(পর্ব-৩২)
সামাদ লঞ্চের দোতলায় অধ্যাপক গোবিন্দ হালদারের কেবিনটা পড়ে আগে। রুমের সামনে দাঁড়িয়ে এক পলক তাকিয়েই বুঝতে পারে, গত রাতটা কেমন গেছে এই পরিবারটির উপর দিয়ে! কেবল এই পরিবার? সামাদ লঞ্চের প্রতিজন যাত্রী ঝড়ের করলে পড়ে চিড়ে চ্যাপটা। চোখে মুখে অবিশ্বাস্য বেঁচে থাকার তীব্র আকুল চিহ্ন আঁকা। মানুষগুলো অনেকটা সিম ভর্তার মতো মিইয়ে গেছে।
মহুয়া হালদার বেঁচে বর্তে আছেন ঠিকই কিন্ত দুচোখের দৃষ্টিতে নেমে এসেছে ঘুম। শরীর অবসন্ন, যদিও বসে আছেন রুমের বেঞ্চের ওপর কিন্ত ইচ্ছে হচ্ছে শুইয়ে পড়ার। শরীরটা ভীষণ রকম ছেড়ে দিয়েছে। মায়ের পাশে গুটিসুটি মেরে বসে সুকন্যা।
-স্যার! অমলেন্দু ঘোষ পরিস্থিতি অনুকূলে নেয়ার জন্য সপ্রতিভ ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় গোবিন্দ হালদারের দিকে, অনেক কষ্ট হয়েছে, বুঝতে পারছি। এখন উঠুন স্যার। বাসায় গিয়ে গোছল দিয়ে একটা কিছু মুখে দিয়ে বিশ্রাম নেবেন, তাকায় মহুয়া হালদারের দিকে, ম্যাডাম আপনাকেও বলছি। সত্যি আমি দুঃখিত, পথে এমন ঘটবে আমি তো জানতাম না। শেষের দিকে অমলেন্দু ঘোষের গলাটা ভারী হয়ে আসে।
হাত বাড়িয়ে অমলেন্দু ঘোষের হাত ধরেন গোবিন্দ হালদার, তোমার কোনো ত্রুটি নেই অমলেন্দু। তুমি তো নির্দোষ নিমন্ত্রণ জানিয়েছ আমাদের। কিন্তু পথের খেলাটা খেলেছেন ওপরের …হাত উঁচু করে দেখান, ওপরের দিকে। অনেক ঘটনা শুনেছি নদীর ঝড়ের, গতরাতে সেই নির্মম অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। বেঁচে আছি সবাই মিলে সেটাই ঈশ্বরের কৃপা।
-জি স্যার।
-এখন অন্যদেরও খোঁজ খবর নাও। আমরা বের হচ্ছি।
-ঠিকাছে স্যার, গোবিন্দ হালদারের কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে অমলেন্দু ঘোষ যায় পাশের রুমে, আবদুল মতিনকে সঙ্গে নিয়ে। পাশের রুমে এলোমেলো খাট বিছনার ওপর খুনের মামলার আসামি হিসেবে রায়ে ফাঁসির আদেশ শোনার পর আসামি বিহ্বলতা, নিঃশব্দ জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাসের নিনাদের বসে আছেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন, অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন। চার জনই সমবয়সের বয়স্ক মানুষ। চোখে-মুখে বয়ে যাচ্ছে গতরাতের ঝড়ের ঝাপটা। বেঁচে আছেন ঠিকই কিন্তু জীবনের দায় ফুরিয়ে গেছে, মনে হয়। তাকিয়ে আছেন ঠিকই কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে কোনো কিছু ধরা পড়ছে, মনে হয় না। দৃষ্টি প্রসারিত ঠিকই কিন্তু দৃষ্টি ফাঁকা। চার জনে বসে বসে ঝিমাচ্ছেন, মনে হচ্ছে পথে নেমে পথ হারিয়ে ফেলেছেন। দিশা নাই। বেঁচে আছেন এখনো, চোখে মুখে শরীরে বেঁচে থাকার অনিচ্ছার সুখ ভেসে বেড়াচ্ছে টলোমলো পায়ে।
চার জন জবুথবু অধ্যাপকের অবিশ্বাস্য চেহারার দিকে তাকিয়ে অমলেন্দ ঘোষের বুকটা ভেঙে আসছে। চোখের কোনে পানি জমে; নদী, নদীর জল ও ঝড় এমন কাবু করেছে একরাতে আমার প্রিয় অধ্যাপকদের! রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে তাকায় আবদুল মতিনের দিকে।
-কোনো ইমোশন দেখাবি না, কড়া কিন্ত ফিসফিসিয়ে গলায় বলে আবদুল মতিন। এমনিতে ভয়নাক যে ঝড়ের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন স্যারেরা, এখন আবার আবেগ দেখালে ভেঙ্গে পড়বে। তুই স্বাভাবিকভাবে ওনাদের নিয়ন্ত্রণ করবি।
-ঠিক আছে, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রুমের মধ্যে ঢোকে অমলেন্দু ঘোষ, স্যারেরা, বুঝতে পারছি গত রাতটা খুব কষ্ট করেছেন। আর ভয় নেই। লঞ্চ ঘাটে এসেছে বরিশালের। আপনারা নামুন। আপনাদের জন্য বরিশালের বিখ্যাত হোটেল গুলবাগে রুম রেখেছি। হোটেলে উঠে জামা কাপড় ছেড়ে গোসল করে নাস্তা খেলে ভালো লাগবে। অমলেন্দু হাত ধরে অধ্যাপক মোজাফ্ফর হোসেনের, চলুন স্যার।
নিজের মতো করে বলে যায় অধ্যাপক মোবারক হোসেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরও বলেন, আমার বাবা, আমার চাচা, আমার দুই মারা সরাসরি শহীদ হয়েছেন স্বাধীনতা যুদ্ধে।
যন্ত্রচালিতের মতো দাঁড়ান অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন, চল। তুলে নেন হাতের ভেজা ব্যাগটা। তাকান সহকর্মীদের দিকে। সবাই অনুসরণ করেন মোজাফফ্র হোসনেকে। রুম থেকে বের হয়ে একটা ছিন্নভিন্ন দলে হাঁটতে থাকে অমলেন্দু ঘোষের পেছনে। সবার শেষে আবদুল মতিন। লঞ্চের সামনে এনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায় দলটা। নেমে দাঁড়ায় সকালের মিহি বাতাসের সঙ্গে টার্মিনালের ওপর। টার্মিনালে আরও কয়েকটা লঞ্চ দাঁড়ানো। লোকজন নামছে তাড়াহুড়ো করছে। আশেপাশে কোথাও মাছের বাজার। গন্ধ আসছে। লঞ্চের সীমাবদ্ধ সীমানা থেকে খোলা আকাশের নীচে নেমে সবার শরীরের আড়ষ্টতা অনেকটা কেটে গেছে। দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখছে।
-এইটা বরিশালের সদরঘাট? অধ্যাপক মোবারক হোসেন হাতের ব্যাগটা টার্মিনালের ওপর রেখে দাঁড়িয়ে সিগারেটে আগুন লাগিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছেন, খুব বেশি বড় না।
-স্যার ঢাকা সদরঘাটের মতো বড় না হলেও একেবারে ছোট না। একটা জেলা শহর তো, পাশে দাঁড়িয়ে বরিশাল সদরঘাটের মান ইজ্জত সম্পর্কে বলছে আবদুল মতিন।
-শোনো, সিগারেটে লম্বা দম দিয়ে টেনে ধোঁয়া উগড়ে দিতে দিতে বলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন, ধান, নদী, খাল, এই তিনে বরিশাল। এই অঞ্চলের প্রচুর মানুষ ঢাকায় যায়। আরও একটা বিষয়, ট্রেন নেই তোমাদের এলাকায়। লোকজনের চলাচল নৌপথে; বরিশালের সদরঘাট আরও বড় হওয়া উচিত ছিল।
-এক অর্থে ঠিক, কিন্তু আপনি যেভাবে ভাবছেন, সেভাবে তো যারা ভাবার ভাবে না। ফলে আমরা পিছিয়ে আছি স্যার।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন অধ্যাপক মোবারক হোসেন, বরিশালের সদরঘাট করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বলতে পারো?
-না স্যার, মাথা নাড়ে আবদুল মতিন।
-একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকা উচিত, বরিশাল, ঢাকা সদরঘাট কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাহলে কৌতূহলী যেকেনো নাগরিককে ভালো লাগতো। বুঝলে, আমরা একটা জাতি, পঙ্গপালের জাতি।
-পঙ্গপালের জাতি? বিস্মিত আবদুল মতিন।
মৃদু হাসেন প্রবীণ অধ্যাপক, পঙ্গপাল বুঝলে না? পঙ্গপাল এক ধরনের পোকা। যারা কোনো এক প্রান্ত থেকে গাছপালার ধান শাক সবজির পাতা খেয়ে খেয়ে সামনে এগুতে থাকে। যা পায় দল বেঁধে খায় আর সামনের দিকে এগোয়। সব ধ্বংস করে ফেলে। আমরা অনেকটা সেই পঙ্গপাল। আমরা আমাদের ইতিহাস খেয়ে ফেলি, ইতিহাসের কোনো চিহ্ন রাখি না, বুঝলে?
ঘাড় কাৎ করে আবদুল মতিন, জি স্যার।
-স্যার, অন্যদের নিয়ে এগিয়ে আসে অমলেন্দু ঘোষ চলুন। গাড়ি অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য।
চলো।
সবাই মিলে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে টার্মিনালের বাইরে, বরিশালের মাটিতে পা রাখবার জন্য। টার্মিনাল পার হয়ে লম্বা সিঁড়ি অতিক্রম করে ছোট দলটা বরিশালের মাটিতেস পা রাখে। এতোসব যন্ত্রনার মধ্যেও অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের স্ত্রী হাসমত আরা আবেদীনের শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে যায়, কবি জীবনানন্দ দাশ এই পথেইতো আসা যাওয়া করতেন? হঠাৎ যদি জীবননান্দ দাশের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, কেমন হবে? শুনেছি তিনি খুব কম বলতেন। আর ছিলেন লাজুক। এই কম কথার লাজুক লোকটা গোটা বাংলা সাহিত্যের রাজা! শোনা যায় স্ত্রী লাবণ্য দাশের সঙ্গে কবির সর্ম্পক ভালো ছিল না! দাম্পত্য জীবনে দুঃখ কষ্ট অশান্তি থাকলে নাকি কবি বা লেখক হওয়া যায়? হাসমত আরা আবেদীন জীবনে কবি হতে পারবেন না? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেন হাসমত আরা- বরিশালের সদরঘাটে দাঁড়িয়ে, ভোরের বিশুদ্ধ বাসাতে নিজের ভাবনা ছড়িয়ে দিতে দিতে। কারণ, আমার দাম্পত্যে আমিই রানি। রাজা একজন আছে বটে কিন্ত আমার মুখের ওপর রা করে না। টাকা পযসারও খুব অভাব নেই আমার, হয়তো অনেক বেশি টাকা নেই- কিন্তু..
আপনারা গাড়িতে উঠুন। অমলেন্দু ঘোষের তাড়ায় সামনের দিকে তাকায় হাসমত আরা আবেদীন। সামনে দাঁড়িয়ে দশ সিটের একটা সাদা রঙের মাইক্রোবাস। ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমেই মাইক্রোবাসে উঠলেন অধ্যাপার গোবিন্দ হালদার, পিছনে স্ত্রী মহুয়া হালদার, মায়ের পিছনে কন্যা সুকন্যা। পরে অধ্যাপক মোজাফ্ফর হোসেন…। সবাই মাইক্রোবাসে উঠলে জানালার সামনে দাঁড়ায় আবদুল মতিন, আমি বাসায় যাচিছ স্যারেরা। ফ্রেস হয়ে বিকেলে দেখা করবো আপনাদের সঙ্গে।
কেউ কোনো প্রতিউত্তর করছে না। নদীর জলের ঝড়ের গ্রাস থেকে বেঁচে মাটিতে এসেছে, অনুভবই করতে পারছে না মানুষগুলো। একটা ঘোরের মধ্যে কাটছে এই প্রবীণ মানুষদের চিত্ত ও মন। পেছনের সিট থেকে কেবল সাড়া দেয় সুকন্যা; বিকেলে দেখা হবে।
সামনের সিটে বসে অমলেন্দু ঘোষ। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়, গাড়ি চলছে দ্রুত বেগে সদর রোড়ের দিকে। সকালের রাস্তা প্রায়ই ফাঁকা। রিকশার ভিড়টা একটু বেশি। প্রাইভেট গাড়ি দুই-একটা যাচ্ছে আসছে। গাড়ির ভেতরটা প্রায় নিঃশব্দ। কেউ কোনো শব্দ করছে না। নিঃশব্দ তাতে ছাপিয়ে অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন হঠাৎ বলেন, আমরা কোথায়? এখনো সামাদ লঞ্চে? ঝড় কমেছে না কেন? লঞ্চটা দুলছে এত ভয়ানকভাবে, উহ, আর বাঁচার আশা নেই।
-স্যার, পাশে বসা অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন নাড়া দেন ডান হাতে, আমরা বেঁচে আছি স্যার। লঞ্চ থেকে নেমে এখন আমরা ডাঙ্গায়। গাড়িতে, বরিশাল শহরে। যাচ্ছি হোটেলে। অমলেন্দু, হোটেলের নাম কী?
-হোটেল গুলবাগ স্যার, অপরাধী গলায় সামনে থেকে উত্তর দেয় অমলেন্দু ঘোষ। বরিশালের সবচেয়ে বড় হোটেল গুলবাগ। সেখানেই থাকবেন আপনারা। আমাদের বাসা থেকে কাছে।
-অমলেন্দু?
অধ্যাপক মোবারকের ডাকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় অমলেন্দু ঘোষ. জি স্যার? বলুন।
-তোমাদের বরিশাল শহরে বিআইডব্লিইডির অফিস আছে না?
-আছে স্যার। কিন্ত কেনো?
-যদি সময় পাই, একবার যাবো।
-কেন যাবেন স্যার? কেউ পরিচিত আপনার?
-না, কেউ পরিচিত নেই আমার। কিন্তু আমি যাবো বরিশাল সদরঘাটের ইতিহাস জানতে। কবে প্রথম লঞ্চ বরিশাল সদরঘাটে ভিড়েছিল, কে প্রথম লঞ্চ থেকে পা রেখেছিল মাটিতে, লঞ্চের মালিক কে ছিল, সাংরে সুকানি মেশিনম্যান কে বা কারা ছিল…
-আরে অধ্যাপক, তুমি তো বুয়েটের ক্যামিক্যাল ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক। তুমি এইসব সদরঘাটের ইতিহাস নিয়ে পড়লে কেন? প্রশ্ন করেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
-শুনুন, একটা সভ্য জাতির সব ধরনের ইতিহাস বা ডকুমেন্ট থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের কোনো তথ্য নেই; মনে হচ্ছে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া শ্যাওলা, গম্ভীর গলায় বলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন।
মৃদু হাসেন গোবন্দ হালদার, সেই হাসি বেঁচে থাকার, না স্মৃতির প্রতি বিশেষ কোনো পক্ষপাদ, না এই মুহূর্তকে উদ্যাপন বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু হাসিটা কানে লাগে মোবারক হোসেনের, কী হে গোবিন্দ, হাসলা কেন? আমি আপত্তির কী বললাম?
-তুমি আপত্তি কিুছ বলো নাই কিন্ত যে দেশে একাত্তরের স্মৃতিই নাই; সব ধুয়ে মুছে ছাপ করে ফেলা হয়েছে, সেই দেশে তুমি খুঁজছো সদরঘাটের ইতিহাস!
অধ্যাপক গোপাল হালদারের গলায় বিষ উথলে উঠতে থাকে। বাঙালির মতো সব খেয়ে ফেলার জাতি তুমি দুনিয়ায় দুটি পাবে না।
-তোমার বেদনা আমারও হাহাকার, ধরো ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে না পারলে তুমি আমি কোথায় থাকতাম? আমাদের মা বাবা ভাইবোন চৌদ্দ গুষ্ঠি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে আমাদের হাড়গোরের ওপর গড়ে তুলতো নাচ মহল! নিজের মতো করে বলে যায় অধ্যাপক মোবারক হোসেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরও বলেন, আমার বাবা, আমার চাচা, আমার দুই মারা সরাসরি শহীদ হয়েছেন স্বাধীনতা যুদ্ধে।
-জানি তো, কতবার বলেছ তুমি।
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন ঝড়ের রাতে পদ্মানদীর মাঝে বিপদাপন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন, এতদিনের চেনা কিন্তু এই মুহূর্তের একদম অচেনা স্ত্রীর দিকে। সত্যি তিনি চিনতে পারছেন না নিজের স্ত্রীকে।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর হোসেনকে থামিয়ে আর্দ্র গলায় বলে মোবারক হোসেন, কিন্তু এই বলা কোনোদিন শেষ হবে না।
-হবে, তুমি অত নিশ্চিত হয়ো না। আমাদের অর্জনের ইতিহাস আমাদের পর কেউ মনে রাখবে না।
-কেন মনে রাখবে না?
-বাঙালি বড় ভুলে যাওয়া জাতি, তোমরা দেখতে পাচ্ছো না। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম হাওয়ায় ওড়ে, হাওয়া খায়। মাটিতে পা রাখে না। মাটির ঘ্রাণ কত মধুর জানে না। হাহাকারের কণ্ঠে বলে অধ্যাপক গোবিন্দ হালদার।
-স্যার, আমরা পৌঁছে গেছি। গাড়ি হোটেল গুলবাগের সামনে এসে থামলে গাড়ি থেকে নেমে বলে অশলেন্দু ঘোষ। গাড়ির দরজা খুলে ম্লান গলায় বলে, নামুন আপনারা।
অধ্যাপকেরা, স্ত্রী দুজন এক কন্যা সুকন্যা ধীরে ধীরে নেমে দাঁড়ায় গাড়ি থেকে। হোটেলটা বাইরে থেকে দেখলে অনেকটা প্রাচীন কালের রাজা বাদশার প্রাসাদের মতো মনে হয়। সবাই ঢোকে হোটেলের মধ্যে। যার যার রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে, গোসল করিয়ে, নাস্তা খাইয়ে অমলেন্দু ঘোষ বাসায় চলে যায়। নাস্তা খাওয়ার পর সব অধ্যাপকেরা ঘুমিয়ে যায়।
তিন দিন বরিশালে থাকার পর, অমলেন্দু ঘোষের বিয়ের খাওয়া দাওয়ার পর হোটলে বসে সিদ্ধান্ত নিতে বসে সবাই। কিভাবে ঢাকা যাবে বরিশাল থেকে? লঞ্চে যেতে আর ভরসা পাচ্ছে না কেউ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের স্ত্রী হোসনে আরা বলে, চলো আমার লঞ্চেই যাই।
-আবার লঞ্চে? অসম্ভব,বরিশাল থেকে বাসে ঢাকা যাবো। কোনোভাবেই লঞ্চে যাবো না, সিদ্ধান্ত জানায় অধ্যাপক মোজাফ্ফর হোসেন। একবার মরনের দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি, আবার সেই মরণের কাছে যাবো ইচ্ছে করে? মাথা নাড়ান তিনি।
-আমিও ভাবীর সঙ্গে একমত, বলেন অধ্যাপক মোবারক হোসেন। তিন দিন আগে যমুনায় ঝড় হয়েছিল বলে আগামীকালও ঝড় হবে। মনে হয় না। আর নদীর তরঙ্গে রাতের দৃশ্য আমার দেখা হয়নি। আমি দেখতে চাই। আর মৃত্যু! হলে হবে। কিন্তু আমি লঞ্চেই যাবো।
-আমি বলি, মাঝখানে দাঁড়ায় আবদুল মতিন, দুটো পথই খোলা। লঞ্চ পথ আর বাসের সড়ক পথ। যে যে পথে যাবেন, যেতে পারেন। আমি সব ব্যবস্থা করবো।
দুটো দলে ভাগ হয়ে যায় ঢাকা থেকে বরিশালে আসার অমলেন্দু ঘোষের বিয়ের বরযাত্রার অতিথিরা। অধ্যাপক মোজাফ্ফর হোসেন, অধ্যপক গোবিন্দ হালদার সড়ক পথে ঢাকায় যাত্রা করলেন। আর অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, হোসনে আরা আবেদীন আর অধ্যাপক মোবারক হোসেন পুনরায় ঢাকায় ফিরতে সামাদ লঞ্চেই উঠলেন। পাশাপাশি দুটো কেবিন। একটা কেবিনে অধ্যাপক মোবারক হোসেন একা। অন্যটায় জয়নাল আর মিসেস জয়নাল। লঞ্চে উঠলেও মনের মধ্যে ভয়ের শিহরণ ছিল, সত্যি কি ঝড় আসবে আবার? আবার ভিজবেন, ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবো?
লঞ্চে ওঠার আগে মতিন, অমলেন্দু স্থানীয় আবহাওয়া অফিস থেকে খবর নিয়ে এসে জানিয়েছে। আজকের আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকবে। কোনো ঝড় বা ঝড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস নেই। সুতরাং প্রশান্ত মনে ও শরীরে সামাদ লঞ্চে ওঠেন অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন ও মোবারক হোসেন।
কিন্তু বিস্ময়কর ঘটনা, রাতে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার সময়ে আবার ঝড় ওঠে।
অন্ধকার নদীর স্রোতের ঢেউয়ের তালে তালে চলছে সামাদ, তিন দিন আগের ঝড়ের মতো। কিন্তু দিন দিন আগের সেই প্রবল ঝড়ের গতি নয়, গতি অনেক কম। ঝড়ের মধ্যে সামাদ চলছে। মজার ঘটনা, তিনদিন আগের সেই ভয়টা এখন নেই তিনজন যাত্রীর। অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের স্ত্রী কবি হোসনে আরা আবেদীন কেবিন থেকে বাইরে এসে রেলিং ধরে দাঁড়ায়। আবদুল মতিন নেই লঞ্চে কিন্তু লঞ্চের দুলনীতে একটু একটু ভয় লাগলেও সেই তিন দিন আগের ভয় নেই। মনে হচ্ছে স্বাভাবিক। এবং পদ্মার উথাল পাতাল ঢেউয়ে সামাদ লঞ্চের দুলুনী অন্যভাবে উপভোগ করে কবি হোসনে আরা আবেদীন। কেবিনের সামনের বারান্দায় লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে প্রবল ঝড়ের সঙ্গে ঢেউয়ের মাতামাতি, অন্ধকারের জলের অশ্লীল কানাকানি- স্রোতের সঙ্গে স্রোতের সঙ্গম কৌতুক শীষ অনুভবে মধ্য বয়সের রমণী কবি হোসনে আরা আবেদীনের মনে শরীরে এক ধরনের রঙ ছড়িয়ে পড়ে।
-তুমি ভয় পাচ্ছো না? পাশে এসে দাঁড়ান জয়নাল আবেদীন।
বিরাট লঞ্চ দুলছে। অন্য কেবিনের যাত্রীরা হালকা ছুটোছুটি করছে। ঢেউয়ের ধাক্কায় পানির ঝাপটা এসে গায়ে লাগে। বাতাসে উড়তে থাকা কালো কুন্তল হাসছে অন্ধকারের বীনের স্রোতে। অদৃশ্য এক অশরীরী সৌন্দর্য খেলা করে হোসনে আরা আবেদনীর চোখের তারায়।
-না, ভয় পাবো কেন? খুব স্বাভাবিক কিন্তু জোড়ে উত্তর দেয় হোসনে আরা আবেদীন।
-কিন্তু তিন দিন আগে তো খুব ভয় পেয়েছিলে। এক মুহূর্তের জন্য আমাকে ছাড়োনি, ঝাপটে ধরে বসেছিলে, হাসে অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
-হ্যাঁ, প্রথম অভিজ্ঞতা তো। এক ধরনের ভয়, এক ধরনের অজানা আতঙ্ক ছিল কিন্তু আজ সেটা আমার মধ্যে নেই। মনে হচ্ছে এটা জীবনের অন্য একটা রূপ। এতদিন নানাজনের কাছে শুনেছি আজ বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার এক বিন্দু ভয় নেই।
-যদি লঞ্চটা ডুবে যায়?
-সাঁতার কাঁটার চেষ্টা করবো। সাঁতার আমি জানি না কিন্তু জলের সঙ্গে একটা সংসার করার সুযোগ তো হবে।
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন ঝড়ের রাতে পদ্মানদীর মাঝে বিপদাপন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন, এতদিনের চেনা কিন্তু এই মুহূর্তের একদম অচেনা স্ত্রীর দিকে। সত্যি তিনি চিনতে পারছেন না নিজের স্ত্রীকে।
চলবে…
মোকাম সদরঘাট-৩১॥ মনি হায়দার