পর্ব: আটত্রিশ
বিলকিস খানম তেমন প্রসাধন করেননি।
শাড়ি পরেছেন সবুজ রঙের। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে ব্লাউজ, পায়ের জুতো, হাতে ও পায়ের নখে মেখেছেন সবুজ রঙ। কপালের ওপর বড় একটা টিপ। কোনো নারী কপালে টিপ পরলে এত মনোহর মানায়, প্রথম দেখে শফিক হাসান। ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে যখন ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ান বিলকিস খানম, চোখে চোখ পড়ে, শফিক হাসান দাঁড়িয়ে যায়। মনে হচ্ছে কোনো নিষিদ্ধ হেরেম খানায় ঢুকেছে।
নিজের দিকে একবার অপাঙ্গে তাকিয়ে প্রশ্ন করে শফিককে, কেমন লাগছে?
অস্ফুট কণ্ঠে উত্তর দেয় শফিক, সুন্দর!
সুন্দর! বিলকিস খানমের মুখে অবারিত খুশির হাসি। চলুন।
ড্রয়িংরুমের দরজার দিকে এগোয় বিলকিস খানম। পেছনে নিজের আড়ষ্ট পরিস্থিতিকে সামলাতে সামলাতে যাচ্ছে শফিক হাসান। বুঝতে পারছে না, এই নারী কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে? বিকেলে, মানে কথানুসারে শফিক বাসায় এসেছে চারটার দিকে। চা খেতে দিয়ে বিলকিস খানম বললো, আপনি চা খান আমি রেডি হয়ে আসছি।
ভেতরে চলে যাওয়ার অনেকগুলো চিন্তা মাথায় ঘুরছে শফিকের, বিলকিস খানম আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? মার্কেটে? হতে পারে? রমনা পার্কে? হতে পারে? আমি চামড়া ছেলা রাস্তার কুকুরে মানুষ। আমাকে নিয়ে ভদ্রমহিলা কি কেনো পরিকল্পনা সাজাচ্ছে? আমি ডুববো না ভাসবো? বাচ্চা দুটো কই? কোনো সাড়া শব্দ নেই। চা বিসকিট খাওয়ার পর আর কিছু করার নেই। কিন্তু ভেতর থেকে বের হওয়ার কোনো নাম গন্ধ নেই বিলকিসের। টি টেবিলের নিচের তাকে একটা দৈনিক পত্রিকা, তুলে দেখে তিন দিন আগের। সমস্যা নেই, পড়তে শুরু করে শফিক। পত্রিকার বারো পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে পড়ার পর হতাশ আর বিরক্ত হয়ে যখন স্থবির হয়ে বসেছিল, কী করবো? চলে যাবো?
সঙ্গে সঙ্গে ঢোকে বিলকিস খানম। দেখেই বুঝে নিয়েছে, ভদ্রমহিলা নিজেকে সাজাচ্ছিলেন। কিন্ত প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ধরে? সিঁড়ি দিয়ে নামনে নামতে বিলকিস খানম কানের কাছে মুখ এনে বলে, একটু দেরি করে নামলাম। বেলাটা পড়ে আসুক; লোকজন যেন বুঝতে না পারে। আপনি বাসা থেকে নেমে হেঁটে রড় রাস্তায় যাবেন। রিকশা ঠিক করবেন; রমনা পার্ক। আমি একটু পরে আসছি, ঠিক আছে?
শফিক হাসান মাথা নাড়ায়, ঠিক আছে। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়। বুকের মধ্যে অনেকগুলো তরঙ্গ সৃষ্টি হতে থাকে, এই সুন্দরী রাজসিক মহিলা আমাকের সঙ্গে নিয়ে রমনা পার্কে যাবে? ইহা অভিসার? ঢাকা শহরে এসে রাস্তায় রিকশায় পার্কে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখানে সেখানে কত কপোত কপোতী দেখেছে; কিন্ত নিজেকে কখনো অভিসারের পাখি ভাবতে পারেনি। কিন্তু কনকের মা বিলকিস খানম আমাকে অভিসারের তীর্থে নিয়ে যাচ্ছে; গোটা শরীর মন প্রাণ জুড়ে বৃষ্টি নামে, খড়রৌদ্র তাপে পোড়া নিদাঘ সময়ে।
সঙ্গে থলথলে শরীর; কুনো ব্যাঙের কায়দায়। আর শফিক হাসান আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে; কোথায় আমার কোমল গান্ধার মন ও শরীরের জন্য লালায়িত হয়ে উঠবে।
রামপুরার রাস্তা পার হয়ে এপার এসে রিকশা ঠিক করে অপেক্ষায় শফিক হাসান। নিজেকে কেমন বেমানান লাগে; মনে হচ্ছে জামা কাপড়-জুতো যা পরে এসেছে, সবটাই বেমানান। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া বা রিকশার পথচারী প্রত্যেকে সুন্দর। পরেছেও আলো ঝলমলো পোষাক। জুতো জোড়াও পুরনো, যদিও সকালে কালি করিয়েছে, কিন্তু পুরনোই লাগছে। ভাবনার মধ্যে বিলকিস খানম আসে, রিকশা কই?
এই তো। উঠুন আপনি।
আমার হাতটা ধরুন, আমি রিকশায় উঠতে পারি না।
শফিক হাসান হাত ধরে বিলকিস খানমের। নরম উষ্ণ হাত; ওর কঠোর হাতের মধ্যে বিলকিসের হাত গলে যাচ্ছে মোমের স্তব্ধতায়। রিকশার এক পাশে বসে জায়গা করে দেয় শফিকের জন্য। শফিক উঠে বসে পাশে। রিকশাঅলা চালাতে শুরু করে রিকশা ফুরপুরে মেজাজে। রিকশাঅলা তরুণ। রিকশায় উঠেছে তরজাতা সওয়ারি, যাদের গতর নরম; উল্কার গতি পায় রিকশা।
শফিক হাসান প্রথম রিকশায় কোনো নারীর সঙ্গে উঠেছে। এক অবাক শিহরণ খেলে যায় শরীরের বিন্দু বিন্দু কোষে। কেমন সুখ আর অস্থির নোনতা অনুভব গোটা শরীরজুড়ে নৃত্য করছে। আড় চোখে তাকায় পাশে বসা রাজকীয় ভঙ্গিতে বিলকিস খানম, মুখে নিষিদ্ধ গোপন হাসির রেখা।
আপনি সহজ হয়ে বসুন, মিষ্টি হাসে বিলকিস খানম।
পাশে তাকায় শফিক হাসান, দুজনার মাঝে অনেক খানি জায়গা ফাঁকা। নিজের আড়ষ্টতার কারণে অনেকখানি সরে সংকুচিত হয়ে বসেছিল। বিলকিসের তাড়ায় ফাঁকা জয়গাটা পূরণ করে বসে শফিক, সঙ্গে সঙ্গে বিলকিস খানমের শরীরের সঙ্গে লেগে যায় শফিক হাসানের শরীর। বিলকিম খানমের শরীরে কোনো তরঙ্গ ওঠে কি না, কিন্তু শফিক হাসানের শরীরের রক্ত কোষে এক দুরন্ত বাঘ ছোটে। সন্ধ্যার একটু আগে আগের সময়, রাস্তায় রিকশা গাড়ি কম, ছুটে চলছে শফিক আর বিলকিসকে বহনকারী রিকশা। একবার বিলকিসের দিকে তাকিয়ে সামনের মসৃণ ইট সিমেন্টের গতিময় রাস্তার ওপর চোখ রাখে।
রাস্তা? ইট সিমেন্টের? মনে হয়ে জলের ধারা। সেই কবে, শৈশবে বাড়ির সামনের কচা নদীর জলের স্রোতে সাঁতার কাটতে কাটতে এগিয়ে যেতো সামনের দিকে, রিকশাটা ঠিক সিমেন্টের ওপর দিয়ে নয়, জলের ওপর দিয়ে জলের তরঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। দুই দিকে ফুটছে জলের খৈ। জৈষ্ঠ মাসের কাল। দক্ষিণের হাওয়া আসছে প্রবল বেগে। বিলকিস খানমের শাড়ির আঁচল উড়ে উড়ে বাড়ি খায় শফিক হাসানের গালে মুখে চোখে।
জানেন, অনেক দিন পরে বের হলাম, সামনে তাকিয়ে বলে বিলকিস খানম।
অনেক দিন পরে কেন?
একা বের হতে ভালো লাগে না আমার। আর যাবো কোথায়? ঢাকা শহরে যাবার কোনো জায়গা আছে? চট্টগ্রামে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। সমুদ্রের পারে, পতেঙ্গার তীরে আমাদের বাসা। বারান্দায়, ডাইনিং টেবিল এমনকি বেডরুম থেকে সমুদ্র দেখা যেতো।
তো ঢাকায় আসলেন কেন?
করুণ মুখে তাকায় বিলকিস খানম, আমি কি আসতে চেয়েছি? আমাকে জোর করে, কৌশলে ঢাকায় এনে রাখা হয়েছে।
আপনি চট্টগ্রাম চলে গেলেই পারেন।
পারলে তো যেতাম, দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বিলকিস খানম। কিন্তু আমিও দেখে নেবো।
রিকশা মালিবাগ, শান্তিনগর মোড় পার হয়ে রমনার দিকে ছুটছে রিকশা। বাতাসে উড়ছে আঁচল। রিকশার সামনের চাকা একটা ইটের ওপর উঠে যায়। ধাক্কা লাগে পেছনে। সামনের দিকে পরে যাচ্ছিল বিলকিস খানম। দুহাতে আগলে ধরে শফিক। বুকের সঙ্গে লাগে বুক। বিব্রত বিলকিস খানম লাজ রাঙা মুখে অনেকটা জড়িয়ে ধরে রিকশায় শান্ত হয়ে বসে। ডান হাতটা আর ছাড়ে না, শফিক হাসানও জোর করে না। দুটি হাত দুটি হাত আকড়ে ধরে রাখে; কেমন লাগছে?
কানের কাছে মুখ এনে অস্ফুট প্রশ্ন করে বিলকিস খানম।
বুঝতে পারছি না, কম্পিত গলা শফিকের, জীবনের প্রথম কোনো নারীর সঙ্গে রিকশায় ওঠা আমার।
হাসে বিলকিস, সত্যি?
মাথা নাড়ায় শফিক হাসান, একদম সত্যি।
রমনা পার্কের গেটে এসে রিকশা থামায় রিকশাঅলা। দুজনে নামে। শফিক ভাড়া মিটিয়ে পাশে দাঁড়ানো বিলকিস খানমের হাত ধরে, চলুন।
শফিক হাসানের সাহস ভালো লাগে বিলকিসের। তাকায় শফিকের মুখের দিকে; দুজনে হাসে। হাসতে হাসতে ঢোকে পার্কের মধ্যে। বিকেলের রম্য আবহ চারদিকে। সবুজ গাছপালা দাঁড়িয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় দুলছে। চারদিকে ইতস্তত মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসছে বা হাঁটছে। বসার জন্য দুজনে একটা বেঞ্চ খুঁজছে। খুঁজতে খুঁজতে ভেতরের দিকে একটা বসার বেঞ্চ পায়। বসে দুজনে। মাথার ওপর একটা অশত্থ গাছ। দূরে, পার্কের খোলা জায়গায় কয়েকটা ছেলে মেয়ে মিলে বল খেলছে।
আমাকে এখানে নিয়ে আসলেন কেন? চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে শফিক হাসান।
একজন বিবাহিত নারী, বাচ্চার মা কেন আপনার মতো একজনকে নিয়ে এখানে আসে? পাল্টা প্রশ্ন বিলকিস খানমের।
আসার নানা ধরনের কারণ থাকতে পারে, কিন্তু সেই কারণটা আমি জানি না।
জানেন না?
না।
তাহলে আমার চলে যাওয়া উচিত।
মানে?
আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছি এখানে, পার্কে। কেন? নিশ্চয়ই আমি অনেক ভেবেছি; একটা সংসারের বিপরীতে আপনাকে নিয়ে কেন আমি এলাম? আপনাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে আপনি রাজি হয়েছেন। তখন তো প্রশ্ন করেননি।
প্রশ্ন নয়, আমি জানতে চাইছি, আমাকে নিয়ে কতটুকু ভেবেছেন?
একজন নারীর পক্ষে যতটুকু ভাবা যায়, আমি আপনাকে নিয়ে ততটুকুই ভেবেছি। যদি আপনি চান, আমি আপনার সঙ্গে চলে যেতেও রাজি।
সংসার ছেড়ে? বিস্ময়ে ভেতরে ভেতরে আঁৎকে ওঠে শফিক হাসান।
হ্যাঁ। শুধু আপনি আমার ছেলেমেয়ে দুটোকে আমার সঙ্গে রাখবেন।
আপনি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
কিছুই জানি না। কিন্ত আপনার ব্যক্তিত্ব, অ্যাটিচ্যুড আমার ভীষণ ভালো লাগে। আপনি আমার ছেলে কনককে বশ করে ফেলেছেন। অথচ কোনো শিক্ষক ওকে পনেরো দিন থেকে এক মাসের বেশি পড়াতে পারেনি। কনকের বাবাও দেখলাম আপনার খুব ভক্ত।
ওনার সঙ্গে তো আমার মাত্র একদিন কথা হয়েছে।
সেই একদিনের কথায় ভদ্রলোক মুগ্ধ।
হাসে শফিক হাসান, আমি কত সাধারণ মানুষ, বোঝেন না আপনি! একজন তরুণ কতটা বিপাকে বা বিপদে থাকলে পরের ছেলে মেয়ে পড়ায়? পড়িয়ে রোজগার করে জীবন চালায়?
জীবনের শুরুতে অনেক মানুষই পরিশ্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। যারা পরিশ্রম করে নিজদের প্রতিষ্ঠিত করে আমি তাদের সন্মান করি।
বিলকিস! আজ এই মুহূর্তে যে আবেগে আক্রান্ত হয়ে বলছেন, সময়ের কঠিন নিগড়ে আটকা পড়লে একেবারে উল্টো বলবেন। কিন্তু আমি আপনার সৌন্দর্য এবং সাহসের প্রশংসা করি। সত্যি, আমি ভাবিনি আপনার মতো কেউ আমাকে নিয়ে বিহারে আসতে পারে!
কেন আসতে পারে না?
আমি কত সামান্য, কত তুচ্ছ আপনার তুলনায়! আমার জন্য আমার চুলোয় কোনো চাল রান্না হয় না। হয় অন্যের চুলায়। অন্যের চুলোর রান্না খেয়ে আমি বেঁচে থাকি পরজীবী এক। কে আসবে আমার জীবনের এমন সুখের সর্বনাশ হয়ে?
আমি! আমি তো এলাম।
কিন্তু থাকবেন না বেশিদিন বা ক্ষণ।
কেন?
শূন্য কলসি নিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না।
আপনি বুঝতে পেরেছেন, কী বলছেন?
আমার সম্পর্কে আমি যা জানি, বুঝি, আমি সেটাই আপনাকে বলছি। যাতে আপনি কোনো ভুল না করেন সামান্য সময়ের আবেগে। জীবন অনেক কঠিন, মর্মান্তিক কঠিন; আপনি কখনো সেই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েননি বিলকিস, তাই বুঝতে পারছেন না।
বিলকিস খানম চুপ। কঠোর দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। পাশে ভ্যানিটি ব্যাগ রেখে আপন মনে আঁচলের গিট খুঁলছে আবার দিচ্ছে। জলে নামার আগে বিলকিস খানম অনেক ভেবেছে। কিন্তু আমি কি মানুষ নির্বাচনে ভুল করলাম? নিজেকে এত বিপন্ন আর ক্ষয়িষ্ণু করে তুলছে কেন? চাচাতো এক দেবর আছে, মশিউর রহমান একটা প্রাইভেট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট; লালাচোখে তাকায়। ইশারা করলে কুকুরের লেলিহান লালসায় ঝাঁপিয়ে পড়বে পায়ের ওপর কিন্তু লোকটাকে দেখলেই চোখে মুখে কেমন এক ঘৃণার তরঙ্গ তৈরি হয় বিলকিসের। নিচতলার লোকমান মৃধা, ব্যবসায়ী; কনকের বাবা জহিরুল ইসলামের বন্ধু চোখের দৃষ্টিতে হায়েনার বার্তা নিয়ে তাকায়, ইশারা করলে নিজের বৌ রেখে পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু লোকটার মাথায় পরচুলা; দেখলেই মনে পড়ে লোকটার মাথা ন্যাড়া। সঙ্গে থলথলে শরীর; কুনো ব্যাঙের কায়দায়। আর শফিক হাসান আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে; কোথায় আমার কোমল গান্ধার মন ও শরীরের জন্য লালায়িত হয়ে উঠবে।
বিলকিস খানম ও শফিক হাসানের দুই জোড়া ঠোট মিশে যায়। আরও গভীর ও নিবিড় আশ্রয়ের নোনতা সাধের সন্ধানে।
আমি জানি, আপনি বিব্রত হচ্ছেন। কারণ, আমি একেবারে বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়েছি আপনার বিরুদ্ধে। আপনি আমাকে অবিশ্বাস করতেও শুরু করেছেন কিন্তু আমি নিশ্চিত একদিন আপনার সুকোমল মন আমাকে অনুভব করবে তীব্রভাবে, তখন আমি আপনার কাছে থাকবো না।
চলুন যাওয়া যাক। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
হাহাহা হাসিতে ফেটে পড়ে শফিক হাসান পার্কের গাছপালা কাঁপিয়ে, আশপাশের লোকেরা অবা তাকায়। নিজেকে নিয়ে কী করবে ভেবে পায় না বিলকিস খানম। মনের মধ্যে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আমি কেন এলাম? না এলেই ভালো ছিল! এই লোকটা কাল থেকে আবার পড়াতে আসবে কনককে। আমি কী করবো?
পার্কে এলে বাধ্যতামূলক যে কাজটি করে সবাই, এক প্যাকেট বাদাম কিনে বসে বসে খুটে আর গল্প করে। আমরা বাদাম না খেয়ে যেতে পারি না। এই বাদাম!
সামনে অপেক্ষায় থাকা বাদামঅলা এগিয়ে আসে। একটা প্যাকেটে দশ টাকার বাদাম দিয়ে চলে যায়। শফিক হাসান দ্রুত বাদাম খুটে বিলকিসের হাতের মধ্যে রাখে, নিন।
আমি বাদাম খাই না।
খান না ঠিক আছে কিন্তু আজকে খান।
বাদাম হাতে নিয়ে বসে থাকে বিলকিস খানম। চোখে মুখে বিরক্তি আর হতাশার প্রলেপ। পার্কের রাতের লাইট জ্বলে উঠেছে। লোকজনও কমছে। শফিক হাসান বাদাম মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলে, এসেছি যখন দুজনে সন্ধ্যায় পরে কোনো হোটেলে খেয়ে যাবো।
না, কঠিন গলায় উচ্চারণ করে বলিকিস খানম। আমি বাসায় যাবো।
বেশ তো, যাবো। আর একটু বসুন, বাদাম কয়টা খেয়েই উঠবো। ভালো কথা, আমি কি আগামীকাল কনককে পড়াতে আসবো?
মানে?
আজকের এই ঘটনার পর নিশ্চয়ই আপনি চাইবেন না, আমি আপনার বাসায় যাই, আপনার ছেলেকে পড়াই?
আপনি মানুষটা ভয়ানক খারাপ।
জানি আমি।
সেজন্য আপনার খুব অহঙ্কার হয় খুব?
খুব না, মাঝে মাঝে হয়।
আপনি নিজেকে কী মনে করেন?
মাকাল ফল।
মাকাল। হাসে বিলকিস খানম, কোনো মানুষ নিজেকে মাকাল ফল বলে?
আমিতো আমাকে বললাম, তাকায় বিলকিসের মুখের দিকে। ঘৃণা করে হলেও বাদাম কটা মুখে দিন। না হলে বাদামগুলো কষ্ট পাবে।
বিলকিস খানম বাদাম মুখে নিয়ে চিবাতে থাকে। হঠাৎ আকাশে বিদ্যুৎ চমকায় এবং দুরে কাছেই বজ্রপাত ঘটে। পার্কের লোকজন নিজেদের মধ্যে বিভোর ছিল, বিদ্যুচ্চমকে ও বজ্রপাতে হৈ হৈ করে জেগে ওঠে। কিন্তু সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিতায় পার্কের লোকজন বিহ্বল। কী করবে, কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারে না। পার্কের মধ্যে ছোট ছোট কয়েকটা ছাতার মতো ঘর আছে, লোকজন সেই ছাতার দিকে ছুটছে। কিন্তু অশত্থ গাছের নিচের পাকা দেয়ালের ওপর বসে বসে বাদাম খঁটুছে আর খাচ্ছে শফিক। অবাক তাকিয়ে থাকে বিলকিস, সামনে বসা মানুষটার দিকে। বৃষ্টি, বজ্রপাত, বিদ্যুৎ. পার্ক কোনো কিছুর দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। নিজের মতো করে বাদাম খুঁটে খেয়েই যাচ্ছে।
আমরা এভাবে বসে আছি কেন? উদ্বেগের সঙ্গে প্রশ্ন করে বিলকিস খানম।
কী করবো? বাদাম মুখে দিয়ে কয়েকটা বাদাম বিলকিস খানমের হাতে দেয়, আপতত বাদাম খান।
বাদাম খাবো?
নয়তো কী? পার্কের গেটের কাছে দৌড়ে গেলে একটাও রিকশা পাবো না। কারণ. মানুষের তুলনায় রিকশা কম হবে এই ভর সন্ধ্যায়। পার্কের লোকজন যে আশ্রয়ে গেছে, দেখুন জায়গা হচ্ছে না। একজন আর একজনকে ঠেলে বের করে দিচ্ছে। তারচেয়ে আমরা দুজন ভালো আছি। প্রেম করতে এসে বৃষ্টি এলে ভিজতে হয়। বৃষ্টিতে ভিজলে প্রেম গভীর আর ঘন হয়।
বিলকিস খানম ভেতরে ভেতরে বিস্মিত, লোকটা ভালো। অন্যরকম। উপস্থিত বুদ্ধি ও বিবেচনা দারুণ। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। অশত্থ গাছের পাতা চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। যত বেশি পানি পড়ে বিলকিস খানম তত কাছে যায় শফিকের। শফিক বাদাম খেতেই থাকে, বৃষ্টিতে ভিজছে তো ভিজছেই। বজ্রপাত ও বৃষ্টি প্রবল বেগে নামে, সঙ্গে সঙ্গে পার্কের লাইট চলে যায়। চারদিকে নেমে আসে হঠাৎ অন্ধকার। দূরের মানুষগুলোর ভয়ার্ত চিৎকার ভেসে আসে।
বিলকিস খানম জড়িয়ে ধরে শফিক হাসানকে, শফিক হাসানও জড়িয়ে ধরে। দুজন দুজনকে জড়িয়ে বুকের সঙ্গে পিষে ফেলতে চাইছে অন্ধকারের মধ্যে অভয় ও আশ্রয়ের মধ্যে। বৃষ্টি আর জোরে নামছে। বিলকিস খানম ও শফিক হাসানের দুই জোড়া ঠোট মিশে যায়। আরও গভীর ও নিবিড় আশ্রয়ের নোনতা সাধের সন্ধানে।
চলছে…