(পর্ব-ছত্রিশ)
রুমের মধ্যে খাটে বসে পা দুলিয়ে আপন মনে রুটি আর কলা খাচ্ছে রৌদ্র, গপাপগ। হোসনে আরা আবেদীন মমতার চোখে দেখছেন আর ভাবছেন, এই রৌদ্রর মতো কত ছেলে মেয়ে রাস্তায় লঞ্চে ট্রেনে বাসে টেম্পুতে এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে জীবনের সকল সঞ্চয় বিলি করে দেয়, মানুষের পায়ে পায়ে! কী পবিত্র সুন্দর মুখ ছেলেটার! চটপটে আর নির্মল রৌদ্র লঞ্চে লঞ্চে কাটিয়ে দিতো জীবনের দিনরাত্রি? বুকটার মধ্যে কেমন একটা মোচড় অনুভব করেন তিনি।
পানি? পানি আছে? খাবার মুখে আটকে যেতেই লাফ দিয়ে নামে রৌদ্র নিচে, এগিয়ে যায় টেবিলের কাছে। টেবিলের ওপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক খেয়ে নেয়। ওর স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত আচরণে খুশি হলেও বিপরীতে শঙ্কিত হন হোসনে আরা আবেদীন, ছেলেটা পোষ মানবে তো? পথের ছেলে, কত সাবলীল! একটুও জড়তা নেই। থাকবে কী করে? পথে পথে জীবনের যে বিস্তার ঘটেছে ওর, সেই জীবন তো মর্মন্তিক, পাশবিক! কত মানুষের কটুবাক্য শুনে, লাত্থিগুঁতো খেয়ে খেয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে রৌদ্র জীবনের সব মায়ার ছাতা হারিয়ে পথের মোড়ে দাঁড়িয়েছিল একলা নুড়ি পাথর।
আমি কি ঝুঁকি নিলাম ঝোকের বশে? নিজের মনে প্রশ্ন করেন হোসনে আরা আবেদীন। ছেলেটা, রৌদ্র আমার জন্য, পরিবারের জন্য বিপদ হয়ে উঠবে না তো? হাসেন তিনি, বিপদ হলে হবে, হোক। আর পরোয়া করি না বিপদের। নিজের সন্তানই যখন দূরের দ্বীপের মানুষ তখন অন্যর সন্তান আমাকে আর কী করবে? বড় জোর খুন করবে বড় হয়ে! সব টাকা কড়ি গয়না হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেবে? দিক, প্রতিদিন পত্রিকার পাতায়, টিভির খবরে কত কিছু নাকি!
কয়েক দিন আগে পত্রিকায় দেখেছেন, ঢাকার নতুন শহরের দিকে এক পালকপুত্র বাড়ির সবাইকে খুন করে নিজে বাড়ি দখল নিয়েছে। সঙ্গে ছিল বিদেশি দামি পিস্তল। খবর পেয়ে পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করলে ছেলেটা যুদ্ধ করতে করতে মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে রক্তাক্ত মুখে পুলিশকে বলেছিল, অনেক অনেক দিন দয়া আর দাক্ষিণ্যে থাকতে থাকতে মালিক হওয়ার সাধ জেগেছিল। তাই সবাইকে খুব করেছি নিজের হাতে; পরিকল্পনা করে, আমি জানতাম, আমি পারবো না, হেরে যাবো। কিন্ত নিজের মতো একটা চেষ্টা করে গেলাম। ছেলেটার নাম মনে পড়ছে, ওবায়দুর রহিম।
পত্রিকায়, টিভির স্ক্রিনে দেখেছে, দারুণ মায়াময় চেহারা। চোখ দুটো চোখের কোটর ছেড়ে বাইরে বের হয়ে আসতে ছিল ওবায়দুর রহিমের। ওর কি আরও কিছু বলার ছিল?
ভাবি!
ভাবনার তার ছিঁড়ে যায়, রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন। রৌদ্রর মুখ থেকে নিজের মুখ ফেরান দরজায়, কী ভাই?
সকাল তো হয়ে এলো। আমরা ডেকে আছি, আসুন নদীর মধ্যে থেকে নদীর ভোর দেখি। জয়নাল ভাইও আছেন। অদ্ভুত সুন্দর নিকানো পবিত্র ভোর চোখের সামনে ডানা মেলে উড়ছে।
হাসেন হোসনে আরা, আপনার মধ্যে কবিত্ব আছে। খাট থেকে নামেন তিনি, চলুন দেখি পবিত্র নিকানো নদীর ভোর।
দরজা থেকে সরে দাঁড়ান অধ্যাপক মোবারক হোসেন। দরজা পর হয়ে রুমের বাইরে আসেন হোসনে আরা। সঙ্গে সঙ্গে নরম ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগে শরীরে। শরীর জুড়িয়ে যায়। দু’জনে হেঁটে ডেকের খোলা জায়গায় দাঁড়ায়। জয়নাল আবেদীন রেলিংয়ের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখছেন সকালের মৌন মুখর নিবিড় সৌধ। পিছনে এসে দাঁড়ান হোসনে আরা। পিঠে হাত রাখেন স্বামীর। ঘুরে তাকান অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, হাত রাখেন স্ত্রীর কাঁধে, দেখেছো হোসনে আরা কী নির্মল আর পবিত্র সকাল?
হ্যাঁ, দেখছি তো। তোমার ছাত্র অরবিন্দ আমন্ত্রণ না জানালে নদী পথে বরিশাল আসা যাওয়ার কারণে জীবনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতাম না। হোসনে আরা স্বামীর শরীর ঘেসে দাঁড়ান। অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন পেছনের দিকে চলে যান। যেখানে অনেক যাত্রী নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি নামাজরত যাত্রীদের পেছনে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকান। আদিগন্ত বিস্তৃতির বিশাল এক দুনিয়া চোখের সামনে ঘোমটা খুলে অপেক্ষায় আছে। এমভি সামাদ লঞ্চটা যন্ত্র দানবের তোড়ে পানি কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। অধ্যাপক পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে দেখছেন ভোরের বিনম্র আলোর প্রপাত মায়াবী মোহে আবিষ্ট করে রেখেছে। ভোর, নদীর নির্ভার শান্ত সমুজ্জল স্রোত, দুই পারের দৃশ্যাবলী; একপাড়ে বিশাল বিশাল অট্টালিকা দাঁড়িয়ে, বিপরীত পারেও ছোট ছোট অট্টালিকার মধ্যে গাছ পালা দাঁড়িয়ে দেখছে অবাক বিস্ময়ে মানুষের যাত্রা। বর্ণনাতীত এক দৃশ্যপটভূমিকায় দাঁড়িয়ে নিজের দৃষ্টি এবং অনুভব ছড়িয়ে দিতে চাইলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন নদী ও প্রকৃতির সোপানের সমান্তরালে। বিস্ময় আর কৃতজ্ঞতায় তিনি অপলক তাকিয়ে রইলেন নদী প্রকৃতির অবাক অববাহিকায়।
কেউ কেউ ছোটে বাথরুমের দিকে। কিন্তু আগে আসা যাত্রীদের কারণে বাথরুমের সামনে লম্বা লাইন। অনেক যাত্রী এলোমেলো বিছানা গুছিয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ হাই তুলছে। বেশ কয়েকজন ডেকের যাত্রী নাক ঢেকে ঘুমুচ্ছে।
অনেক অনেক দিন পর অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের পাশঘেঁষে দাঁড়ালেন হোসেন আরা। বয়সের কারণে দুজনে একটি বাসায় থাকলেও দুজনে আলাদা রুমে থাকেন। আঠারো শো স্কোয়ার ফিটের বিশাল বাসায় দুজন মানুষের বসবাস। অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন ক্লাসে চলে গেলে বাসায় একলাই থাকেন হোসনে আরা। সারা দিন থাকেন কবিতার বিমর্ষ জগতে, নয়তো ছাদের ছাদ বাগানের যত্ন করেন। এইসব করে করে হাপিয়ে উঠলে নিউমার্কেটে যান। না তেমন কিছু কেনা কাটা করতে যান না, যান মানুষ দেখতে। জোড়া জোড়া মানুষ দেখলে তিনি নিরাপদ দূরত্বে থেকে পেছনে পেছনে হাঁটেন। দেখেন ওই দুজনের কেনাকাটা, আচার আচরণ, ওদের হাসি এবং সম্পর্কের মধ্যে প্রকৃত সম্পর্কের সৌরভ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। মাঝে মধ্যে তিনি এক একজন নারীকে বেছে পিছু নেন। দেখা ও বোঝার চেষ্টা করেন, এই নারী কোনো অভিপ্রায়ে এসেছে নিউ মার্কেটে! কখনো কখনো তিনি আরও দেখেন, অনেক নারী আসেন নিউ মার্কেটে কেবল ঘুরতে। একা একা ঘোরেন। এই দোকান সেই দোকানে যান, এটা-ওটা দেখেন, নাড়াচাড়া করেন, দামও জিজ্ঞেস করেন কিন্তু না কিনেই চলে আসেন। আবার আর একটা দোকানে যান। কোনো কিছু না কিনেই একের পর এক দোকানে ঢোকেন। এক সময়ে নিউ মার্কেটের গেট পার হয়ে চলে যান। সেই নারীদের পেছনে পেছনে হোসেন আরাও আসেন। অনুসরণ করা নারী যখন কোনো কিছু না কিনেই চলে যায়, তখন খুব ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করতে, আপনি দোকানে দোকানে ঘুরলেন, কত দ্রব্য দেখলেন কিন্ত কোনো কিছুই না কিনেই চলে গেলেন যে!
কিন্তু দ্বিধা আর সংকোচের কারণে জিজ্ঞেস করা হয় না। তিনি, হোসেন আরা ফিরে আসার সময় ভাবেন, নিজেকে প্রশ্ন করেন, কেনো এই ভদ্রমহিলা কোনো কিছুই না কিনে চলে গেলেন? কেনো আসেন প্রায়ই একা একা? কোনো অবসাদে আক্রান্ত তিনি? না কি আমার মতো সময়ের ঘোরটোপে বন্দি? সময় কাটানোর জন্য আসেন? ধা করে মাথায় বিপরীত প্রশ্ন ধাক্কা মারে, না কি টাকা নেই!
টাকা! কাগজ মাত্র নয়, জীবনের সব সৌরভের দুগ্ধ টাকা। হোসনে আরা আবেদীন নিজেও এক সময়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসেন বাসায়। সেই একঘেয়ে জীবন। অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন ক্লাসের পর ক্লাব, মিটিং আর দেশ বিদেশের সভা সেমিনার নিয়েই থাকেন। নিজেদের সংসারে দুজনের দেখা হয় কালেভদ্রে। সেই মাকাল কালের সময় কাটিয়ে নদীর স্রোত প্রবাহে দুজনে কতদিন পর শরীরঘেঁষে দাঁড়ালেন!
ভালো লাগছে খুউব…হোসনে আরার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নদীর স্রোতে দৃষ্টি রাখেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
আমারও…অস্ফুট কণ্ঠে বলেন হোসনে আরা। জানো, আমার এখন কী ইচ্ছে করছে?
হাসি মুখে আবার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকান জয়নাল, কী ইচ্ছে করছে?
নদীতে সাঁতার কাটতে।
হাহাহা হাসিতে ফেটে পড়েন অধ্যাপক, তুমি তো সাঁতারই জানো না। কিভাবে সাঁতার কাটবে?
জানি না বলেই তো সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করছে। কেমন বিপন্ন বিষণ্ন মন্দ্রিত কুসুমকোমল সকাল…এমন সকাল অনেক দিন দেখিনি।
দেখো নদীর প্রবাহে আমাদের মধ্যে কেমন পরিবর্তন এনে দিয়েছে! অধ্যাপক জয়নাল আবেদিন অনেকটা ইচ্ছে করেই হোসনে আরার কোমর ডান হাতে জড়িয়ে ধরেন। হোসনে আরা সকালের আবহে ভেতরে ভেতর উত্তাপ ছড়ালেও নিজেকে প্রকাশ করতে পারছেন না; অনেক দিনের জড়তায়।
ছাড়ো, ছোট শব্দে আলতো বলেন তিনি। কেউ দেখবে।
দেখলে দেখবে, আমি কি অন্যর বউ ধরেছি? আমার বউকে ধরেছি!
বয়স হয়েছে, ছাড়ো। যদিও মুখে বলছেন ছাড়ো; কিন্তু নিজেকে ছাড়িয়ে সেবার কোনো চেষ্টাই করছেন না। কতদিন পর দুটো মানুষ; নারী ও পুরুষের সংরাগ তৈরি করে দিয়েছে ভোরের কুহক আর নদীর কুয়াশা কাতর এই অসীম জলধারা।
মা!
দুজনে চট করে পেছনে তাকান। ভোরের হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র। সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের হাতের বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে হাত বাড়ান হোসনে আরা, কী রে রৌদ্র!
আমরা তো সদরঘাট আইয়া পড়ছি।
সঙ্গে সঙ্গে জয়নাল আবেদীন তাকান নদীর তীরের দিকে, সত্যিই তো চলে এসেছে। ভোরও আড়মোড়া ভেঙে একটু একটু করে জেগে উঠছে। সকালের মাথায় পূর্ব আকাশে সূর্যটা রঙের পাখা মেলছে।
ক্যাবিনে লন, ব্যাগ গুছাতে হবে না! তাড়া দেয় রৌদ্র।
ছেলে দেখি এখনই দায়িত্ব নেওয়া শুরু করেছে; পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন।
হাসেন হোসনে আরা, হাত ধরেন রৌদ্রের- চল রুমে যাই।
রৌদ্র ও হোসনে আরা রুমে চলে যান, দুই অধ্যাপক নদীর ভর কেন্দ্রে ভাসমান দাঁড়িয়ে দেখেন মানুষের সর্ম্পকের সূত্র ও সেতু! দুই জন মানুষ; একজন নারী অন্যজন শিশু-নদী তৈরি করে দিয়েছে ব্যাখ্যাতীত এক সম্পর্ক। সেই সর্ম্পকের সূত্রে একজন হোসনে আরার পুত্র বনে যায় কোনো এক সাধু, যে এখন রৌদ্র!
আমার মনে হয়, ছেলেটা যথাযথ একটা ঠিকানা পেয়েছে।
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন সমর্থন করেন সহকর্মী মোবারকের দিকে, ছেলেটা যেমন আশ্রয় পেয়েছে আপনার ভাবিও একটা অবলম্বন পেয়েছে সংসারে বেঁচে থাকার।
ঠিক বলেছেন, কিন্ত এখন চলুন রুমে। লঞ্চ এখনই সদরঘাটে ভিড়বে।
অধ্যাপক মোবারক হোসেনের উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চের মেশিন রুমে লঞ্চ থামার ঘণ্টা বাজে। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রচালকেরা লঞ্চের গতি কমিয়ে দেয়। গোটা লঞ্চের যাত্রীদের মধ্যে তুমুল সাড়া পড়ে যায়। যে যার মতো ঘুম ভেঙে উঠে বসে। কেউ কেউ ছোটে বাথরুমের দিকে। কিন্তু আগে আসা যাত্রীদের কারণে বাথরুমের সামনে লম্বা লাইন। অনেক যাত্রী এলোমেলো বিছানা গুছিয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ হাই তুলছে। বেশ কয়েকজন ডেকের যাত্রী নাক ঢেকে ঘুমুচ্ছে।
এমভি সামাদ লঞ্চের মধ্যে প্রাণের বিপুল চাঞ্চেল্যের মধ্যে দুই অধ্যাপক ঢোকেন নিজের নিজের কেবিনে। নিজের রুমে ঢুকে অবাক জয়নাল আবেদীন, দুই জনার ব্যাগ ইতিমধ্যে গুছিয়ে রৌদ্র বসে আছে মায়ের পাশে।
দেখেছো ছেলেটার কাণ্ড! গর্বিত ভঙ্গিতে বলেন হোসনে আরা।
পাশে বসেন জয়নাল আবেদীন, কী কাণ্ড! রৌদ্র আমাকে ব্যাগ জামা কাপড় কিছুই ধরতে দেয়নি। নিজেই সব অল্প সময়ের মধ্যে গুছিয়ে ব্যাগে ভরেছে।
হোসনে আরা বলেন, হঠাৎ সদরঘাট নিয়ে গবেষণার ইচ্ছে হলো কেনো? ভাবি, আমি আর একদিন আপনার বাসায় এসে বলবো সদরঘাট নিয়ে গবেষণার কারণ।
আমিতো লঞ্চের রুমের যাত্রীগো ব্যাগ গুছাইয়া নামাই দিতাম। আমি জানি সব। নামাইয়া দিলে আমাকে টাকা দিতো, নিজের কাজের ফিরিস্তি দেয় রৌদ্র। তো আমাদেরটা গুছাইলাম।
ভালোই তো, তোমার কাজ অনেকটা কমিয়ে দেবে ও।
কাজ কমিয়ে দিলে আমি কী করবো?
ওর সঙ্গে ঝগড়া করবে!
কে কার সঙ্গে ঝগড়া করবে? নিজের ব্যাগ কাধে নিয়ে রুমের সামনে দাঁড়ান অধ্যাপক মোবারক হোসেন।
শোনেন ভাই, রৌদ্রর বাবা বলে আমি রৌদ্রের সঙ্গে ঝগড়া করে সময় কাটাবো! প্রচ্ছন্ন অভিযোগের সঙ্গে বলেন হোসনে আরা, ভদ্রলোকের মাথায় গণ্ডগোল আছে।
কার মাথায় কী গণ্ডগোল আছে, হাসপাতালে গিয়ে দেখা যাবে। এখন চলুন, লঞ্চ ঘাটে থেমেছে, তাড়া দেন মোবারক হোসেন।
আংকেল! রৌদ্র বলে, আর একটু পড়ে নামেন। এখন অনেক ভিড় নিচে। ডেকের যাত্রীরা নেমে গেলে কেবিনের যাত্রীরা নামে, ধীরে সুস্থে!
জীবনের পাঠশালায় কতো কিছু শেখা যায় রে! রৌদ্রর পাশে বসে অধ্যাপক মোবারক হোসেন। আমার মনে হয়, আপনাদের সংসারটা আবার পূর্ণ হয়ে উঠবে ওর কারণে।
হাসেন হোসনে আরা আর জযনাল আবেদীন।
হাসির শেষে অধ্যাপক জয়নাল বলেন, মানুষের জীবন কি ঘূর্ণিপাকে চলে? সেদিন বরিশাল গেলাম আমরা দুজন, আসার পথে আমরা তিনজন। মানুষের চলিষ্ণু জীবনের যাত্রা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয় মোবারক ভাই।
আমার কাছে বিস্ময়কর তো বটেই, রোমাঞ্চকরও মনে হয়।
রৌদ্র চট করে রুম থেকে বের হয়ে যায়। তিনজনেই বুঝে গেছে রৌদ্র গেছে নীচতলায়, ডেকের যাত্রীরা সবাই নেমে গেছে কি না, দেখার জন্য।
ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান, বলেন মোবারক হোসেন।
হ্যাঁ, একই সঙ্গে সপ্রতিভও।
কথার মধ্যে হাপাতে হাপাতে ঢোকে রৌদ্র, সবাই পেরায় নামছে। নীচটা ফাঁকা, আপনেরা চলেন। বলতে বলতে হোসনে আরা আর জয়নাল আবেদীনের ব্যাগ নিজের কাঁধে নেয় রৌদ্র। চারজনে রুম থেকে বের হয়ে আসেন। তিন তলার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়, দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায়। নামতে নামতে ডেকের খালি জায়গায় চোখ যায় অধ্যাপক মোবারক হোসেনের, এই ডেকের জায়গা জুড়ে পনেরো বিশ মিনিট আগেও প্রচুর মানুষ ছিল। আর এখন ফাঁকা!
লঞ্চ থেকে নেমে দাঁড়ান চারজনে। এম ভি সামাদের প্রায় সকল যাত্রী নেমে গেছে। বিরাট টার্মিনাল। টার্মিনালজুড়ে মানুষ আর মানুষ। এইসব যাত্রী মানুষদের সঙ্গে সদরঘাটে, এমভি সামাদের পাশে ভোলা থেকে বিরাট লঞ্চ এমভি সাগরিকা এসে থামে।
ভাই চলেন, পেছনে থেকে তাড়া দেয় হোসনে আরা।
ভাবি, আপনারা যান।
আপনি যাবেন না?
যাবো, কিন্ত আমার একটু কাজ আছে।
সদরঘাটে কী কাজ আপনার? জানতে চান অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
এম ভি সাগরিকা থেকে যাত্রী নামতে শুরু করেছে। সাগরিকার পেছনে রাঙ্গবালী থেকে আর একটা লঞ্চ এসে জায়গার স্বল্পতার কারণে ভিড়তে পারছে না টার্মিনালে, ভোঁ ভোঁ বাঁশি বাজাচ্ছে সারেং। যাত্রী, কুলি আর লঞ্চের বিচিত্র শব্দে ঢাকা সদরঘাট পরিণত হয়েছে আজব কারখানায়।
আমি বাসায় গেলে আর বের হতে পারবো না। একটু সময় নিয়ে আমি নৌপরিবহন অধিদপ্তরে যাবো, জানতে চাইবো ওদের কাছে, কবে ঢাকা সদরঘটা প্রথম চালু হয়েছিল, কোনো হদিশ দিতে পারে কি না!
মানে কী? এসব দিয়ে আপনি কী করবেন?
আমি ঢাকা সদরঘাট নিয়ে গবেষণা করছি ভাই।
অবাক চোখে তাকান হোসনে আরা জয়নাল আবেদীন। হোসনে আরা বলেন, হঠাৎ সদরঘাট নিয়ে গবেষণার ইচ্ছে হলো কেনো?
ভাবি, আমি আর একদিন আপনার বাসায় এসে বলবো সদরঘাট নিয়ে গবেষণার কারণ। এখন আমি সদরঘাটে থাকবো আর লঞ্চে থেকে নামা যাত্রীদের পায়ের চিহ্ন দেখার চেষ্টা করবো…কোথা থেকে আসে মানুষ, কেনো আসে মানুষ, যায় কোথায় মানুষ; এই মোকাম সদরঘাট থেকে!
চলবে…
মোকাম সদরঘাট-৩৫ ॥ মনি হায়দার