দ্বিতীয় পর্বের পর:
চিত্রকল্প-উপমা সৃষ্টিতে স্বাতন্ত্র্য অর্জনই প্রকৃত কবির শক্তিমত্তার মূল পরিচায়ক। অগ্রজের চিত্রকল্প-উপমার চর্বিতচর্বণ অনুজকে অনুকারকে পরিণত করে। তাই যিনি কবি হতে এসেছেন, তিনি অগ্রজের দেখানো পথ ধরে হাঁটলেও শেষ পর্যন্ত সে পথকেই একমাত্র বা অনিবার্য জানেন না। তিনি সৃষ্টি করেন নতুন স্বতন্ত্র পথ। এই নতুন পথের স্রষ্টাদের একজন চন্দন চৌধুরী।
সমকালীন কবিরা তো বটেই, সাধারণ পাঠক, সমালোচক ও অগ্রজরাও তাকে যে কবিতাটির জন্য চেনেন, তাঁর সে কবিতাটির নাম ‘প্রকাশ’। এ কবিতায় কথক একজন সদ্য যৌবনে পা রাখা প্রেমিক। প্রকাশ কবিতায় চন্দন চৌধুরী কোনো তথ্য প্রকাশ করেন না। কেবল ইঙ্গিত দেন। তাতে পাঠক বুঝে নেন এর পেছনে কী রয়েছে। চন্দন চৌধুরী মাত্র সাত পঙক্তিতে কবিতাটি রচনা করেছেন। আর এই মাত্র সপ্তপদীতে তিনি যা বলেছেন, তাতে ফুটে উঠেছে ব্যীক্তমনের গোপন কাঙ্ক্ষা ও নারী-পুরুষের অব্যক্ত বাসনা। পুরো কবিতাটি এবার পাঠ করা যাক।
রাগিও না, নক্ষত্র ছেপে দেব।
সেই যে মিনুদি, কৈশোরের গল্পচ্ছলে
দেখিয়েছিলেন দুধাল কোমর
এর আগে বুঝিনি
মানুষের শরীরে যে নদী বাস করে
শোনা যায় ঢেউয়ের আওয়াজ।রাগিও না, বলে দেব সেই কথা।
(প্রকাশ: চন্দন চৌধুরী)
কবিতা যখন মানবমনে দোলা দিয়ে যায়, তখন এর অর্থ বোঝার চেয়ে মর্ম উপলব্ধিই বড় হয়ে ওঠে।
অল্পশব্দে অনেক কথা বলার শক্তি কবিকে আয়ত্ত করতে হয়। চন্দন চৌধুরীর ‘প্রকাশ’ কবিতায় এর প্রমাণ রয়েছে। অল্প শব্দে অনেক কথা বললে তা পাঠকমনে দ্রুত ও সহজে জায়গা করে নেয়। বেশি কথা বললে কখনো কখনো পাঠক মনে বিরক্তির উদ্রেকও করে। তখন পুরো কবিতাটি পাঠক আর পাঠ করে না। ফলে কবিতার সম্পূর্ণ রস আস্বাদন না করে খণ্ডিত ধারণা লাভ করে। এতে কবি ও পাঠক, উভয় পক্ষেরই উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাখরখানি’ গান রচনার পটভূমির কথা। চলুন তার মুখ থেকেই শুনি। একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘‘১৯৮৩তে শাহানগর লাইব্রেরির একটি কক্ষে আমি গেছি। সেখানে ‘এই সময়’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী বা এমন কিছু ছিল। তো সেদিন কবি সমীর রায় চৌধুরী তার কিছু কবিতা পড়েনে। তার মধ্যে একটি কবিতা শুনে আমার খুব ভালো লাগে। অনুষ্ঠান শেষে আমি সমীর দাকে বলি যে, আপনার এই কবিতাটি আমি টুকে নেব? তখন তিনি বললেন, আপনি আমার বইটাই নিয়ে নিন। এই বলে তিনি অটোগ্রাফসহ আমাকে দিলেন। বইটা নিয়ে রাত্রিবেলা আমার গবেষণা শুরু হলো। কবিতাটি ছিল এ রকম: ‘আলো বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাখরখানি/ সাবধান! বেচো না চোখের মনি। একটি সাবধানবাণী ছিল। আমার মনে হলো, আমি সাবধান করব না। কবিতাটি দিয়ে আমি আবেদন করব। বলব যে, চোখের মণিটাকে বেচে দিও না। আমার মনে হলো যে, আমি সবার কাছে আরও ভালোভাবে পৌঁছুতে পারব। এমনি করে করে শুরু করে দিলাম কবিতার গীতি রূপান্তর। নানা রকম কথা ছিল। এক জায়গায় ছিল: ‘ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকিতে/ হাজার টাকায় বেচতে পারো ঝরনা মাসির সোনার গয় না।’ তো আমি বসে আছি। কিছুতেই এটাকে গান করতে পারছি না। তখন আমাদের বাড়িতে কাজে সহায়তা করতো, ১০/১১ বছরের একটি মেয়ে। থাকতো আমাদের সামনের ঝুপড়িতে। সে খুব ভালো গান করতো। এমন সময় সে এসে বলল, ও মেসো কী করতেছ?
আমি বললাম: আমি তো একটি গান বানাচ্ছি। কিন্তু পারছি না।
সে বলল: কেন? কী হয়েছে?
আমি বললাম: প্রথম লাইন করলাম। শুনে সে বলল, এতো ভালো গান হয়েছে গো।
তখন বললাম: এই জায়গাটা তো পারছি না- ‘ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকিতে, হাজার টাকায় ঝরনা মাসির সোনার গয়না।’ কী করে গাইব এটাকে? আচ্ছা ঝরনা মাসিকে না হয় বিদায় দিলে বললাম, আপনাকে নিতে পারছি না, ঝরনা মাসি চলে গেলেন। তো কী করব? আমি এত বড় লাইন রাখতে পারছি না। ননী এতক্ষণ গম্ভীর হয়ে ছিল। সে এসে বলল: ‘ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকিতে/ হাজার টাকায় সোনা’ বললেই তো হয়। ও যে সোনার গয়না, ও ঠিক লোকে বুঝে নেবে।
ভাবুন, আমার তখন ৪১ বছর বয়স। মেয়েটি কৃষকের সন্তান। তার বয়স ১১। তার কাছে আমি শিখলাম কী করে একটি কবিতার গীতিরূপান্তর সম্ভব। ও আমাকে বোঝালো, কতকথা ইঙ্গিতে বললে পাঠকেরা (শ্রোতা) সেটা ঠিক বুঝে নেয়। অত বাড়িয়ে কথা বলার দরকার হয় না।’’
কিংবদন্তি গণসঙ্গীত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় যে বার্তা আমাদের দিয়েছেন, তাহ হলো কমশব্দে-চিত্রকল্পে-উপমায় কবিকে কেবল ইঙ্গিতেই দিতে হবে। বাকিটা লোকে বুঝে নেবে। এখানে তিনি পাঠককেও বোধের দিক থেকে কবির সমান্তরালে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তেমনি চন্দন চৌধুরীর প্রকাশ কবিতায় অল্পকথায় বলা হয়েছে জীবনের বৃহত্তর দিকটি। প্রথম পঙ্ক্তি—’রাগিও না, নক্ষত্র ছেপে দেব।’ এটিই এ কবিতার চাবিবাক্য। এই বাক্যে একইসঙ্গে হুমকি, অনুরোধ ও সতর্কতাই ইঙ্গিত রয়েছে। কথক তার দয়িতাকে অনুরোধ করছেন, যেন তাকে না রাগায়। অর্থাৎব্যক্তি মাত্রই কামনার করে, তার কিছু কথা গোপন থাকুক। কিছু বিষয় হোক একান্তই তার নিজস্ব। যে বিষয়টিকে কেউ ঘাটাবে না, কিংবা কারও একান্ত কিছু ব্যক্তিগত বিষয়ে অন্যরা হস্তক্ষেপ করবে। সমাজে-রাষ্ট্রে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা পূর্বপরিকল্পিত থাকে না। কিন্তু ঘটে। এই ঘটে যাওয়ার জন্য কিছু লোক বিব্রত হয়। তারা চায়, তাদের বিষয় গোপন থাকুক। কিন্তু আরেকটি পক্ষ থাকে, অন্যের ত্রুটি পাওয়া মাত্রই তা রাষ্ট্র করে দিতে চায়। মাঝে-মাঝে অন্যের ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে বাহ্বাও কুড়ায়। এক্ষেত্রে ভুল শনাক্তকারী তার কৃতিত্বের জন্য উল্লসিত হলেও, যে ভুল করে, সে থাকে সন্ত্রস্ত; সম্মান হারানের ভয়ে ভীত। তখন এই ভীত-সন্ত্রস্ত ব্যক্তির একমাত্র আরাধ্য হয়ে ওঠে, ঘটে যাওয়া ঘটনার যেন লোকসমাজের কানে ছড়িয়ে না পড়ে। আবার কিছু ঘটনা থাকে, যার সঙ্গে একাধিক লোকের সম্পৃক্ততা থাকে। কিন্তু কেউ কেউ বিষয়টি থেকে নিজেকে দ্রুত মুক্ত নিতে পারে, মুছে ফেলতে পারে সমস্ত ভুলের চিহ্ন। তখন কেবল বাকি লোকটিকে হেনস্থা করার উদ্দেশ্যেই থাকে সে। সময় ও সুযোগ পেলে করেও তাই। আবার আরেক দল থাকে, যারা মানুষের দুর্বল দিককে পুঁজি করে, নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে। কিন্তু দুর্বলও চিরকাল দুর্বল থাকে না, আঘাতে আঘাতে সেও সর্বংসহা হয়ে ওঠে। সেও প্রতিবাদ জানায়। এই চিত্র সমাজের জটিল রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি নারী-পুরুষের গোপন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। দৃশ্য-ঘটনা যখন এমন, তখন কবি মনেও কিছুটা রোমান্স কিছুটা সমাজবাস্তবতার মিশেলে তৈরি হয় ঘোর। আর এই ঘোরের নামই প্রকাশ। অর্থাৎ নিগূঢ় কোনো কথা ফাঁস করে দেওয়ার মৃদ্যু সতর্কবার্তা, করুণ মিনতি। আর কবিতার শেষ পঙক্তি মূলত প্রথম পঙ্ক্তিরই সম্পূরক অংশ। প্রথম পঙ্ক্তিতে গোপনীয়তা ফাঁস করে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকিসমেত সতর্কবার্তা, শেষ পঙ্ক্তিতে পুরো বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়ার পর মৃদু ভয় দেখানো। প্রথম পঙক্তির ‘নক্ষত্র’ চিত্রকল্পে রয়েছে বিষয়বস্তুকে প্রকাশ্য স্থানে এনে চিরদিনের জন্য গোপনীয়তার পর্দা সরিয় দেওয়ার স্বভাবচিত্র, আর শেষ পঙ্ক্তিতে প্রকাশিত হয়েছে, কোনো বিষয়কে গোপন করে রাখার সানুনয় নিবেদন।
কবি বোঝাতে চেয়েছেন, একটি ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় তিনি ধরতে পেরেছেন নারীর যৌবন নদীর মতো প্রবহমান। সেখানেও ঢেউ জাগে, সে ঢেউ কামনার। নদী যেমন বলে-কয়ে কাউকে বোঝায় না, আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, তেমনি যৌবনবতী নারীও তার কামনার ঢঙ ও চাহনি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় নিজের বাসনার কথা, ইচ্ছার কথা।
এই দীর্ঘ শীবের গীতের লক্ষ্য একটিই। তাহলো চন্দন চৌধুরীর চিত্রকল্পময় ‘প্রকাশ’ কবিতাটি কমশব্দযোগে রচিত হলেও তাতে অনেক কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে শৈশব থেকে যৌবন ও এই সময়ের মধ্যকার ইতিহাসের কথাও।
চলবে…