পূর্ব প্রকাশের পর:
যাযাবর জীবন
দেখা হলে কী হতো,কী হতে পারতো
তা-কি কেউ বলতে পারে? দূর থেকে ভেসে আসা
মাতাল সঙ্গীতের মতো কল্পনার পাখা গতিপ্রগতিতে
বুঝি চিরকাল এমনিভাবে পূজারীর সম্মুখে নিমিষে
দোলাতে দোলাতে মিলিয়ে দিতে চায়।
গোপন বাসনা কখনো প্রকাশ্য বেদনা হয়ে
উঠে আসে না,বরং জীবনের সীমা থেকে যে
রঙ কখনো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না, তাকে ক্রমে ক্রমে
দখলের মন্ত্র শিখিয়ে তৃপ্তিবিহীন
এক তৃষ্ণার সাগরে ডুবিয়ে দিতে হয়।
যুগে যুগে এই অশ্লীল বিকারগ্রস্ত পালতোলা
নৌকা যার নাম কেউ ভোলে না কখনো, জীবনের
সমস্ত কল্লোল তুলে মিশিয়ে দিতে থাকে
মনে,প্রাণে গাঢ় হয়ে কল্পনার ডানায়।
তাকে আজ কী দিয়ে বাঁধি? কোন যতিচিহ্নে?
সেই দূরন্ত স্রোত, বুকের ধুকধুকানি,
বলো ভালোবাসি,বলো বউ, বলো নোনা স্বাদ,
চিরকাল ঘুমহীন মুখের আঁশটে, অপাঠ্য ঘ্রাণ,
বলো মৃদু পায়ে উঠে আসা ভয়ের চাহনি মাখা
গোপন কাঁপন, বলো ঘামের স্পর্শ মাখা কবিতা—
স্থিরতা কি কারো ধাঁচে থাকে, বলো?
(স্থিরতা কি কারো ধাঁচে থাকে: মামুন রশীদ)
কেন যাযাবর জীবনের ইতি টেনেছিল মানুষ? সে কি শুধুই স্থির হওয়ার জন্য? সেই স্থির হওয়ার মধ্যে কী ছিল—খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের নিরাপত্তার চিন্তা? না কি মানুষ ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আর তাই একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য যাযাবর জীবনের ইতি টানে? প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু প্রশ্নগুলো মাথায় ভেতরে দানা বাঁধে। মাঝে মাঝেই কথাগুলো মনে হয়। সমাজতাত্ত্বিকের কাছে গেলে হয়তো সঠিক উত্তর মিলত, অথবা না মিললেও জেনে নিতে পারতাম যাযাবর জীবনের ইতিবৃত্ত। কিন্তু মন আসলে প্রশ্নের উত্তর খোঁজেনি। এলোমেলো ভাবনার মাঝে ঘুরতেই সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে। মনের ভেতরে কথাগুলোর ভিড় করার কারণও রয়েছে। ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ পিতামহ মারা গেলেন। সত্যিকার অর্থে পিতামহের কবরের পাশে দাঁড়িয়েই প্রথম আমার ওপরের কথাগুলো মনে হয়েছিল। অবাক হলেও, কথাটা সত্যি। পিতামহ নেই,তার হাসিমুখ আর দেখব না। আমাকে বন্ধু বলে ডাকছেন—সেই ডাক আর শুনব না। এসবের কোনো কিছুই না, বরং সেই সময়, তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আমার যাযাবর জীবনের কথাই মনে পড়েছিল। আমি যখন গ্রামে পৌঁছি, তখন জানাজায় অংশ নিতে যারা এসেছিলেন, তারা ফিরে যাচ্ছেন। আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই বাড়ির উঠোনে, বারান্দায় এলোমেলে বসে আছেন।দাদি ঘরে বসে ছিলেন,পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই আমাকে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন, কান্নার মাঝে মাঝে কী কী বলে গেলেন, বুঝিনি। শুধু একটা লাইন শুনলাম—দাদি বলছেন, মানুষটা চলেই গেলো। দাদির পাশে কিছু সময় বসার পর, ঘরের বাইরে এলাম। গ্রামে আমাদের এই বাড়িটার দিকে তাকালাম। আসা হয় না নিয়মিত। অপরিচয়ের গন্ধ সবখানেই। তবু এ বড় আপন আলয়। উঠোনের একপাশে একটি আমড়া গাছ, পাতা নেই—ডালে ডালে ঝুলে আছে বেশ কিছু আমড়া।অন্যপাশে একটি কামরাঙা গাছ, নতুন সবুজ পাতা তার রূপ দেখিয়ে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে। তারপাশে বাঁশ দিয়ে তৈরি মাচার ওপরে, উঁচুতে বানানো হয়েছে কবুতরের ঘর। আমি উঠোনে দাঁড়ালাম, আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই তখনো রয়ে গেছেন, অধিকাংশকেই চিনি না, ছেলেবেলায় দেখেছি, মনে নেই। আব্বা ছিলেন, কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এলোমেলো কথা শেষে, ছোট চাচার সঙ্গে বের হয়ে দাঁড়ালাম দাদার কবরের পাশে। কিছু আগে মাটি খুঁড়ে তৈরি করা কবর। মাটি একদম টাটকা। বালু মাটি, সেই মাটিতে পানি ছিটিয়ে মাটিকে শক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কবরস্থানের কিছু কিছু কবর যত্নের অভাবে, নিকটাত্মীয়দের নিয়মিত খবরের অভাবে ভেঙে পড়েছে। ওপরের মাটি সরে বেরিয়ে পড়েছে কবরের কাঠামো। ভেতরে অবশিষ্ট কিছু নেই, বহুদিনের কবর, হয়তো মাটিতে মিশে গেছেন, যিনি ওখানে শেষ শয্যায় ছিলেন। করবস্থানের একপাশে বাঁশঝাড়, একটি ছোট মসজিদ। অন্যপাশে কয়েক শ হাত দূরে নদী। ফুলজোড় নদী। আমার শৈশবে এই নদীটিকেই দেখেছি অনেক বড়। নদীতে ভরা বর্ষায় নৌকাবাইচ হতো। এখন একটা খালের চেয়েও ছোট। পুরো নদীই মৃত। নদী বলে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। পানির অভাবে হাহাকার করছে। চারপাশে শুধু বালু আর বালু। চাচা আমাকে রেখে আবার গেলেন পানি আনতে, যেন কবরের ওপরে ছিটিয়ে দিতে পারেন। মাটি শক্ত না হলে রাতের বেলা শেয়াল মাটি খুঁড়ে ফেলতে পারে। আমি একা দাঁড়ালাম দাদার কবরের পাশে। (আমাদের গ্রামে দুইটি কবরস্থান। এই কবরস্থানে আমাদের কোনো নিকটাত্মীয় নেই। কিন্তু দাদা চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর তাকে যেন নদীর পাশে কবর দেওয়া হয়। এই কবরস্থানটিই নদীর পাশে। এখান থেকে নদী মাত্র কয়েক শ হাত দূরে। আমার দাদা পড়ালেখা জানতেন না। তিনি শিখেছিলেন প্রকৃতি থেকে। যখন আমাদের কাছে আসতেন, আমাদের দেখতে আসতেন, মাঝে মাঝেই দেখতাম দাদা বই বা খবরের কাগজ হাতে ধরে আছেন। দেখলে মনে হবে পড়ছেন, দাদাকে জিজ্ঞেস করতাম, কী দেখেন? উনি হেসে বলতেন, এমনি দেখছি, বই কেমন? আমার অক্ষরজ্ঞানহীন দাদা কেন নদীর কাছে শেষ শয্যায় শুয়ে থাকতে চেয়েছিলেন? এর উত্তরও আমি কোনোদিনই আর পাব না। দাদা মারা যাওয়ার দিন শেষে রাতের অন্ধকার নেমে আসা গ্রামকে পেছনে ফেলে আমি আর আব্বা যখন বগুড়ায় ফিরছি, তখন আব্বাকে বলেছিলাম, আপনার দাদার কবর কোথায়? আব্বা জানালেন,সেই কবরের চিহ্ন নেই। অনেক আগে নদীতে ভেঙে গেছে। সেখানে নতুন চর উঠেছে। তখনই আবার মনে হলো যাযাবর জীবনের কথা। দাদা তো নেই, মানে একটি অধ্যায়ে শেষ হয়ে গেল জীবন থেকে। দাদা নেই, মানে গ্রামের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার যেখানে,যে গ্রামে আমাদের বাড়ি, সেখানে অনেক বছর আগে, যমুনা পেরিয়ে টাঙ্গাইল থেকে এসেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ। ফুলজোড় নদীর তীরে তিনি প্রথম আমাদের হয়ে বসতি স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন আমার দাদারো কয়েক পুরুষ আগের মানুষ। আমাদের দশ পুরুষ আগে যার নাম জেনেছি, তিনি ছিলেন হত্বা আখন্দ, তারও আগে এ অঞ্চলে এসেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ।
টাঙ্গাইল থেকে যিনি এসেছিলেন, তিনি তো যাযাবর জীবনের ধারাবাহিকতায় এসেছিলেন আমাদের আজকের এই গ্রামে। ফেলে এসেছিলেন তার পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি, তাদের কবর। দাদা বেঁচে থাকতেই আমরা গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও, গ্রাম ছেড়ে প্রথমে এসেছিলাম উপজেলা শহরে। এখানে বাড়ি তৈরি করে স্থির হতে না হতেই আবার আমাদের আবাস বদল হয়। আব্বা চাকরি সূত্রে বিভিন্ন জেলা ঘুরে ফিরে এলেন বগুড়া জেলায়। আমাদের পড়ালেখা, আমাদের বেড়ে ওঠার বড় অংশই এই শহরে। ফলে এ শহরের সঙ্গেও তৈরি হলো আমাদের সম্পর্ক। আমরা এখানেই স্থির হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। আব্বাও মেনে নিলেন, আবার তৈরি হলো বাড়ি। দাদার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এ বাড়ির সঙ্গেও হয়তো একদিন আমার সম্পর্ক থাকবে না। কারণ, দাদার মৃত্যু যেমন আমাদের একেবারেই পৈত্রিক ভিটের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে দিলো, তেমনিভাবে আমার আব্বা চলে গেলেও হয়তো কমে আসবে বগুড়ার সঙ্গে সম্পর্ক। আমি যে কাজ করি, তাতে বগুড়ায় ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। (যদিও সকল ভ্রমণ শেষে আমার বগুড়ায় ফিরে যেতে সাধ হয়)। বগুড়ায় ফিরে যাওয়া মানে ছুটি নিয়ে যাওয়া, কাজকে বিদায় জানিয়ে যাওয়া। কিন্তু ওখানে আমার কাজের সুযোগ নেই। তাই ঢাকা, প্রাণহীন এই রাজধানী। মন না চাইলেও আমাকে থেকে যেতে হচ্ছে। আব্বা-মা’র জন্য প্রতি মাসেই বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করি, তারা না থাকলে কী আর এভাবে বাড়ি যাওয়ার জন্য মন ছুটবে? একদিন হয়তো ঢাকাতেই শেকড় গেড়ে বসে পড়ব। আমার ছেলে,ও তো বেড়ে উঠছে এই শহরে। আমার কাছে যে শহরকে ইট-কাঠের জঞ্জাল মনে হয়, তাকে ছেড়ে আমার পুত্র হয়তো এর চেয়ে কম গতিশীল শহর বগুড়ায় ফিরতে চাইবে না। আমরা যেমন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার চেয়ে গতিশীল বগুড়ায় এসে আর ফিরতে চাইনি। তেমনিভাবে ও হয়তো ফিরতে চাইবে না। জানি না জীবন আমার পুত্রকে কোথায় নিয়ে ফেলবে। যদি পথ ঠিক থাকে, তাহলে ও হয়তো, ঢাকা নয়, ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের সীমানা পেরিয়ে অন্য কোনো আলো ঝলমলে শহরে স্থির হবে। মন পড়ে থাকবে, মন কাঁদবে ঢাকার জন্য। কিন্তু সেই রঙিন বহুবর্ণিল শহর থেকে ওর আর ফেরার পথ থাকবে না। এই নিয়মেই হয়তো ওর সন্তান অন্য কোনো শহরে স্থির হবে। কিন্তু এই যে স্থির হওয়া, স্থির হওয়ার ইচ্ছে—তা তো সত্যিকার অর্থে স্থিরতার সংজ্ঞায় পড়ে না। স্থিরতা কি সত্যি আমাদের ধাঁচে আছে? নাকি সেই যাযাবর জীবনের স্রোত যা আমরা বয়ে নিয়ে চলছি রক্তে, যেখানে স্থিরতা বলে কোনো শব্দ নেই?
চলবে…