদের হাতে বেতের বাড়িও জুটতো। প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার উত্তরপত্র ক্লাসেই নগদ প্রাপ্তিসহ বুঝিয়ে দিতেন শিক্ষকরা। আমিও উত্তরপত্র ফেরত পাওয়ার পর, কয়েকদিন গা থেকে জামা খুলতাম না। এমনকি গোছলের সময়েও জামা পরে থাকতাম কখনো কখনো, যদি হাত ও পিঠের দাগটা স্থায়ী হতো। বাড়িতে অবশ্য আলাদা করে কিছু জুটতো না। কারণ স্কুলে যা পেতাম, তা দেখে বাড়ির কারও আর নতুন করে প্রাপ্তি যোগ করার ইচ্ছে হয়তো হতো না।
প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িকীর রেজাল্ট কার্ড ফেরত দিতাম আমার স্বাক্ষরেই। স্কুলে থাকতেই স্বাক্ষর, আজকের অটোগ্রাফ দেবার অভ্যাস ভালোভাবে রপ্ত করেছিলাম।
ক্লাসের পাঠের জন্যও নগদ প্রাপ্তি জুটতো। তবে তা শুধু গণিত ক্লাসেই। অন্য বিষয়ের জন্য কখনো আলগা আদর জোটেনি। গণিতের মধ্যে জ্যামিতির জন্য জুটতো সবচেয়ে বেশি। উপপাদ্যগুলো এত ভালো করে মুখস্ত করতাম, স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সামনে চোখ বন্ধ করে দাড়ি, কমাসহ বলে দিতে পারতাম। কিন্তু শিক্ষক ক্লাসে এলে কিছুই মনে থাকতো না। আর কেন যেন টিচার ক্লাসে ঢুকে প্রথমে আমাকেই জিজ্ঞেস করতেন। আমিও দুই এক লাইন বলেই আটকে যেতাম। অমনি শুরু হয়ে যেত বৃষ্টির মতো বেতের আঘাত। কিন্তু কেন যে কিছুতেই মুখস্ত করা পড়াগুলো মনে করে বলতে পারতাম না, ভেবে পাইনি তখন। এখন মনে হয়, ভয়েই ভুলে যেতাম। শুধু গণিতের শিক্ষকই নন, অন্যান্য শিক্ষকদেরও বেশিরভাগ ক্লাসে এসেই আমার কাছে প্রথম পড়া শুনতে চাইতেন। কখনো না পারলে বেত একটাও মাটিতে পড়তো না। হয়তো শিক্ষকরা আমাকে বিশেষ নজরে দেখতেন। তবে কেন, তা জানি না। আবার এমনও হতে পারে, আমাকে মারার জন্য তাদের হাত নিশপিশ করতো, তাই আমার কাছেই সবার আগে জানতে চাইতেন ক্লাসের পড়া।
শিক্ষকদের বাইরে ক্লাশে আমাকে নিয়ে অন্যদেরও কৌতূহল ছিল। জানি না কেন? হয়তো নিয়মিত ফেল করতাম বলে। (বিশেষ দ্রষ্টব্য: কোনো ক্লাসেই আমি দু’বার থাকিনি।) আমার তখন খুব কলমের শখ ছিল। ইকনো বল পেনের রমরমা বাজার। এর সঙ্গে আরও নানারঙের নানা ধরনের কলম তখন বাজারে। আব্বা ডজন ধরে কিনে দিতেন নানা রকমের কলম। সেগুলো থেকে আমি একেকদিন একেকটা কলম নিয়ে স্কুলে যেতাম।
ক্লাস টেনে পড়ার সময়, সে বছর দিনাজপুরে খুব বন্যা হয়েছিল। বন্যার পানিতে সারাশহর তলিয়ে গিয়েছিল। বন্যায় আমাদের বাড়িতেও ঢুকে পড়ে পানি। খাটের নিচে চার-পাঁচটা ইট দিয়ে তার ওপর থাকার ব্যবস্থা। মাঠের মধ্যে কোমর সমান পানি। সাঁতার জানতাম না, তবু এর মধ্যেই বেরিয়ে পড়তাম। কলাগাছ কেটে আমরা তৈরি করেছিলাম ভেলা। ওই ভেলা নিয়েই সবাই বেরিয়ে পড়তাম। একদিন কলার ভেলায় উঠে চলে গিয়েছিলাম, ঘাঘরার খালের কাছে। [এটা দিনাজপুরের বিখ্যাত খাল। শহরের ময়লা-আবর্জনা নিষ্কাশনের জন্য গর্ভেশ্বরী (গাবুরা) নদীর সংযোগ খাল হিসেবে রাজা রামনাথ সপ্তদশ শতাব্দীতে ঘাঘরা খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কোম্পানি সরকার ঊনবিংশ শতকে গঠন করে ঘাঘরা কমিশন। এই কমিশন জনস্বাস্থ্য রক্ষায় শহরের পূর্বাংশে প্রশস্ত ক্যানেল খননের পরামর্শ দেয়। পরে দক্ষিণ অংশেও একটি খাল খনন করা হয়। মরে যাওয়া গর্ভেশ্বরী নদীর সংযোগ রক্ষা করে শহরের পূর্বাংশ দিয়ে রেলবাজার-বালুবাড়ী-খালপাড়া-পুলিশ লাইন-বড়পুল-বড়মাঠের দক্ষিণ ছুঁয়ে পশ্চিমমুখী হয়ে পুনর্ভবা (কাঞ্চন) নদীতে তা যুক্ত হয়। অন্য শাখাটি সুইহারি, কালীতলা, চুড়িপট্টি, মালদহপট্টি, বাঞ্ছারামপুর হয়ে বালুবাড়ীতে প্রবেশ করে।]
শহরের মধ্যে ধেয়ে আসা বন্যার সব পানি ওই খালে গিয়ে পড়ছিল। আমাদের ভেলাও ভেসে ভেসে খালের দিকেই নিয়ে যেতে থাকি। কিন্তু খালের কাছে যে তীব্র স্রোত, তা আমাদের ধারণায় ছিল না। সেই স্রোতে ভেলার দফারফা। একে একে আটকানো কলাগাছগুলো খুলে যেতে থাকে। আমরা আটকে রাখতে পারছিলাম না। যারা সাঁতার জানে, তারাও হাবুডুবু খাচ্ছিল, আর আমার অবস্থার কথার নাই বা বললাম। মৃত্যু মনে হয় হাতের কাছে, টের পাচ্ছিলাম। সেখানে কয়েকজন লোক মাছ ধরছিলেন। তাদেরই একজন/দু’জন পানিতে ঝাঁপিয়ে আমাদের টেনে তোলেন। তাদেরই কেউ একজন সাঁতার না জেনেও ভেলা নিয়ে আসায় আমার গালে একটা চড়ও বসিয়ে দিয়েছিলেন।
বন্যার ওই কটি দিন ছিল মহাআনন্দের। স্কুল নেই, পড়ালেখা নেই। বাড়িতেও কেউ বই খুলতে বলে না। শুধু খাওয়া এবং ঘুম। সুযোগ পেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া। সুখের দিন স্থায়ী হয় না। শান্তি নষ্ট হলো, পানি নেমে গেলো। স্কুল খুললো। এগিয়ে এলো স্কুলের নির্বাচনি পরীক্ষা। বাড়ির বাইরে ঘোরা কমে গেলো। সাইকেল নিয়ে বেরুনোও। মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল নির্বাচনি পরীক্ষা।
এ সময়েই পাশের বিল্ডিংয়ের একটা মেয়ে, আমার বেশ ছোট। কোন ক্লাসে পড়তো, মনে নেই। আমার সঙ্গে কথাটথাও হয়নি, হতো না। (মেয়েদের ওই বয়সে কেন যেন লজ্জা পেতাম। বগুড়ায়, স্কুলের মেয়েরা আমার নাম দিয়েছিল, ‘লজ্জাবতী’!)। তবে স্কুল থেকে ফিরে, কিছু খেয়ে, জামাকাপড় পাল্টে যখন সাইকেল নিয়ে বেরুতাম, তখন মাঝে মাঝে ওকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। ওইটুকুই। স্কুলের নির্বাচনি পরীক্ষা শেষের দিনেই সম্ভবত, কলোনিতে চোর ধরা পড়লো। স্কুল থেকে ফিরে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি। সন্ধ্যায় ফেরার পর, শুনলাম। কলোনির মাঠে চোর নিয়ে নানারকম গল্প। বড়োরা আছে, ছোটরা আছে। আমার সমবয়সী যারা কলোনিতে, তাদের সঙ্গে বসে চোর ধরা পড়ার কাহিনীর ডালপালা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা পেরিয়েছে। যার যার ঘরে ফিরছি। হঠাৎ শুনি পেছন থেকে কে যেন ডাকছে। তাকিয়ে দেখি সেই মেয়েটি। দাঁড়ালাম, কিন্তু আমাকে অবাক করে ও কাছে এসেই জোরে হাঁটা শুরু করলো। তারপর সোজা চলে গেলো ওদের ব্লিডিংয়ে। মেজাজ খারাপ হলো, ডাকলো কেন? আবার চলেই বা গেলো কেন? নাকি আমিই ভুল শুনলাম?
এরমাঝে আমিও পৌঁছে গেছি আমাদের গেটের কাছে। তখন দেখি, ওদের বারান্দা থেকে আমাকে এবার হাতের ইশারায় ডাকলো। এগিয়ে গেলাম। (ওরা বিল্ডিংয়ের নিচতলায় থাকতো)। এগিয়ে যেতেই, কোন ভনিতা না করে বললো, আচ্ছা, আপনি কাকে ভালোবাসেন? থতমতো খেয়ে বললাম, মানে? আবার বলল, আপনি কাকে ভালোবাসেন? বললাম, কাউকে না। উত্তর শুনে সে চলে গেল। আমিও অস্বস্তি আর এক ধরনের অস্থিরতা নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
পরদিন সকালে বগুড়ার পথে। তিন মাস বগুড়ায় কাটিয়ে স্কুল ফাইনালের আগে-আগে ফিরলাম, দিনাজপুর। ভয়ে ভয়ে ওই বিল্ডিংয়ের দিকে তাকালাম। কাউকে চোখে পড়লো না। বিকেলে বারান্দায় অপরিচিত মানুষ দেখলাম। চেনা মুখের কাউকেই চোখে পড়ল না। পরীক্ষা শুরু হলো। এক সময় শেষও হলো। এর মাঝেই জানলাম, বাবার বদলির কারণে—ওরা চলে গেছে। মনটা খারাপ হলেও, পরীক্ষার জন্য তা পাত্তা পায়নি। পরে বগুড়ায় এসেও মনে হয়েছে। ভেবেছি, আহ্হা। কিন্তু এই আফসোস জানানোর সুযোগ আর তৈরি হয়নি।
গানের কথাগুলো মনে পড়ায় ফিরে এলো—অতীত। প্রথম প্রেম কিনা! একে প্রেম বলা যায় কি না, জানি না। তবে এক জীবনে এত মানুষের ভালবাসা পেয়েছি, যার যোগ্য কোনোদিনই ছিলাম না। তবু গানের কথাগুলো—তাকে মনে করিয়ে দিলো। জানি না কোথায় আছে, কেমন আছে? কোনোদিন আর দেখা হবে না, দেখা হলেও আমরা কেউ কাউকে জানব না, চিনব না। তবু ভালো থাকুক, যেখানেই থাকুক।
চলবে…