(পর্ব: বিয়াল্লিশ)
তুমি তো আমার পাতায় গল্প দিতে পারো।
জি দেবো শিগগিরই।
কী ধরনের গল্প লেখো শফিক হাসান? বনেদী পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক জানতে চান।
আমি সব ধরনের গল্পই লিখি। গ্রামের পটভূমিতে গল্প লিখতে বেশি ভালো লাগে।
গ্রাম! সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক চেয়ারে হেলান দিয়ে খানিকটা উদাস হয়ে গেলেন। চক্ষু মুদ্রিত করে একটা কিছু ভাবলেন। চোখ মেলে তাকালেন, গ্রাম কী গ্রাম আছে? সব পাল্টে যাচ্ছে।
কই পাল্টে যাচ্ছে? সবই তো ঠিক আছে।
তোমার গ্রাম কোথায়?
বরিশাল।
বরিশাল? বরিশালতো অনেক বড় জেলা। বরিশালের কোন থানায় তোমার বাড়ি?
বরিশালের পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থানায়। গ্রামের নাম উজানগাঁও। আমার গ্রামের পাশ দিয়ে বিশাল একটা নদী বয়ে গেছে কচা।
কচা! কচা নদীর নাম আমি শুনেছি। আচ্ছা বলো তো তোমাদের এলাকার বিখ্যাত কারও নাম।
বিখ্যাত সাংবাদিক তোফাজজল হোসেন মানিক মিয়া, কবি আহসান হাবীব…
রাইট, তোমার বাবা কী করেন?
আমার বাপ বেঁচে নেই।
বিখ্যাত পত্রিকার সাহিত্য মাথামুড়োনো সাহিত্য সম্পাদক হালকা দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, বড়ই দুঃখের ঘটনা। তুমি ঢাকায় কিভাবে চলো?
টিউশনি করে চলি।
চলে?
হ্যাঁ চলে। বাংলাদেশ বেতারে কন্টাক্ট হিসেবে কাজও করি।
বোঝা যাচ্ছে তুমি পরিশ্রমী ছেলে।
রুমের মধ্যে ঢোকে এক মধ্যে বয়সী নারী। ঢোকার সঙ্গে রুমটা মিষ্টি পারফিউমের গন্ধে ভরে যায়। বব চুলের মহিলার শরীরের রঙ আলতা রঙ রঙিন। হালকা ছিপছিপে গড়নের মহিলা রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বিখ্যাত পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক দাঁড়িয়ে যান আগ্রহের সঙ্গে, গলায় আনন্দবাদ্য, আরে তুমি! অবিশ্বাস্য। বস বস…
মহিলা হাসে, টেবিলের ওপর রাখেন হাতের ব্যাগটা। বসে আয়েশ করে সামনের চেয়ারে, আপনি কতদিন আসতে বলেছেন, তাই এলাম।
খুব ভালো করেছ আইরিন আলেয়া তুমি এসে, আজকে মনটা খুব খারাপ। বসেন নিজের চেয়ারে সাহিত্য সম্পাদক।
মন খারাপ কেন?
সেসব পরে বলবো, তুমি কী খেয়ে এসেছ?
আমি ডায়েটি আছি, দুপুরে তেমন কিছু খাই না আমি ভাইয়া।
আজ আমার সঙ্গে খাবে। হালকা সামান্য হলেও। মতিঝিলে খুব চমৎকার একটা রেস্টুরেস্ট হয়েছে, দোতলা-তিন তলা মিলিয়ে। তিন তলায় একটা টেবিল রিজার্ভ করে দেই ফোন করে…
এসবের দরকার নেই, আইরিন আলেয়ার গলায় হালকা ভণিতা, আমি দুপুরে তেমন খাই না।
বিখ্যাত পত্রিকার বিখ্যাত সাহিত্য সম্পাদক আইনির আলেয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে হাতের বাম পাশে রাখা টেরিফোন সেটা হাতে তুলে রিং ঘোরাতে থাকলেন। কয়েক সেকেন্ড পর ও পারে কেউ রিসিভার তুললো, হ্যালো আমি বিখ্যাত পত্রিকার বিখ্যাত সাহিত্য সম্পাদক বলছি। তিন তলায় একটা টেবিল হবে? আসবো পনেরো মিনিট পরে। ওকে, আসছি…। টেলিফোনের রিসিভার রেখে মধুর হাসেন বিখ্যাত সাহিত্য সম্পাদক, ছোট একটা কাজ আছে, পাঁচ মিনিট লাগবে।
আড়মোড়া ভাঙেন হাই তোলেন আইরিন আলেয়া। হাই তুলতে তুলতে লক্ষ করেন পাশে একটা লোক বসে আছে। আইরিন আলেয়া চোখ তুলে তাকান বিখ্যাত সম্পাদকের দিকে। সম্পাদক এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন পরিচয় পর্ব। কিন্ত এখন উপায় না পেয়ে বলেন, নতুন গল্পকার।
কী নাম আপনার?
শফিক হাসান।
আপনার সাহিত্য পাতায় তার গল্প পড়েছি?
আইনির আলেয়ার প্রশ্নে দুই হাতে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করেন বিখ্যাত পত্রিকার বিখ্যাত সাহিত্য সম্পাদক। আরে ও মাত্র আজকে এসেছে আমার কাছে। আমি গল্প দিতে বলেছি। আর গল্প লেখা এতো সহজ?
রুমের মধ্যে ঢোকে মুশফিক আজাদ। ঢুকেই মহিলাকে দেখে একটু থমকে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে পকেটে হাত দিয়ে লন্ড্রির রিসিট কপি বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে, এই নিন আপনার লন্ড্রির রশিদ। আজকে যাই?
বিখ্যাত সম্পাদকও চাইছিলেন যেন এই ওরা চলে যায়। তিনি দ্রুততার সঙ্গে হাত নাড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে যাও। তোমার গল্প আমি দেখবো।
দরজার দিকে পা বাড়ায় মুশফিক আজাদ। পেছনে পেছনে বের হয়ে আসে শফিক হাসান। মনটা বিষণ্ন, তাহলে সাহিত্য সম্পাদক এই মাল!
দুজনে মতিঝিলের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে গল্প, গল্পের কলকবজা, এই সময়ের গল্পকারদের গল্পের কারুশিল্প বিষয়ে আলাপ করতে করতে চলে যায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। দুজনে দুই কাপ চায়ের সঙ্গে টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে খেতে আরও কত গল্প করে! গল্প করতে করতে সিদ্ধান্ত নেয়, যেভাবেই হোক কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় গল্প ছাপাতেই হবে। সেই আলোচনা মাথায় নিয়ে অন্যধরনের প্লট মাথায় নিয়ে গল্প লিখতে বসে মেসে। কিন্তু ঢুকে যায় মাহমুদ হাসান।
গল্প লেখা বন্ধ করে তাকায় মাহমুদের দিকে, তোরে কেডায় কইলো?
শিউলি কইচে।
তাইলে তো ঠিকই কইচে। মুই সিদ্ধান্ত লইচি, শিউলির ছোট বুইন শান্ত সমান্তরালকে পড়ামু।
খাটের ওপর একটা গড়ান দিয়ে হাসে মাহমুদ, বুঝতে পারছি।
কী বুঝতে পারচো?
ভদ্রমহিলা নিঃসন্দেহে সুন্দরী কিন্তু তিনটা বাচ্চার মা। স্বামীটা বড় সহজ আর সরল। যদিও লোকটা চোখ মুখ বিদঘুটে; কিন্ত রেহানা ভাবির তো কোনো সমস্যা নেই। দিব্যি বছরের পর বছর সংসার করে চলেছে।
আমরা যখন কইছিলাম তহন মজা লাগে নাই, এহন নিজে নিজে মজা লইয়া শিউলি আখতারের বাড়ি হানতেছো। ক্যান, তোর ছাত্রর মায়ে কই? বাদাম তুইলা ভাগছে?
মিটি মিটি হাসে শফিক হাসান, আমি তো শুনছি আমার ছাত্রের মায়ে তোর লগে ভাগছে।
চিৎ হয়ে শোয় মাহমুদ হাসান, ভালোই কইচো। আমার লগে ভাগলে আমারে কী এইহানে পাইতি? আমি করে হেরে লইয়া বানেশ্বর চইলা যাইতাম।
হেরে লইয়া বানেশ্বর যাই যাবি ক্যান? তুই রেহোনা ভাবীরে লইয়া যা। খেলা ভালো জমবে।
চিৎ থেকে মাহমুদ দ্রুত সোজা হয়ে শোয় মাহমুদ, ব্যাটা তুই কী মনে হরচো মুই হেই চিন্তা হরি নাই? অনেক চিন্তা হরছি। মুইতো হেরে কইচি, মোর লগে মোর দ্যাশের বাড়ি চলেন। হেয় মাগি কয়, মুই সোংসার ছাইড়া কোথাও যামু না। মুই পাগল অইলে কী অইবে, হেতো মোরে পোছে না।
তাই?
হয়। হারামজাদি মাগি মোরে হের বাসার আশেপাশে যাইতে মানা করছে। কত্ত বড় সাহস।
সাহসের কী অইলো? রেহানা ভাবি তোরে ভালোবাসে কিন্ত সংসার ছাড়বে না, ছেলে মেয়েদের ফলে কোথায় যাবে?
দালালি হরো!
দালালি হরমু ক্যান? একজন নারী নিজেরে রক্ষা হরার চেষ্টা হরতেছে…আমিও আমার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা হরতেছি।
তুই একটার পর একটা মাইয়া মাইনষের লগে লটর পটর হরো, আর আমি একটা মেয়ে মানুষরে পছন্দ হরলাম, তোর লাইগা গেলো? মাহমুদ খাট থেকে নেমে খোলা লুঙ্গি গিট দিয়া পরতে পরতে বলে, তোরা লেখকরা হইলি কুকুর।
লেখকরা কুকুর হইলে তোদের মতো মানুষটা শুয়ার।
আমি বুঝতে পরারছি রেহানা বেগম ক্যান আমারে পছন্দ হরে না। পেছনে তুই ঘুটি চালাইতেছিস, মনে করতোছো আমি কিছুই বুঝি না। ফর্সা মুখের মাহমুদ ক্রোধে কালো হয়ে গেছে, নিজের খাট থেকে নেমে হেঁটে শফিক হাসানের খাটের সামনে দাঁড়ায়, আজকে তোরে কইতে হইবে, ক্যান তুই রেহানা বেগমের কাছে আমার বিরুদ্ধে লাগাইচো?
হাসে শফিক, তোর মাতা খারাপ হইচে? আমি ক্যান তোর বিরুদ্ধে হের কানে লাগামু?
তাইলে হে আমারে এহন পাত্তা দেয় না ক্যান?
হেইডা সেই বেহানা বেগমের ব্যাপার। তুই হেরে গিয়া জিগা, আমারে জিগাও ক্যান? লগে শিউলি আখতারকেও লইয়া যাইতে পারো।
তুই আমার লগে মশকরা করো! আমার সম্পর্ক ভাইঙ্গা দিয়া এহন মজা ল্ইতে ছোঁ, তোরে আমি আইজ উচিৎ শিক্ষা দিমু, মাহমুদ হাসান ঝাপিয়ে পড়ে শফিকের ওপর। শফিক কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না। খাটের ওপর বসা থাকায় মাহমুদের ধাক্কায় পরে যায় খাটের ওপর বিছানায়। মাহমুদ ক্রোধে সত্যি কাঁপছে, উঠে বসে শফিকের বুকের ওপর, দুহাতে সাপটে ধরে শফিকের গলা, ক তুই ক্যান আমার ক্ষতি হরলি?
নিচে পরে মাহমুদের হাতের সাড়াশি আক্রমনে দিশেহারা শফিক, বুঝতে পারেনি মাহমুদ এইভাবে ঝাপিয়ে পড়বে। হতবাক মাহমুদ কী করবে, কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবে বুঝতে পারছে না। দুই হাতে মাহমুদের হাত গলা থেকে সরাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, শরীর অবশ লাগছে, পেছনের দুটি পা দাপাচ্ছে শূন্যে।
এই তোরা কী গোয়া মারামারি করছস? ঢোকে আমীর হোসেন। হাতের ব্যাগটা ওর খাটে রেখে এগিয়ে আসে শফিকের খাটের কাছে এবং তাকিয়েই বুঝতে পারে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে। মুহূর্ত্যের মধ্যে পেছন থেকে সাপটে ধরে মাহমুদকে। পেছন থেকে সাপটে ধরায় মাহমুদের শরীরের শিথিলতা নেমে আসে। ছুটে যায় শফিকের গলায় সাঁড়াশি আক্রমণের দুটি হাত। মাহমুদকে ধরে নিচে নামিয়ে আনে আমীর। নেমেই মাহমুদ ঘুষি মারে আমীর হোসেনকে। আমীর হোসেন ঘুষির জন্য প্রস্তুত ছিল না। অবাক হয়ে ঘাড়ের ওপর ঘুষির ব্যথা নিয়ে তাকিয়ে থাকে মাহমুদের দিকে, কী অইচে তোর?
হইচে আমার বাল! ক্রোধে গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে ফ্যাস ফ্যাস করছে। শফিক হাসান মুক্তি পেয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না, গলা ভেঙে একের পর এক শুকনো কাঁশি বের হয়ে আসছে। কাঁশির সঙ্গে শরীরটা নুয়ে সেজদায় যাচেছ। এক হাতে গলা ধরে ব্যথা সামলানোর চেষ্টা করছে, আর এক হাতে উঠে বসার চেষ্টা করছে। চোখ ফেটে পানি আসছে শফিকের। পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে মাহমুদ হাসান বুঝতে পারে, স্ব-প্রয়োজিত একটা কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছে। শফিক হাসান কাশছে, কাশছে আর ঘামছে। কাশির শব্দে পাশের রুমের খবির আর সুশান্ত রুমে ঢোকে।
কী হয়েছে রে শফিক ভাই? সুশান্ত এগিয়ে আসে।
তুমি ঘাড় ঢলতাছো ক্যা? আমীর হোমনেকে প্রশ্ন করে খবির।
পানি খামু, কথা বলত গিয়ে বুঝতে পারে, গলার স্বর প্রকাশ হচ্ছে না। এক ধরনের ফ্যাস ফ্যাস আর্তনাত বের হচ্ছে গলা থেকে। ইশরায় বোঝায়, পানি খামু।
সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের ওপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে বাড়িয়ে ধরে শফিকের দিকে। একহাতে গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে বিছনার ওপর শুয়ে পড়ে। রুমের গোটা পরিস্থিতি যুদ্ধক্ষেত্র। মাহমুদ রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য সামনের দরজার দিকে হাঁটা দেয়, এক পা বাড়িয়েছে, পরনের লুঙ্গি খুলে মাটিতে পড়ে যায়। এক পলক মাত্র, রুমের মধ্যে এতমধ্যে হাসির ফোয়ারা ছোটে। খবির হাসতে হাসতে মাহমুদের বিছনায় শুয়ে পড়ে, দেখছিস শালার নুনু কত বড়!
মাহমুদ খুব নির্বিকার। লুঙ্গি খসে পড়ুক না নুনু খুসে পড়ুক, কিছুই জানে না। আলগোছে নুয়ে কাপড়টা তুলে কোমড়ে গিট দিতে দিতে রুম থেকে বের হয়ে যায়। মাহমুদের লুঙ্গি খুলে যাওয়া,হাসাহাসি কিছুই বুঝতে পারে না শফিক। নিজের বিছানার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হচ্ছে, অর্ধমৃত শফিক বুঝত্ চেষ্টা করছে, কেন মাহমুদ মেরে ফেলতে চাইলো? কী করেছি আমি? পরিস্থিতি যা হয়েছিল, আমীর হোসেন রুমে ঢুকতে এক মিনিট দেরি করলে আমি মারা যেতাম মাহমুদের তীব্র সাঁড়াশি আক্রমণে। মানুষের জীবন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। রেহানা ভাবির সঙ্গে আমার তো গত দুই তিন মাস দেখাই নাই। উলন মসজিদ ম্যাসে চলে আসার পর রেহানা ভাবিদের বাসার দিকে যাওয়াই হয়নি, দেখা বা কথা হওয়া দূরের ঘটনা। কিন্ত মাহমুদ কি সত্যি পাগল হয়ে গেছে রেহানা ভাবির জন্য? ভদ্রমহিলা নিঃসন্দেহে সুন্দরী কিন্তু তিনটা বাচ্চার মা। স্বামীটা বড় সহজ আর সরল। যদিও লোকটা চোখ মুখ বিদঘুটে; কিন্ত রেহানা ভাবির তো কোনো সমস্যা নেই। দিব্যি বছরের পর বছর সংসার করে চলেছে।
আরও পড়ুন: মোকাম সদরঘাট-৪১॥ মনি হায়দার