সপ্তম পর্বের পর:
প্রথম মৃত্যু ও গোল চাকার গাড়ি
আমাদের বাড়িটা ছিল গ্রাম আর শহরের সংযোগস্থলে। একপাশে বয়ে চলেছে মৃতপ্রায় ফুলজাড় নদী। অন্যপাশে নগরবাড়ী-বগুড়া মহাসড়ক। একদিকে নগর জীবনের হাতছানি অন্যদিকে গ্রামীণ জীবনের আদর। দু’য়ের মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা। দুই-ই আমাকে ভরিয়ে দিয়েছে। তাই হয়তো শহরের জৌলুস, চাকচিক্যের প্রতি যেমন মুগ্ধতা ভেতরে বহন করে চলেছি, তেমনি ফেলে আসা দিনের জন্যও বেদনা আমাকে সমান আহত করে।
আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূর দিয়ে চলে যাওয়া সড়কটি নামে মহাসড়ক হলেও আজকের মতো তখন ব্যস্ত সড়ক ছিল না। তখনো যমুনা নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি হয়নি। এই নদীকে শাসন করে এর ওপর ব্রিজ তৈরি হতে পারে, এমন কথাও আমাদের মনে আসেনি। নগরবাড়ী ঘাট পার হয়ে তখন রাজধানীতে যেতে হতো। উত্তরবঙ্গের সব বাস-ট্রাককে তখন এ পথেই যেতে হতো। সারাদিন টুকটাক বাস-ট্রাক চলতো। কখনো কখনো অনেক সময় বসে থাকলে হয়তো একটি বাস বা ট্রাকের দেখা মিলতো। তবে ফেরি পারাপারের পর, এক ঝাঁক বাস-ট্রাক যেতে দেখতাম। আন্তঃজেলার মধ্যে যেসব বাস চলতো, তাদরে সঙ্গে দূরপাল্লার বাসের পার্থক্য ছিল অনেক। দূরপাল্লার বাসগুলো নিয়ে আমাদের গল্প, আমাদের কথা ও কাহিনি নানাভাবে ডানা মেলতো। সবচেয়ে ভালো লাগতো তেলবাহী লরিগুলো। মেঘনা, যমুনা অথবা পদ্মা লেখা সেই লরিগুলোর পেছনে ঝোলানো থাকতো একটি লোহার শেকল। এই শেকলের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তখন না জানলেও আমরা মনে করতাম, এটা দিয়ে সবাইকে বিদায় জানানো হয়। এই শেকল চলার পথে দুলতে দুলতে সবাইকে টাটা দিয়ে যায়। তেলবাহী গাড়িগুলো এমন ভারিক্কি চালে চলতো, তা দেখে স্বপ্ন দেখতাম, আমিও একদিন তেলবাহী লরির চালক হয়ে ঘুরে বেড়াবো এখানে-ওখানে। একজীবনে এ রকম কত কিছুই যে হতে চেয়েছি, তার তালিকাও অনেক লম্বা।
________________________________________________________________________________________________
কারও কারও বালতি হারিয়ে যেত কুয়োর গভীরে
________________________________________________________________________________________________
মহাসড়কে তেলের লরি চালাতে না পারলেও, আমরা ফাঁকা মহাসড়ক ধরে লোহার গোল চাকা চালিয়ে চলে যেতাম বহুদূরে। দুপাশে ধানক্ষেত, ডোবা, জলাশয়ের মধ্য দিয়ে ছুটে চলা মহাসড়ক আমাদের নিয়ে যেত অনেক দূরের গ্রামে। আমার পাঁচ বছরের ছেলেকে একা বাড়ি থেকে বেরুতেই দেই না। অথচ ওর চেয়ে অল্প বড় বয়সেই আমরা ঘুরেছি ইচ্ছেমতো। বাবা-মা কারো চিন্তাও হয়তো হয়নি, কখনো হারিয়ে যাব বা যেতে পারি।
আমাদের বাড়িতে টিবওয়েলের পাশাপাশি একটা কুয়োও ছিল। পোড়া মাটির রিংয়ের বাঁধানো সেই কুয়োর পাড়টার আশপাশে সিমেন্ট-বালির প্লাস্টারের মেঝেতে বসে মা এবং বাড়ির অন্যরা হাড়িপাতিল ধোয়া, কাপড়-চোপড় ধোয়াসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালী কাজ করতেন। কুয়োর পানি খুব ঠাণ্ডা বলে আমরা ছোটরা গোছল করতাম না। আমাদের গোছলের জন্য ছিল পাশের বাড়ির পুকুর। সেই পুকুরেও গোছল করতে যেতাম ভয়ে ভয়ে। কারণ, যার পুকুর, তিনি মাছ চাষ করতেন। পুকুরের মধ্যে ছিল একটা মাচা, তার ওপর ছোট্ট খড়ের ঘর। রাতে ওখানে লোক থাকতো পাহারার জন্য। দিনের বেলায় কেউ না থাকলেও পুকুরে নেমে আমাদের দাপাদাপি দেখে চলে আসতেন মালিক। তিনি এমন বকাঝকা শুরু করতেন, ভয়ে আমরা দৌড়। গোছল হলো কি হলো না, তা নিয়ে ভাবার অবকাশও তখন থাকতো না। তবে তিনি যখন বাজারে যেতেন, দুপুরের সেই সময়টাতেই বেশিরভাগ সময় গোছল করতে যেতাম বলে সবদিন বকাবকি শুনতে হতো না। তার বাড়ির অন্যরা বকা দিলেও, তা তেমন জোরালো ছিল না।
আমাদের বাড়ির সেই কুয়ো থেকে পানি তোলা হতো ছোট বালতি দিয়ে। বালতির মাথায় লাগানো রিংয়ের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নামিয়ে দেওয়া হতো কুয়োর ভেতর। তারপর দড়ি ধরে একটু নাড়াচাড়া করলেই বালতিতে পানি ঢুকতে শুরু করতো, তখন তাকেই আর একটু নাড়া দিলেই পানিতে ভর্তি হয়ে যেতো বালতি। তারপর দড়ি টেনে বালতি তুলে আনা হতো। বালতির দড়ি নরম হয়ে কখনো কখনো ছিঁড়ে যেত। কারও কারও বালতি হারিয়ে যেত কুয়োর গভীরে। তবে তার একেবারে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। আমাদের ঘরে অনেকগুলো কাঁটা লাগানো বড়শির মতো একটি লোহার আংটা ছিল। কারও বালতি পড়ে গেলে কুয়োয়, ওই লোহার আংটার সঙ্গে দড়ি বেঁধে নামিয়ে দেওয়া হতো কুয়োয়। তারপর এপাশ-ওপাশ টেনে টেনে ঘোরানো হতো কুয়োর ভেতরে। একসময় আংটার কাঁটায় ঠিক ঠিক বেঁধে যেত বালতির মাথায় থাকা রিং। তখন বালতি টেনে তোলা হতো।
________________________________________________________________________________________________
রাতের অন্ধকারে আজো তার শরীরের থেঁতলে থাকা মাংসপিণ্ড আমাকে বিহ্বল করে
_______________________________________________________________________________________________
এই বালতিগুলো পুরনো হতো, একসময় আর ব্যবহারের যোগ্য থাকত না। তখন বালতির মাথায় থাকা ওই রিং আমরা নিয়ে যেতাম কামারের দোকানে। টাকা দিয়ে সেই রিংটাকে পুরো গোল করে বানানো হতো চাকা। সেই চাকাটিকে চালানোর জন্য আমরা বাঁশের একটি কঞ্চি, এক হাত সমান, তার ভেতরে একটি তার বাঁকিয়ে ঢুকিয়ে দিতাম। তারপর সেই কঞ্চির মাথায় লাগানো তার দিয়ে চাকাটিকে ঠেলে নিয়ে যেতাম। এটা ছিল আমাদের প্রিয় খেলার একটি। চাকাটিকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে চলে যেতাম মহাসড়কে। মহাসড়কের মসৃণ পথে দল বেঁধে দৌড়। কার চাকা আগে যায়, কে আগে যেতে পারে এই খেলাতেই চলে যেতাম দূরে দূরে। দুপাশের ধানক্ষেতের ভেতরে, ডোবার ভেতরে কখনো কখনো আমাদের কারও কারও চাকাটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, হারিয়ে যেত। তখন খালি হাতে অন্যদের সঙ্গে ফিরতে হতো। হারিয়ে যাওয়া চাকাটির জন্য বেদনা নিয়ে।
এমনই এক দুপুরে, স্কুল বন্ধ ছিল। সবাই বেরিয়েছি নিজেদের চাকার গাড়ি নিয়ে। মহাসড়ক ধরে চলে গিয়েছি অনেকটা। ফেরার পথে একটা দোকানের কাছে জটলা। অনেক মানুষ কথা বলছে। কানে এলো এক্সিডেন্ট হয়েছে। তখনো আমি জানি না এক্সিডেন্ট কি? সম্ভবত সেই প্রথম শব্দটি আমার শোনা। পথে পথে অনেক মানুষের জটলা পেরিয়ে একসময় আমরা পৌঁছি বাড়ির কাছে। আমাদের ঝিকিড়া, শ্রীকোলা মোড়েই হয়েছে এক্সিডেন্টটা। আমাদের দেখেই বড়রা সরিয়ে দেয়। বলে, তোমাদের দেখার দরকার নেই। মানুষের পায়ের ফাঁকের অংশটুকু দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, তাতেই আমি শিউরে উঠি। একদলা মাংসপিণ্ড থেঁতলে আছে। কি যে বিভৎস? উহ! রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্ত। আমাদেরই বয়সী একটি ছেলেকে চাপা দিয়ে গেছে ট্রাক। রাস্তা পার হচ্ছিল, অসতর্ক মুহূর্তে ট্রাক তাকে থেতলে দিয়ে গেছে।
কিছু মানুষ রাস্তার পাশে লাল কাপড় টানিয়ে টাকা তুলছে। মহাসড়ক দিয়ে যাওয়া বাস-ট্রাক থেকে লোকেরা টাকা ফেলছে। কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসি নিজের নিজের বাড়িতে। প্রথম দেখা এক্সিডেন্টের বিভৎসতার চেয়েও আজ সেই ছেলেটিকেই বেশি মনে হয়। তার মুখ দেখিনি। জানিও না কোন বাড়ির ছেলে? সে কি আমাদের সঙ্গেই খেলত? আমার পরিচিত? কিছুই জানা হয়নি। কিন্তু সেই না দেখা মুখের ছেলেটিকেই আমার মনে পড়ে। রাতের অন্ধকারে আজো তার শরীরের থেঁতলে থাকা মাংসপিণ্ড আমাকে বিহ্বল করে।
‘বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী।’ কথাটির মতো নিঃসঙ্গতা আমাকে অতীতের কাছে ফিরিয়ে নেয়। অসহায়ত্ব অনুভব করি। এই অসহায়ত্ব মাঝেই ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে ওমর খৈয়াম-এর রুবাইয়াৎ। তিনি বলেছিলেন:
পৃথিবীটাতো মায়ার খেয়াল সূর্যবাতির ফানুস খোল
ছায়ার পুতুল আমরা সবাই চৌদিকে তার করছি গোল।
জীবনের প্রতি পদে এই গোল করা থেকেই যখন একটু অবসর মেলে তখনই নানারকম ভাবনা উঁকি দেয়। মনে হয় মৃত্যু- ‘কি আশ্চর্য মৃত্যু একদিন আমার দিকেও হাত বাড়াবে।’
চলবে…