দ্বিতীয় পর্ব: বিজ্ঞাপনের সাহিত্যমূল্য
বিজ্ঞাপন একটি শিল্প। এর নির্মাণের একটি প্রেক্ষাপট থাকে। বিজ্ঞাপনের একটি ভালো পাণ্ডুলিপি, একজন ভালো পরিচালক, অভিনয়শিল্পী এবং প্রচারমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সে যা-ই হোক। সব বিষয়ে আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার আলোচনা পাণ্ডুলিপি নিয়ে। তার কারণ কী? কারণ অবশ্যই আছে। পাণ্ডুলিপি ছাড়া বিজ্ঞাপন সম্ভব নয়। আর এই পাণ্ডুলিপি সাহিত্যের একটি অংশ। যা তৈরি হয় একজন লেখকের হাত দিয়ে।
বিজ্ঞাপনের মান নির্ভর করে পাণ্ডুলিপির ওপর। কারণ পাণ্ডুলিপির গল্পটাই কোনো পণ্যের বা প্রতিষ্ঠানের মূল বার্তাটি বহন করবে। ফলে গল্পটা হতে হয় গ্রহণযোগ্য। তবে বিজ্ঞাপনের গল্পে অবশ্যই রস থাকতে হবে। সাহিত্যের নয়টি রসের যেকোনো একটি রস তাকে বহন করতে হবে। পাশাপাশি প্রচারিত বিষয়বস্তুর সঙ্গে গল্পেরও সামঞ্জস্য থাকতে হবে। তাহলে বলা যায়, একটি সার্থক বিজ্ঞাপনের প্রধান উপাদান একটি ভালো পাণ্ডুলিপি। সার্থক বললাম কেন? সার্থক বললাম এ কারণে যে, কোনো কোনো বিজ্ঞাপন ভালো গল্পের অভাবে তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে ব্যর্থ হয়। কখনো কখনো বয়ে আনে সমালোচনা, অপবাদ কিংবা দেশদ্রোহিতার মতো জঘন্য অপরাধের অভিযোগও। কোনো কোনো বিজ্ঞাপনের কারণে সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। অবুঝ শিশুরাও প্রভাবিত হতে পারে।
ধরুন সম্প্রতি তিনটি বিজ্ঞাপন নিয়ে চারিদিকে সমালোচনা হচ্ছে। যেমন—টেলিফোন অপারেটর কোম্পানি রবির দুটি এবং বাংলাদেশের অন্যতম বহুজাতিক শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রাণের জিরা পানির। প্রতিষ্ঠান বা পণ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব অপরিসীম। নির্মাণের দিকে থেকে এটিও একটি শিল্পমাধ্যম। একটি সিনেমা বা নাটকের চেয়ে কোনো অংশেই এর ব্যয়ভার কম নয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নেয়। অনেক অর্থ ব্যয় করে এর পেছনে। অথচ এর ব্যাপ্তি একবারেই কম। এক মিনিটের একটি বিজ্ঞাপনকে অনেক বড় বিজ্ঞাপন বলা হয়।
বিজ্ঞাপন যেমন পণ্যের প্রচার-প্রসার ঘটায়। তেমনি আমাদের কিছু শেখায়। আবেগে ভাসায়, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। বিজ্ঞাপন প্রকাশের মাধ্যম অনেকগুলো। যেমন- টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন ও লিফলেট প্রভৃতি।
সম্প্রতি বেসরকারি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রবির নতুন একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। অনেকে বলছেন, এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে রবি জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছে। বিজ্ঞাপনটিতে দেখানো হয়েছে, জাতীয় পতাকার ডিজাইন অঙ্কিত টি-শার্ট দিয়ে বাসার কাজের বুয়া জানালার গ্রিল পরিষ্কার করছেন। এই দৃশ্যটি দেখেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেকে। সাধারণ দর্শকদের পাশাপাশি বেশ ক’জন তারকাও এই বিজ্ঞাপনটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ফেসবুকে। তারা সেখানে নিজেদের মন্তব্যও প্রকাশ করেছেন।
বিজ্ঞাপনটির সমালোচকদের দাবি, ‘বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্টটি কোনো কাজের বুয়া শ্রেণীর মানুষ লেখেননি। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মাথাঅলা লোক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে কফি খেতে খেতে লিখেছেন।’ তবে আশার কথা হচ্ছে—সমালোচনার মুখে শেষপর্যন্ত বিজ্ঞাপনটি বন্ধ রেখেছে রবি। ৯ অক্টোবর থেকে দেশের কোনো টিভি চ্যানেলেই এটি প্রচার করা হচ্ছে না। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্বাগতিক বাংলাদেশের দ্বিতীয় ওয়ান ডে ম্যাচটি প্রচার করা জিটিভিতেও দেখা যায়নি বিজ্ঞাপনটি।
আমরা জানি, সমালোচনার মুখেই বিজ্ঞাপনটি বন্ধ করে দিয়েছে রবি। তবে এটি সাময়িকভাবে। পরবর্তী সময়ে আবারও সেটি প্রচারের আশঙ্কা রয়েছে। বিজ্ঞাপনী সংস্থা অ্যাডকমের ব্যানারে নির্মিত ২০ সেকেন্ডের এই বিজ্ঞাপন নিয়ে সমালাচনার মুখে পড়তে হয়েছে জনপ্রিয় এই প্রতিষ্ঠানকে।
এছাড়া রবির আরেকটি বিজ্ঞাপনে আপত্তিকর দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। পাত্রপক্ষ কন্যাকে দেখতে এসেছেন। সবাই বসে নাস্তা করছেন। কনে পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মেয়ে খুব শান্তশিষ্ট। এমন সময় কন্যা গলায় ঢোল ঝুলিয়ে ‘বাংলাদেশ- বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করতে করতে রুমে ঢুকতে যায়। এ অবস্থায় ঘরে অতিথিদের দেখে সে বিব্রত হয়। আমার প্রশ্ন—যে মেয়েকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে, সেই মেয়ে এ সম্পর্কে কিছুই জানবে না? এমন সস্তা গল্প কিভাবে পছন্দ করলো প্রতিষ্ঠানটি? নাকি মানুষকে সস্তা বিনোদন দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য ছিল? যেটা বাস্তকে ঘটে বা ঘটতে পারে, এমন কিছুকে কেন্দ্র করে হোক না বিজ্ঞাপন!
এবার আসি অন্য প্রতিষ্ঠানের কথায়, এই তো গত কোরবানির ঈদ থেকে একযোগে প্রচারিত হচ্ছে ‘প্রাণ জিরা পানি’র বিজ্ঞাপন। ‘অনেক কোপাইছেন, এবার থামেন, জিরা পানি খান’—এমন সংলাপে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় মানুষের মধ্যে। গ্রামাঞ্চলে ‘কোপানো’ শব্দটি ‘যৌনক্রীড়া’ বা ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ফলে এমন শব্দে আপত্তি তুলেছে সুশীল সমাজ। এ শব্দটি দ্বারা শিশুরাও প্রভাবিত হচ্ছে। হাতের কাছে দা-ছুরি যা পায়, নিয়ে তেড়ে আসে আর বলে, ‘এবার কোপাবো’। বিজ্ঞাপনটি নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সমালোচনা হচ্ছে।
একটু অতীতে দৃষ্টি দিলে দেখব—একসময় রুচি ঝাল চানাচুরের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে ‘ঝাল খেয়ে পানিতে লাফ দিতে’। সেটাও সমালোচনার মুখে পড়ে। ভারতে বডি স্প্রে ‘এক্স’-এর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছিল—এক্স ব্যবহার করলে চতুর্দিক থেকে নারীরা ছুটে আসে। কিন্তু ওই ব্যবহারকারীও এক্স ব্যবহার করে কোনো নারীর সন্ধান পাননি। তাই তিনি প্রতারণার মামলা করেছিলেন।
এভাবে বহু বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে মামলার কথা হয়তো আপনারা শুনেছেন। তার কারণ অবশ্যই আছে। বিজ্ঞাপন তৈরির নীতিমালাও রয়েছে। যেহেতু বিজ্ঞাপন একটি ব্যয়বহুল শিল্প, সেহেতু এর নির্মাণের ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া উচিত।
এইযে বিজ্ঞাপন নিয়ে এত ঝামেলা, সমালোচনা ও মামলা ইত্যাদি তা কেবল দুর্বল পাণ্ডুলিপির জন্য। তবে পাণ্ডুলিপি যারা নির্বাচন করেন তাদেরও হয়তো সাহিত্যজ্ঞান বা শিল্পজ্ঞান কম। ফলে ‘জনগণ খাবে’ বলে বা সম্পর্কের খাতিরে একটি সস্তা পাণ্ডুলিপিকে মনোনীত করে ফেলেন। তারা ভাবেন না যে, বিজ্ঞাপনেরও একটি শিল্পমূল্য রয়েছে। তবে ভুলে যাবেন না যে, বিজ্ঞাপন নিয়ে যেমন সমালোচনা হয়েছে, তেমনি আলোচনাও হয়েছে অনেক। গ্রামীণফোনের ‘কথা তো মুছে গেছে বাজান’ কথাটি এখনো শ্রোতার কানে বাজে। তারপর ‘বাবা তুমি কই’ কথাটি আজো সব বাবার অন্তরে বেজে ওঠে। ‘আমারে ছাড়িয়া রে বন্ধু কই রইলারে’র মতো বিজ্ঞাপনও এদেশে নির্মিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
সবশেষে বলতে চাই, বিজ্ঞাপনে মানুষের আবেগ নিয়ে খেলা যায়। সুতরাং মানুষের মেজাজ বিগড়ে যায় এমন বিজ্ঞাপন তৈরি না করাই ভালো। যারা বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট তৈরি করেন, তাদের আরও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের প্রথিতযশা কবি-লেখকদের যুক্ত করা যেতে পারে। প্রত্যেকটি কোম্পানি একজন করে কবি-লেখককে তাদের মিডিয়া বিভাগে নিয়োগ দিতে পারে। আমরা সমস্বরে বলতে চাই, বিজ্ঞাপন হোক সবার কল্যাণে।
চলবে…