পর্ব: ৩৭
দুপুরে একটা খাসা ঘুমে বিভোর শফিক হাসান।
অনেক অনেক দিন পর দুপুরে এমন ঘুমে পেয়েছে ওকে। বাড়ি, উজানগাও গ্রামে থাকার সময়ে চৈত্র বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসে নয়া বাড়ির পুব দিকে, মতি চাচার বাড়ির সামনে পুকুর পাড়ে সবুজ ঘাসের ওপর হোগলা বিছিয়ে ঘুমাতো চারবাড়ির অনেকে। দক্ষিণের বাতাসে শরীর থাকতো ঠাণ্ডা। প্রায় দেড় দুই বছর ঢাকা শহরের নানা জায়গায় থেকে একটু স্থিতিশীল জীবনের আশায় লজিং নিয়ে রামপুরার উলন রোডে আসে শফিক বন্ধু মাহমুদের পরামর্শে। কিন্তু শুরুতেই পড়ে আছে গাড্ডায়। থাকার মতো ভালো একটা রুম বা মেস পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকায় ঘনবসতি ঠিক আছে, কিন্ত সবাই বাড়িঅলা। ভাড়া পাওয়া যায় বাসা। বাসা ভাড়া নিয়ে আয়ের সবটাই চলে যাবে, বাধ্য হয়ে মাহমুদের আবিষ্কার রেহানা ভাবির ভাড়া বাসার পেছনের ছোট এই টিনশেড বারান্দায় থাকছে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটিয়েছে আমীর হোসেন। আমীর মিরপুরে মামার বাসা থেকে পুরোনো একটা সিংলিং ফ্যান এনেছে। সেই ফ্যানটা মাথার ওপর ঘুরছে, সেই বাতাসের নিচে ঘুমুচ্ছে শফিক।
ভাবি! আপনার পাশের বাসায় নতুন মেহমান এসেছে নাকি! সুরেলা গলায় ঘুম ভাঙে শফিকের। বুঝতে পারে, টিনের বেড়ার ওপারে রেহানা বেগমের কাছে কেউ একজন এসেছে।
হাসে রেহানা বেগম, মেহমান না। বাড়িঅলার নতুন বাড়াইট্টা এসেছে।
নতুন ভাড়াইট্টা তুমি সামলাইতে পারবা?
আমি সামলামু ক্যান? আমার জামাই আছে না? লাগে তুমি যাও নতুন ভাড়াইট্ট্যাগো সামলাইতে। তিন জন আছে। দেখতেও সুন্দর।
মা আমারে বলেছে, তয় সাদা রঙের লোকটা নাকি খুব ভালো।
কে বললো তোমারে শিউলি?
কেডা বলবে? মায়ে বলছে। আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে মার লগে কথা কইচে। আশেপাশের আরও অনেকের লগে কথা বলেছে। তিনজনের একজন নাহি রেডিওতে চাকরি করে?
এত খবর তো আমি জানি না। তুমি কোথায় শুনলা?
ওই তো সাদা রঙের লোকটা, কী নাম…
মাহমুদ!
হ মায়রে মাহমুদ সবই বলেছে।
শুয়ে শুয়ে হাই তুলতে তুলতে রেহানা ভাবি আর শিউলির মধ্যে কথোপকথন শোনে। শুনতে শুনতে বুঝতে পারে, গত পনেরো বিশ দিনে এই এলাকায় মাহমুদ হাসান খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পারেও বটে হারামজাদা। যেখানে সেখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতে, নিজের পরিচয তুলে বন্ধুদের পরিচয় দিয়ে এমন একটা আবহ তৈরি করে ফেলে, মনে হয় এই এলাকার ও স্থায়ী বাসিন্দা। অপ্রয়োজনে যেখানে সেখানে আলাপ করে জমিয়ে তুলতে পারে না শফিক হাসান। বন্ধুদের আড্ডা হলে আবার গল্পের শিরোমণি বনে যায়। আর আমীর হোসেন যেখানে রাত সেখানে কাত। কোনো সমস্যা নেই ওর, যেখানে ফেলো আছে, না ফেললেও নেই।
শফিক হাসান বুঝতে পারে, আজকের সময়টুকু অনেক যত্নে সাজিয়েছেন কনকের মা বিলকিস খানম। কারণ, আজ কাজের মেয়েটিও নেই বাসায়|
সন্ধ্যার আগে একটা টিউশুনি আছে শফিকের। আলসেমি ভেঙে উঠে পড়ে, হাত মুখ ধুয়ে প্যান্ট শার্ট পবে রেব হয়ে পেছন থেকে সামনে আসতেই দেখে, শিউলি দাঁড়িয়ে গল্প করছে রেহানা ভাবির সঙ্গে। একটু মোটা, শরীরের রঙ ফরসা, মাথায় অনেক চুলের কারণে মাথার পেছনে বড় একটা খোপা। মেয়েদের খোপা খুব ভালো লাগে শফিকের। মুখোমুখি হতেই ডাক দেয় রেহানা ভাবি, শফিক ভাই?
জি বলেন, দুই দিকের ছোট ছোট বাড়ির জন্য ঘের দেওয়া দেয়ালের মধ্যে সরু পথের মাঝখানে দাঁড়ায় শফিক।
পরিচয় করিয়ে দেই, ওই য়ে দোতলা বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকে; শিউলি আখতার। ওনার বাপে দুবাই থাকে। শিউলি আপার মা খুব ভালো মানুষ। আপনাগো খোঁজ খবর নেয়।
কী উত্তর দেবে, বুঝে উঠতে পারে না শফিক হাসান। বেকুফের হাসি দিয়ে বলে, আমার একটু তাড়া আছে। যাই ভাবি। পরে এসে কথা বলবো, যদিও কথা বলে রেহানা বেগমের উদ্দেশে কিন্ত চোখ রাখে পাশে দাঁড়ানো শিউলি আখতারের ওপর। মেয়েটি একটু মোটা, গড়পড়তার বাঙালি মেয়েদের চেয়ে একটু লম্বাও; চোখ দুটি ভীষণ ডানপিটে, কামুক, আমন্ত্রণ জানায়।
আ্ইচ্ছা! সায় দেয় রেহানা বেগম।
শফিক হাসান সামনের দিকে হাটে। মিনিট তিনেক হাঁটার পর দুই পাশের উঁচু বাড়ির আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার আগে শফিক পেছনে ফিরে তাকায়। শিউলি আখতারের কবুতরের দুটি চোখ তাকিয়ে আছে। সামনে যেতে যেতে দৃষ্টি হারিয়ে যায় শফিকের। মনে মনে গল্প বোনে, বাহ মেয়েটি তো বেশ!
কিন্তু যে বাসায় পড়াতে যায় ক্লাম সিক্সের ছেলে কনককে, সেই বাসার কনকের মায়ের মতিগতি ভালো মনে হচ্ছে না শফিকের। কনকের বাবা জহিরুল আলম চাকরি করেন চিটাগাং পোর্টে। বাসার আসবাব পত্র সাজ সজ্জা দেখে অনুমান করা যায়, জহিরুল আলম ভালোই কামান। কনকের মায়ের ইচ্ছে কনকের বাবার সঙ্গে চিটাগাং গিয়ে থাকার কিন্তু রাজি নয় জহিরুল আলম।
তোমার আমার ঢাকার নিজের বাসা রেখে তুমি চিটাগাং থাকবে কেন? তোমার তো কোনো অভাব আমি রাখি নাই। দুটি বাচ্চা নিয়ে এখানেই থাকো। প্রতি মাসে দুই বার না হলে একবার তো আসি।
আমি তোমার কাছে সব সময়ে থাকতে চাই, আবদার করে কনকের মা বিলকিম খানমের। আমার একা একা ভালো লাগে না, এই বিরাট বাসায়।
কী বলো তুমি বিলকিস? একলা কেন তুমি? ছেলে কনক, মেয়ে প্রজাপতি তোমার সঙ্গে থাকে না? মা মেয়ে ছেলে মিলে এক সঙ্গে থাকার মধ্যে খুব আনন্দ! পারিবারিক বন্ধনের ইতিহাস শোনান জহিরুল আলম। তুমি আমি; আমাদের সন্তান মিলে একটা সুখী পরিবার। এমন সুখের পরিবার ঢাকা শহরে আরে নেই; তোমাকে আমি কত ভালোবাসি, তুমি জানো না? প্রতি ছয় মাস পর পর তোমাকে গহনা কিনে দেই না?
কনক আর প্রজাপতির মা বিলকিস খানম বুঝে যান, স্বামী জহিরুল ইসলাম আমাকে কখনোই চিটাগাং নেবেন না। অথচ আট নয় বছর আগে চিটাগাং কয়েক বছর ছিলেন অসম্ভব আনন্দ আর জৌলুসের সঙ্গে। পোর্টের কর্মকর্তা হিসেবে প্রায় প্রতি সপ্তাহে পোর্টের বড় বড় জাহাজে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতেন। সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসতেন বিলকিস খানম।
হঠাৎ জহিরুল আলমের বাবা অসুস্থ হয়ে মারা গেলে, চলে এলেন ঢাকার রামপুরার এই বাসায়। আর যাওয়া হলো না চিটাগাং। আটকে গেলেন ঢাকা শহরের সীমানায়। কিন্ত বিলকিস খানমকে খুব টানে চট্টগ্রামের নদী, নদীর ঢেউ আর বিরাহমীন বেয়াদপ হাওয়া। বিলকিস খানম আরও বুঝতে পারেন, চিটাগাং আর একটা সংসার পেতেছেন কনকের বাবা জহিরুল আলম। হ্যাঁ তিনি সংসারের সব দায় দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করছেন, কোথাও কোনো বাহ্যিক ত্রুটি রাখছেন না কিন্ত বিলকিস খানমের শরীরের সমুদ্রে আর আগের মতো মৎস্য শিকারে আসেন না। অথচ বিলকিস খানম অপেক্ষায় তেতে থাকেন শরীরের সফেন সমুদ্রে অবারিত তৃষ্ণায়… কিন্ত বিস্ময়কর নিশ্চুপ থাকেন একসময়ের প্রবল সাতারু জহিরুল আলম।
বিলকিস খানম নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে নিজেই একটি রচনার পরিকল্পনা করেছেন। সেই পরিকল্পনায় রাখতে চান শফিক হাসানকে। সুঠাম শরীরের অধিকারী শফিক হাসানকে পুত্র কনকের টিউটর হিসেবে রাখেন বা নির্বাচন করেন পরিকল্পনা করেই। কনককে পড়াতে আরও অনেক শিক্ষক এসেছিল কিন্ত পছন্দ করেন নি বিলকিস খানম।
কনককে পড়াতে আসার এক সপ্তাহ পরই বিলকিস খানম সামনে আসেন। বসেন সোফায় মুখোমুখি। পুত্রকে ছুটি দিয়ে বলেন, যাওতো বাবা, খেলা করো। আমি তোমার টিচারের সঙ্গে একটু কথা বলি।
কনক তো আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। তাকায় শফিকের দিকে, স্যার যাই?
যাও।
কনক চলে গেলে বিলকিস খানম বলেন, আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই। বলতে চাই সরাসরি। আশা করি কিছু মনে করবেন না। অবশ্য মনে করলে আমার কিছু যায় আসে না।
অবাক তাকিয়ে থাকে শফিক হাসান সামনে বসা পৃথুলা মহিলার দিকে। মধ্যে বয়স পার না হলেও, বয়স চল্লিশ পার হয়েছেন। শরীরের বাঁধন আলগা হলেও একটা বুনো আক্রোশ দানা বেঁধে আছে । আয়তো কালো চোখ জোড়া গভীর আর তীক্ষè। হাসলে গালে ঢোল পড়ে। খুব খারাপ লাগে না আবার ফেলেও দিতে পারে না শফিক হাসান সামনে বসা এই বিভাবরী নারীকে।
আগামী পরশু শুক্রবার। আপনার কোনো কাজ আছে? চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করছে বিলকিস খানম।
একটু ভাবে শফিক হাসান, এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত আছে সন্ধ্যায় তিনজনের; ওর, মাহমুদ হাসান আর আমীর হোসেনের। কিন্ত বেমালুম ভুলে যাওয়ার ভাণ করে শফিক হাসান, না কোনো কাজ নেই আমার। সাধারণত শুক্রবার আমি ঘুমাই সারাদিন।
হাসেন বিলকিস খানম, সারা দিন ঘুমান অসুবিধা নেই। বিকেলে আমার বাসায় আসবেন। আপনাকে নিয়ে মার্কেটে যাবো।
আমাকে নিয়ে মার্কেটে যাবেন? বিস্ময়ে শফিক হাসানের শরীরের মধ্যে সুনামী আছড়ে পড়ে আর ঈগল চোখে তাকায় সামনে বসা রহস্যময়ী নারীর দিকে।
খুব স্বাভাবিক প্রণোদনায় বলেন বিলকিস খানম, হ্যাঁ। আপনার কোনো সমস্যা আছে?
না মানে-
মানে কী? আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা না হলে আপনার তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। নাকি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে? যে দেখলে আম ছালা দুটোই যাবে?
হো হো হাসিতে ফেটে পবে শফিক হাসান। হাসির শব্দে রুমের ভেথরে ছোট বোন প্রজাপিতর সঙ্গে খেলতে থাকা কনক দৌড়ে আসে। আর শফিক হাসানের ঢেউ খেলানো হাসির ফোরায়ার দিকে অবাক তাকিয়ে বিলকিস খানম- মানুষ এমন করে হানতে পারে!
বাবা যাও। তোমার টিচার মজা করার জন্য হাসছে, বলেন বিলকিস খানম, পুত্র কনককে। কনকের হাত ধরে হাটছে প্রজাপতি, খেলার জন্য। কনক ও প্রজাপতি চলে যায় নিজেদের রুমে।
আপনি ভালোই বলেছেন; আমাকে আপনি কতটুকু চেনেন? একটা ছেলে কতটা কঠিক পরিস্থিতিতে পড়লে বাড়ি এসে টিউশনি করায়? সেই টিউশনি করা ছেলের সঙ্গে কোন মেয়ে করবে ডেটিং? আমারও কি টাইম আছে? আমি আমার এই বাজুবন্ধে আমার সময় এবং শ্রম আটকে রেখে চলি। আপনার সঙ্গে মার্কেটে গেলে আমার খারাপ লাগার কোনো কারণ নেই, বরং ভালোই লাগবে।
গুড, তাহলে শুক্রবার আসছেন বিকেলে।
আসবো।
একটু বসুন। বিলকিস খানমে ঘূর্ণিপাকের স্রোত তুলে শরীরটাকে এক মোচড়ে তুলে ভেতরে গেলেন। ফিরে এলেন নিজের হাতে ট্রে নিয়ে। ট্রেতে অনেক ধরনের ফল। মাংসের কাবাব।
শফিক হাসান প্রায় পনেরো দিন ধরে, সপ্তাহের চারদিন বিকেলে পড়ায় কনককে। পড়িয়ে চলে যাওয়ার আগে কাজের মেয়ে খাবার নিয়ে আসে নিয়মিত। হ্যাঁ একটা ফল থাকে, একটা পিরিচে কয়েকটা বিস্কুট আর এক কাপ চা। খুব যত্ন করে বানানো নাস্তাটাকু খুব যত্ন করে খায় শফিক। সেই তুলনায় আজকের নাস্তার পরিমাণ অনেক বেশি এবং আয়োজনও জৌলুসময়।
শফিক হাসান বুঝতে পারে, আজকের সময়টুকু অনেক যত্নে সাজিয়েছেন কনকের মা বিলকিস খানম। কারণ, আজ কাজের মেয়েটিও নেই বাসায়। শরীর ও মনে রোমাঞ্চ ও ভয় দুটোই একটি রেখায় চলতে শুরু করে শফিক হাসানের।
আমাকে কে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন এই নারী? কিন্তু…
তাহলে এই কথাই রইলো! বিলকিস খানমের উচ্চারণে বুঝতে পারে শফিক হাসান, কনকের মা এখন চলে যেতে বলছেন।
জি, আমি আসবো যথা সময়ে। দাঁড়ায় শফিক হাসান।
মাহমুদ এক গ্লাস পানির পুরোটা খেয়ে তাকায় শফিকের দিকে, বললি না কার খোপা দেখেছিস?
আমার সঙ্গে যেদিন পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে কনককে পড়াতে এলেন, সেদিন একটা বাক্য আমার খুব ভালো লেগেছিল। কনককে পড়াতে বেশ কয়েক জন টিচার এসেছিল; তারা প্রত্যেকে আমি যেভাবে বলছিলাম কনককে পড়াতে, সবাই এক বাক্যে রাজি হয়েছিল। কিন্তু আপনি বলেছিলেন; পড়ানোর ব্যাপারটা আমার আর আমার ছাত্রের। আমি দায়িত্ব নিয়ে আমার মতো পড়াবো। আপনার মতো নয়। আপনার মতো পড়াতে চাইলে, আপনিই পড়াবেন, টিচার কেন?
রাইট, আমি যা করি মনোযোগ দিয়ে করি। যা করি না, করিই না।
আমারও পছন্দ এটা; ওকে, আসুন।
বাসা থেকে সন্ধ্যার নাগরিক গোধূলি বেলায় বের হয়ে আসে শফিক হাসান। চারতলা বাড়ির তিনতলা থেকে নেমে রামপুরার এবেড়োখেবড়ো রাস্তায় হাঁটে আর ভাবে, কনকের মা আমার কাছে কী চায়? নাকি খেয়ালের কোনো জাদুর বাঁশি? আমাকে তো কোনো খেয়ালির যাদুর বাঁশি হওয়া যাবে না। গ্রামে, উজানগাওয়ে পর আছে আমার বিধমা মা, একটি ভাই, দুটি বোন। যাদের দায় আমার এই কাঁধে। আমি কোনো হারিয়ে যাবো স্রোতের কানা গলিতে? কিন্তু আমি কি একটু চেখে দেখবো না পথের মধু?
কী ভাবছিসরে? শফিকের ঘাড়ের ওপর থাবড়া মারে মাহমুদ হাসান, দশ মিনিট ধরে তোর পেছনে হাঁটছি। কী ভাবছিস এত শফিক হাসান?
মাহমুদ? কোনো দরকার ছিল আমার চৌদ্দ বছর বয়সে বাবাটা মরে যাওয়া? আমি এখন ডুবন্ত সংসারটাকে কিভাবে টেনে তুলি?
ঘাড়ের ওপর হাত রাখে মাহমুদ, জন্ম মৃত্যুর ওপর কি কারো হাত আছে রে? মন খারাপ করিস না, চল আজ গরুর মাংস দিয়ে রুটি খাবো। তুই খুব পছন্দ করিস।
টাকা পেয়েছিস কোথায়?
আজকে বেতন পেলাম টিউশনির।
খুশি হয় শফিক হাসান, সত্যি গরুর গরম মাংসের সঙ্গে গরম রুটি ভীষণ পছন্দ করে ও। হোটেল মাছরাঙ্গার দিকে যেতে যেতে বলে শফিক, আমীরকে বাদ দিয়ে খাওয়া কি ঠিক হবে?
ওকে এখন কোথায় পাবো? আমীর আসবে রাত দশটায়।
তাহলে এক কাজ কর, তোর রেহানা ভাবীরে নিয়ে আয়।
হারামজাদা, তোরে একবারে গুলি করে মেরে ফেলবো। কোনো দিন ভুলেও তাকাবি না রেহানা ভাবির দিকে। দেখিস, আমি একদিন রেহানাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।
দুজনে ঢোকে মাছরাঙ্গা হোটেলে। ছোট কিন্তু ছিমছাম হোটেল। মাঝেমধ্যে হোটেলে এসে চা ডিম পরাটা খায়। বয়স্ক মেসিয়ার পান্না মিয়ার সঙ্গে পরিচয় আছে। ছোট টেবিলের দুই পাশে বসে মাহমুদ আর শফিক। কিন্তু শফিক তাকিয়ে আছে মাহমুদের দিকে, কানে বাজে বাক্যটা, দেখিস, আমি একদিন রেহানাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। সত্যি কি দুই সন্তানের জননী, সুন্দরী রেহানা ভাবিকে নিয়ে একদিন চলে যাবে মাহমুদ হাসান? কোথায় যাবে? আর রেহানা বেগমই বা যাবেন কেন স্বামী সংসার ছেড়ে?
তোরে কি আজ ভাবনায় পেয়েছে? দুজনার সামনে গরুর গরম মাংস আর গরম রুটি দিয়ে গেলে, মাহমুদ প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, আজ আমি একটা মুগ্ধকর জিনিষ দেখেছি; গরুর মাংস আর গরম রুটি মুখে দিতে দিতে বলে শফিক হাসান।
কী দেখেছিস?
এক নারীর খোপা।
বাজখাই চোখে তাকায় মাহমুদ, কোন নারীর খোপা দেখেছিস তুই?
দুনিয়ায় তোর রেহানা ভাবির খোপা ছাড়া আর কোনো নারীর খোপা থাকতে নেই? বেশি ঝামেলা করলে আমি কিন্তু রেহানা ভাবির জামাই সাইফুল মিয়াকে বলে দেবো।
কী বলবি?
বলবো, আমাদের মাহমুদ হাসান একদিন আপনার সুন্দরী বৌকে নিয়ে ভাগবে। একবার যদি বলি, তোকে ভাজা শৌল মাছের মতো ভেজে খাবে।
হাত ধরে মাহমুদ, সত্যি বলছি তোকে, তুই তো লেখক, আর কেউ না বুঝলে তুই বুঝবি। আমি রেহানা বেগমকে এক মুহূর্তের জন্যও মন থেকে ভাবনা থেকে মুছে ফেলতে পারি না। সব সময়ে জামার বুক পকেটের মতো আমার বুকে সেটে থাকে রেহানা বেগমের মুখ চোখ…
হাসে শফিক।
তুই হাসছিস কেন?
তোর বাপে না মাওলানা? তুই মাওলানার ছেলে, মাওলানা মনসুর আলী একটা ইস্কুলের শিক্ষক; তুই ঢাকায় আসছো জীবন আর জীবিকার সন্ধানে। সেই তুই এসব করছিস কেন?
আমি সব জানি, কিন্তু মন তো মানে না বন্ধু! কী করবো বুঝতেও পারছি না। এক কাজ কর…
কী কাজ?
চল এখান থেকে মানে রামপুরার উলন থেকে আমরা অন্যকোথাও চলে যাই, মাহমুদের গলায় হতাশা পাখা মেলে।
মাত্র এলাম তিন মাস, একটু গুছিয়ে বসলাম, আবার কোথায় যাবো?
সেটাও বুঝি? মাহমুদ এক গ্লাস পানির পুরোটা খেয়ে তাকায় শফিকের দিকে, বললি না কার খোপা দেখেছিস?
শিউলি আখতারের খোপা দেখেছি, মেয়েটা দারুণ রে…
চলবে…
আরও পড়ুন: মোকাম সদরঘাট-৩৬॥ মনি হায়দার