ডুগি-তবলা
বাতাসে কান পেতে রাখি, এই বুঝি ডাকছো তুমি।
আকাশে চোখ মেলে রাখি, এই বুঝি পাঠালে চিঠি।
আমি একবার বলি, বারবার বলি, বলি যে লক্ষবার
তুমি আমার প্রিয়তম, তুমি যে শুধু আমার।
চলতি পথে হঠাৎ-ই কানে আসে গানটা। গানের কথাগুলো পুরোপুরি না শুনলেও, সুরটা মনের মধ্যে থেকে যায়। গান আমার সেভাবে শোনা হয় না। তাই, জানিও না, কার গাওয়া, কার সুর করা অথবা যিনি লিখেছেন তার নাম। কিন্তু চলতি পথে শোনা গানটি মনের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল। একদিন বাসের মধ্যে একজন তার সেল ফোনে গানটি শুনছিল। গাড়ির শব্দ, রাস্তার নানারকম শব্দে এবারো স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম না কথাগুলো। লজ্জার মাথা খেয়ে অনুরোধ করলাম, গানটি আমাকে শেয়ার করার জন্য। প্রযুক্তি তো হাতের মুঠোয়, তাই মুহূর্তেই তিনি সানন্দে শেয়ারইট অ্যাপস ব্যবহার করে গানটি আমার সেলফোনে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর আর শোনার সময় পাইনি। মাঝে ভুলেই গিয়েছিলাম। কয়েকদিন আগে—সন্ধ্যার মুখে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেল। গরমে, ঘামে অস্থির হয়ে হাঁটতে বেরুলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম অনেকটা পথ। একদম ফাঁকা বলতে গেলে, বালু ফেলে একটা খাল ভরাট করা হচ্ছে। লোকজন নেই, সামান্য আলো আছে। সেলফান ঘাঁটতে ঘাঁটতে গানটা বাজালাম। আধো আলো আধো অন্ধকারের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে গানটি শুনছি। নিজের মনেই হাসি পেলো। কারণ—গ্রাম থেকে শহরে আসা, বা আমাদের দৃষ্টিতে ঠিক আধুনিক হয়ে উঠতে না পারা অনেকেই আজো চলতি পথে জোরে জোরে সেলফোনে গান শুনতে শুনতে হেঁটে চলে। আমরা তাদের দেখে বিরক্ত হই। আমি শুধু না, পথচারীদের অধিকাংশই বিরক্ত হয়। কারণ এটা নাগরিক সভ্য রুচির সঙ্গে যায় না। সভ্য মানুষরা, কানে শ্রবণযন্ত্র লাগিয়ে গান শোনে, এফএম রেডিও শোনে। আর একটু নিন্মরুচির মানুষ জোরে জোরে গান শোনে, মানুষকে বিরক্ত করে। আমিও সেই দলে পরে গেলাম, এটা ভেবেই হাসছিলাম। পথ ফাঁকা, লোকজন নেই। যারা দুই একজন আছে, তারা সম্ভবত এ রকম রাস্তায় গান বাজিয়ে হেঁটে যাওয়া লোক দেখে অভ্যস্ত। তাই কেউ ঘুরে তাকায়নি আমার দিকে। কিন্তু নিজের ভেতরে লজ্জা অনুভব করছিলাম। আমার তখন মনে হতে থাকে—লজ্জা বোধটাই বুঝি ভেতর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে আমার ভেতরে কুঁকড়ে থাকা, সবসময় লুকিয়ে থাকা, আড়াল করে রাখা মানুষটা। যে ছোট বেলা থেকেই ছিল লাজুক প্রকৃতির। সেই লাজুকতা, সেই সরলতা, যা দেখতাম তাতেই বিস্মিত হয়ে পড়া যে শিশু, যে কিশোর, যে যুবক ছিল আমার ভেতরে, সে হারিয়ে যাচ্ছে। তাকে আর কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এখন একটুতেই রেগে যাই। রাস্তায় যাকে তাকে দেখে—মারমুখী হয়ে উঠি। মানুষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ি, এই কি সেই আমি? আমি মেলাতে পারি না। এইসব ভাবতে ভাবতে গান শুনতে শুনতে রাতের আলো-অন্ধকারের ভেতরে নিজে নিজেই হাসছিলাম। আর সেই হাসির ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল আমার হারিয়ে যাওয়া সময়। ছেলেবেলায়—আশপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা আমাকে লজ্জাবতী বলে খ্যাপাতো। স্কুল জীবনের কখনোই কো-অ্যাডুকেশনে পড়া হয়নি। শুধু একটা পর্যায়েই কো-অ্যাডুকেশনে পড়েছি। সেটা অর্নাসে। এছাড়া স্কুল, কলেজ, এমনকি এমএ-ও আমি পড়েছি এমন প্রতিষ্ঠানে যেখানে শুধু ছেলেরাই পড়ে।
আমরা থাকতাম তখন বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলায়। ছেলেদের স্কুলটা ছিল শহরের একদিকে, আর অন্যদিকে ছিল মেয়েদের স্কুল। মানে শহরের দু’দিকে, দুই প্রান্তে ছিল স্কুলদুটি। পথের ঠিক মাঝে ছিল আমাদের বাড়ি। যখন স্কুলে যেতাম, তখন মেয়েদের স্কুলে আসা মেয়েদের সঙ্গে দেখা হতো, আবার যখন ফিরতাম, তখন ওরাও ফিরে যেতো বাড়ি। ফলে মাঝপথে অনেকের সঙ্গেই দেখা হতো। বিকেলে যখন খেলতে বেরুতাম, তখন তো সবাই মাঠে থাকতাম। আশপাশের বাড়ির মেয়েরা, ছেলেরা। মাঠেও একেক দিকে একেক গ্রুপে খেলতে বসতো। মেয়েরা গোল্লাছুট, বৌচি এরকম খেলাগুলোর মধ্যে আমরা কখনো ফুটবল, কখনো মার্বেল আবার কখনো সিগারেটের প্যাকট দিয়ে ধরা বাজিতে খাপড়া ছুড়ে ফেলায় মেতে থাকতাম। আজকের শিশু, কিশোরদের মতো ঘরে বন্দি থাকতে হতো না আমাদের। আর মফস্বল শহরে তো নয়ই। আমরা ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতাম। বাবা-মা শুধু খেয়াল রাখতেন, ঠিকমতো স্কুলে যাচ্ছি কিনা। ছুটির দিনে দুপুরে ঘুমাচ্ছি কিনা আর সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে ফিরছি কিনা।
_________________________________________________________________________________________________
এই লজ্জাবতী নাম কিভাবে যেন ছড়িয়ে গেল, স্কুল ফিরতি মেয়েরাও একসঙ্গে কয়েকজন থাকলে, আমাকে একা দেখলে লজ্জাবতী বলে ডাকতো। কি যে মেজাজ খারাপ হতো।
________________________________________________________________________________________________
ওই সময় পড়ার মেয়েরা আমার নাম দিয়েছিল লজ্জাবতী। আমি বাইরে গেলে, আমাকে দেখলেই তারা দল বেধে ছড়া কাটতো। লজ্জাবতী, লজ্জাবতী বলে খ্যাপাতো। আর আমি দিতাম দৌড়। দৌড়ে বাড়ি চলে আসতাম, অথবা চলে যেতাম রাস্তায়। ওখানে হাঁটতাম, ঘুরতাম। তারপর সন্ধ্যায় বাড়ি। এই লজ্জাবতী নাম কিভাবে যেন ছড়িয়ে গেল, স্কুল ফিরতি মেয়েরাও একসঙ্গে কয়েকজন থাকলে, আমাকে একা দেখলে লজ্জাবতী বলে ডাকতো। কি যে মেজাজ খারাপ হতো।
ও সময় আমাদের সেই মফস্বল শহরে একদিন বিকেলে মাইকিং হলো—একটা গানের স্কুল খোলা হচ্ছে। তাতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হবে। আমার আব্বা তো মহাখুশি। পরদিনই আমাকে আর আমার ছোট বোনকে নিয়ে গেলেন। সম্ভবত, ওই স্কুলে আমরা দুই ভাইবোনই ছিলাম প্রথম ছাত্রছাত্রী। আমাদের পরে, আরও অনেকেই ভর্তি হয়েছে। তবে স্কুলটা টেকেনি। কিছুদিন পরেই, স্কুলের টিচাররা, ছাত্রছাত্রী ভাগ করে নিয়ে স্কুল ভেঙে দিল। তারপর আমরা দু’ভাইবোন বাড়িতেই শিখতাম। আমার বোন গান আর আমি তবলা বাজানো।
আমরা যখন ছোট ছিলাম, মানে আমাদের ভাইবোনের সংখ্যা তখনো তিন হয়নি। দুই-ই ছিল। সে সময় আব্বা অফিস থেকে ফিরলে আমরা দু’ভাইবোন আব্বাকে ধরতাম গল্প শোনানোর জন্য। আব্বা গল্প বলতেন, সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল লোককাহিনী। এগুলোর মাঝে গান থাকতো। আব্বা মাঝে-মাঝে জানতে চাইতেন, গানটা শোনাবেন নাকি গল্প বলে যাবেন? মাঝে মাঝে আমরা গান শোনাতে বলতাম, আর যেদিন গল্পের উত্তেজনা আমাদের ভেতরে বেশি থাকতো সেদিন বলতাম, গান দরকার নেই, আপনি গল্প বলেন। এখন মনে হয়, আব্বার মনেও হয়তো সুপ্তবাসনা ছিল গানের প্রতি। নিজের সেই অপূর্ণ স্বাদ আমাদের দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিলেন। যেমন, আমি আমার ছেলেকে দেখে ভাবি নিজের অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো পূরণের কথা।
তবলা বাজানো আমি প্রায় শিখে গিয়েছিলাম। একটা দুটো অনুষ্ঠানেও বাজিয়েছি, বাজাবো, এমন অবস্থা। কিন্তু ওই মেয়েগুলো দেখলেই বলতো, লজ্জাবতী এবার তবলা বাজাবে। কেমন লাগে? তাই একদিন বাড়িতে বললাম, আমি আর শিখব না তবলা। আমার ভালো লাগে না। ব্যস, বন্ধ হয়ে গেল। আব্বা-মা মাঝে মাঝে বলতেন, তাগাদা দিতেন। কিন্তু আমি আর পাত্তা দেইনি। আব্বাকে দেখতাম, ডুগি-তবলাটা মাঝে-মাঝে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করতে। অনেক দিন ছিল ডুগি-তবলটা। মাঝে বেশ কয়েকবার বাড়ি বদল হয়েছে। আমরা মফস্বল শহর থেকে মূল শহরে চলে এসেছি, তখনো ছিল ওটা। স্পষ্ট মনে আছে, উচ্চ-মাধ্যমিকের পরেও ওটাকে বাড়ির স্টোর রুমে দেখেছি। তারপর কী হলো, আর জানি না।
চলছে…