দ্বিতীয় পর্বের পর:
আজও তো আমি চিঠি চাই
বিদেশ গিয়ে বন্ধু তুমি আমায় ভুইলো না,
চিঠি দিও, পত্র দিও, জানাইও ঠিকানা।
এই গানটি আমি প্রথম শুনেছিলাম ২০০৮ সালে। এরপর আবার শুনেছি, দুই হাজার চৌদ্দ সালের মাঝামাঝি। পুরনো এবং মর্মস্পর্শী গান। কিন্তু আমার শোনা হয়নি। গানের অন্য লাইনগুলো মনেও নেই। কিন্তু এই দুইটি লাইন বারবার আমার মাথার ভেতরে তাড়া দিয়েছে। দু’বারই গানটি শুনেছি দুজন মহিলার কণ্ঠে। দ্বিতীয়বার যখন গানটি কানে আসে, তখন অফিসের কম্পিউটার রুম, যেখানে পত্রিকার পৃষ্ঠা সাজানোর কাজ হয়, সেই রুমের এক মহিলা সহকর্মী দুপুরে তার কাজের ফাঁকে গানটি গুনগুন করে গাইছিলেন। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কানে আসে গানটি। আমার মন সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় কয়েক বছর পেছনে। দুই হাজার আটের একটি দিনে। যেদিন আমি প্রথম গানটি শুনেছিলাম।
দুই হাজার নয় সালের আগে পর্যন্ত আমার অস্থিরতা ছিল বেশি। কোনো কিছুই মনমতো হচ্ছিল না। মফস্বল ছেড়ে সবাই ঢাকায় আসে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি হতে। আমিও রাজধানীতে এসেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল সাংবাদিক হওয়া। ২০০১ সালে সেই লক্ষ্য স্থির করে আসার পর থেকে আজও আমার সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আজও ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছি সাংবাদিক হওয়ার। যখন প্রথমবার একটি উদ্দেশ্য নিয়ে রাজধানীতে আসি, তখন মনের ভেতরে অনেক স্বপ্ন। কিন্তু কিছুতেই ঢাকায় মন বসাতে পারছিলাম না। তাই বারবার ফিরে যেতে থাকি। চাকরির জন্য এখানে ওখানে দৌড়ঝাঁপ করি, পেয়েও যাই, কিন্তু মন বসাতে পারি না। তাই বারবার চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম। দুই হাজার ছয় সালের মাঝামাঝি, মনে হতে থাকে আর না। আর ফিরে যাওয়া যাবে না। কারণ, ফিরে যাওয়া থেকে প্রতিবার প্রত্যাবর্তনের পর, আর নতুন করে সব শুরু করতে হয়। কিছুই আগের মতো থাকে না। সেবার ফেরার পর, চাকরি হয় দৈনিক আজকের কাগজে। দুই হাজার সাত-এর সেপ্টেম্বরের একদিন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় দৈনিক আজকের কাগজ। মুহূর্তের মধ্যে আবার বেকার। অক্টোবর, নভেম্বর ফুটপাতই ছিল ভরসা। চাকরি ছিল না। ডিসেম্বরে যোগ দিলাম একটি পাক্ষিক কাগজে। এর ঠিক দুই মাস পরেই একটি দৈনিকের স্পোটর্স বিভাগে যোগ দেওয়ার সুযোগ তৈরি হলো। সব ঠিকঠাক, তবু যোগ দেওয়া হলো না। মনে হতে থাকলো, জায়গাটা ব্লক। এখান থেকে বেরুনোর পথ নেই। আর দৈনিক আজকের কাগজে কিছুদিন স্পোর্টস বিভাগে কাজ করায়, আগ্রহও কমে গিয়েছিল। পাক্ষিকে আমাদের যিনি নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন, তিনিও কয়েকদিনের মাঝে যোগ দিলেন অন্য একটি দৈনিকের স্পোর্টস বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে। আমাকে খুব স্নেহ করতেন, তাই যোগ দেওয়ার পরই ডাকলেন। কথাবার্তা হলো, ফেব্রুয়ারির শুরুতেই তার সঙ্গে কাজ করব, এমন কথাও হলো। কিন্তু জানুয়ারির শেষেই মন অস্থির হয়ে উঠলো ঢাকা ছাড়ার জন্য। ছেড়ে দিলাম পাক্ষিক। চলে গেলাম বগুড়ায়।
আমার এক বন্ধু, কাজ করত নওগাঁর একটি এনজিওতে। কাজ ছেড়ে দিয়ে ও তখন চলে এসেছে বগুড়ায়। স্বপ্ন দেখছে নতুন কিছু করার, নিজেদের কিছু করার। সে রকমই একটি সময়ে স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করা একটি বিদেশি এনজিও’র ট্রেনিং সেল চালানোর চুক্তিভিত্তিক কাজে ও যোগ দিয়েছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি নদী ভাঙনকবলিত এলাকায় শ্রমজীবী মানুষদের জন্য ট্রেনিং সেল। তাদের ভেতরে নেতৃত্ব বিকাশের ধারণা তৈরির কাজের দায়িত্ব ওর কাঁধে। নিজেই প্রচুর পরিশ্রম করে তৈরি করছে, ট্রেনিংয়ের সরঞ্জাম, মডিউল। সব শুনে আমারও আগ্রহ হলো, ওর সঙ্গে কাজ করার। সহকারী হিসেবে নিয়ে নিল। প্রায় একমাসের প্রস্তুতি শেষে নেমে পড়লাম মাঠে। সেই ভোরে উঠে দুজনে বের হতাম, নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে নয়টা, কখনো আরও বেশি সময় লেগে যেত। ঘড়ির কাঁটা ধরে ট্রেনিংয়ের সিডিউল। ট্রেনিং চলতো সকাল দশটা থেকে পাঁচটা। মাঝে এক ঘণ্টার বিরতি। প্রায় চল্লিশ জন অংশগ্রহণকারী। এখানে প্রত্যেকের অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা থাকত। এক একটা গ্রুপকে নিয়ে দুই দিন কাজ করতে হতো। শেষ দিনে দেখা যেত দুপুরের বিরতির মাঝেই মূল পর্ব শেষ। তখন অংশগ্রহণকারীরা আমাদের কথা শুনতে চাইতো, আবার আমরাও তাদের কথা, তাদের ধারণা সম্পর্কে জানতে চাইতাম। তাদের ধারণা নিয়ে পরে ট্রেনিং মডিউলের অনেক পরিবর্তন এনেছিল আমার বন্ধু। ট্রেনিংয়ের বিরতিতে অংশগ্রহণকারীরা কে কোন কাজ ভালো জানে, তাও আমাদের জানাতো। এমনি একটি গ্রুপের ট্রেনিং পর্বের দ্বিতীয় দিনে অংশগ্রহণকারীরা বিরতির পর, সেশন শুরু হলে, গল্প শুরু করল। তাদের কেউ কেউ অভিনয়, গান পরিবেশন করল। তাদেরই মাঝে একজন অংশগ্রহণকারী, শোনান ওপরের গানটি। গান গাইতে গাইতে ভদ্রমহিলা কেঁদে ফেলেন। প্রথমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তারপর হাউমাউ করে। আমরা স্তব্ধ। কেউ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে না। তিনি গানও থামিয়ে দেননি। কান্নার মাঝেই গানটি গেয়ে শেষ করলেন। কান্না আর গান দুইয়ে একাকার। গান শেষ হলো। আমি আর আমার বন্ধু নির্বাক। কিছুই বলার নেই, স্বাভাবিকতায় কী-ই বা বলা যায়। আমরা ভেবে পাচ্ছি না। তখন অংশগ্রহণকারীদের মাঝ থেকে একজন বলে, ‘ওর কিছু দিন আগে বিয়ে হয়েছে। স্বামী বিদেশ থাকে।’
এত আবেগ, চেপে রাখা এই বেদনার সাক্ষী হয়ে সারা পথ আমরা দুই বন্ধু কোনো কথা বলতে পারি না। পথ শেষে বিদায় নিয়ে চলে আসি নিজের নিজের বাড়িতে। এরপর আমি আর একটা বা দুইটি ট্রেনিং সেশন-এ গিয়েছি। তারপর আবার ফিরে আসি ঢাকা।
সহকর্মীর কণ্ঠে গানটি দ্বিতীয় বার শুনে, তখন যেমন কয়েক বছর আগের দিনটিতে ফিরে গিয়েছিলাম, তেমনি আমার মনে পড়ে চিঠির আবেদন সত্যি ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। অন্তত আমার কাছে। আমাদের পরের যারা, তারা হয়তো চিঠির ব্যাপারটা বুঝতেই পারবে না। আমাদের ছেলেমেয়েরা হয়তো চিঠি কী তা-ই জানবে না। কিন্তু আমার কাছে, আমাদের সময়ের মানুষের কাছে চিঠির মূল্য অনেক। অন্তত আমি তাই মনে করি। একসময় চিঠির জন্য কত অস্থির হয়ে থাকতাম। স্কুলের পর, কলেজে পড়ার সময়েও আমি প্রচুর চিঠি লিখেছি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের কাছে। চিঠি পাঠিয়ে দিন হিসাব করতাম, কবে উত্তর আসতে পারে সেই দিনটির। তারপর হিসাব মতো ঠিক ওই দিন সকালে ডাকঘরে চলে যেতাম। পরিচিত ডাকপিয়নের কাছে জানতে চাইতাম, চিঠি আছে কি না? থাকলে, খুশিতে ঝলমল করে উঠতো মুখ। আর না থাকলে, পরদিন আবার যেতাম। ডাকপিয়ন খুব কমদিনই আমাদের বাড়িতে আসার সুযোগ পেয়েছে। পুরনো সেইসব চিঠি, কত কত আবেগ, কত হারানো সময়, হারানো কথামালা, সেইসব হারিয়ে ফেলা চিঠিগুলোর জন্য আমার ভেতরে একধরনের হাহাকার এখনো আছে, সহকর্মীর কণ্ঠের গানটি আমাকে সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। এখনো আমি, আমার ভেতরের আমি চিঠির প্রতীক্ষা করি। চিঠির ভেতর দিয়ে যে আবেগ, যে মানুষ উঠে আসে, তা কি সেলফোনের কথায় পাওয়া যায়? যায় না বলেই হয়তো, মানুষ চিঠির নতুন সংস্করণ চ্যাটিং, আর সেলফোনের বার্তাগুলোকে ভালোবাসে। বারে বারে দেখে, অনুভব করে প্রিয় মানুষটিকে।
চলবে…