[পর্ব-০৩]
হঠাৎ এক ফালি ঈদের চাঁদের আকারে দেখতে পায় শফিক দোতলা পূবালী লঞ্চের মাথা।
খুব সকালে রায়েন্দা স্টেশন ধরে পূবালী লঞ্চটি বলেশ্বর নদীর স্রোত পার হয়ে শরণখোলা-তুষখালী-বালিপাড়ার চতুরমুখী তীরের চক্রে, বলেশ্বর, কচা আর পানগুছি নদীর ত্রিমুখীসঙ্গম পাড়ি দিয়ে তীব্র স্রোতের প্রতিকুলে সাঁতার কেটে কেটে আসছে। কচানদীর তীরে ছোট গঞ্জ তেলিখালীর লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে অনেক যাত্রীর সঙ্গে অপেক্ষা করছে শফিক। পরনে অনেক পুরনো প্যান্ট। গায়ে আরও পুরনো কালো রঙের শার্ট। হাতে নায়লনের ঝুলন্ত ব্যাগ। সেই ব্যাগে আরও দুটি পুরনো শার্ট, একখানা লুঙ্গি, গামছা আর দুই-তিনটি গল্পের বই।
মার্চের সকালে হালকা শীত। নদীর ভেজা বাতাসে অনেকে দাঁড়িয়ে চা-সিগারেট-বিড়িতে মগ্ন। প্রবল ভাঙনকবলিত এলাকা তেলিখালী হওয়ার কারণে লঞ্চ ভেড়ার জন্য কোনো টার্মিনাল নেই। লঞ্চ সরাসরি কাদার মধ্যে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকে। খালাসিরা লঞ্চের সামনে থেকে লম্বা কাঠের সিঁড়ি ফেলে। সেখান দিয়ে যাত্রীরা প্রথমে নামে। তাদের নামা শেষ হলে অপেক্ষারত যাত্রীরা ওঠে। উঁচু পাড়ের নিচে প্রবল স্রোতের সঙ্গে বাঁধা কয়েকটা টাপুরে নৌকা দুলছে। নদীর মাঝ বরাবর স্রোতের সঙ্গে বুক রেখে ভেসে যাচ্ছে সবুজ কচুরিপানা।
যাত্রীরা বার বার তেলীখালি লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে জুনিয়া আর বালিপাড়ার যৌথ কচানদীর বাঁকে চোখ রেখে দেখছে, পূবালী আসছে কি না! দুই একজন যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকা ফেরিঅলাদের জিজ্ঞেস করে কনফার্ম হতে চাইছে, গতকাল দুপুরে তেলিখালী ঘাটে লঞ্চটা ভিড়েছিল কি না, ঢাকা থেকে এসে।
ফেরিঅলা বাবুল মিয়া ডালার বাদাম ঠিক করতে করতে জবাব দেয়, হয় হয়। মুই তো কাইল ভানডারিয়া দিয়া পূবালী লঞ্চে বাদাম বেচতে বেচতে তেলিখালী নামছি।
-তাইলেতো ঠিকই আছে। যাত্রী আশ্বস্ত হয়। ঠিক সময়ে চিৎকার দিয়ে শফিক জানায়, বালিপাড়ার ঠোডায় লঞ্চটা দেহা যাইতেছে।
শফিকের চিৎকারে লঞ্চঘাটে উপস্থিত যাত্রীরা তাকায়, ওর হাতের ইশারা লক্ষ করে। কেউ কেউ দেখতে পায়, হালকা কুয়াশার পর্দা ভেদ করে উজান ঠেলে পূবালী আসছে। পনেরো-বিশ মিনিট অপেক্ষা করার পরই লঞ্চা এসে ঘাটে ভেড়ে। যাত্রীরা নামার পর অনেক যাত্রীর সঙ্গে শফিকও ওঠে। পকেটে মাত্র তিরানব্বই টাকা। তাও নিজের নয়, মেঝো ভাইয়ের আলমারি ভেঙে চুরি করেছে। উপায় নেই, শফিককে ঢাকা যেতে হবে। মাত্র কয়েকদিন আগে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। ঢাকা! সদরঘাট কেবল মানুষের মুখে শুনেছে। পত্রিকায়, গল্পে, উপন্যাসে পড়েছে। ট্রানজিস্টারের খবরে শুনেছে। ঢাকায় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, চোর-বাটবাররা থাকে। আরও থাকে লেখকেরা। লেখক হওয়ার তীব্র বাসনা ওর। জীবনে আর কিছু হওয়ার ইচ্ছে নেই। ওই বয়সেই জেনে গেছে, ঢাকা ছাড়া লেখক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
পূবালী লঞ্চে উঠে ঘুরতে থাকে হাতের ব্যাগটি নিয়ে। নদী, কচানদীটা ভীষণ প্রিয় শফিক হায়দারের। বাড়ি থেকে প্রায় আধা মাইল দূরের এই নদীটার কাছে এসে বসে থাকতো। নদীর সঙ্গে নিবিড় একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই সব সম্পর্ক ছিন্ন করে কচানদীর ওপর দিয়েই চলে যাচ্ছে, ঢাকা শহরের দিকে। আবার কবে ফিরবে? জীবনে কোনো গতি হবে ঢাকায়? শফিক হায়দারের অভ্যাস, লঞ্চে উঠলে ছাদে চলে আসা।
কিন্ত ঢাকায় কোথায় উঠবে? একটা ঠিকানার জন্যই শফিক গিয়েছিল লেবার পার্টির অফিসে।
তেলিখালীর পরই পূবালী লঞ্চ যে গ্রাম পার হচ্ছে, নিজের গ্রাম উজানগাঁও। ছাদে দাঁড়িয়ে তাকায় নিজের গ্রামের দিকে। কেউ ওর জন্য কাতর নয়। কেউ জানতেও চাইছে না, কোথায় যাচ্ছ? কেন যাচ্ছ? ফিরবে কবে? নিঃশব্দ গ্রাম পরে আছে, কয়েক মিনিটের মধ্যে অতিক্রম করে পূবালী দারুলহুদা গ্রামে পৌঁছায়। দারুলহুদা পার হয়ে পৌঁছে যায় ইন্দুরকানী আর পাড়েরহাটের ঠোডায়। ঠোডা পার হয়ে এসে নোঙ্গর করে পাড়েরহাটের উল্টো পারে, হেতালিয়া। নিজেকে লুকানোর জন্য শফিক লঞ্চের দোতলার ওপর মেশিনের ধোঁয়া উদগরিণের চোঙ্গের পাশে বসে। এলাকার লোকজন সাধারণত হেতালিয়া থেকেই লঞ্চে ওঠে। পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। সেই উত্তর দেওয়ার চেয়ে আড়ালে থাকাই ভালো। কিছুক্ষণ পর লঞ্চ ছেড়ে দিলে তাকিয়ে থাকে নদীর স্রোতের দিকে। অনেক নৌকা ভিড়ে আছে পাড়েরহাটের ছোট খালে।
পাড়েরহাট অতিক্রম করে লঞ্চ ঢোকে ভানডারিয়া পোনা নদীতে। পোনা নদী? মাথায় ঢোকে না শফিকের, এই বড় খালটা নদী কেন? প্রমত্তা কচা নদীর পেট চিরে এই খালটা ঢুকেছে ভেতরে, কিন্তু লোকেরা নদী বলে ডাকে। এই খালের মধ্যে লঞ্চ ঢোকে, সেই কারণেই নদী? মাথার ওপরে শান্ত নীল আকাশ। ভানডারিয়া থেকে লঞ্চ ছেড়ে আবার কচানদীতে পড়লে শফিক হাসান পেটে খেদে অনুভব করে। দুপুর পার হয়ে সূর্য হেলে পেড়ছে, বেশ পশ্চিমে। ক্ষুধা তো লাগবেই। লঞ্চে এখন এলাকার কারও সঙ্গে দেখা হলে, সমস্যা নেই। কারণ পরিচিত এলাকা পার হয়ে পূবালী লঞ্চ ছুটছে হুলারহাটের দিকে।
ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিচের তলায়, যেখানে মেশিন চলছে, তার পেছনে চলে আসে। পেছনে হোটেল। ছোট হোটেল। দুপুরের পর পর, প্রচুর যাত্রী খাচ্ছে। সাধারণত, লঞ্চের হোটেলে ইলিশ ভাজা থাকেই। ইলিশ ভাজার সঙ্গে ভাপ ওঠা গরম ভাত, পেটেরে খিদে আরও চাগিয়ে ওঠে শফিক হায়দারের। ঠাসাঠাসি ক্রেতারা খাচ্ছে গোগ্রাসে। এক-একজন খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বের হয়। দরজার কাছের একজন যাত্রী খাওয়া শেষ করে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢোকার জন্য পা রাখে শফিক। ঠিক সেই সময়ে একজন ক্রেতা কাউন্টারে দাঁড়ায়। মেসিয়ার জানায়, ভাইজানের বিল একশো আশি।
একশো আশি! নিজের মনে উচ্চারণ করে শফিক হায়দার। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে রাখা পা টেনে ফিরে দাঁড়ায় ও। সঙ্গে মাত্র তিরানব্বই টাকা। তাও খুচরো টাকা, এক বেলার খাবার একশো আশি টাকা! হোটেলের সামনে থেকে দ্রুত নিজেকে প্রত্যাহার করে লঞ্চের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। বিকেলের সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। লঞ্চের ছায়াও বড় আকারে পানির ওপর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। স্রোতের সঙ্গে বিশাল লঞ্চের ছায়ার দৌড় দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। পেটে খিদেটা চাগিয়ে উঠছে। কী করবে শফিক হায়দার? খিদে একদমই সহ্য করতে পারে না। বাড়িতে থাকলে একটা কিছু মুখে দেওয়া যেতো। ভাত সব দুপুরে না হলেও একেবারে না খেয়ে থাকে না। বেশি সমস্যা হলে বাগানের মধ্যে গিয়ে নারকেল গাছ থেকে হালকা শাঁসের নারকেল পেড়ে পানির সঙ্গে শাঁস খেলেই খিদে কোথায় পালায়! কিন্তু এখন এই পূবালী লঞ্চে কোথায় পাবে শাঁসঅলা নারকেল? মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে।
একবার প্রস্রাব করতে গিয়েছে লঞ্চের পেছনে। সেখানে টিউবওয়েলে পানি তুলতে দেখেছে। লঞ্চের সামনে থেকে হেঁটে পেছনে যায়। পেছনে গিয়ে টিউবওয়েল চেপে পানি খায় কয়েক আঁজলা। চোখে মুখে পানি দিয়ে আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। লঞ্চের টিকিট মাস্টার একটু দূরে কয়েকজনের টিকিট কাটছে। তেলিখালী থেকে ঢাকার টিকিট ষাট টাকা। ভানডারিয়া থেকে ঢাকার ভাড়া পঞ্চাশ টাকা। তিরানব্বই টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে টিকিট কিনলে ঢাকায় নামবে। যে শহরে কেউ পরিচিত নয়। সম্বল মাত্র একটা ঠিকানা। ১০/বি, সেগুনবাগিচা, ঢাকা। প্রেসক্লাবের সামনে। সেই ঠিকানার কাউকে চেনে না শফিক। সূত্র মিজনুর রহমান চৌধুরী। মিজানুর রহমানের পরিচয় কাকতলীয়ভাবে, ভানডারিয়া বন্দরে।
ভানডারিয়া বন্দরে পত্রিকা কিনতে আসতো শফিক হায়দার। হঠাৎ একদিন চোখে পড়ে বাংলাদেশ লেবার পার্টির একটা সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডের নিচে একটা অফিস। অফিসের মধ্যে ওরই বয়সের একটা সুন্দর ছেলে বসা। সাহস করে ঢুকে শফিক পরিচয় দিয়ে বলে, আমাদের গ্রামে লেবার পার্টির একটা অফিস করা যায় না?
অফিসের ছেলেটি খুবই উৎসাহ দেখিয়ে বলে, আমি মিজানুর রহমান চৌধুরী। আপনি চাইলে করা যায় পার্টির অফিস। আপনি দায়িত্ব নেন।
শৈশব থেকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন শফিক আরও আলোচনা করে মিজানের সঙ্গে। সেই সূত্রে কয়েকমাস আগে উজানগাঁওয়ে গিয়েছিল মিজান। একটা কমিটি হয়েছে, যদিও কমিটি নিয়ে দুই গ্রুপ ঝগড়া করেছে। পার্টির ফল যাই হোক, মিজানের সঙ্গে শফিকের সর্ম্পকের একটা ভিত তৈরি হয়ে যায়। এই ভিতটাই তৈরি করতে চেয়েছিল শফিক। পরিকল্পনা, তৃতীয়বার মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে আর উজানগাঁওয়ে থাকবে না। স্থির সিদ্ধান্ত লেখক হবে, লেখক হওয়ার জন্য ঢাকা ছাড়া উপায় নেই। কিন্ত ঢাকায় কোথায় উঠবে? একটা ঠিকানার জন্যই শফিক গিয়েছিল লেবার পার্টির অফিসে।
মেট্রিক পরীক্ষার পরই মিজানকে বলে, আমি ঢাকা যেতে চাই। কিন্তু কেউ নেই আমার। কোথায় উঠবো, জানি না। লেবার পার্টির অফিসে থাকা যাবে? সঙ্গে সঙ্গে মিজান বলেছিল, হ্যাঁ হতে পারে। আমি মামাকে বলে দেবো। আপনি যান।
মিজানের মামা মানে লেবার পার্টির প্রধান মাওলানা মতিন। সেই সূত্র ধরে শফিক লঞ্চে ক্ষুধায় কাতর হয়ে পানি খেয়ে নিচতলা থেকে ব্যাগ হাতে দোতলায় উঠে কেবিলের সামনের লম্বা ব্যলকনিতে দাঁড়ায়। দেখছে প্রবহমান নদী, নদীতে মাছ ধরছে নৌকার জেলেরা। হঠাৎ পাশের কেবিনের দরজা খুলে যায়, ভেতর থেকে বাইরে আসে অপূর্ব সুন্দর এক নারী। চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায়, ঘুম থেকে উঠেছে।
শফিক একটা পুরনো পত্রিকার ওপর বসে রুটি আর কলা খেতে শুরু করে। খাচ্ছে রুটি-কলা কিন্তু ঘ্রাণ পাচ্ছে ইলিশ মাছের!
নারী এত সুন্দর হয়? নিজের মনে প্রশ্ন জাগে শফিকের। অনেক বছর আগে, শৈশবে উজানগাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলে ডায়নামা চালিয়ে সিনেমা দেখানো হয়েছিল। জীবনে প্রথম সিনেমা দেখা। যতদূর মনে পড়ে, ফাইভে পড়তো শফিক। সেই ছবিতে দেখেছিল সুচন্দাকে। সুচন্দা ছিল নায়িকা। নায়ক রাজ্জাক। অনেক পরে, ঢাকার উদ্বাস্তু জীবনের দিনগুলোতে জেনেছে কুচবরণ কন্যা ছবির পরিচালক জহির রায়হান। সুচন্দার স্বামী। তো এই নারীকে দেখে মনে হয়েছিল সিনেমার সেই সুচন্দা এতদিন পরে, সামনে দাঁড়িয়ে। সালোয়ার কামিজ পরা মহিলা শরীরের আড়মোড়া ভেঙে হাই তোলে, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে তরঙ্গ তোলে। হাই তোলা শেষ হলে মহিলা লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়ায় শরীরটাকে হালকা ভাঁজ করে। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে শফিক হাভাতের চোখে। পেটের খিদেটা নেই একদম। সুন্দর দেখলে খিদে পালিয়ে যায়?
হঠাৎ এক ভদ্রলোক নিচ থেকে এসে মহিলার পাশে দাঁড়ায়, ঘুম ভাঙলো?
মহিলা হাসে, হ্যাঁ।
-ঘুম যে দিলে একটা!
মহিলা আবারও হাসে, লঞ্চে ঘুমুতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।
-তাইতে দেখি, যতবার আসা-যাওয়া করি, তুমি অধিকাংশ সময় ঘুমিয়েই কাটাও।
-ওই যে বললাম, লঞ্চের কেবিনে ঘুমুতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। কেউ ডিসটার্ব করে না। অখণ্ড অবসর। ঘুমের মধ্যে সময় কেটে যায়। আর সঙ্গে তুমি…
-স্যার, আনচি…
নিচের হোটেল থেকে একটা ট্রেতে দুই প্লেটা ভাত, ইলিশের বড় বড় দুই টুকরো, মুরগির মাংস নিয়ে সামনে দাঁড়ানো একটা ছেলে। ইলিশের গন্ধে শফিকের পেটের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া খিদেটা আবার ফিরে আসে। লোকটা ইঙ্গিতে ছেলেটাকে রুম দেখালে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে সে। ভেতরে প্লেটটা রেখে ছেলেটা বের হয়ে যায়। লোকটা আর মহিলা আরও কয়েক মিনিট দাঁড়ায়, হাসে। মহিলা হাসেও সুন্দর, জলের রেখায় ছায়ার মতো।
-চলো খাওয়া যাক। মহিলার হাত ধরে লোকটা কেবিনের মধ্যে ঢুকে যায়। ঠিক সেই সময়ে পূবালী লঞ্চটা ভেড়ে হুলারহাট বন্দরে। লঞ্চটা ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ পঁচিশ জন ফেরিঅলা ক্যাঙ্গারু লাফে লঞ্চে উঠে চিৎকার করতে থাকে, গরম গরম রুটি। এই লাগবে কলা, পাকা কলা, সাগরকলা। দেবো চিড়া ভাজা আর নারকেল। দেবো চিড়াভাজা নারকেল। সেদ্ধ ডিম লাগবে সেদ্ধ ডিম।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। শফিক দোতলার কেবিনের সামনে থেকে নিচে নেমে আসে। হুলারহাট থেকে প্রচুর যাত্রী উঠেছে। যেখানে পারছে বিছানা বিছিয়ে বসে পড়ছে। অবাক কাণ্ড, এক বয়স্ক লোক দুইটা ছাগল নিয়ে উঠেছেন। ভদ্রলোকের হাতে ছাগলের দড়ি। লঞ্চের দোতলায উঠবার সিঁড়ির রেলিংয়ের সঙ্গে বাঁধছেন। ছাগলদুটো একেবারে কালো। ভ্যা…ভ্যা…ভ্যা…দুটি ছাগলই তারস্বরে ডাকছে। ঘাসের মাঠ নয়, পূবালী লঞ্চের নিচতলায় এত মানুষের উপস্থিতি ভালো লাগছে না, জানান দিচ্ছে। ছাগলদুটি ভ্যা ভ্যা ভ্যা করতে পাশের এক যাত্রীর বিছনার ওপর গোল গোল লাদি হেগে দেয়। মধ্যে বয়স্ক লোকটা আয়েশ করে শুয়েছিল। ছাগলের লাদির বিছানায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে, ওই মেয়া, এইডা কি আপনেরে ঘর পাইছেন? উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াতে গিয়ে লোকটার পরনের লুঙ্গি অনেকটা নিচে পরে যায়, সঙ্গে সঙ্গে ধরে কোমরে বাঁধতে বাঁধতে ছাগলের মালিকের দিকে তেড়ে যায়। আশপাশের যাত্রীদের মধ্যে হাসির রোল ওঠে।
ছাগলের মালিক দুই হাত জড়ো করে, ভাইজান ছাগল অইচে বোবা পেরানি। না বুইজা কামডা সারছে। মুই এহনই পরিষ্কার কইরা দিতাছি।
তেড়ে আসা যাত্রী থেমে যেতে বাধ্য হয় বয়স্ক দাড়িঅলা লুঙ্গিপরা লোকটাকে হাত জোড় করতে দেখে। কিন্তু শরীরের রাগ কমে না, ছাগলের লাদি হালান, ছ্যাত কইরা হালান। এক্কেরে আমার বিছনাডা নষ্ট কইরা দেচে। ক্যমানে যে ঘুমামুআনে!
ছাগলের মালিক লুঙ্গি পরা বয়স্ক লোকটা খুব যত্নের সঙ্গে হাতে করে ছাগলের একটু আঠালো কিন্তু হালকা শক্ত লাদিগুলো দুহাতে ধরে নদীতে ফেলে দেন।
গোটা নিচতলাজুড়ে ফেরিঅলাদের হাক ডাক। দোতলার ওঠার সিঁড়ির গোড়ায় একজন ফেরিঅলা পাউরুটি আর পাকাকলা বিক্রি করছে। একটা পাউরুটি দুই টাকা আর একটা কলা আট আনা। শফিক একটা পাউরুটি আর দুইটা কলা কিনে দোতলার ছাদে উঠে আসে। চলে যায় লঞ্চের একেবারে পেছনে। রোদ পড়ে আসায় বেশ কয়েকজন যাত্রী ছাদে বসে গল্প করছে। অনেকে চিড়া-নারকেল কিনে খাচ্ছে। শফিক একটা পুরনো পত্রিকার ওপর বসে রুটি আর কলা খেতে শুরু করে। খাচ্ছে রুটি-কলা কিন্তু ঘ্রাণ পাচ্ছে ইলিশ মাছের!
চলবে…