পর্ব-৬
কলা-রুটি খেতে খেতে শফিকের গলায় আটকে যেতে শুরু করে, গলাটা শুকিয়ে গেছে। অর্ধেক খেয়ে দ্রুত যায় লঞ্চের পিছনের দিকে। লঞ্চের পিছনে ইঞ্জিন রুমের পর খালাসিদের ছোট ছোট খুপরি ঘর, সেইসব ঘর পার হওয়ার পর খাবারের দোকান, সঙ্গে ছোট ছোট বাথরুম। বাথরুমের পরে একেবারে শেষ প্রান্তে ছোট আকারের একটা টিউবওয়েল। টিউবওয়েল চেপে আঁজলা ভরে পানি খায় শফিক। পানি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভেতরের আঠালো ভাবটা চলে যায়। আবার আসে আগের জায়গায়, বাকি অর্ধেক রুটি ও কলা খাওয়া শেষ করে ধীরে ধীরে। কলার ছোকলাটা ফেলে দেয় নদীর অথৈ জলে। অন্ধকারে বসে থাকে শফিক। মনটা খারাপ। ঢাকা যাচ্ছে, কত গল্প শুনেছে মানুষের কাছে, শেষ পর্যন্ত সেই ঢাকার যাত্রী নিজেই।
সিকদার বাড়ির মোজাম্মেল চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চাচা বাড়ি এলে উজানগাঁও বাজারে এলে ঢাকার গল্প করতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কত গল্প বলেছে। শত শত ছাত্রছাত্রী, এক সঙ্গে পড়ে, আড্ডা দেয়। অনেক টাকাঅলা ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই গাড়ি চালিয়ে ক্লাস করতে আসে। মধুর ক্যানটিনে বসে রাজনৈতিক ছাত্রদলগুলোর তুখোড় আড্ডা। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে মারামারিও হয়। মারা যায় কেউ কেউ। সব চেয়ে আজব জায়গা সদরঘাট আর হাইকোর্টের মাঝার। সদরঘাটে হাজার হাজার লোকের আসা-যাওয়া ছাড়াও প্রচুর লঞ্চ আসা-যাওয়া করে। লঞ্চের পেটের মধ্যে থেকে হাজার হাজার যাত্রী নামে সদরঘাটে, আবার মিশে যায় ঢাকা শহরের জনস্রোতে। হাইকোর্টের মাঝারে নানান কিসিমের লোক আসে, প্রায়ই মজমা বসে। বাউল গান গায় সাধু পুরুষেরা। নূরা পাগলা একজন সাধু, লোকটা প্রায় ন্যাংটাই থাকে শীতে বর্ষায় গ্রীস্মে। সারা শরীরে পেচানো থাকে লোহার শিকল।
-লোহার শিকল হারা গায়ে? অবাক হয়ে শুনছে যারা, তাদের মধ্যে কেউ প্রশ্ন করে মোজাম্মেল চাচাকে।
চাচা বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইকোর্ট তো দূরে না। কাছেই। আমরা বিকেলের দিকে বন্ধুরা মিলে হাঁটতে হাঁটতে যাই।
-কেউ কিচ্চু কয় না?
-কী বলবে? মোজাম্মেল চাচার গলায় অহঙ্কার, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের কেই কিছু বললে ভেঙে চুরে ঢাকা শহরে তছনছ করে ফেলবো না?
লোকজন চলে যাবার সেই ছেলেটা সব গুছিয়ে ট্রাংকে ভরে, আর ক্যানভাসার একটা সিগারেট ধরিয়ে টানে। কিছুক্ষণ পর লোকটা আর ছেলেটা খালের পারে নৌকাঘাটের দিকে চলে যায়। সারাটা রাত ক্যানভাসারের মুখ চোখের সামনে ভাসছিল।
বছর খানেক আগে উজানগাওয়ের বাজারে বৃহসপতিবার বিকেলে, হাটের সময় এসেছিল এক ক্যানভাসার। ক্যানভাসার কি জিনিষ এতদিন কেবল শুনেছে, সরাসরি দেখলো সেদিন প্রথম। একটা ছোট ছেলে পোটলা-পুটলি সাজিয়ে বসেছে বাজারের দক্ষিণ দিকে, একটু খোলা জায়গায়। হাটুরে লোকজন অবাক হয়ে নতুন ছেলেটার কাজ দেখে। ছেলেটা কোনো দিকে তাকায় না। প্লাসটিকের একটা চাদর বিছিয়ে, চাদরের ওপর রাখে একটা বাক্স। সেই বক্সটার মধ্যে থেকে বের করে আসে হাতলঅলা কাঠের চেয়ার। সেই চেয়ারটা বসিয়ে উঠে বসে চেয়ারের হাতলের ওপর, এক পায়ে। অবাক ঘটনা, চেয়ারটা হেলে পরে যাওয়ার কথা কিন্তু পরে না, চেয়ারটা সোজা থাকে। ছেলেটা চেয়ারের বাতার ওপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে দুই দিকে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দেয়, একটা পাখির ডানার গতিতে হাতদুটি নাড়ায়। গ্রামের বাজার উজানগাঁও। চোখের সামনে অভিনব এই দৃশ্য দেখার জন্য প্রচুর লোক জড়ো হয়, গোলাকার বৃত্তে।
ঠিক সেই সময়ে ভিড় ঠেলে কালো রঙের একজন ঢোকে টকটকে কালো রঙের লম্বা চওড়া একজন। লোকটা যদিও কালো পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। ঢুকেই মুহূর্তে ছেলেটাকে একটা আতা বা শরীফ পাড়ার মতো করে নিচে নামিয়ে এনে মাটির ওপর ছেড়ে দিয়ে পায়ের ওপর পা রেখে চেয়ারে বসে। ঘটনার আকস্মিকতায় উজানগাঁও গ্রামের হাটুরে বিস্মিত।
চেয়ারে বসে লোকটা তাকায়, মনে হচ্ছে লোকটা গ্রামের বা উপস্থিত সবাইকে চেনে। এমন গভীর আন্তরিক চোখে তাকিয়ে বলেন, আপনারা কেমন আছেন? আমি সাধারণত গ্রামে মজমা মিলাই না। আমার মজমা হয় খুলনা বরিশাল ঢাকা চট্টগ্রামে। সবচেয়ে বড় মজমা মিলাই আমি ঢাকা হাইকোর্টের মাজারে। বলতে বলতে লোকটা ঘূর্ণিপাকের মতো দাঁড়াতে দাঁড়াতে ঘোরে গোটা জটলা ঘিরে।
কত ফকির ঘোরেরে…ওই হাইকোর্টের মাঝারে…নাচতে নাচতে লোকটা দরাজ গলায় গায়। গোটা হাট ভেঙে পড়লো মজমা ঘিরে। আর মনে নেই ক্যানভাসারের গানের বাকি কথাগুলো। গান গাওয়ার পরে ক্যানভাসার ট্রাংকের মধ্যে থেকে বের করে আনে একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটা। বাটা হাতে নিয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, এই বাটার মধ্যে আছে আমার আপনার প্রাণ, সুস্থ সবল শরীরের মন্ত্র। নিজের রানের ওপর ডান হাতের প্রকাণ্ড এক থাপ্পড় দিয়ে বলে, গিয়েছিলাম কামরূপ কামাখ্যায়। সেখান থেকে আনছি নি-ফল গাছের চামড়া। শত শত গাছের বাগান। কিন্তু প্রত্যেকটা গাছে জড়িয়ে আছে আজদাহা সাপ। সেই সাপ হা করলেই নিমিষে পেটের মধ্যে চলে যাবেন। কিন্তু না। সবাই যাবে না। যারা সহি, পবিত্র, কখনো গিবত গায় নাই, পরের জিনিস চুরি করে নাই, এতিম আর গরিবের টাকা পয়সা মারে নাই, সেইসব লোক গাছের গাছে গেলে সাপগুলো গাছ থেকে নেমে দূরে চলে যায়, যাতে গাছের চামড়া তুলে আনতে পারা যায়।
আহারে, ক্যানভাসারের গলায় আফসোস, সেইসব গাছের চেয়ে দেখলাম, পড়ে আছে অসংখ্য মানুষের লাশ, হাড়গোড়। যারা অসৎ, গিবতকারী, অন্যর টাকা লুণ্ঠনকারী, গিয়েছিল নি-ফলের গাছের চামড়া আনতে, সাপের ছোবলে শেষ। মহান আল্লাহ পাক সাপের মুখে ভাষা দেয় নাই। কেন দেয় নাই, জানেন মাবুদ। কিন্তু আমি মনে করি সাপের মুখে ভাষা দিলে অনেক মানুষ দ্রুত চেনা যেতো। যাই হোক, আমি বিসমিল্লা বলে অনেক নি-ফল গাছের মধ্যে বড় একটা গাছ টার্গেট করে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি, সেই গাছে বড় বড় তিনটা সাপ পেছিয়ে আছে। আমি কী করবো? ভয় লাগছে, প্রাণের মায়া কার না থাকে, বলুন আপনারা? কিন্তু নিজের জীবনের মায়া কাটিয়ে গাছের দিকে এক পা দুই পা করে যাচ্ছি, আমি তো আমার জন্য যাচ্ছি না, যাচ্ছি আপনাদের জন্য। প্রাণ হাতে নিয়ে গাছের দিকে যেতে যেতে দেখতে পাচ্ছিলাম, আপনাদের মুখ। সব মুখ অসুস্থ। বেদনায় কাতর। আমি একটু একটু করে গাছটার দিকে যাচ্ছি, দেখি, ওমা গাছের সাপ তিনটা নেমে যাচ্ছে। আমার শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে, গাছের সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে মহান পরোয়ারদেগারের দরবারে দুহাত তুললাম।
লোকটা, ক্যানভাসারের গলায় কান্না নেমে এলো। মনে হলো, ক্যানভাসারের গলার কান্নার সঙ্গে মজমায় সবাই একাত্ম হয়ে কাঁদছে। লোকটা মোনাজাতের একটা হাত নামিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে আমার দুহাতে মোনাজাত ধরে, বললাম হে পরোয়ারদেগার আপনার লীলা বোঝা দায়। বাংলাদেশের কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরের সোলেমান মিয়াকে আপনি কামরূপ কামাখ্যায় কেন আনলেন? আর আনলেনই যদি কেন এই সাপের রাজ্যে আনলেন? আনছেন যখন তখন নিশ্চয়ই কোনো সুযোগ দেবেন আমারে। আমার কোনো নিজের লাইগা কিছু চাওয়ার নাই, আমার দেশের গরিব দুঃখী মানুষের শরীরে অনেক ব্যথা, আমার উছিলায় যদি সেই গরিব-দুঃখী মানুষগো কোনো উপকার হয়, জীবন দিয়া করবো। মোনাজাত শেষ করে আমি চোখ খুলে তাকাই, ধারে কাছে কোনো সাপের অস্তিত্ব নাই। আমি দ্রুত ব্যাগ বের করলাম। ব্যাগের মধ্যে রেখেছিলাম বড় একটা ড্যাগার। সেই ড্যাগার খুলে নি-ফলের গাছের চামড়া তুলতে লাগলাম। নি-ফলের বাগানে ঢোকার সময়ে গেটের পাহারাদার বলে দিয়েছিল, এক ব্যাগের বেশি আনা যাবে না। যদি আনি সাপে…। লোকটা চক্ষু মুদ্রিত করে দাঁড়ায়, কুর্নিশ করে আবার চোখ খোলে, সেই এক ব্যাগের চামড়া আমি বিলাইতে বের হইছি ভাই। এতদিন তো শহরে শহরে বিলাইলাম কিন্তু গতমাসে আমার ওস্তাদ বললো, সব নিয়ামত শহরের মানুষগো দিলে তো আল্লাহপাক নারাজ হবেন।
জন্মেছি যখন মরিতে হইবে। মরার পর জবাবাদিহি করতে হবে পরম ঈশ্বরের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে ওস্তাদের চরণে সালাম জানিয়ে বের হয়ে পড়লাম ঢাকার হাইকোটের বিশাল মজমা ছেড়ে। চলে এলাম সদরঘাট। একরাত একদিন লঞ্চে কাটিয়ে গতকালই নেমেছি পাড়েরহাট। সেখানে মজমা মিলিয়ে বৈকালে চইলা এলাম আপনাদের উজানগাঁওয়ে।
আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগছে, এই কৌটার কামরূপ কামাখ্যার গাছের চামড়ার কী কাজ করবে? আমি সোজা কথার মানুষ, কামরূপ কামাখ্যার ওস্তাদ শিবানী ঠাকুর বলেছেন, এই নি-ফল গাছের চামড়ার কোনো দাম হয় না। কারও কাছে দাম চাই না। বলবা, হাদিয়া হিসেবে যা দেবেন। এখন আসল কথায় আসি, নিশ্চয়ই আপনাদের জানতে ইচ্ছা করতাছে, নি-ফল গাছের চামড়া ধুয়ে খেলে কী-কী রোগের উপকার করবে? আমি শত শত রোগের নাম বলবো না, আমি তিনটা রোগের নাম বলবো। তিনটা, মাত্র তিনটা। তাও ব্যথার রোগ। আমি আল্লার নামে কসম কেটে বলছি, যা বলবো, যা বলছি, সত্য বলতেছি। তিনটা রোগ হচ্ছে, কোমরব্যথা, মাথাব্যথা আর পেটব্যথা। যাদের এই তিনটা ব্যথা আছে, নিজের জন্য তো বটেই, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পিতা-মাতার জন্য নিতে পারেন। রাতে খাবারের পর ঘুমাতে যাওয়ার আগে, হালকা গরম পানির লগে ইকটু ইকটু চামড়া দাঁতে কামড়ে মুখের ভিতরে নিয়ে চিবিয়ে খাবেন। তিন রাত খাবার পরেই বুঝবেন, আল্লাপাকের শান। গাছেরা তো গভীর রাতে আল্লার সানে সেজদা করে যখন আমরা মাখলুখাতের শ্রেষ্ঠ মানুষেরা ঘুমিয়ে থাকে, সেই গাছের ছাল আপনাদের সঙ্গে কোনোদিন প্রতারণা করতে পারে না। ক্যানভাসারের মুখে করুণায় ভরে যায়।
একটু বিরতি নিয়ে বলে, নিশ্চয়ই আপনারা এতক্ষণে অস্থির হয়েছেন, নি-ফল গাছের চামড়ার হাদিয়া কত? না, দেশে-বিদেশে যেখানেই যার কাছ থেকে যা নিই, আপনারদের কাছ থেকে বেশি নেবো না। হাদিয়া মাত্র পাঁচ টাকা, পাঁচ টাকা, পাঁচ টাকা। কে কে নেবেন হাত বাড়ান। হাতের উপর টাকাটা রাখবেন। হে আল্লাহ আপনি দেখছেন সব।
মজমা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা অধিকাংশ হাটুরেরা হাতে পাঁচ টাকা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, ক্যানভাসার আর সঙ্গের ছেলেটা টাকাটা নিয়ে দ্রুত হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। দিতে দিতে বলতে থাকে, আমাকে আজকেই ঢাকা যেতে হবে। সদরঘাটে বিরাট মজমা হবে পরশু। আগে, ঢাকার সদঘাটে যেসব মজমা করেছি, সেইসব মজমায় যারা নি-ফলের গাছের ছাল নিয়েছে, তাদের আত্মীয়রা এইবার নেবে। সদরঘাট থেকে যাবো আবার হাইকোর্টের মাঝারে। আল্লার কাছে লাখ লাখ শোকর, আল্লার বান্দাদের সেবা করতে পারছি।
অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি শীতের সন্ধ্যা দ্রুত ঘনিয়ে আসে। হাটুরেরা যে যার মতো চলে যায়, কিন্তু অপেক্ষায় থাকে শফিক হায়দার। ক্যানভাসার লোকটাকে গল্পের যাদুকরের মতো লাগে। কী সাবলীল উচ্চারণ, উজানগাঁওয়ের গোটা বাজারটাকে হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছিল। লোকজন চলে যাবার সেই ছেলেটা সব গুছিয়ে ট্রাংকে ভরে, আর ক্যানভাসার একটা সিগারেট ধরিয়ে টানে। কিছুক্ষণ পর লোকটা আর ছেলেটা খালের পারে নৌকাঘাটের দিকে চলে যায়। সারাটা রাত ক্যানভাসারের মুখ চোখের সামনে ভাসছিল।
পাশের বাড়ির হামিদ ভাই কোমরের ব্যথার জন্য সেই নি-ফলের গাছের ছাল কিনেছিল নিজের জন্য, মায়ের জন্যও। কয়েকদিন পরে শফিক জিজ্ঞেস করেছিল, হামিদ ভাই আপনার কোমরে ব্যথার খবর কী?
অন্ধকার জলের জগৎ থেকে পেছনে তাকিয়ে দাঁড়ায় ঘুরে, চোখের তারায় পূবালী লঞ্চের দোতালা বিছানা, বিছানায় যাত্রীরা শুয়ে বসে কিন্তু ওর জন্য কোথাও একবিন্দু স্থান নেই, যেখানে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারে!
হামিদ মিয়া খেজুর গাছে উঠতে বলে, ওই হারামজাদারে পাইলে দা দিয়া কোপাইতাম। যত্তসব দুই নম্বরী। শফিকের মনটা খারাপ হয়ে যায়, ক্যানভাসার লোকটা এত আল্লাহ রসুলের নাম করলো আর কাজ করলো দুই নম্বরী!
শফিকের ভাবনার মধ্যে পূবালী লঞ্চ বানাড়ীপাড়া পার হয়ে মীরেরহাটের দিকে যাচ্ছে। রাত অনেক। শফিক বসার জায়গা ছেড়ে দাঁড়ায়। একমনে লঞ্চটা যান্ত্রিক সুর তুলে পানি কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। যাত্রীদের অনেকে যে যার মতো বিছানা করে শুয়ে পরেছে। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির নীচে তিন সদস্যর একটা পরিবার। স্বামী-স্ত্রী আর একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা মায়ের কাধের ওপর ঘুমিয়ে গেছে। পাশে বসে স্বামী লোকটা লো-ভলিউমে ট্রানজিস্টার বাজাচ্ছে। ট্রানজিস্ট্রারে রাত সোয়া আটটায় পরিবার পরিকল্পনার অনুষ্ঠান সুখী সংসার হচ্ছে। কিভাবে কনডম ব্যবহার করা যায় একজন নারী ও একজন পুরুষ কণ্ঠে বর্ণনা করছে। শুনতে শুনতে শফিক এগিয়ে যায় লঞ্চের একেবারে সামনের দিকে। যথেষ্ঠ বাতাস বইছে, কিন্তু লঞ্চের একেবারে সামনেটা উঁচু থাকায় বাতাস সরাসরি ঢুকতে পারছে না। খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েকজন যাত্রী সিগারেট ফুঁকছে। লঞ্চের বিরাট গেরাফির ওপর বসে দুই জনে গল্প করছে। গল্পের বিষয় পাশের বাড়ির মেয়ে শিখা।
একজন বলছে, জানোস তুই আমার বালডা। শিখারে তো আমি…
অন্যজন কপট তাকায়, হাচাই?
আগের জন মাথা নাড়ায়, হ।
-আমি বিশ্বাস হরি না।
-আল্লার কিরা।
-তাইলে ক্যামনে করলি?
-হোন, শিখার ছোট ভাই আনিচরে আমি পড়াইতাম না? হেই সমায় ওগো ঘরের মইধ্যে এক রাইতে…প্রথম জনের কথা শেষ হতে পারে না, দ্বিতীয়জন বাগড়া দেয়, কেউ আছিল না বাড়িতে?
-ছিল, কামতো মিয়া ওর মইধ্যেই অয়, খিক খিক হাসে প্রথমজন। শীত লাগে বাতাসের ঝাপটায় শফিকের। ওখানে আর দাঁড়ায় না। সারাদিনের পর শরীরের মধ্যে ক্লান্তি অনুভব করে ঘুরে দাঁড়ায় লঞ্চের মাথা থেকে। বুঝতে পারে শরীর এখন শুইতে চায়। কিন্তু কোথায় শুইবে? হাতে যে ছোট্ট ব্যাগটা আছে, সেই ব্যাগের মধ্যে কোনো চাদর নেই। কী বিছিয়ে শুইবে শফিক? ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠে। উঠেই অবাক। দোতলার পুরোটা এলাকাটাকে বিছানা মনে হচ্ছে। অধিকাংশ যাত্রীরা ঢালা বিছানার ওপর শুয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বিছনার ওপর বসে পাশের যাত্রীর সঙ্গে গল্প করছে। শফিক হেঁচে মাঝখানের চিলতে ফাঁকা জায়গা দিয়ে হেঁচে পেছনের দিকে যাচ্ছে। কয়েকটা দল মিলে তাস খেলছে, খেলতে খেলতে হাসছে খেলোয়াড়রা, কথা বলছে, সিগারেট টানছে। শফিক দাঁড়ায়। লঞ্চে মাজ ভরাভর একটা সংসার কিনারে বসে ভাত খাচ্ছে। সংসারে একটা মেয়ে, একচন নারী, দুই জন পুরুষ, একটা সাত আট বছরের ছেলে। গোল হয়ে বসে খাচ্ছে। ওদের সামনে বড় একটা টিফিনক্যারিয়ার।
শীতের দিনের কোনো মাছের তরকারি, খাণ্ডা পরেছে। খাণ্ডার একটা সুপ্রসন্ন গন্ধ এসে লাগে শফিকের নাকে। নাক গলে গন্ধটা চলে যায়, পেটে।
শফিক দ্রুত চলে যায় সংসারটা ছেড়ে, পূবালী লঞ্চের একেবারে পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। লঞ্চের জানালা দিয়ে তাকিয়ে জলের মধ্যে কেবলই অন্ধকার দেখতে পায়। অন্ধকার জলের জগৎ থেকে পেছনে তাকিয়ে দাঁড়ায় ঘুরে, চোখের তারায় পূবালী লঞ্চের দোতালা বিছানা, বিছানায় যাত্রীরা শুয়ে বসে কিন্তু ওর জন্য কোথাও একবিন্দু স্থান নেই, যেখানে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারে!
চলছে…