নাম ছাড়া আমার আর কোনো পরিচয় নেই
কবিতা লেখার চেষ্টা করব, ভাবনাটা কখন এলো মনে নেই। পাঠ্যবইয়ের প্রতি অনীহা থাকলেও কবিতা পড়তে ভালো লাগতো। তবে ছেলেবেলা থেকেই যে কবিতাগুলো বেশি ভালো লাগতো, সেগুলো জোরে জোরে বারবার করে পড়তাম। মনে হতো এগুলো আমারই লেখা। সে থেকেই হয়তো কবিতা লেখার ভাবনা মনের ভেতরে গেঁড়ে বসতে পারে। জানি না ঠিক। এরপর পেরিয়েছে অনেক দিন। ক্লাস নাইনে যখন পড়ি, তখন হঠাৎ করেই কয়েকটি লাইন নিজের মতো করে সাজিয়ে ফেলেছিলাম।
দিনাজপুর বালুবাড়িতে ছিল একটি বড় বস্তি। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে, বিকেলে ঘুরতে বেরিয়ে সেই বস্তির মানুষগুলোকে দেখেই লিখেছিলাম সেদিনের ভাবনা। লেখার পর কাউকে দেখানোর লজ্জাবোধ থাকার পরও, আমার সেজমামা দেখে ফেলেন। তিনি লেখাটি বাড়ির সবাইকে পড়ে শোনান। আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। মামা বলেছিলেন,‘বেশ ভালোই হয়েছে, তুমি যা দেখেছ, তাই লিখেছ।’এরপর আর লেখার চেষ্টা করিনি।
বইয়ের প্রতি আগ্রহ আমার শৈশবের। মাকে দেখতাম বই পড়তে। রান্না ঘরের তরকারির ডালার ভেতরে বই থাকতো, মা কাজের অবসরে বই পড়তেন। শোবার ঘরে বিছানার পাশে বই ছিল। দুপুরে আমরা ঘুমিয়ে পড়লে মা বই পড়তেন। রাতে আমাদের পড়তে বসিয়ে ফাঁকে ফাঁকে মা বইয়ের পাতায় চোখ রাখতেন। আব্বা বাড়ির বাইরে গেলে, ফেরার সময় আমাদের জন্য বই নিয়ে আসতেন। তখন প্রতিটি রেল স্টেশনেই বইয়ের দোকান চোখে পড়েছে আমার। সেইসব বইয়ের দোকান থেকে আব্বা কোনো না কোনো বই কিনে দিতেন। রেল গাড়িতে হকারাও উঠতো নানারকম বই নিয়ে। সেইসব বই থেকে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ঠাকুরদার ঝুলি’র মতো নানান স্বাদের রূপকথার বই কিনে দিতেন আব্বা। বাড়িতে ফিরে সেগুলো আমরা বানান করে পড়তাম। কখনো মা আবার কখনো আব্বা বইগুলো থেকে পড়ে শোনাতেন।
নানা বাড়িতে মামাদের দেখতাম বই পড়তে। নানা বই পড়তে ভালোবাসতেন। ইতিহাস ছিল তার প্রিয় বিষয়। ভূগোলক দেখতে পছন্দ করতেন। ভূগোলক দেখা শিখিয়েছিলেন আমাকে। নানা বাড়িতে সবার ঘরে র্যাকে বই সাজানো থাকতো। টেবিলে পাঠ্যবইয়ের সঙ্গেই থাকতো গল্পের বই। দুপুরে খাবারের পর শুয়ে থেকে মামাদের দেখতাম বই পড়তে। আমরা বেড়াতে গেলে, মামারা বই থেকে পড়ে শোনাতেন। ছেলেবেলায় খালার বাড়িতে যখন বেড়াতে গিয়েছি, সেখানে খালার ননদ চন্দনা খালা ও সান্ত্বনা খালাকে দেখতাম বই পড়তে। খালার বড় জা-এর মেয়ে চান্দা আপাকে দেখতাম বই পড়তে। ছেলেবেলা থেকেই আমার চারপাশের মানুষদের মাঝে বইয়ের যে জগৎ দেখেছিলাম, তাই আমাকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। কিন্তু নিজে কখনো লিখতে চেষ্টা করব, তা ভাবিনি।
মাধ্যমিকের পর চলে এলাম বগুড়ায়। ভর্তি হলাম উচ্চ মাধ্যমিকে। কলেজের উথাল-পাতাল দিন। স্বাধীন ধরাবাঁধাহীন, দেখার নেই কেউ। মুক্ত জীবনের আনন্দ আমাকে নিয়ে ফেললো বইয়ের মহাসমুদ্রে। বন্ধুদের আড্ডা, সঙ্গলাভের পরেও অন্য একজীবনের সন্ধান আমার ভেতরে বুনে দিল বই। বাড়ির পাশে ছিল সিডিএলের পাঠাগার। সকাল দশটায় খুলতো, দুপুর দেড়টায় সাময়িক বিরতি শুরু, খুলতো আবার তিনটায়। চলতো সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত। উচ্চমাধ্যমিকের দুইটা বছরের বেশিরভাগ সময় কেটেছে সিডিএলের পাঠাগারে। পাঠকক্ষের দরজা খোলার আগেই হাজির থাকতাম বেশিরভাগ দিন। সামনের রাস্তা ছিল আমার অপেক্ষালয়। দুপুরেরর বিরতিতে বাড়িতে খেয়ে আবার যেতাম, ফিরে আসতাম পাঠাগারের দরজা বন্ধ করে। বইয়ের আরও বড় এবং বিচিত্র জগতের যে ছাতছানি অপেক্ষা করছিল, তার সন্ধান মিললো বগুড়ার উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরির মাধ্যমে। এই পাঠাগারে বই ও পত্র-পত্রিকার জগতের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার ইচ্ছে থেকেই দৈনিকের চিঠিপত্র কলামের জন্য চিঠি পাঠাতে থাকলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে সেইসব চিঠি নিয়মিত প্রকাশিতও হতে থাকলো। কাগজের পাতায় নিজের নাম দেখা এ এক অন্যরকম নেশা। এ এক অন্যরকম ভালোলাগা। কিন্তু সেই ভালোলাগা থেকে যে কবিতা লেখার চেষ্টা করব, তা তখনো ভাবনায় আসেনি।
বই পড়ার এই নেশার মধ্য দিয়েই টেনেটুনে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খোলার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। ফলে ঘুরে-ফিরে বগুড়াতেই। স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে পড়ার সময়ে, দেখলাম ক্লাসের প্রায় সবাই লেখে। কবিতাই লেখে সবাই। ছেলে-মেয়ে প্রায় সবাই। আমাদের বিভাগ থেকে একটি ভাঁজপত্র বেরুলো। ওখানে লেখারও বিপুল প্রতিযোগিতা, বিপুল প্রশংসা। আমি কোথাও নেই। বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠান হলো, ছেলেরা-মেয়েরা নিজেদের লেখা কবিতা পাঠ করলো বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে। আমি কোথাও নেই। ক্লাসে টিচার আসার আগে রোজ চলতো কবিতা পাঠের আসর। ডায়াসে গিয়ে কবিতা পড়তো, আহা, উহু আর নানারকম উল্লাস ধ্বনির মধ্য দিয়ে ফিরে আসতো দরবারি আমেজ। আমি কোথাও নেই।
ক্লাসের কয়েকজন মিলে তৈরি করেছে সংগঠন ‘সুহৃদ’। নানারকম স্বপ্ন, পরিবর্তনের ভাবনা। একসময় আমিও যোগ দিলাম। ‘সুহৃদ’-এর মুখপত্র বেরুবে, সবার লেখা থাকছে। আমার থাকবে না? মুখপত্র প্রেসে চলে যায় যায় অবস্থা। অনেক খেটেখুটে তৈরি করলাম একটি লেখা। ‘সুহৃদ’ সম্পাদক সৈকত ভাইকে দেখালাম, উনি রেখে দিলেন। যথাসময়ে মুখপত্র বের হলো। ছাপার অক্ষরে প্রথম আমার পদ্য দেখলাম। ভালো লাগার চেয়ে চারদিক থেকে লজ্জা আমাকে গ্রাস করে ফেললো। আমি গুটিয়ে গেলাম শামুকের মতো। সেই গুটিয়ে যাওয়া থেকে যখন মাঝে মাঝে শুঁড় বের করতাম, তখন নানাজনের সঙ্গে পরিচয় হতো। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই সুপান্থ মল্লিকের হাত ধরে বগুড়া লেখক চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ। এরপর একে একে পড়ুয়ার আড্ডা, পার্বণের আড্ডা (এগুলো পরে বলব খন)। কত মানুষ, কত বই, কত পত্র-পত্রিকা। এইসব বই, পত্র-পত্রিকা আর মানুষের হাত ধরেই লেখার বাসনা ধীরে ধীরে আমার ভেতরে শেকড় গেঁড়ে বসে। তার মূল এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে পরে। আর আমার ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো ক্রমশ জড়িয়ে পড়তে থাকি। জড়িয়ে যেতে থাকি অক্ষর আর শব্দের মায়াবী জাদুতে।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পেরিয়ে গেছে তখন। দৈনিক পত্রিকারও তখন সুসময়। ছোটকাগজের সঙ্গে সঙ্গে দৈনিকের সাহিত্যপাতাগুলোও আগ্রহের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। প্রতি শুক্রবার সাহিত্যপাতায় কার লেখা থাকল, সেইসব লেখা পাঠ করে তার আলোচনা-সমালোচনায় তখন আমাদের উত্তাল সময় কাটছে। ঢাকা থেকে আমাদের মফস্বল শহরে কেউ এলে আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনি। তার সঙ্গসুখে নিজেদের ধন্য মনে করি। তারা ফিরে যাওয়ার পর তার সুখস্মৃতি রোমন্থন করি। যদিও রাজধানীতে ফিরে আমাদের কাউকে আর তাদের মনে থাকে না। তবু, যে জীবন দোয়েলের ফড়িংয়ের তার লোভ আমাকে জাগিয়ে রাখে। যদি কোনোদিন দেখা হয়ে যায়।
বগুড়াতে তখন বয়সে বড় এবং ভালো লেখেন বলে যাদের সুনাম, তাদের সঙ্গও আমার ভালোলাগে। তাদের কথা শুনি। পরামর্শ দেন তারা নানান বিষয়ে। তারা কখনো কখনো কোনো কোনো বইয়ের নাম বলেন, সেগুলো পড়ার জন্য খুঁজে বের করি, সংগ্রহ করি। (তবে নিজের মতো করে, পারিবারিকভাবে ভালোলাগার যে রুচি গড়ে উঠেছিল, তার প্রতি শ্রদ্ধা আমার এখনো।) এ রকম সময়েই বগুড়ার দু’জন খুবই নামি কবির সঙ্গ আমাকে খুশি করে। ঢাকায় বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে অংশগ্রহণের সুযোগ তাদের হয়েছে। অনেক বইয়ের সন্ধান, খবর তাদের কাছে। যদি সেইসব বইয়ের নাম-ধাম জানা যায়? তাই তাদের সঙ্গ পছন্দ করি। যদিও নাম-ধাম তারা জানায় না কখনোই বরং চা খাওয়া, অন্যের সমালোচনাই তাদের কাছে বেশি। আর মাঝে মাঝে নিজেদের লেখা নিয়ে আসেন, পাঠ করি সেগুলো। নানারূপে নানাব্যখ্যায় তারা সেগুলো শোনান। এরই মাঝে একদিন আমাকেও বলেন লেখা নিয়ে যেতে। কিন্তু বাইরে দেখানোর মতো লেখা, যা অন্যকে দেখানো যায়, তেমন কিছু তখনো লেখা হয়নি। তাই দেখানো হয় না। তারাই বলেন, যাই লেখো নিয়ে এসো, পড়ব, অন্যকে না পড়ালে বুঝবে কী?
একদিন সাহস করে নিয়ে যাই একটি লেখা। তারা পাঠ করেন। আমরা চা খাই। তারা সিগারেট খান। তারপর সাতমাথার ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকি। সপ্তপদী মার্কেটে তখন (এখনো) অনেক ফটোকপির দোকান। আচমকা দুজনের একজন আমাকে বলেন, ‘মামুন, একটা কাজ করতে পারো?’ আমি আগ্রহ নিয়ে তাকাই। তখন তিনি বলেন, ‘একটা কাগজের পুরোটা জুড়ে তোমার নাম লেখো। তারপর সেই কাগজটা তোমার সাধ্য অনুযায়ী ফটোকপি করে শহরের দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে দাও।’ আমি অবাক হয়ে কারণ জানতে চাই। তখন অন্যজন বলেন, ‘তুমি তো নামের জন্য, নাম জানানোর জন্য লেখার চেষ্টা করছো। তো এত কষ্ট করার প্রয়োজন কি? তারচেয়ে দেয়ালে দেয়ালে তোমার নাম লাগানো থাকলে, সবার চোখে পড়বে। সবাই তোমার নাম জানবে।’ আমি চুপ করে থাকি। দুপুরের খাবারের সময়েরও অনেক পরে আমাদের আড্ডা শেষ হয়। বাড়ি ফিরে আসি। নিজের ভেতরে অনুভব করি, নাম ছাড়া আমার আর কোনো পরিচয় নেই। সেই সত্য আজও আমি উপলব্ধি করি। আজও আমি জানি, নাম ছাড়া আমার আর কোনো পরিচয় নেই।
চলবে…