পর্ব-৪১
দরজা খুলে অবাক শিউলি আখতার। বিকেলের দিকে ঘুমিয়েছিল। বাসায় কেউ নেই। ছোট বোনটা গেছে স্কুলে। ভাইটা কলেজে। মা বড় বোনের বাড়িতে। শিউলি আখতার ঘুমুতে খুব পছন্দ করে। এমন দিন যায়, শিউলি কেবলই ঘুমুচ্ছে আর ঘুমুচ্ছে। কিন্ত সেই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালে মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। বাসায় কেউ থাকলে ডাকাত পড়লেও ঘুম থেকে ওঠে না। কিন্ত আজকে বাসায় কেউ নেই, বার বার কলিংবেল বাজার কারণে মেজাজ গরম কড়াইয়ে নিয়ে দরজা খোলে শিউলি আখতার। কিন্ত দরজা খোলার পর সামনে শফিক হাসানকে দেখে প্রথমে চমকে ওঠে, দ্বিতীয়ত নিজেকে দ্রæত সামলে নেয়, তৃতীয়ত কি করবে বুঝে উঠতে পারে না।
ঘুমভাঙা মুখের ওপর লাবণ্যর লালিমা ছড়িয়ে পড়েছে। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে শফিক হাসান, নিজেকে নিয়ে এই মুহূর্তে কী করবে, বুঝতে পারে না শিউলি আখতার। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। মৃদু হাসে শফিক, কেমন আছেন আপনি?
মুখ তুলে তাকায় শিউলি আখতার, ভালো। আপনি কেমন?
আমিও ভালো। শুনুন, আমি আপনার বোনকে এখন পড়াতে পারবো।
বড় বড় চোখে তাকায় শিউলি, সত্যি পড়াতে পারবেন?
মাথা নাড়ায়, পারবো।
আপনি ভেতরে আসুন। বসুন।
না, আজ থাক। আর একদিন আসবো। আজকে তো মাসের আঠারো তারিখ; আগামী মাসের এক তারিখ থেকে পড়াবো। ওর স্কুল কটায়? সকালে না বিকেলে?
ঠিক আছে, যখন ইচ্ছে পড়াবেন। কিন্তু ভেতরে আসুন। আমি আসছি; দরজা ছেড়ে চলে যায় ভেতরে শিউলি আখতার।
খোলা দরজায় একলা দাঁড়িয়ে থাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় শফিক হাসান। এসেছিল পড়ানোর খবরটা দিয়েই চলে যাবে। বন্ধু নির্মল এসেছে উজানগাঁও থেকে। মা মুড়ি, ঝুনা নারকেলসহ আরও খাবার-দাবার পাঠিয়ে। নির্মল উঠেছে মুগ্ধায় ওর বড় ভাই শ্যামল দার বাসায়। সেখানে যাবে, একটু আড্ডা মারবে। মন খারাপ ছিল, অফিসে যায়নি। ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সারাদিন। মাঝেমধ্যে একটা দিন রাত নিজের মতো কাটিয়ে দিতে ভালোই লাগে। দুপুরে খাওয়ার পর হালকা একটা ঘুম দিয়ে বের হয়েছে। যাওয়ার পথে ঢুকলো শিউলি আখতারের বাসায়। ভেবেছিল, খবরটা দিয়ে চলে যাবে। কিন্ত এ কী গ্যাঁড়াকলে আটকে গেলো?
গ্যাঁড়াকল? পকেট থেকে স্টার সিগারেট বের করে ধরায় আগুন দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে। হঠাৎ নাকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসে, ফিরে তাকায় শফিক হাসান। আবার ফিরে এসেছে শিউলি আখতার। পরিপাটি হয়েছে একটু। মুখে পানি দিয়ে সামান্য প্রসাধন সেরেছে। ফর্সা শরীরে কালো শাড়ি মোড়ানো। চওড়া কপালের মাঝখানে বড় কালো একটা টিপ। মনে হচ্ছে একটা কালো পরী আসমান থেকে নেমে এসেছে। ওর দিকে তাকিয়ে আয়ত দৃষ্টির মোহনীয় তরঙ্গে।
আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন?
সিগারেটর ছাই ঝাড়ে শফিক হাসান, আমার একটু তাড়া ছিল।
ব্যস্ত মানুষ,তার ওপর লেখক, তাড়া তো থাকবেই। ভেতরে আসুন; অনন্ত এককাপ চা খেয়ে যান।
ওকে, সিগারেটের শেষাংশ বাইরে ফেলে শিউলি আখতারের পেছনে পেছনে ঢোকে ড্রয়িংরুমে। মধ্যেবিত্তের সুরচিতে সাজানো ড্রয়িংরুম ।
রসুন, বসার আমন্ত্রন জানায় শিউলি আখতার।
শফিক বসে সোফায়। মুখোমুখি বসে শিউলি, তাকায় সরাসরি- আপনি আমাকে এড়িয়ে চলেন কেন?
মানে? শফিক সোজা হয়ে বসে। এমন আচমকা প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তাকায় শিউলি আখতারের দিকে, আমি আপনাকে এড়িয়ে চলবো কেন?
শুনুন শফিক ভাই, আপনি লেখক। মানুষের মনের নিয়ে গল্প লেখেন। কিন্ত আমিও নারী। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের একটা অনুভূতি আছে। কি মনে করেন, আমি বোকা?
কী অবাক কাণ্ড! আপনাকে বোকা ভাববো কেন?
জানি না, কেন ভাববেন। কিন্তু আপনি আমাকে এড়িয়ে চলেন।
কেন? কেন আপনাকে এড়িয়ে চলবো? আর আপনার সঙ্গে আমার তেমন তো কথা বা দেখাও হয়নি।
যেটুকু দেখা বা কথা হয়েছে, আমার উদ্যোগে হয়েছে, তাই না?
তা ঠিক।
কিন্তু যখনই আপনার কাছে গিয়েছি আপনি চেষ্টা করেছেন অল্পকথায় আমাকে বিদায় দিতে অথবা এড়িয়ে যেতে। আমি কোনো অভিযোগ করছি না, শুধু আমার অনুভূতিটুকু প্রকাশ করলাম। আবার কিছু মনে করবেন না শফিক ভাই। আমি সরাসরি বলতে পছন্দ করি; তাই বললাম। বসুন, আমি চা নিয়ে আসছি, দাঁড়ায় শিউলি আখতার।
বাসায় আর কেউ নেই?
ভেতরের দরজার দিকের মুখ ঘুরিয়ে তাকায় তীর্যক চোখে, কেন?
না আর কাউকে দেখছি না তো।
আমি একা থাকলে আপনাকে কামড়ে দেবো?
হো-হো হাসিতে ফেটে পড়ে শফিক, কামড়ে দেবেন? দিলে তো ভালোই হবে। পত্রিকায় নিউজ হবে একজন পুরুষকে কামড়ে দিয়েছে এক সুন্দরী নারী।
আমি সত্যি কিন্ত আপনাকে কামড়ে দেবো শফিক ভাই। একটু অপেক্ষা করুন, চা নিয়ে আসছি। রুম ছেড়ে চলে যায় শিউলি আখতার।
দীর্ঘশ্বাস বেরোয় নাক চিরে শফিক হাসানের। বসে আছে শিউলি আখতারের বাসার সোফায়, মন পরে আছে বিলকিস খানমের কাছে। এক মাস হয়ে গেছে, বিলকিস খানম নেই। কোথাও নেই। রামপুরায় নেই, ঢাকা শহরে নেই, রমনা পার্কে নেই…নেই, নেই, নেই কোথাও নেই। কোথায় গেলো চন্দ্রমুখী আমার? কী হলো? কোথায় গেলো? জুয়েল আইচের মায়াবী জাদুর প্রকৌশলে দুর্নিবার দুরন্ত বিলকিস খানম কোথায় হারালো? কী হতে পারে? হঠাৎ কি শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে? না কি, ওর স্বামী সব জেনে নিয়ে গেছে চট্টগ্রাম? কেমন আছে বিলকিস খানম? বুকটা জ্বলে যায়। ঝড়ের রাতে এক স্বপ্নের কুহুকে এসেছিল বিলকিস খানম। পানসে একগুয়ে স্বপ্নহীন জীবনের বিলকিস এসেছিল সুখের বৃষ্টির মতো। কিন্ত কোথায় গেলো? কারও কাছে কোনো ঠিকানা নেই। অথচ কত দ্রুত কাছাকাছি এসেছিলাম আমরা?
সোফায় বসতে বসতে উত্তর দেয় শিউলি আখতার, হ্যাঁ বলেছিল পড়ানোর টাইম নাই। কিন্তু আবার তো পড়াতে চাইছে। পড়। তোর জন্য ভালো হলো।
আচ্ছা, ওর স্বামী কী ঘটনা জানার পর তুলে নিয়ে আটকে রেখেছে? মারছে? কষ্ট দিচ্ছে? না কি মেরেই ফেলেছে? কী হয়েছে; যদি জানতে পারতাম, এই অন্ধ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতাম। বিষণ্ন যন্ত্রণা নিয়ে আর থাকতে পারছি না; নিজের মনে গেয়ে যাচ্ছে জীবনের গল্প।
গল্প লিখেছেন না কি?
চমকে ফিরে তাকায় শফিক হাসান। দুহাতে ট্রে সাজিয়ে দাঁড়িয়ে শিউলি আখতার। রান্নাঘরে থাকার কারণে, মুখের ওপর হালকা ঘাম জমেছে। ফুটফুটে ঘামের ওপর লাইটের আলোয় অদ্ভুদ বিচ্ছুরুণ দেখছে শফিক হাসান।
কিসের গল্প?
কথা বলছিলেন কার সঙ্গে?
কথা বলছিলাম? আমি? কার সঙ্গে?
সামনের টি টেবিলের ওপর ট্রে রেখে নাস্তা সাজাতে সাজাতে তাকায় শিউলি আখতার, আপনি রেডিওতে যে অনুষ্ঠান করেন, বলেননি তো।
বলার কী আছে? জানেন তো চাকরি করি।
চাকরি করা আর অনুষ্ঠান করা এক হলো? নিন, ডিম আর পরোটার প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলে শিউলি আখতার, গত পরশু সকালে রেডিও শুনছিল। আমি শুয়ে শুয়ে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দর্পণ অনুষ্ঠানে আপনার নাম শুনলাম। আপনি একটি পাণ্ডুলিপি পাঠ করলেন। মহাকবি আলাওলকে নিয়ে লেখা। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনলাম; আপনার গলার স্বরটা অন্যরকম। শুনতে ভালো লাগে।
তাই না কি? পরাটায় কামড় বসায় শফিক হাসান।
হ্যাঁ, শুনুন আমি অযথা কাউকে প্রশংসা করি না। জানেন, টিভিতে নাটক করেছি ছোট বেলায়। খুব ইচ্ছে ছিল, নাটক করবো। কিন্তু বিয়েটাই আমাকে শেষ করে দিয়েছে।
আমি কিছুটা জানি।
কে বলেছে?
আমীর হোসেন আর মাহমুদ হাসান।
কী বলেছে আমার সর্ম্পকে?
এইটুকুই বলেছে; কিন্ত আমি একা খাচ্ছি। আপনি তো খাচ্ছেন না কিছুই।
আমি ডায়েটে আছি। চা এনেছি। আপনি পরাটা মাংস খাওয়ার পর চা যখন খাবেন, আপনার সঙ্গে চা খাবো।
আপনি তো এখনো শুরু করতে পারেন।
কী শুরু করতে পারি?
টিভি নাটকে অভিনয়। আপনার ফিগার, উচ্চারণ, সৌন্দর্য সবই পারফেক্ট।
না, করবো না। কিচ্ছু করবো না; শিউলি আখতারের গলায় অভিমান। কী হবে এসব করে? কার জন্য করবো?
কার জন্য করবেন মানে? আপনার নিজের জন্য করবেন ম্যাম।
মনটা মরে গেছে আমার।
দরজায় কলিংবেল বাজে। দরজা খোলে শিউলি আখতার। ছোট বোন শান্তা এসেছে স্কুল থেকে। ভেতরে ঢুকে শফিক হাসানকে দেখে তাকায় বোনের দিকে। শিউলি আখতার হাসে, তোর টিচার। আগামী মাস থেকে পড়াবেন তোকে। এইবার মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। নইলে পিটিয়ে হাড় গুঁড়ো করে দেবে।
তোমার নাম কী? তাকায় শফিক।
শান্তা সমান্তরাল।
কী বললে তোমার নাম?
শান্তা সমান্তরাল।
কে রেখেছে এই নাম?
আমার বাবা রেখেছে, শান্তার বদলে জবাব দেয় শিউলি আখতার। আমার বাবা একজন কবি। কিন্তু কোথাও বলেন না। বাসায় ট্রাংক ভরা খাতা আছে, কবিতায় ভরা।
অসাধারণ নাম রেখেছে তোমার বাবা শান্তা সমান্তরাল। বাংলা ভাষায় কত চমৎকার নাম রাখা যায়; আমার তো দারুণ লাগলো তোমার নামটা।
শান্তা, ভেতরে যা। ড্রেস চেঞ্জ করে আয়।
ঠিক আছে আপা। শান্তা ভেতরের রুমে চলে যায়। শিউলি আখতার সামনে বসে শফিক হাসানের, কই কিছু খেলেন না তো?
একটা পরোটা, এক বাটি গরুর মাংস খেলাম। আর পারবো না; আসুন, এবার চা-পর্বে প্রবেশ করি। শফিক চায়ের কাপ হাতে নেয়, সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাপটাও হতে নেয় শিউলি আখতার।
চায়ে চুমুক দিয়ে শফিক তাকায় শিউলির দিকে, দারুণ চা বানিয়েছেন!
আমার হাতের চা মা খুব পছন্দ করেন।
খালাম্বা কোথায়?
মা গেছেন বড় বোনের বাসায়, ঝিকাতলা। আসবেন রাতে। যাইহোক আপনার ভয়টা কাটলো!
মানে?
না এতক্ষণ আমার মতো একজন কামড়ে দেওয়া নারীর সঙ্গে থাকলেন, কামড়ে দিলাম না। আপনার ছাত্রী আমার ছোটবোন শান্তাও এলো, ভয় তো থাকার নয়।
আবারও হাসে হো হো শব্দে শফিক, আপনি ভীষণ মজার মানুষ। আর শুনুন কিছু কিছু কামড় খেতে ভালোও লাগে।
চোখ বড় বড় করে তাকায় শিউলি আখতার, সত্যি বলছেন!
এখন যাই, আপনার সঙ্গে সময় কাটানোর এই মুহূর্তগুলো মনে থাকবে। দাঁড়ায় শফিক হাসান, আর আগামী মাসের এক তারিখ আমি আপনার ছোটবোন শান্তা সমান্তরালকে পড়াতে আসবো। এগিয়ে যায় দরজার দিকে, পিছনে আসে শিউলি আখতার।
আসি! দরজা পার হয়ে চলে যায় শফিক হাসান, অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে শিউলি আখতার। মানুষটা এসছিলো! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু এসেছিল সত্যি।
আপা! পেছনে এসে দাঁড়ায় শান্তা সমান্তরাল।
কী রে? দরজা বন্ধ করে ফিরে তাকায় ছোট বোনের দিকে।
তুমি না বলেছিলে শফিক স্যার আমাকে পড়াবেন না?
সোফায় বসতে বসতে উত্তর দেয় শিউলি আখতার, হ্যাঁ বলেছিল পড়ানোর টাইম নাই। কিন্তু আবার তো পড়াতে চাইছে। পড়। তোর জন্য ভালো হলো।
হাসে শান্তা।
তুই হাসছিস কেন?
এমনি! দ্রুত চলে যায় শান্তা সমান্তরাল। মাথা নুয়ে পড়ে শিউলি আখতারের; মানুষটা এত সুন্দর স্বরে গুছিয়ে বলে কথা, মনে হয় মিষ্টি চায়ের কাপে চা খাচ্ছি।
ওকে! উঠে দাঁড়ায় বড় ইলিশ মাছ দেওয়া কবি এবং কবির সঙ্গের ঝাকড়া চুলের কবি। দেখবো আগামী দুই এক সংখ্যা, কবির গলায় ক্রোধ কমে না। ক্রোধ নিয়েই দুজনে উঠে চলে গেলে বসে মুশফিক আজাদ ও শফিক হাসান।
তুই নাকি শিউলির বোনকে পড়াবি? রাতে মেসে নিজের বিছনায় শুয়ে প্রশ্ন করে মাহমুদ হাসান। আমীর হোসেন বাইরে।
শফিক নিজের টেবিলে বসে গল্প লিখছে। গতকাল দেশের বড় একটা দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকের অফিসে গিয়েছিল। বনেদী পত্রিকা, রামকৃষ্ণ রোড়ে। সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে হালকা চেনাজানা আছে। গল্পকার বন্ধু মুশফিক আজাদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা সাহিত্য সম্পাদকের। গত তিন মাসে আজাদের দুটি গল্প ছাপা হয়েছে। শফিকের খুব ইচ্ছে; এই নামি পত্রিকায় আমারও গল্প ছাপা হোক। নিজের অভিলাষ জানায় বন্ধুকে।
চল আমার সঙ্গে, পুরানা পল্টনের পুরানো পত্রিকার স্টলে দেখা দুজনের। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে বলে মুশফিক হাসা।
যাবি? এত সহজে রাজি হয়ে যাবে মুশফিক, ভাবতে পারেনি ও।
হ্যাঁ যাবো। তুই এই সময়ে ভালো গল্প লিখিস। তোর গল্প ছাপবে না কেন?
চা খাওয়ার পর মুশফিকের সঙ্গে পল্টন থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। যেতে যেতে দুজনে থমকে দাঁড়ায় দৈনিক বাংলার মোড়ে এসে। পাঁচতলা সাদা বিল্ডিং। এই বিল্ডিংয়ে বসেন আহসান আহীব। কবি আহসান হাবীব। দৈনিক বাংলায় দুই পৃষ্ঠার সাহিত্য প্রকাশিত হয়। গল্প কবিতা প্রবন্ধ বইয়ের আলোচনা। কী সুন্দর ঝকঝকে ছাপা! অলংকারণ, মেকআপ চোখ ঝলসে যায়।
শফিক, আহসান হাবীবের এই পাতায় কবে লেখা ছাপা হবে?
দোস্ত প্রশ্নটা তো আমারও। আমরা যাই না কেন আহসান হাবীবের কাছে। আর ওনার বাড়ি তো আমাদের দেশে।
বরিশাল?
হ্যাঁ, পিরোজপুরের শংকরপাশায়। যদিও যান না উনি। সেই পরিচয়ে যাওয়া যায় না?
না, লাভ হবে না।
কেন?
দৈনিক বাংলা পার হয়ে, রাজউক সামনে দিয়ে বঙ্গভবনের সামনের বিশাল রাস্তা ধরে হাঁটছে শফিক আর মুশফিক আজাদ।
আমি শুনেছি লেখা ছাপানোর ক্ষেত্রে আহসান হাবীব বড় কড়া। লেখা পছন্দ না হলে তিনি ডাস্টবিনে ফেলে দেন। খাতিরে তিনি লেখা ছাপেন না। সেইজন্য সবাই বলে, আহসান হাবীরের পত্রিকায় গল্প ছাপা মানে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া।
আমিও জানি কিন্তু আমরা তো গেলামই না।
ঠিক বলেছিস। আগামী মাসে দুই জনে দুইটা ভালো গল্প নিয়ে যাবো। না গেলে তো হবে না; ছাপা না হলে না হবে কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে।
দারুণ বলেছিস।
দুজনে; শফিক হাসান আর মুশফিক আজাদ বঙ্গভবন পার হয়ে রামকৃষ্ণ রোডের বনেদি পত্রিকার বিল্ডিংয়ে ওঠে। তিন তলায় উঠে রাস্তার দিকের সরু বারান্দায় দিয়ে হেঁটে সাহিত্য সম্পাদকের রুমের সামনে দাঁড়ায়। বড় টেবিল সাহিত্য সম্পাদকের। তিনি আয়েশ করে বসে আছেন। টেবিল ঘিরে তিন জন সিনিয়র লেখক বসে বসে আড্ডা মারছেন আর হাসছেন আর সিগারেট ফুকছেন। টেবিলের ওপর একটা প্লেটে কয়েকটা সিঙ্গারা। সঙ্গে কাঁচা পিয়াজ টুকরো টুকরো কাটা। সবাই মিলে খাচ্ছে। দরজায় মুশফিককে দেখে সাহিত্য সম্পাদক হাক ছাড়েন, আসো আসো মুশফিক আজাদ।
মুশফিক আজাদ ঢোকে। ওর পিছনে ঢোকে শফিক হাসান। সাহিত্য সম্পাদক পানজাবীর উপর গলাকাটা কোট পড়ে আছেন। তাকান জিজ্ঞাসু চোখে মুশফিকের দিকে। মুশফিক পরিচয় করিয়ে দেয়, ভাই আমার বন্ধু। গল্প লেখে। খুব ভালো গল্প লেখে।
সিঙ্গারার দিকে ইশারা করে বলেন সাহিত্য সম্পাদক, নাও একটা একটা করে। নইলে সামনের এই কবিরা সব সাবাড় করে দেবে।
আজাদ খানিকটা ইতস্তত করে একটা সিঙ্গারা হাতে নেয়। আর একটা দেয় শফিক হাসানকে। তিন জনের একজনকে চেনে শফিক। কবি হুমায়ুন রশীদ। সরকারি অফিসে চাকরি করেন। মাথার চুল সব সাদা। চেহারায় একটা জেল্লা আছে। শোনা যায়, শহরের বিশেষ বিশেষ মহিলার সঙ্গে ওনার বিশেষ সম্পর্ক। কতটা সত্য কতটা মিথ্যা বা মিথ বুঝতে পারে না শফিক হাসান। শোনে আর ভোদাইরাম বনে যায়। সাহিত্য করতে এসে কতো আজব পরিস্থিতি আর গল্পের সঙ্গে পরিচয় হলো!
বাকি দুজনকে চিনতে পারছে না । সিঙ্গারা খাওয়া শেষ করে দাঁড়ায় কবি হুমায়ুন রশীদ, কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ, আল রফিক ভাই, যাই!
যাবেন? আবার আসবেন। আর আপনার গুচ্ছ কবিতা দুই এক সংখ্যা পরেই যাবে।
ওকে ওকে…তিনি দ্রুত বের হয়ে গেলেন।
আল রফিক ভাই, বাকি দুজনের একজন ডাকেন সাহিত্য সম্পাদককে, আমার কবিতার কি হলো? প্রায় তো দুই মাস হয়ে গেলো কবিতা দিয়েছি আপনাকে। আপনার বাসায়ও গিয়েছিলাম আপন্রা পছন্দের বড় বড় ইলিশ মাছ নিয়ে। খেয়ে জানিয়েছিলেন, ইলিশ মাছে বড় স্বাদ পেয়েছিলেন।
মাছ শব্দটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য সম্পাদক আল রফিক তীর্যক দৃষ্টিতে তাকান মুশফিক আজাদ আর শফিক হাসানের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে খুব বিরক্তির সঙ্গে বলেন, আরে যাবে যাবে! তোমাদের কবিদের এই এক স্বভাব, কবিতা দিয়েই ছাপার জন্য চাপ দাও। আরে বাবা, সম্পাদককে তো পড়ার সময় দেবে? কবিতা ছাপানো কতো ঝামেলার জানো?
তিনটা কবিতা পড়তে কতোদিন লাগে রফিক ভাই? কবির গলায় একটু ঝাজ।
হবে হবে, দুই এক সংখ্যার মধ্যে তোমার কবিতা যাবে। এখন যাও।
ওকে! উঠে দাঁড়ায় বড় ইলিশ মাছ দেওয়া কবি এবং কবির সঙ্গের ঝাকড়া চুলের কবি। দেখবো আগামী দুই এক সংখ্যা, কবির গলায় ক্রোধ কমে না। ক্রোধ নিয়েই দুজনে উঠে চলে গেলে বসে মুশফিক আজাদ ও শফিক হাসান। বসার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য সম্পাদক টেবিলের নিচে রাখা একটা বড় কাপড়ের ব্যাগ তুলে রাখেন টেবিলের ওপর। তাকান মুশফিক আজাদের দিকে, যাও তো। নিচের লন্ড্রিতে দিয়ে আসো।
সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ায় মুশফিক আজাদ। দ্রুত কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে যায়। স্থবির হয়ে বসে থাকে শফিক হাসান। লেখা ছাপানোর জন্য মাছ, লন্ড্র্রির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। সাহিত্য চর্চা নাকি খুব শুদ্ধতার ব্যাপার! তাহলে?
তোমার কী নাম?
আমার নাম শফিক হাসান, বনেদি পত্রিকার বনেদি সাহিত্য সম্পাদক আল রফিকের প্রশ্নের উত্তরে বলে, শফিক হাসান।
কী লেখো?
গল্প!
চলছে..