পর্ব-৪৪
উজানগাঁও নিস্তরঙ্গ গ্রাম।
কালের আবর্তনে সকালে পূর্ব দিকে সূর্য ওঠে। বিকেলে সেই সূর্য ডুবে যায় গ্রামের পশ্চিমে, কচানদীর ওপারে। গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া নিভৃতচারী মানুষ পুলিশের খবর শুনলেই দিশেহারা। ভয়ে থরকম্পমান। কথায় আছে বাঘে ছুলে এক ঘা, পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা। কিন্তু কৌতূহল মানুষদের মধ্যে কিছুটা হলেও সাহস তৈরি করে। উজানগাঁও বাজারে যাা ঘটছে এত অবিশ্বাস্য ঘটনা। গ্রামের সম্পন্ন মানুষ, শালিসিতে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে, সেই শামসুদ্দিন ছেলে তমালসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার! বাপ-ব্যাটা দুজনের হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা। দুজনে, বাপ ও ব্যাটা পাশাপাশি হাঁটছে। সঙ্গে সঙ্গে হাটের প্রায় সব হাটুরে। গ্রামের বা আশপাশের গ্রামের অনেক মানুষই জানে না, তমাল বিয়ে করে ঢাকা থেকে নতুন বৌ নিয়ে বাড়ি এসেছে। কিন্তু পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর এক কান দুই কান করতে করতে অনেকের কানে পৌঁছে যায়। ঢাকা শহরের সেই অবাক করা মেয়েটা; তমালের বৌ, শামসুদ্দিনের পুত্রবধূ ভানডারিয়া থানার ওসির ওপর যেভাবে চড়াও হয়েছে, বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে দেখছে। বুকের হার্টবিট বেড়ে গেছে।
আপনি আমার হ্যাসবেন্ড আর শ্বশুরকে ছাড়বেন না? ওসি দিবাকরের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে মিলি।
দিবাকর রায় এমন পরিস্থিতির জন্য একদমই প্রস্তুত ছিল না। কী করবে ভেবে কূল পাচ্ছে না। সঙ্গে আসা সাতজন কনেস্টবলের হাতে সাতটা রাইফেল যদিও আছে কিন্তু রাইফেল দিয়ে কী করতে পারবে? রাইফেল দিয়ে সব সময়ে সব সামলানো যায় না। এই মুহূর্তে এলাকার উপস্থিত লোকগুলো যদি হামলে পড়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যাবে।
বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য বলে, আপনি শিক্ষিত একজন মেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, আমিও সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আসুন, মেজাজটা ঠাণ্ডা করে আমারা কথা বলি।
শ্বশুর ও স্বামীর সম্মানের জন্য এমন লড়াই করে? এত এত মানুষের সামনে-শহরের মেয়ে হয়েও কি নির্বিকার সাহসের সঙ্গে লড়াই করলো? মিলি কী রাজনীতি করতো বা করে?
আমার সঙ্গে কথা বলার আগে, আপনি আমার হ্যাজবেন্ড আর শ্বশুরের হাতের দড়ি খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। ওদের বাঁধন না খুললে আপনার সঙ্গে কথা বলার প্রশ্নই আসে না। আগে দড়ি খুলুন।
এতগুলো মানুষের সামনে ভান্ডারিয়া থানার ওসি হিসেবে এভাবে একটা মেয়ের কাছে হেরে যাওয়া মানে, চিরকালের জন্য হেরে যাওয়া। এই লোকগুলো গল্প করে বেড়াবে, ভান্ডারিয়া থানার ওসি দিবাকর রায় তমালের বৌয়ের কাছে হেরে গিয়ে দড়ি খুলে দিয়েছে। চা খেতে খেতে খিকখিক হাসবে আর রসিয়ে রসিয়ে বলবে, থানার ওসি হালায় যা ভয় পেয়েছিল!
আপনি ওদের হাতের দড়ি খুলবেন না? গলা আরো চড়ে যায় মিলির। মিলিকে মনে হচ্ছে খোলা আসমানের নিচে, ধানক্ষেতের শক্ত মাটির ওপর তীক্ষ্ণ তরবারি। তরবারির ধারে কেটে যাচ্ছে পুলিশ, পুলিশের শোষাক আর মাথার ক্যাপ।
যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে বলছে ওসি, ওরা আসামি! আসামিদের হাতকড়া চাইলেই খোলা যায় না।
খোলা যায় না? মিলি মাহজাবীন চট করে ওসি দিবাকরের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে আনে উপস্থিত জনতার দিকে, আপনারা এই গ্রামের মানুষ। আমি ঢাকা থেকে আপনাদের গ্রামের ছেলে শিমুলকে বিয়ে করে আপনাদের গ্রামে এসেছি। আপনারা আমাকে আপন করে নিয়েছেন। আপনাদের মতো ভালো মানুষ আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু এখন আপনাদের গ্রামের ইজ্জত রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের হাতে।
এগিয়ে যায় শামসুদ্দিনের কাছে, ধরে ডান হাত; এই মানুষটির কোনো অপরাধ আছে? আমি বিয়ে করেছি তার পুত্রকে। আমি আপনাদের গ্রামের বৌ। আমার নিরাপরাধ শ্বশুর আর স্বামীকে ওরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি এখন আমাকেও গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে। বলুন, বিয়ে করা কি অন্যায়? বিয়ে করে আমি ও আপনাদের গ্রামের ছেলে তমাল কী অন্যায় করেছে?
ঝিমিয়ে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে এক ধরনের আগুনের স্পর্শ বয়ে যায়। ভিড়ের মধ্যে এতক্ষণ চুপচাপ থাকা শিমুলের বন্ধুরা সামনে এগিয়ে আসে। সবার আগে আসে জগদীশ দাস। দুই হাত উঁচু করে তীব্র গলায় সমর্থন করে, বিয়া করা অন্যায় অইবে ক্যা?
এনামুল হক জানায়, বিয়া করা তো ফরজ।
তাহলে ফরজ কাজ করে কেন গ্রেপ্তার হবো আমরা? আর আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই অপমান দেখবেন?
স্যার! এই মেয়ে পরিস্থিতি জটিলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, ওসি দিবাকরের কানে কানে বলে এস আই জহির, এতগুলো লোক ক্ষেপে গেলে সামলানো যাবে না।
আমিও বুঝতে পারছি, কিন্তু কী করেবো?
মেয়েটি আসামিদের মুক্তি চায় নাই, হাতের বাঁধন খুলে দিতে বলছে। এখন আসামিদের হাতের বাঁধন খুলে দেন,জটিলতা কমলে বুঝিয়ে শুনিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া যাবে। আর দেখুন লোক আরও বাড়ছে আর পনেরো বিশ মিনিট পর সন্ধ্যা নামবে।
ওসি দিবাকর রায় মনে মনে যদিও ভয়ানক রুষ্ট কিন্তু পরিস্থিতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ না করে উপায় থাকে না। এগিয়ে যায় মিলির কাছে, আপনি কী করছেন?
কী করছি দেখতে পাচ্ছেন না?
আপনি শান্ত হোন। আমি আপনার হ্যাজবেন্ড ও শ্বশুরকে ছেড়ে দিচ্ছি। প্লিজ আর উত্তেজনা ছড়াবেন না। তাকায় জহিরের দিকে, ওনাদের হাতের দড়ি খুলে দিন।
ওকে স্যার! এস আই জহির একের পর এক শামসুদ্দিন আর তমালের হাতের দড়ির বাঁধন খুলে দেয়। দুটি হাতের বাধন খুলে গেলে মুক্ত হাতদুটোর আড়মোড়া ভাঙে পিতা ও পুত্র। শামুদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে মিলি, বাবা! আমার জন্য আপনার এত অপমান! আমাকে ক্ষমা করুন।
ঘটনার আকস্মিতায় বিমূঢ় শামসুদ্দিন আদরের পুত্রবধূকে জড়িয়ে ধরে, না মা। তোমার কোনো অপরাধ নাই। সব আমার নসিবে আছিল।
উপস্থিত জনতা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পুত্রবধূ আর শ্বশুরের গভীর অনুভব প্রত্যক্ষ করে। কারও কারও চোখ ভিজে যায়। ওসি দিবাকর রায়ও বুঝতে পারে, কোথাও একটা ভুলের ফুল ফুটে আছে। ফুলের চারপাশে কাঁটাও থাকে। শহরের, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একটা মেয়ে এমন করে শ্বশুরকে ভালোবাসে? শ্বশুর ও স্বামীর সম্মানের জন্য এমন লড়াই করে? এত এত মানুষের সামনে-শহরের মেয়ে হয়েও কি নির্বিকার সাহসের সঙ্গে লড়াই করলো? মিলি কী রাজনীতি করতো বা করে?
চলবে…