টিকা এবং স্কুল পালানো
পূর্ব প্রকাশের পর:
এখনকার বাবা-মায়েদের মতো আমার বাবা-মা আমাকে স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসার কাজটি কখনোই করেননি। যতবার স্কুল পাল্টিয়েছি, নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছি—প্রথম দিন বাবা নিয়ে যেতেন। কিন্তু এরপরে আর না। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়েছি ঝিকড়া বন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায়। বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে হলেও, আমরা কয়েকজন হেঁটেই যাওয়া-আসা করি। আমাদের গ্রামের নামও ঝিকিড়া। বাড়ির সঙ্গেই লাগায়ো ছিল—একটা বিশাল বাঁশঝাড়। ভর দুপুরে বাঁশপাতার খসখসে শব্দ, রাতের বাতাসে তার রহস্যময় শব্দ, আমাদের ভূত সম্পর্কে বিশ্বাসকে দৃঢ় করেছিল। আর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাঁশঝাড়টা পেরুলোই হাতের ডানে পড়তো একটা কালিমন্দির। সেই মন্দির পেরিয়ে বিশাল এক তেঁতুল গাছ। তার গা ছমছমে অন্ধকার ভাবটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই একটা মাঠ, তার এককোনে বিশাল এক বটগাছ। চারপাশ সুনসান—ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। তেঁতুল গাছে ভুত থাকে। এই গল্প শুনতে শুনতেই বড় হওয়া, রাতে ঘুমিয়ে পড়া। তেঁতুল গাছটিতে ছিল অসংখ্য বক পাখি। স্কুলে যাওয়া আসার পথে অনেকদিন দেখেছি বকের ছানা মাটিতে, পথের ধারে পড়ে আছে, মৃত। আমরা দৌড়ে পার হয়ে যেতাম পথটুকু। এই বকের ছানার মৃত্যু যে স্বাভাবিক না, একে যে রক্ত চুষে কোন ভূত রাতের অন্ধকারে মেরে ফেলেছে, তা আমাদের কাছে নিশ্চিত ছিল। রাতের বেলা বকের ছানারা কাঁদতো, চেঁচাতো—যাকে আমরা ভূতের ডাক বলেই জানতাম। ওই কান্না শুনেই ভয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। কারণ না ঘুমালে ওই ভূত বকছানার ঘাড় না মটকে যদি আমাদেরটাই মটকাতে আসে, তাই। বাঁশঝাড়, কালিমন্দির, তেঁতুলগাছ পেরিয়ে পড়তাম বটগাছের সামনে। ওরে বাবা—তার বিভীষিকা বুকের ভেতের এতক্ষণের চেপে রাখা ভয়কে আরও উস্কে দিতো। কি যে এক অদ্ভুত নীরবতা সেই বটগাছ ঘিরে। তার সবুজপাতা, গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে আসার কষ, এখানে-ওখানে গর্ত, মাঠের ভেতরে যে দূরের, কাছে পিঠেও কাউকে দেখা যেত না। তাই ভয়ের ষোলকলা পূর্ণ হতো আমাদের। এজন্য একা একা এই পরিবেশে ওই বয়সে স্কুলে যাওয়া ছিল কঠিন। তাই আমরা কয়েকবন্ধু একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। বাড়ি থেকে বলে দেওয়া ছিল না, তবু নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা অজান্তেই আমরা করে নিয়েছিলাম।
অথচ বিকেল বেলা, ওই মাঠেই যখন আমরা খেলতে আসতাম, তখন অবলীলায় বটগাছের গায়ের গর্তে হাত ঢুকিয়ে দিতাম পাখির ছানার খোঁজে। তারপর—খেলা শেষে আবার সবাই দলবেঁধে একসঙ্গে এক দৌড়ে যার-যার ঘরে পৌঁছে যেতাম। তা ওই বাঁশঝাড়, কালিমন্দির, তেঁতুলগাছ, বটগাছ পেরিয়ে আমরা পৌঁছতাম স্কুলে। স্কুলের মাঠের এক কোনে বসতো একজন আইসক্রিমওয়ালা। বাড়ি থেকে যাবার জন্য চার আনা পয়সা মা’র কাছ থেকে নিয়ে যেতাম। কোনো কোনো দিন বিশ পয়সাও নিয়েছি। এই পয়সাও থাকতো ভাগ করা। বটগাছটা পেরুনোর পরে একটু এগুলোই যে বড় কাঁচারাস্তা, যেটি ছিল আমাদের প্রধান সড়ক, তার ধারে একটি মুদি দোকান। সেখান থেকে কোনো কোনো দিন দশ পয়সা দিয়ে একটি কাঠি লজেন্স কিনে মুখে পুরে চুষতে চুষতে স্কুলের দিকে এগুতাম। কাঠি লজেন্সের গোলাপি রং জিভে, ঠোঁটে লেগে থাকতো। কার ঠোঁটের রঙ কতো গাঢ় তা নিয়ে তর্কও তো আমাদের। যেদিন কাঠি লজেন্স খেতাম না, ওদিন স্কুলের মাঠের আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে দশ পয়সা দিয়ে একটি বরফ কিনে, তার ওপর বিট লবণ ছিটিয়ে নিয়ে আরামসে চাটতে থাকতাম। আহ, কি তার স্বাদ! ওই স্বাদের বরফ, আমি আর পাইনি। বাকি পনের পয়সা দিয়ে কখনো আমড়া অথবা চালতার আচার খেতাম। কখনো কখনো যে পাঁচ পয়সা বাঁচতো, তা জমা থাকতো পরের দিনের জন্য। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সেরে বসতাম ক্লাশে।
স্কুলের মূলভবন ছিল ইটের। তবে আধাপাকা না পাকা এখন মনে করতে পারছি না। ছাদের কাছ পর্যন্ত ইটের গাঁথুনি। ছাদটা ঢালাইয়ের না টিনের—এখানেই একটু খটকা আছে। আর অন্যপাশে পুরো টিনের একটি ঘর। পাকা ভবনে ছিল হেডস্যারের রুম। সেইসঙ্গে ক্লাশ থ্রি থেকে পঞ্চম শ্রেণীর কক্ষ। প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্লাশ হতো ওই টিনের ঘরে। টিনের ঘরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল। আমি বেশিরভাগ দিনেই খালের দিকের জানালার কাছে বসতাম। ঠিক কী কারণে—এই জানালার দিকে আগ্রহ, মনে নেই। তবে এর সুবিধা আমি নিয়েছি। একদিন ক্লাশে বসে আছি, টিচার পড়াচ্ছেন। হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পড়তেই, স্কুল মাঠে দেখি একটা জটলা। হেডস্যার আছেন, সঙ্গে বেশ কয়েকজন। চিনি না কাউকেই। একটু পরে—কে যেন এসে টিচারকে বলে গেল, স্কুলে টিকা দেওয়ার লোক এসেছে। সবাইকে ক্লাশে থাকতে হবে—টিকা দেবে। খবর শুনেই আমার আত্মা খাঁচাছাড়া। এখন যে হাত-পায়ের তালু ঘামে—তার পেছনে বুঝি এদিনের উত্তেজনাও দায়ী। আমাদের নানারকম গুঞ্জনের মধ্যেই ক্লাশ টিচার বেরিয়ে গেলেন। তাকে এগিয়ে যেতে দেখলাম হেডস্যারের রুমের দিকে। এর মাঝে মাঠের জটলাও ঢুকে পড়েছে হেডস্যারের রুমে।
ক্লাশ টিচার বেরিয়ে যেতেই আমি ব্রেঞ্চের ওপর উঠে—জানালা দিয়ে দিলাম লাফ। গড়িয়ে পড়লাম খালের পানিতে। আমার পেছনে আরও ধুপধাপ শব্দ। আরও কয়েকজন লাফিয়ে নামলো। কে কে নামছে, তা দেখার অবকাশ নেই। পানি থেকে উঠেই দৌড়। দ্বিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। পেছনে থেকে কানে আসতে থাকে নানা রকম শব্দ। মনে হতে থাকে কেউ বুঝি আমাকে ধরতে এগিয়ে আসছে। শব্দ যত বাড়তে থাকে আমাদের দৌড়ের গতিও তত বাড়তে থাকে। কোথায় কোথায় কোনদিকে যে দৌড়ে বেরিয়েছি, মনে নেই। আমাদের পাশের পাড়ায় ছিল একটি টিনের ফ্যাক্টরি। ওখানে টিনের মুখের যে অংশটা কেটে ফেলা হতো—তা কুড়িয়ে এনে আমরা খেললাম। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় সেই পাড়ায় পৌঁছে যাই। কত সময় পেরিয়ে গেছে, মাঝে মনে নেই। ওখানেই ঘুরে ফিরে, ফ্যাক্টরির বাইরে বসে থাকি। ভীষণ ক্ষুধায় একসময় মনে হয়, বাড়ি ফেরা দরকার। আস্তে ধীরে ফিরে আসতে থাকি। বাড়ির সামনে বাঁশঝাড়ের পাশে পুকুরের চেয়ে ছোট একটা খাল ছিল, তার পাড়ে কয়েকজনকে বসে থাকতে দেখি। কেউ কেউ কাঁদছে। একজনকে বললাম কি হয়েছে রে? বললো, ‘টিকা দিয়েছে, ব্যথা। তুই কোথায় ছিলি? যা বাড়িতে, তোদের বাড়িতে টিকা দেওয়ার লোক বসে আছে।’যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়—এই প্রবাদ তখন না বুঝলেও, না জানলেও—এখন বেশ বুঝতে পারি, কেন এরকম প্রবাদের জন্ম হয়েছিল। ওদের কথা শুনে বাড়ি ঢোকা তো দূরের, আবার দৌড়। বাড়ির পেছনের অংশটা ছিল খোলা মাঠ। ধান, পাট চাষ হতো। ক্ষেতের মাঝ দিয়ে আল পথে ধরে, লোকে অন্য পাড়ায় যেত। ওই পথেই দৌড়। মাঠের শেষে নদী, তারপর অন্যপাড়া। নদীর আগেই ছিল একটা পোড়া বাড়ি। কেউ থাকতো না বাড়িটাতে। দেবদারু গাছে ভর্তি। ওখানেও ভূত থাকে— এ বিশ্বাসও আমাদের ছিল। ও বাড়িতেও আমরা কেউ যেতাম না। কিন্তু টিকার ভয়, আমাকে তাড়িয়ে আনলো এখানে। ভূতের ভয় নিমেষেই টিকার ভয়ের কাছে কাবু হয়ে গেল। বসে থাকলাম ওই বাড়িতে। সেদিনই লক্ষ করেছি—বাড়ির ভেতরে ছিল একটি কুয়ো। পরিত্যক্ত বাড়ি হওয়ায় কুয়োটিও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তার পাড়ে শ্যাওলা, ঢেঁকিশাকের সারি। ওই কুয়োতে ভূতেরা আমাকে মেরে ফেলতে রাখতে পারে, তা বারবার মনে হলেও, আমি নড়তে পারছিলাম না। যদি ধরা পড়ে যাই, যদি টিকা দিয়ে দেয়।
কতো সময় ছিলাম, মনে নেই। তবে তখন বিকেল, পড়ন্ত বিকেল। ক্ষুধায় অস্থির হয়ে বেরিয়ে আসি। আবার এগুতে থাকি বাড়ির দিকে। বাড়ির কাছাকাছি এসে আবার দেখা হয় দুই-একজনের সঙ্গে। আমাকে দেখেই ওরা বলে ওঠে, ‘কোথায় ছিলি, তোর বাড়ির সবাই তোকে খুঁজছে।’ আমি বলি, ‘টিকা দেবার লোকেরা যায়নি?’ ওরা ঘাড় কাত করে বলে, ‘চলে গেছে। তুই হারিয়ে গেছিস, বলে তোর বাড়িতে সবাই খুঁজছে। তাড়াতাড়ি যা, তোর মা তো কাঁদছে।’ এবার নতুন ভয় গ্রাস করে, মা তো নির্ঘাত আজ পেটাবে। তবু এত ক্ষিধা লেগেছে, বাড়ি না ফিরলে মনে হয় রাস্তাতেই পরে যাব। বাড়ির বাইরের উঠোনে লাগোয়া কাঠের দরজাটা ঠেলে উঁকি দেই। আমার মুখ দেখেই কে যেন বলে ওঠে, ওই তো মামুন।’এটা শুনেই আবার দৌড় দেই। কিন্তু যাবার শক্তি নেই, আর যে আমার পিছু নেয়, সে মুহূর্তেই ধরে ফেলে। কোলে করে নিয়ে আসে মায়ের সামনে। বাবা ছিল না বাড়িতে। উনি তখন সিরাজগঞ্জের অন্য একটি উপজেলায় চাকরি করেন। অফিস শেষে রাতে ফিরতেন। মা গালে দুই চারটি চড় দিয়ে, নিজেই কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরেন বুকের মধ্যে।
চলবে…