প্রাচীনকালে লেখার কোনো উপকরণ ছিল না। মানুষ নগ্ন থাকতো। পরনের কোনো পোশাক ছিল না। লজ্জা নামের অনুভূতি ছিল না তাদের। অনুভূতি না থাকায় সাহিত্যচর্চারও প্রশ্নই আসে না। একসময় আস্তে-আস্তে মানুষ সভ্য হতে শুরু করে। লজ্জা বা বোধকে আবিষ্কার করে। আগুন আবিষ্কার করে রান্না করতে শেখে। আবিষ্কার করে অনেক কিছু।
আবিষ্কার করে ভাষা। মনের ভাব প্রকাশের জন্য ইশারাকে বিদায় জানিয়ে বর্ণ সৃষ্টি করে। বর্ণ দিয়ে কথার মালা গাথতে শুরু করে। কথামালাকে একসময় শিল্পে রূপান্তর করে। তারা শিখতে শুরু করে। শেখাতে শুরু করে। লিখতে শুরু করে। পড়তে শুরু করে। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় লেখাপড়ার উপকরণও আবিষ্কৃত হয়।
এসব কিছুই একদিনে হয়ে যায়নি। ধীরে-ধীরে প্রয়োজনের তাগিদে সময়ের ব্যবধানে সবকিছু করায়ত্ত করেছে মানুষ। মনোরঞ্জনের জন্য শিল্পের উদ্ভব হলেও ধীরে-ধীরে তা গ্রহণযোগ্যতা পেতে থাকে। শিকারের বর্ণনা দিতে গিয়ে তৈরি হয় মঞ্চনাটকের প্রেক্ষাপট। প্রথমে নির্বাক তারপর সবাক। এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে শিল্পকর্ম। যাবতীয় শিল্পকর্মের মধ্যে প্রধান একটি জায়গা দখল করে আছে সাহিত্য। একসময়ের শুধু কাব্যনির্ভর সাহিত্য থেকে রূপান্তরিত হয় গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক ইত্যাদি।
আদিম পর্বে পশুর চামড়া, পাথর, ঘরের দেয়াল, গাছের ছাল-বাকল, পাতা এবং কাপড়ে লিপিবদ্ধ হতো কথামালা। এভাবেই এগোতে থাকে সংস্কৃতি। লিপিবদ্ধ হতে থাকে কাব্য ও সঙ্গীত। কখনো কখনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় সে উপাদান। কিন্তু শত শত বছর পরেও আবিষ্কৃত হয়েছে অনেক সাহিত্য বা শিল্পকর্ম। চর্যাপদ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো মহামূল্যবান কাব্য জন্মের অনেক বছর পর পাওয়া গেছে। কোনোটা গোয়াল ঘরে, কোনোটা রাজ গ্রন্থাগারে।
সে অনেক আগের কথা। এখন বদলে গেছে অনেক কিছু। মানুষ তখন হাতে লেখা পুঁথি বা কাব্য পড়েছে। এখন সাহিত্যে অতি-আধুনিকতার যুগ শুরু হয়েছে। আধুনিকতার শুরু তো হয়েছে সেই ১৮০০ সালে। তখন মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে। কবিরা ধর্মের কাহিনি ছেড়ে ছুটে আসতে চাইলেন মানবতার গানে। কিছুদিন পরই কাব্যচর্চার পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হলো গদ্যচর্চা।
তবে মানুষ স্বভাবতই কবি। জন্মটা অনেকের কবি হয়েই। দু’চার শ্লোক বা অন্ত্যমিলযুক্ত পদ্য দিয়ে পথচলা শুরু। তারপর খুঁজে নেন আপন গন্তব্য। এই তো রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কবিতা লিখে রেখে গেছেন। তাদের পাণ্ডুলিপি হাত নিলে কখনো কখনো গলদঘর্ম হতে হয়। এত কাটাকুটি, আঁকিবুকির মাঝে মূল কথা বের করাই মুশকিল হয়ে উঠতো।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। গেলে প্রায় এক যুগ আগের কথা। আর বর্তমান যুগ তো প্রযুক্তির। তখন লেখা হতো কাগজে। পকেটে বা কাঁধের ঝোলায় কাগজ-কলম থাকতো। যখনই ভাব আসতো, কবিরা লিখে ফেলতেন। পরে বাসায় গিয়ে তা ডায়রিতে লিখতেন। কারো কারো চার-পাঁচটা ডায়রি ভরা আছে কবিতায়। আরো বেশিও হতে পারে।
ফেসবুকে প্রচারসর্বস্ব সাহিত্যকর্ম
সম্ভবত ২০০৭ কি ২০০৮ সালের দিকে সবাই ফেসবুকের দিকে ঝুঁকতে থাকে। ফেসবুকে সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। ভালো কথা। ডিজিটাল যুগে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে মনে রাখতে হবে ফেসবুকের স্ট্যাটাসভিত্তিক সেলিব্রেটি হয়ে লাভ নেই। সেটা সাহিত্য নয়। তাৎক্ষণিক তৃপ্তি হয়তো পাওয়া যেতে পারে। তবে তার স্থায়ীত্ব নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তবে বর্তমান যুগটা সহজ। লেখাও সহজ। কবি হওয়া আরও সহজ! ফেসবুক, ব্লগ, অনলাইন আছে তো। লিখতে থাকুন। লাইক, কমেন্ট ও শেয়ারের বন্যায় ভেসে যাবেন আপনি। যাচ্ছেনও অনেকেই। কবিকে যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘কোন ছন্দে লিখলেন?’ তিনি বলবেন, ‘ছন্দ আবার কী?’ আসলেও তা-ই। ছন্দ বলতে আবার কী? প্রযুক্তির যুগে ছন্দের কোনো প্রয়োজন নেই। অন্ত্যমিল থাকতে পারে। কথাগুলো রসালো করে বললেই তো হয়ে গেল। ছন্দ আবার অনেকেই মানতে চান না। (আসলে ছন্দ যে কী, তাই বোঝেন না, কোনোদিন শেখেননি)। তথাকথিত ওই কবি হাজারটা লাইক, অর্ধশত শেয়ার এবং শতাধিক মন্তব্য পেয়েছেন। কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো ফেসবুকে। এই ফেসবুক সর্বস্ব সাহিত্যকর্মে তিনি স্বঘোষিত প্রধান কবিও ভাবতে পারেন নিজেকে। যেহেতেু ফেসবুক একান্ত ব্যক্তিগত একটি মাধ্যম। আপনি যা খুশি লিখতে পারেন। তবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, অশালীনতা এড়িয়ে যেতে হবে অবশ্যই। মোটামুটি যেন সাইবার ক্রাইম না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখলেই হলো।
এ প্রসঙ্গে এক গদ্যে মারুফ রায়হান যখন বলেছেন, ‘আজকের যুগে ফেসবুকই হয়ে উঠেছে লেখার সবচেয়ে বড় ধারক। বলতে পারি খোলাখাতা। তবে তার একটা প্রেক্ষাপটও রয়েছে। দেশে অনলাইন বা ইন্টারনেট সুলভ হওয়ার আগে নবীনদের লেখার জায়গা ছিল ব্লগ। সামহোয়্যার ইন ব্লগসহ কয়েকটি ব্লগ এক্ষত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। ধর্ম বা রাজনীতি বিষয় নিয়ে লেখা কিংবা অশ্লীল না হলে সে লেখা অতি সহজেই ব্লগে জায়গা করে নিচ্ছে। যদিও সচলায়তনসহ কোনো কোনো দায়িত্বশীল ব্লগ সুস্পষ্ট নীতিমালার আলোকে লেখা প্রকাশ করে থাকে।’ সে কথা মেনে নিলে সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি হওয়ারই কথা। কিন্তু তা কি হচ্ছে?
এ সময়ের লেখকরা শুধু কি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টেই সীমাবদ্ধ? আরও তো আছে। ফেসবুক পেজ খুলতে পারেন। তৈরি করতে পারেন গ্রুপও। পেজ বা গ্রুপের সদস্যরা নিজের ইচ্ছেমতো কবিতা বা অকবিতা সব কিছুই পোস্ট করতে পারেন। পাঠক কবিতা বুঝুক বা না বুঝুক; কমেন্ট তো করবেই! দারুণ, চমৎকার, ওয়াও, নাইস, সুন্দর, এগিয়ে যান, ভালো লাগলো প্রভৃতি প্রশংসায় ভেসে যেতে থাকে কমেন্টস বক্স। আর তা দেখেই কবি খুশিতে গদগদ অপ্রস্তুত কর্মবীর-কবিতামূর্খ কবিযশপ্রার্থীরা। শুদ্ধ বানান ও মানসম্মত কবিতা হলে মেনে নিতে কোনো আপত্তি ছিল না।
তাহলে কি তিনি কবি নন? কবিতা তো প্রায় সবাই লেখেন, সবাইকেই কি কবি বলতে পারি? কবি হওয়ার জন্য কী করা যায়? নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, ‘কবিতা লিখতে হলে কী কী চাই? বিশেষ কিছু না। দরকার শুধু-
১. কিছু কাগজ (লাইন টানা হলেও চলে, না হলেও চলে)
২. একটি কলম (যেকোনো সস্তা কলম বা পেন্সিল হলেও চলে)
৩. কিছু সময়।’
তাহলে ধরে নিলাম—কিছু কাগজের পরিবর্তে ফেসবুক টাইমলাইন। কলমের পরিবর্তে কিবোর্ডে আঙুল। সময় তো ঢের রয়েছেই। তো হয়ে গেলেন কবি-লেখক। তাতে আপত্তি নেই। তবে এই অবাধ-উন্মুক্ততার সুযোগে যাচ্ছেতাই লিখে নিজেকে কবি-লেখক দাবি করতে পারেন না।
এ জন্য আবার ভেবে নেবেন না—ফেসবুকে কবিতা-ই লিখবেন না। আমি কবিতা বা লেখার বিরোধিতা করছি না। আপনারা অবশ্যই লিখবেন। মানদণ্ড অক্ষুণ্ন রেখে কবিতা বা যেকোনো লেখা পোস্ট করুন। আমরা তাতে উপকৃত হব। পাঠকের জন্য শিক্ষণীয় কিছু তুলে ধরুন। আপনার সস্তা বা বস্তাপচা লেখালেখি অন্যের সময় হরণ করার অধিকার রাখে না। ফেসবুকে তো নির্মলেন্দু গুণ, মুহাম্মদ নূরুল হুদা থেকে শুরু করে অনেক খ্যাতিমান কবিও কবিতা লিখছেন। তাঁরা তাদের প্রকাশিত লেখা ফেসবুকে দিচ্ছেন আরও কিছু পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য। আমার প্রশ্ন—মানসম্মত লেখা নিয়ে। আমাদের মানসম্মত লেখা ফেসবুকের মাধ্যমে পৌঁছে যাক সবদেশে।
তবে কবিতা লেখা হওয়া চাই মানসম্মত। প্রত্যেক লেখককে চিন্তা করা উচিত— তাঁর প্রতিটি লেখাই হবে সমাজের জন্য, মানুষের জন্য, দেশের জন্য। কবিতা, গল্প বা উপন্যাসের রীতি মেনেই তা সৃষ্টি হবে। কোনো শিল্পই নিয়ম ছাড়া এগোতে পারে না। প্রত্যেকটি শিল্পকর্মের নিজস্ব সূত্র রয়েছে। সূত্র ছাড়া কিছু নির্মিত হলে তার স্থান ভাগাড়। এ ধরনের চর্চা-প্রচারসর্বস্ব আচরণ, মূলত সাহিত্যের প্রতি শত্রুতা। সাহিত্যের সাম্প্রতিক শত্রুগণের মধ্যে ‘ফেসবুকে প্রচারসর্বস্ব প্রবণতা’ অন্যতম।
চলবে…