পর্ব-২২
স্কুল ছুটির পর শফিক বাড়ির দিকে হাটতে থাকে। গ্রাম তো, অধিকাংশ মানুষই লুঙ্গি পরে। মাঝেমধ্যে দুই-একজনে প্যান্ট বা পাজামা পরে। দক্ষিণ সূতালড়ির এইজ এম জে কে এম হাই স্কুল থেকে লজিং বাড়ি প্রায় দুই মাইল। আসা-যাওয়ার পর গ্রামীণ মাঠ ঘাট আর ধান উঠে গেলে খোলা জমিন। পথের পাশে পাশে শীতের সময় খৈ গাছে ফুটে থাকে খৈ। ছাইরঙের কাঁটাঅলা গাছ। গাছটা এক নাগাড়ে লম্বা হয়ে ছোট ছোট কাঁটাঅলা ডালে ভরে যায়। সেই ডালের মাথায় সিমের মতো ফুল হয়। সিমের মধ্যে যেমন বিচি থাকে, ওই গাছের সেই সিমের মধ্যে থাকে ঝুনা নারকেলের মতো মিষ্টি সুগন্ধঅলা শাঁস। যেহেতু কাঁটাঅলা গাছ, সেই গাছে ওঠা কঠিন, ফল পেকে পেকে রঙিন হয়ে মাটিতে পড়ে। ছেলে বুড়ো সবাই কুড়িয়ে খায়। শফিকও আসা যাওয়ার পথে খৈ ফুল কুড়ায়। মুখে দিয়ে চিবোয়…চমৎকার স্বাদ!
স্কুল থেকে লজিং বাড়ি পর্যন্ত এলোমলো গ্রামীণ পথ, পথের সঙ্গে মায়ের মাথার সিঁথির গতির চিকন একটা খাল। খালে অল্প পানি, পানির সঙ্গে জলজ লতাগুল্ম। সেই লতাগুল্মের জলের গহীনে সাঁতার কাটে ছ্টো ছোট মাছ। শফিক বিকেলে স্কুল ছুটির পর সেই ঘাসের ঘ্রাণ ছড়ানো পথ, লতাগুল্মের খাল পার হয়ে আসে তোবারক হোসেনের বাড়ি।
দুপুরের খাবার খায়। বাড়ির মধ্যে আরও একটি আশ্রিত পরিবার। বাবা, মেয়ে। বাবা হেকমত হোসেন দূর সম্পর্কের আত্মীয় তোবারক হোসেনের। মহাজনের কাছে সব হারিয়ে তোবারক হোসেনের কাছে মেয়ে আর মেয়ের কোলে চার পাঁচ বছরের এক নাতিসহ আশ্রয় নেয়। তোবারক হোসেন ঘরের পেছনে বারান্দায় থাকার ব্যবস্থা করে। হেকমত বাড়ির সব কাজ করে, নারকেল গাছ বায়, পরিষ্কার করে, পুকুরের মাটি কাটে, মাছ ধরে, তিন জনের কোনোভাবে চলে যায়। অবসরে বাড়ির সামনে সোঁথা খালের সামনে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর যৌবনের গল্প বলে শফিক হায়দারের কাছে। শফিক খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে হেকমতের ঘটনা। কিন্ত তবারক হোসেন শফিক আর হেকমতের মধ্যে এই সম্পর্কটা পছন্দ করে না। তবারক হোসেনকে ডেকে জানিয়ে দেয়, তুমি আমার আত্মীয়। আর ওই ছেলেটা লজিং থাকে আমার বাড়ি। ওর সঙ্গে এত কী কথা তোমার?
না, আমার জীবনের ঘটনা বলি ছেলেটার কাছে, মিনমিনে গলায় জবাব দেয় হেকমত।
তোমার আবার জীবন? আবার সেই জীবনের ঘটনা! বাদ দাও ওসব। তোবারকের নির্দেশ মানতে হয় হেকমতের। কিন্তু তোবারক হোসেন যখন গঞ্জে যায় সারাদিনের জন্য, তখন হেতমত আলী পরাণের গোপন দুয়ার খুলে বসে শফিকের কাছে। মানুষটা বলতে খুব ভালোবাসে নিজের জীবনের ঘটনা। হালকা পাতলা গড়নের মানুষটির মুখে কয়েক গাছি সাদা দাড়ি। একজন মানুষ, যার কিছুই নেই। নিজের বাড়ি ঘর নেই, স্ত্রী নেই, একটা বিবাহিত মেয়ে নিয়ে দূর আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন, সেই মানুষটারেও জীবনের অনেক বলা ঘটনা আছে, অবচেতনে শফিক নিজেও কি হেকমত হোসেনের সঙ্গী?
মেয়েটা, লীনার সঙ্গে তেমন কোনো কথা হয় না। একটা বাড়ির মধ্যে থাকলে না চাইলেও দুজনের মধ্যে দেখা হয়্। কথা হয়। লীনা নতুন দোতলা বাড়ির দোতলার রুমে থাকে।
দিন যায়, আর মাত্র দুটি দিন আছে। তোবারক হোসেনের দেওয়া মাসের শেষ তারিখ এসে পড়ছে, বিমল সমাদ্দর এখনো নতুন লজিংয়ের কোনো খবর দিতে পারেনি। নিজের কাছে আছে আড়াই টাকা। কী করবে, কোথায় যাবে, কাকে বলবে বাড়ি থেকে শত মাইল দূরের গ্রামে বালক শফিকের দুঃসহ ঘটনা? কেউ শোনার নেই। বিকেলে, সন্ধ্যার আগে তোবারকের বাড়ির সামনে খালের ওপর ছোট সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে মাথার ওপর চোখ রাখে, আকাশজুড়ে দেখতে পায় হোসনে আরার কালো গহিন দৃষ্টি। কী অনিন্দ্য সুন্দর দৃষ্টি! চোখ ফেরাতে পারে না হোসনে আরার আকাশ চোখ থেকে।
দিন চলে যায়। বিমল সমাদ্দার বলছেন, চেষ্টা করছি। কয়েকটা বাড়িতে জানিয়েছি আমি। শিগগিরই একটা ভালো খবর দিতে পারবো। ক্লাসে হোসনে আরা চোখে চোখ রাখে না। কঠিনভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। শফিক হাসে, মেয়েটি অভিমান করেছে। কিন্তু আমি কেমন করে বলি, আমার জগৎ শূন্য!
মাসের শেষ দিন, রাতে খাবার খেয়ে ঘুমিয়েছে শফিক তবারকের বাড়ি। সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় আর নাস্তা আসে না। না খেয়ে স্কুলে যায় শফিক। সারা দিন ক্লাস করে বিকেলে বাড়ি ফেরার সময়ে আট আনার চিড়া কিনে আনে শফিক। হেকমতের কাছ থেকে কিনারা উঁচু একটা থালা এনে চিড়া ভেজায়, বেশি পানিতে। চিড়া ভিজিয়ে পড়তে বসে। আজ আর পড়তে আসে না তোবারক হোসেনের নাতিরা। নিজের রুমে একলা শুয়ে শফিক। টিনের চালে দেখে টিকটিকির ছোটাছুটি।
রাতে লবণ দিয়ে চিড়ার পানি খেয়ে ঘুমিয়ে যায় শফিক। সকালে উঠে খালি মুখে স্কুলে যায়। বিমল স্যারকে জানায়, স্যার আমার খাবার বন্ধ করে দিয়েছে তোবারক চাচা।
খাবার বন্ধ করে দিয়েছে? বিমল সমাদ্দরের কালো রঙের চোখে বিষাদের ছায়া। আর একটু কষ্ট কর…হয়ে যাবে নতুন একটা লজিং।
আবার দোকান থেকে আট আনার চিড়া কিনে লজিং বাড়ি ফেলে শফিক হায়দার। শরীরটা অবসন্ন। একমাত্র খাওয়া পানি। বালক মাত্র, কার কাছ থেকে নেবে পরামর্শ, বুঝতে পারছে না। বাড়ি যাবে? গিয়ে কী করবে ভগ্ন বাড়িতে? বিধবা মা দুটি বোন আর ছোট একটা ভাই নিয়ে দিশেহারা। সৎ দুই ভাইয়ের আশ্রয়ে দিন আনা দিন খাওয়ায় টিকে আছে।
আমি বাড়ি না গেয়ে খাওয়ার একটা মানুষ তো কম হবে, রাতে বাড়ির সামনে খোলা মাঠের সবুঝ ঘাসের ওপর গামছা বিছিয়ে চিৎ শুয়ে আকাশ দেখে। কালো আকাশে কি ভাগ্যর কোনো রেখা দেওয়া যায়? ভাগ্য? তাকায় হাতের কড়ের দিকে, হাতের এই দাগগুলো নাকি ভাগ্যরেখা? আমার ভাগ্য কোথায়? কতদূর? কার বাড়িতে ঘুমায়? পেটে তীব্র খিদে। মোচড়ায়। পুবের আকাশে আধখানা চাঁদ বাঁকা হাসিতে জেগে উঠেছে। খিদের জ্বালায় মাঠ থেকে বাড়িতে, নিজের ছোট্ট রুমটায় আসে। টেবিলের ওপর খাড়া থালে চিড়া ভিজানো থালা দিয়ে ঢাকা।
ঢাকা বইটা তুলে কেবল বসেছে, দরজা খুলে যায়। হেকমতের মেয়েটা দাঁড়িয়ে, হাতে একটা টিনের থালা। থালায় গরম ভাত, আলু ভর্তা আর একটা ডিমের অর্ধেক।
দ্রুত ঘরে ঢুকে থালাটা রেখে চলে যায় আরও দ্রুত। শফিক হায়দারের কিছু করার থাকে না, দয়ামায়া, অনুগ্রহ; যাই হোক, তিন দিন তিন রাত পেটে কোনো ভাত নেই, চিড়া, চিড়ার পানি আর পানি ছাড়া। চিড়ার থালাটা সরিয়ে রেখে ভাতের থালা টেনে নেয় সামনে। ভাত মুখে দিয়ে মনে হয়, জীবনে এত মধুর স্বাদের ভাত আর খায়নি। খাড়া টিনের প্লেটে তবারক হোসেনের বাড়িতে আশ্রিত মেয়েটি অনেক ভাত দিয়েছে। আলুভর্তা আর অর্ধেক ডিম দিয়ে ভাত খাওয়ার পর, দুই গ্লাস পানি খায় শফিক। আহ! ভাত, এক প্লেট ভাত!
শরীর তিন দিন পরে ভাত পেয়ে লাগাম ছেড়ে দেয়, শুয়ে পড়ে বিছনার ওপর। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে যায় শফিক হায়দার। সকালে উঠে স্কুলে যায়। বড় আশা, বিমল স্যার নিশ্চয়ই আজ নতুন একটা লজিংয়ের খবর দেবেন। পকেটে আছে আট আনা। আর এক খাড়া প্লেট চিড়ার দাম…। কী হবে আগামীকাল? না, বিমল স্যার কোনো ভালো খবর দিতে পারেন না। কিন্তু ভরসায় রাখছেন, শফিক আমি চেষ্টা করছি, আর দুই-একটা দিন, ঠিকই হয়ে যাবে লজিং।
লাল মিয়া স্যারের ইতিহাস ক্লাস শেষ। শরীরে শক্তি পায় না শফিক। চুপচাপ বসে থাকে রুমে। ছাত্ররা যে যার মতো টিফিন পিরিয়ডের জন্য বাইরে। একটা বই পরে যায় হোসনে আরার হাত থেকে। পরে যায় না, ফেলে দেয় হোসনে আরা। বইটা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য রুমে থাকে। সবাই বের হয়ে যায়, বেঞ্চে নিজের জায়গায় বসে দেখছে শফিক। বইটা কুড়িয়ে সামনে দাঁড়ায়, সমস্যা কী আপনার?
আমার কোনো সমস্যা নেই তো, শুকনো মুখে জবাব দেয় শফিক হায়দার।
আপনার চেহারা দেখেছেন?
আয়না তো এখানে নেই।
আপনি একটা বদমাইশ মানুষ।
জানতাম না তো।
আমার কাছে পাঁচশো টাকা আছে, বুকের ভেতর থেকে বের করে হোসনে আরা, দ্রুত রাখে বইয়ের আড়ালে। পরে শোধ দিয়েন। আর অত ব্যাটাগিরি দেখানোর দরকার নেই…মুখে একটা ভেংচি কেটে চলে যায়। পাথর হয়ে বসে থাকে শফিক। কী করবে? হোসনে আরা কেন আমাকে পাঁচশত টাকা দিয়ে গেলো? কেন মুখে অমন মধুর ভেংচি কাটলো? বাইরে থেকে ক্লাসের দিকে কারও আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত টাকাটা পকেটে রাখে।
বিকেলে লজিং বাড়ি যাওয়ার সময়ে শেষ পঞ্চাশ পয়সায় চিড়া কেনে শফিক। কালকে কী হবে? বুঝতে পারছে না। যদিও পকেটে আছে হোসনে আরার পাঁচশত টাকা। কী করবে এই টাকা দিয়ে? বাড়ি ফিরে খাড়া থালায় চিড়া ভেজায় শফিক। পেটটা লেগে গেছে পিঠের সঙ্গে। এ কদিনে একবারও দেখা হয়নি তোবারক হোসেনের সঙ্গে। এটা নতুন বাড়ি। অধিকাংশ সময়ে থাকেন পুরনো বাড়িতে। খবরা খবর নেন হেকমত হোসেনের কাছে। একটা বিষয় ভাবছে বিছানায় শুয়ে, খেতে দেয়নি, এখনো বের করে তো দেয়নি। যদি বের করে দেয়, এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কী করবে? কার কাছে কোন বাড়ি গিয়ে বলবে, আমাকে একটু থাকার জায়গা দিন।
পরের দিন সকালে সর্বশেষ চিড়া পানি খেয়ে স্কুলে যায় শফিক হায়দার। বিমল সমাদ্দার স্যার হাসি মুখে জানান, তোমার নতুন লজিং হয়েছে।
সেই দিন ক্লাস করে বিকেলে নতুন লজিং বাড়িতে যায় শফিক, বিমল সমাদ্দারের সঙ্গে। বিরাট বাড়ি জহির ব্যাপারীর। জোতদার টাইপের মানুষ। দুই স্ত্রী। বড় বউয়ের এগার বছর ধরে বাচ্চা না হওয়ায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন জহির ব্যাপারী। ছোট বউয়ের গর্ভে পর পর তিনটি বাচ্চা হওয়ার পর বড় বউয়ের গর্ভেও একটা বাচ্চার জন্ম হয়।
বাচ্চাটা মেয়ে, বিউটি। একটু বোকাসোকা টাইপের। গায়ের রঙটা দুধেআলতা সুন্দর। পড়ে ক্লাস টুয়ে কিন্তু মাথায় নেই ঘিলু। কিছুই মনে রাখতে পারে না। বড় বউয়ের বড় শখ, বিউটি লেখাপড়া শিখুক। বউয়ের পরামর্শ শোনে জহির ব্যাপারী। দক্ষিণ সূতালড়ির হাই স্কুলের শিক্ষক বিমল সমাদ্দারের কাছে একজন লজিং মাস্টার চেয়ে পাঠায়।
ছোট বউয়ের ছেলে মেয়েরা অনেক বড়। বড় মেয়ে পারুলের বিয়ে হয়েছে। পরের ছেলে আলী আকবর বাগেরহাটে থেকে কলেজে পড়ে। পরের ছেলেটা নজরুল পড়ে ফাইবে। নজরুলের ছোট বোন সীমা টুয়ে। তিন জনকে পড়ায় শফিক। স্বভাব অনুসারে, ঘরের ছেলের মতো মিশে যায় জহির ব্যাপারীর বাড়ি। জহির ব্যাপারীর আর একটা মেয়ে লীনা ভয়ঙ্কর সুন্দরী। লম্বা ছিপছিপা গড়নের। মেয়েটি নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর আর স্কুলে যায়নি। বিয়ের চেষ্টা চলছে কিন্ত জহির ব্যাপারী মনের মতো পাত্র পাচ্ছেন না, বিয়েও দিতে পারছেন না। মেয়েটা, লীনার সঙ্গে তেমন কোনো কথা হয় না। একটা বাড়ির মধ্যে থাকলে না চাইলেও দুজনের মধ্যে দেখা হয়্। কথা হয়। লীনা নতুন দোতলা বাড়ির দোতলার রুমে থাকে।
সেই জমা শিশিরে পা ভিজে যাচ্ছে, আর চোখও ভিজছে শফিকের। কার জন্য? অবাক শফিক অনুভব করছে, লীমা দূরে সরে যাচ্ছে আর হোসনে আরা শিশিরের ঘ্রাণে ওকে জড়িয়ে ধরছে।
ব্যাপারী বাড়ির দিনগুলো চমৎকার কাটছে শফিক হায়দারের। পড়ানো, খাওয়া, থাকার কোনো সমস্যা নেই। নিজের বাড়ির মতো থাকে। আগে, তোবারক হোসেনের বাড়ির একেবারে উল্টোদিকে ব্যাপারী বাড়ি। বর্ষার সময়ে মাঠে পানি আসলে ঘুরে রাস্তা দিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হয়। সেই পথের সঙ্গী হোসনে আরা, পথের অর্ধেক দুজনের আসা-যাওয়া চলে।
আপনি কি বই পড়েন? যেতে যেতে প্রশ্ন করে শফিক হায়দার।
হাসে হোসেন আরা, স্কুলে পড়ি, বই না পড়লে চলে? বইতো পড়তেই হয়।
ক্লাসের বাইরে কোনো বই।
গল্প উপন্যাস?
মাথা নাড়ায় শফিক, হ্যাঁ।
পড়ি তো। কিন্তু এই এলাকায় তেমন পাওয়া যায় না। আমার বড় বোন খুলনায় থাকে। সেখানে গেলে বই কিনি, নিউমার্কেট থেকে। আপাও গল্পের বই পড়ে।
কাল আপনাকে একটা বই দেবো।
আপনি পড়েন?
পড়ি, আমার খুব নেশা।
পরের দিন নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের উপন্যাস ‘প্রেমের সমাধি’ বইটা একটা পত্রিকার প্যাকেটের মধ্যে স্কুল থেকে যাওয়ার পথে হোসনে আরার হাতে দেয় শফিক। হোসনে আরা দ্রুত বইটা নিজের কাঁখের বইরে মধ্যে মিশিয়ে নেয়। পরের দিন পথে আর পায় না হোসনে আরাকে, বুঝতে পারে শফিক। মেয়েটি আবার রাগ করেছে। কারণ, বাড়ি গিয়ে বইটি খুললে সেই পাঁচশত টাকা পেয়ে যায়। স্কুল থেকে আসার পথেও হোসনে আরাকে পায় না। হোসনে আরা অন্যদের সঙ্গে দ্রুত চলে যায়।
নভেম্বর মাস। পরীক্ষা চলছে, শফিক সারাদিন রাত পড়াশোনা করে। বাড়ির ছাত্রদের পড়ায়, নিজেও পড়ে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাড়ি আসবে, কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ে। জ্বর, কাশি। ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ এনে খায়। জহির ব্যাপারীর বড় বউ, বিউটির মা শফিককে খুব আদর করেন। হয়তো ভাবেন, কোন মায়ের সন্তান, পড়ার জন্য বিদেশে পড়ের বাড়িতে থাকছে! অসুস্থতার সময়ে খুব সেবা করে শফিকের। কয়েকদিন পর শফিক হায়দার মোটামুটি সুস্থ।
রাতে ঘুমিয়ে বিছনায়। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় শফিকের। একটা মানুষ বিছানায়, ওকে জড়িয়ে ধরেছে। আঁৎকে ওঠে শফিক, কে?
চুপ, আমি লিমা।
কয়েক মুহূর্ত স্থির শফিক। লিমা দোতলায় ঘুমায়, ঠিক শফিকের মাথার ওপর। দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসার বড় ঘরের নিজের মা, ছোট ভাই-বোনদের ডিঙিয়ে আসতে হয়েছে। আর বারান্দার পাশের রুমে ঘুমিয়ে জহির ব্যাপারী।
এত রাতে?
আপনি অসুস্থ, দিনে তো কথা বলার সুযোগ নেই। আপনার অসুস্থ মুখ দেখে খুব মায়া লাগে। শফিকের ঠোঁটে চুমু খায় লীমা।
সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরে শফিক বুকের সঙ্গে। পরের রাতেও লীমা আসে শফিকের কাছে। দুই রাত পর আবার আসে। আর দিনে আড়ালে আবডালে হাসে, টুক করে হাত দেখে। পঞ্চম রাতের পর দুপুরে দিকে জহির ব্যাপারীর বড় বউ শফিককে ডাকে নিজের রুমে।
তুই কি বাঁচতে চাস? গম্ভীর প্রশ্ন।
আমি কি করলাম চাচি?
আজকে রাতটা থাকবি, সকালে উঠে বাড়ি মায়ের কাছে ফিরে যাবি। ব্যাপারী যদি টের পায়, তোরে জবাই দিয়ে বিলে পুতে রাখবে। চেনো না তো ব্যাপারীকে। এখন বয়স হলেও যদি রেগে যায়…। যা বলেছি, বুঝেছিস? তোর মা তোর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বেঘোরে প্রাণ হারাবি ক্যান?
বুঝতে পারে শফিক সবার আগে প্রাণ! আর এই বিদেশে জহির ব্যাপারীর মতো মানুষ একটা কিছু করলে, কেউ আশ্রয় দেবে না। আর লেখক হওয়ার খুব বাসনা। লেখক হতে হলে বাঁচতে হবে আগে। সারা দিনে লীমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। বুকের মধ্যে যন্ত্রনার যন্ত্র চলছে। লীমা নিশ্চয়ই ওর মায়ের কাছে ধরা পড়েছে। নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে নিজের ঘরে।
পরের দিন নিজের বইপত্র বাঁধাছাদা করে লজিং বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে আসে শফিক হায়দার। আসার আগে খুব চেয়েছিল পাঁচ রাতের অসম্ভব সুখের সঙ্গী লীমার সঙ্গে অনন্ত একটা বার দেখা হোক। কিন্তু….। ছয় মাসের লজিং বাড়ি ছেড়ে যতই দূরে সরে যাচ্ছে, শফিক হায়দার এক বিস্ময়কর দৃশ্যর সামনে দাঁড়ায়। ব্যাপারী বাড়ির সঙ্গেই খোলা বিরাট মাঠ। সেই মাঠের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মোড়েলগঞ্জ বন্দরের দিকে যাচ্ছে, অনুভব করছে সঙ্গে কেউ একজন হাঁটছে। কে হাঁটছে? লীমা না কি হোসনে আরা? বুকের মধ্যে এক ধরনের শিশির পড়ার টাপুরটুপুর নৃত্য বাজছে। শীতের সকাল, সবুজ ঘাসের ওপর সারারাতের শিশির জমেছে। সেই জমা শিশিরে পা ভিজে যাচ্ছে, আর চোখও ভিজছে শফিকের। কার জন্য? অবাক শফিক অনুভব করছে, লীমা দূরে সরে যাচ্ছে আর হোসনে আরা শিশিরের ঘ্রাণে ওকে জড়িয়ে ধরছে।
চলছে…