(পর্ব-পঁচিশ)
ঘুম ভাঙলে মিলি চোখ মেলে তাকায়। কানে আসে অবাক শব্দের সুর, বাক-বাকুম বাক-বাকুম বাক-বাকুম। কিসের শব্দ? কারা করে? কোত্থেকে আসছে? মিলি উঠে বসে। বিকেল পার হয়ে গোধূলির মুখোমুখি সময়। চারদিকে নেমে আসছে আবছা অন্ধকার। ঘরের মধ্যে কেউ নেই। মুখটা তিতা এবং আঠালো লাগছে। কিন্তু ঘরের ভেতরে কেউ নেই কেন? হারামজাদা শিমুলটা কোথায়? ভাবতে ভাবতে মিলি খাট থেকে নামার জন্য দুই পা মাটিতে রেখেছে, ঢোকে রূপালী।
এগিয়ে আসে, ওমাগো ভাবি তুমি কত বড় একটা ঘুম দিলা! পাশে বসে, তোমার খিদে লাগে নাই? ও মা? মা? চিৎকার দিয়ে ডাকে রূপালী, দেহো ভাবী ঘুম দিয়া উঠছে।
সঙ্গে সঙ্গে রুমে ঢোকে পারুল বেগম। মিলির সামনে এসে দাঁড়ায়, পান খাওয়া মুখে হাসি, আহারে মাইয়াডার মুখ শুকাইয়া গেছে। পারুল খাইতে দে। হেই কহন খাইচে। পেডে দানা পানি না পড়লে মুখ হুকাইয়া যায়। দে তাড়াতাড়ি দে।
দিতাছি মা, মিলির হাত ধরে রূপালী আখতার, ভাবী লও মুখ ধুইবা না?
মাথা নাড়ায় মিলি, হ্যাঁ হাত মুখটা ধোওয়া দরকার।
লও তাইলে, দুজনে ঘরে থেকে বের হয়ে যায়। পারুল বেগম বিছানা ঝাড়ু দিয়ে নতুন করে সাজায়। ঘরের বাইরে এসে বিস্ময়কর ভালো লাগায় ভরে যায় মন। পেছনের দিকের উঠোন। উঠোনে বিশ পঁচিশটা পায়রা বাক-বাকুম বাক-বাকুম ডাকছে আর ধান খাচ্ছে। এমন অসাধারণ দৃশ্য কখনো দেখেনি মিলি। অবাক তাকিয়ে থাকে পায়রাগুলোর দিকে। একটা বাটিতে করে ধান বিছিয়ে দিচ্ছে শিমুল। দুপুরের পর এই প্রথম শিমুলের সঙ্গে দেখা। শিমুল কাছে আসে ধান বিছাতে বিছাতে…পায়রাগুলোও ওর সঙ্গে আসে। রুপালী হাত ছেড়ে দেয় মিলির, ভাবী তুমি ভাইয়ার লগে কতা কও। আমি পানি আনতেছি।
রূপালী চলে যায়। দুজন তাকায় দুজনের দিকে।
তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। ঘুম মাখা মুখ প্রথম দেখলাম তো…শিমুল হাসে।
সারাদিন কই ছিলে? অনুযোগ মিলির কণ্ঠে।
তোমার কাছেই ছিলাম।
দেখলাম নাতো।
কেমনে দেখবে? তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে। এই মাত্র উঠেছো। তুমি না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছো, মায়ের দুশ্চিন্তা যায় না। কতবার তোমার মুখ দেখে এসেছে। তোমার জন্য মায়ের মমতা দেখে খুব ভালো লেগেছে। বাবা বাইরে থেকে বার বার আসে, তোমাকে দেখার জন্য। অথচ তুমি ঘুমে। কী করবো আমি? ভেবেছিলাম একটু শুই, ভালো লাগবে। কিন্তু শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম—অনেকটা কৈফিয়তের সুরে বলে মিলি মাহজাবীন।
শুয়ে আছেন? মা আসমা রব্বানীর সমস্যা হলো, সংসারের বিকট কোনো ঝামেলা হলে মাথা ঘুরে পড়ে যান এবং কয়েকদিন হাসপাতালে থাকেন। মিলি ভাবছে, মা কি মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন? এখন কি হাসপাতালে? আর বাবা গোলাম রব্বানী?
ভাবী! হাতে অ্যালুমিনিয়ামের জগ নিয়ে আসে রূপালী আখতার। ধরে হাত, মা তোমার খাবার লইয়া বইসা আছে। হাত মুখ ধুয়ে চলো।
মিলিকে টেনে নিয়ে যায় পুকুরের পারে। পারে একটা জলচৌকি। জলচৌকি দেখিয়ে রূপালী বলেম, বসো জল চৌকির ওপর।
মিলি বুঝতে পারে, এই ছোট বসার তাকের উর বসতে বলছে রূপালী। বসে মিলি। এই নাও জগ, জগের পানি দিয়ে কুলি করো। তোমাগো শহরে কল টিপলে পানি আহে, ভাইয়া কইচে। আমাগো গেরামে ওসব নাই। জগের পানি দিয়া কাম সারো।
মিলি জগটা নিয়ে বসে থাকে। জগের পানি দিয়া কিভাবে কুলি করবে ও? কবুতরের খাবার দিয়ে বাটিটা রেখে কাছে আসে শিমুল, আমার হাতে দাও জগটা।
জগটা নিয়ে বলে, হা করো।
হা করে মিলি, মুখের মধ্যে অল্প পানি ঢালে জগ কাৎ করে শিমুল। মুখের বাইরে পানি ছড়িয়ে যায়। মিলি মুখ ঝাকিয়ে দাঁড়ায়, কি করলে? পানি সারা মুখে ছড়িয়ে পড়লো।
এইভাবে কেমনে কুলি হরবে মাইয়া? পেছনে এসে দাঁড়ায় পারুল বেগম। আমার কাছে দে, শিমুলের কাছ থেকে জগটা কেড়ে নেয় পারুল বেগম, মাইয়া তুমি বও জলচৌকির ওপর।
বসে মিলি।
তুমি দুই হাত পাতো।
তাকায় শিমুলের দিকে। শিমুল দুই হাতে অঞ্জলি পাতা দেখায়। সঙ্গে সঙ্গে মিলি অঞ্জলি পাতে। পারুল বেগম জগ থেকে পানি ঢালে মিলি অঞ্জলিতে, এহন মুখে দিয়া মুখ ধোও…কুলি কর…।
মিলি পানি মুখে নিয়ে কুলি করে, আবার পানি ঢালে মিলি অঞ্জলিতে পারুল বেগম। খুব দ্রুত পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে দাঁড়ায় মিলি। রূপালী একটা তোয়ালে এগিয়ে দেয়, নাও ভাবী। মোছো…
তোয়ালে নিয়ে মুছতে মুছতে ঘরের দিকে এগোয় মিলি, শিমুল, রূপালী, পারুল বেগম। পায়রাগুলো এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আধার খাচ্ছে। মোরগ মুরগীগুলো কক কক ডাকছে উঠোনের চারদিকে। সন্ধ্যা নামছে চারদিকে। রূপালীর পিছু পিছু ঘরের মধ্যে ঢোকে সবাই। ঘরে ঢুকেই সামনে দেখতে পায় একজন বয়স্ক পুরুষ সামনে দাঁড়িয়ে। শরীরে পানজাবি। নিচের দিকে লুঙ্গি। শরীরের রঙ তামাটে বর্ণের। মুখে হালকা দাড়ি। কিন্তু চোখ দুটো উজ্জ্বল আলোয় পরিপূর্ণ।
মাইয়া, তোমার শ্বশুর।
মিলি সঙ্গে সঙ্গে নুয়ে দুই পায়ে সালাম করে। শ্বশুর শামসুদ্দিন হাত ধরে তোলে, বাঁইচা থাকো মা। বাঁইচা থাকো। তাকায় রূপালীর দিকে, মারে বৌয়ের মুখতো হুকনা। এহনও খাইতে দেও নাই?
দিতাছি আব্বা।
বউ, তোমরা শহরের মাইয়া। গেরামে আইচো। খুব কষ্ট অইবে। মাইনা লইও। তাকায় শিমুলের দিকে, শিমুল বউয়ের দিকে খেয়াল রাহিস।
চলে যায় শামসুদ্দিন। মিলির মনে হলো, জীবনে প্রথম একজন সাধকের সামনে দাঁড়িয়েছিল। এমন সহজ এমন সরল মানুষ জীবনে আর দেখেনি। সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে পিতা গোলাম রব্বানীর মুখ উপস্থিত হয়। কত ব্যবধান দুটা মুখের মধ্যে!
ভাবী বও, আগে খাও পরে কথা কও।
টেনে বসায় রূপালী আখতার খাটের ওপর। খাটের পাশে টেবিলের ওপর চোখ রেখে অবাক মিলি মাহজাবীন। কত ধরনের খাবার?
এত খাবার? প্রশ্ন মিলির।
হাসে পারুল বেগম, হয় তোমার লাইগা বানাইচি। মোরা তো জানি না, তুমি কী পছন্দ কইরা খাও। যা তোমার ভালো লাগে, খাও। শরম কইরো না।
চলে যায় পারুল বেগম। শিমুল আর রূপালী সামনে দাঁড়ানো। ভাবী, বলে রূপালী, আগে দেহো তুমি কী খাইবা। খাবারের ঢাকনাগুলো তোলে। সবার আগে চোখে পড়ে ইলিশ মাছ। আর সাদা রূপালী ভাত।
আমি ভাত খাবো ইলিশ মাছ দিয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে রূপালী আখতার একটা প্লেটে ভাত আর ইলিশ মাছের একটা বড় টুকরো তুলে দেয়। ভাত মেখে খেতে শুরু করে মিলি। মুখে দিয়ে অন্যরকম একটা স্বাধ পায়। কয়েক লোকমা মুখে দিয়ে তাকায় শিমুলের দিকে, তুমি খেয়েছ?
মাথা নাড়ে শিমুল, খেয়েছি। তুমি খাও। রূপালী, পানির গ্লাস আন।
দাঁতে জিবহায় কামড় দিয়ে দ্রুত বের হয়ে যায় রুম থেকে। লজ্জা পেয়েছে,সব খাবার আনা হয়েছে, পানির জগও দেওয়া হয়েছে খাবার টেবিলের ওপর কিন্তু গ্লাস দেওয়া হয়নি।
তুমি বসো আমার সঙ্গে—অনুনয় করে মিলি।
ঠিক আছে, একটা প্লেট টেনে নিয়ে বসে শিমুল। প্লেটে নেয় ভাত আর গরুর মাংস। দুজনে খায়। খেতে খেতে তাকায় শিমুল।
মিলি?
বলো।
কেমন লাগছে?
কী, কেমন লাগছে?
আমাদের বাড়ি, বাবা মা ভাইবোন?
পরে বলবো। মিলি ভাত নিয়ে আবার মাংস নেয় পাতে। মাংসের সঙ্গে ভাত মুখে দিয়ে ঝাল লাগে। মুখ খুলে ঝালের জন্য হা হু করতে থাকে, রূপালী গ্লাস নিয়ে ঢোকে, জগ থেকে পানি ঢেলে এগিয়ে দেয় মিলির দিকে। মিলি পানি খেয়ে মুখের ঝাল কমায়।
আমরা মাংসে ঝাল খাই ভাবী, বলে রূপালী আ্খতার। তাইলে বাইন মাছ দিয়ে খাও, গরুর মাংস রেখে দাও।
না, চেষ্টা করি, মিলি আবার মাংস আর ভাত মুখে দেয়। ঝালে ওর মুখে কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। রূপালী খাটের ওপর রাখা তালপাখা দিয়ে বাতাস করে, তুমি ঘামছ তো। কষ্ট করে খাওয়ার দরকার নাই ভাবী। তুমি আর একটা প্লেটে রাইখা দাও।
না, আমার অভ্যাস করতে হবে না? মিলির গলায় জেদ।
শিমুল হাসে, তুমি হাসো কেনো?
এক কাজ করো, মাংসের সঙ্গে পাতলা ডাল মিশিয়ে নাও, ঝাল অনেকটা কমে যাবে।
হয়, ভাইজানে ঠিক কইচে, পাখা রেখে রূপালী বাটি থেকে পাতলা ডাল ঢেলে দেয় মিলির পাতে। মিলি পাতলা ডাল, গরুর ঝাল মাংস আর সাদা ভাত মিলিয়ে মুখে দেয়।
কেমন লাগছে?
শিমুলের প্রশ্নের উত্তরে বলে মিলি, মজা। ঢাকায় তো এইভাবে কখনো খাইনি। আসলে গ্রামের খাবারের মধ্যে স্বাদের বৈচিত্র্য আছে।
ধুম ধাম শব্দের মধ্যে ঘরে ঢোকে তমাল। তমালের শরীর ভেজা। পড়নে একটা গামছা। ভেজা লুঙ্গি হাতে। পেছনে জগদীশ । ওরও একই অবস্থা। রুমের মধ্যে ভাই ভাবী বোনকে দেখে লজ্জা পেয়ে আর এক দৌড়ে পাশের ঘরে ঢোকে।
ওরা কোথায় ছিল? জানতে চায় মিলি।
আপনে তো আইচেন, দেখবেন তমাল সাহেবের কাণ্ড। হেরা ফুটবল খেইলা আইচে, জবাব দেয় রূপালী আখতার। শরীর ভেজা কেন?
গ্রামের মাঠে ফুটবল খেললে শরীরে কাদা লাগে। ফুটবল খেলার পর খালের পানিতে গোসল করা আমাদের পুরনো অভ্যাস, হাসতে হাসতে বলে শিমুল।
ও। তুমি খেলেছ?
খেলবো না? ফুটবল হাডুডু কত খেলেছি! আমি তো হায়ারেও খেলতাম।
হায়ার কী?
ধরো আমাদের পাশের ইউনিয়নে ফুটবল খেলার আয়োজন করা হলো। তো যারা আয়োজন করতো তারা আশেপাশের গ্রাম থেকে ভালো ভালো খেলোয়াড় দাওয়াত নিয়ে নিতো, ওদের দলের হয়ে খেলার জন্য। আমি ভালো ফরোয়াডে ভালো খেলতাম। ফলে অনেক বার আমি আমাদের উজানগাঁও গ্রামের বাইরে খেলতে গেছি নাইনে টেনে পড়ার সময়ে। ওরা এক একজন প্লেয়ারকে টাকা দিতো…আর সম্মান ছিল কত!
তুমি যে ভালো প্লেয়ার, সেটা শৈশব থেকেই প্রমাণিত!
ঘাড় নাড়ে শিমুল, তোমার কোনো সন্দেহ আছে?
সন্দেহ থাকলে কি আর এখানে আসি! হাসে মিলি মাহজাবীন।
খাওয়া শেষ হলে প্লেট নিয়ে চলে যায় রূপালী আখতার। যাওয়ার আগে অনেকগুলো বাটি দেখিয়ে বলে, ভাবী এইসব বাটিতে পিঠা আছে, পায়েশ আছে। খিদা লাগলে খাইয়েন। আর জগভরা পানি আছে। কিছু লাগলে আমারে ডাক দিয়েন।
ঘাড় কাৎ করে মিলি, ঠিক আছে।
খাওয়ার পর শরীরটা চনমন করে ওঠে মিলি মাহজাবীন। মনটা অদ্ভুদ ভালোলাগায় ভরে যায়,বাড়িটার পরিবেশ, শ্বশুর শাশুড়ি ননদ ননদীর আদর আপ্যায়নে মুগ্ধ। যতটা ভয় আর দুশ্চিন্তার সঙ্গে শিমুলের সঙ্গে যাত্রা করেছিল অনেকটা খেয়াল আর জেদের কারণে, সেই ভয়টা নেই। হ্যাঁ, ঢাকায় অনেক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছে, নিজে অনেক বিয়ের অনুষ্ঠানে আত্মীয়দের বান্ধবীদের হয়ে দায়িত্ব পালন করেছে, কত আনন্দ উল্লাস হৈ চৈ আর নাচ গান জৌলুস…সেই তুলনায় শিমুলের গ্রামের বাড়িতে কিছুই হয়নি, হওয়া হয়তো সম্ভবও না। কিন্তু মানুষগুলোর সহজ সরল আন্তরিকতায় ওকে গ্রহণ করায় গোটা চিত্রকল্প পাল্টে যায় মিলির। গ্রামের মানুষের এই সহজিয়া রূপ ওকে একেবারে আকুল করে তুলেছে।
গান শুনবে? পাশে বসে শিমুল।
গান? তুমি গাইবে?
হাহাহা হাসে শিমুল, আমার গান শুরু হলে মানুষ বিড়াল পিপড়া কুকুর সব ছুটে পালাবে।
তাহলে কিভাবে গান শুনবো?
ব্যবস্থা করছি, শিমুল ডাকে, তমাল? তমাল?
জে, তমাল সামনে এসে দাঁড়ায়। মাথার চুল তেল দিয়ে আঁচড়ানো। গায়ে হাফ হাতার জামা। মুখে ঈষৎ হাসি।
তোর ভাবীরে কেমন লাগলো?
মাথা নিচু করে বুকের ওপর রাখে থুতনি, কিরে কথা বলছিস না কেন?
তমালের লজ্জামখা মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে মিলি মাহজাবীন। ছেলেটার মুখটা কী পবিত্র আর বর্ণিল! খাট থেকে নেমে মিলি দাঁড়ায় তমালের সামনে, নামিয়ে আনে মুখ,আমি দেখতে পচা?
নাহ !
তুমি মুখটা নিচু করে আছ কেন? তাকাও আমার দিকে, মিলি দুহাতে তুলে ধরে তমালের মুখ।
আমি যাইগা—এক ছটকায় নিজেকে মুক্ত করে ঘরের দিকে ছোটে। শিমুল হাসে, এই বান্দর, ট্রানজিস্টারটা দিয়ে যা।
ট্রানজিস্টার? চেয়ারে বসা শিমুলের কাছে দাঁড়ায় মিলি।
হ্যাঁ, ট্রানজিস্টার। আমাদের একটা ট্রানজিস্টার আছে। এখন তো টিভি আর মোবাইলের যুগ । কিন্তু আমরা ছোটবেলা থেকে ট্রানজিস্টার শুনে শুনে বড় হয়েছি। এখনো আছে—শোনো, ভালো লাগবে। কইরে তমাল?
তমাল ট্রানজিস্টার হাতে ঢোকে রুমে। রাখে টেবিলের ওপর। কাঠের বড় একটা ট্রানজিস্টার। বাইরেটা কাপড়ের ঝালর দিয়ে ঘেরা। শিমুল ট্রানজিস্টার হাতে নব ঘোরাতে শুরু করে, কয়েক মুহূর্ত পর বাজে, বাংলাদেশ বেতার। এখন শুনবেন নজরুল সঙ্গীত। শিল্পী খালিদ হোসেন। শুরু হয় গান, ‘আমায় নহে গো ভালোবাসো, ভালোবাসো শুধু মোর গান/ বনের পাখিরে কে চিনে রাখে গান হলে অবসা ।’
জীবনে প্রথম ট্রানজিস্টার শুনছে মিলি মাহজাবীন। ঢাকা শহরের বাইরে, শত শত কিলোমিটার দূরে এক নিভৃত গ্রামে রাতের প্রথম প্রহরে স্বামীর পাশে বসে ট্রানজিস্টারে নজরুল সঙ্গীত শুনবে, দুদিন আগেও ভাবেনি। জীবন কিভাবে পাল্টে যায়! খালিদ হাসেন দরদি ভরাট গলায় গাইছেন, ‘চাঁদেরে কে চায়, জোছনা সবাই যাছে/গীত শেষে বীণা পড়ে থাকে ধূলি মাঝে।’
চক্ষু মুদ্রিত করে গানটা শুনছে মিলি। শুনতে শুনতে মনে পড়ে যায় মাকে, আসমা রব্বানীকে। মা! কেমন আছেন? অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? শুয়ে আছেন? মা আসমা রব্বানীর সমস্যা হলো, সংসারের বিকট কোনো ঝামেলা হলে মাথা ঘুরে পড়ে যান এবং কয়েকদিন হাসপাতালে থাকেন। মিলি ভাবছে, মা কি মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন? এখন কি হাসপাতালে? আর বাবা গোলাম রব্বানী?
খালিদ হোসেন গাইছেন, ‘তুমি বুঝিবে না, তুমি বুঝিবে না, তুমি বুঝিবে না…আলো দিতে কত পোড়ে প্রদীপের প্রাণ/ভালোবাসো মোর গান।’
হাত ধরে শিমুল, কী ভাবছো?
অস্ফুট ভাবনার সঙ্গে বলে মিলি, কিছু না।
একটা কিছুতো ভাবছো। ট্রানজিস্টার বন্ধ করে দেবো?
না, শুনি। জীবনে প্রথম শুনলাম তো।
মিলি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ে শিমুলের বুকের ওপর, ওসব কী?
আর কখনো ট্রানজিস্টার শোনো নাই?
নাহ, মৃদু হাসে মিলি।
ভাবী? ডাকে তমাল।
চোখ তুলে তাকায় মিলি, বলো তমাল?
ঢাকা ভালো না, মো গো গেরাম ভালো? লাজুক গলায় জানতে চায় তমাল।
হাসে মিলি, গ্রাম ভালো।
হাঁচাই?
ঘাড় নাড়ে মিলি, সত্যি বলছি গ্রাম ভালো। কারণ গ্রামে তুমি আছো তো , তাই!
ইসরে… হাসতে হাসতে চলে যায় তমাল।
ভাইজান? পাশের ঘর থেকে ডাক দেয় রূপালী আখতার। পড়তে বসেছে।
কী রে?
আপনে ভাবীরে লইয়া পুকুরপাড়ে যান। চান উটছে।
চাঁদ উঠছে? চঞ্চল হয়ে ওঠে শিমুল, হাত ধরে মিলির, চলো। চাঁদ উঠেছে, গ্রামের জোছনা দেখবে।
চলো।
দুজনে হাত ধরাধারি করে পেছনের উঠোনে নামে, চতুর্থদশীর ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ আকাশে। আম জাম কাঠাল আমড়া গাছের পাতার ফাঁক গলে চাঁদের জোছনা গলে গলে পড়ছে। চারপাশটা কেমন উদাস আর পরাণ কেড়ে নেওয়া এক আবেগে চরাচর ভেসে যাচ্ছে। জোছনার এই সর্বগ্রাসী সৌন্দর্য রূপ দেখে মুগ্ধ মিলি মাহজাবীন চোখ ফেরাতে পারে না। ঢাকা শহরে কখনো চাঁদের জোছনা দেখেছে মনে করতে পারে না। আর একটু সামনে এগিয়ে পায় পুকুর। পুকুর স্বচ্ছ পানির মধ্যে বাঁকা চাঁদের হাসি আর জোছনা দেখে দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। শিমুল পায়ের কাছ থেকে একটা ঢিল তুলে ছুড়ে মারে। পানির ওপর হালকা ঢেউ উঠে। চাঁদ, চাঁদের আলো জোছনা ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে যায় ঢেউয়ের সঙ্গে।
বিরক্ত মিলি, তুমি চাঁদটাকে বিরক্ত করছ কেনো?
তোমার জন্য। দেখো কিভাবে জোছনা আর চাঁদ পানির মধ্যে হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে!
মিলি অপলক দৃষ্টিতে পানির মধ্যে চাঁদ আর জোছনার মিলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে, ঢেউ হারিয়ে যাওয়ার পর চাঁদের আর জোছনার আগের জায়গায় ফিরে আসা দেখে, এমন করে কখনো দেখা হয়নি।
স্বাভাবিক, কারণ তোমার জীবনের সঙ্গে এই জীবন তো ছিল না মিলি। হাত ধরে ঘনিষ্ঠভাবে বুকের সঙ্গে ঝাপটে ধরে, মিলি তখন তো বললে না, এখন বলো।
কী বলবো?
কেমন লাগছে?
খুব খুব খুব ভালো লাগছে। হ্যাঁ আমার টেনশন ছিল, আমার ভয় ছিল, আমার ভীষন রকম দুর্ভাবনা ছিল, কিন্তু তোমার বাবা মা ভাইবোন আর বাড়ি দেখে, আমাকে যেভাবে গ্রহণ করলেন সবাই, আমি মুগ্ধ। আমার কোনো কষ্ট নেই। আমি জগতের সুখী একজন মানুষ।
আমার ভাবনাটা গেলো। খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
হাত ছেড়ে দিয়ে পুকুরের দিকে একটা পা বাড়িয়ে চাঁদ আর জোছনা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে মিলি, আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলে?
থাকাটা স্বাভাবিক না? কথা শেষ হতে পারে না, বাড়ির সামনের দিকের পরের ঘন জঙ্গল থেকে তার স্বলে ডেকে ওঠে কয়েকটা খেক শিয়াল—হু হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া।
মিলি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ে শিমুলের বুকের ওপর, ওসব কী?
চলবে…
মোকাম সদরঘাট-২৪॥ মনি হায়দার