॥১৫॥
বাসের লাইট জ্বলে ওঠে আবার। একঝাঁক আলো এসে চোখের পাতায় আঘাত করে। তখন হয়তোবা কেটে যায় আমার আজকের টাটকা স্মৃতি। তখন হয়তোবা কেটে যায় মায়ের মায়াভরা উঠোন। তখনই হয়তোবা কেটে যায় মায়ের নিঃশ্বাস গোপন করার সজল দৃশ্যটি। হয়তোবা তখন আমার ছেলেবেলা কেটে যায়। তখন হয়তোবা কেটে যায় আমার স্বপ্ন-স্বপ্ন ভাব। তখন হয়তো বা আমার ঘোর কেটে যায়। তখন হয়তো বা আমার সম্বিত ফিরে আসে। তখন হয়তো বা আমার বিহ্বলতা কেটে যায়। তখন হয়তো বা কেটে যায় আমার ঘুম ঘুম ভাব। তখন হয়তো বা লাগে না আমার তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব।
আমি সোজা হয়ে বসি। তখনই দেখি আমার পাশের সিটে একটি ছেলে ঘুমুচ্ছে। বাসের লাইটের তীব্র আলো এসে ওর চোখে মুখে লাগলো। মনে হলো ওর চোখ পিট পিট করছে। যেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম ভেঙে যাবে ওর।
আমি তাকে ভালোভাবে লক্ষ করলাম। এই ছেলেটি বিনোদন পার্কে দেখা ওই ছেলেটি কি না। কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারলাম না। একবার মনে হলো, হ্যাঁ এই ছেলেটি পার্কে দেখা ছেলেটিই। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, না এই ছেলে এতক্ষণ আমার সঙ্গে-সঙ্গে থাকা ছেলেটি নয়। তাহলে এতক্ষণ আমি কী দেখলাম! বিনোদন পার্কে কাটানো পুরো সময়টা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল যে ছেলেটি, দীর্ঘ বাসযাত্রায় আচ্ছন্ন করে রাখল যে ছেলেটি, জানালার কাঁচে চোখ রেখে রেখে যে ছেলেটিকে এতক্ষণ দেখলাম, দেখলাম আলো-আঁধারিতে চলমান পদক্ষেপ যে ছেলেটিকে, এই বাসযাত্রার মাঝে হঠাৎ নেমে যাওয়া প্রকৃতির মাঝে ঝাপসা চাঁদের আলোর ভেতরে অলৌকিক সম্মোহনে ছুটে চলা এই আমি, হঠাৎ যে ছেলেটির সাক্ষাতে চলে এলাম আগের গন্তব্যে, তাকে আমি চিনতে পারছি না! তাকে আমি শনাক্ত করতে পারছি না!
আমি চোখ সরানোর আগেই তার ঘুম ভেঙে গেলো। খুব হকচকিত হয়ে ঠিক মতো বসতে বসতে বললো, কোনো বেয়াদবি হয়নি তো স্যার। ঘুমাইছিলাম তো!
তোমার নাম কী।
ঢোক গিলে আমতা আমতা করতে লাগলো সে এবার। বুঝলাম সে তুমি সম্বোধনটায় অভ্যস্ত না। এজন্য এ রকম করছে।
ভয় নেই। তোমার নাম কী বলো।
ইমু। হগগলে ডাকে হিমু।
আমি প্রচণ্ডরকম তড়িতাহত হই নামটা শুনে। প্রিয়কষ্ট আমাকে গোপনে এই নামে ডাকতো। বাসটি হার্ডব্রেক করে। দরজায় মুখ বাড়িয়ে হেলপার গালাগালি করে। বাসের ভেতরেও তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কোনোদিকে মনোযোগ দিতে ইচ্ছে করে না আমার।
তারপর কী হয় জানি না। বাস যায়, বাস যায়। দেখি একটা অচেনা জায়গায় গাছের নিচে শুয়ে আছি। বড় আপা এসে ধমক দিচ্ছে, উঠ এখান থেকে। ঘরে চল। ঘুমাবি না?
আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি গাছের সব পাতা হলুদ। আগুনলাগা সন্ধ্যার আভা এসে লাগাতে সোনালি রঙ ধারণ করেছে। আমাকে গায়ে হাত দিয়ে বড় আপা বলে, ‘উঠ তো এখুনি’। বড় আপা আমাকে হাত ধরে নিয়ে যায়। হাটের ছাউনির মতো একটা ঘর দেখা যায়। ছাউনি আছে চারদিকে। দেয়াল একটু খানি তোলা। ছাউনি ও দেয়ালের মাঝেখানে ফাঁকা। ভেতরে একটা চৌকি পাতানো। আমাকে বড় আপা বলে, ওখানে শুয়ে আছিস কেন। এখানে ঘুমা। আমি ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে যেই চৌকিতে বসি তখনই চৌকি ভেঙে নিচে পড়ে যাই।
মাথাটা গিয়ে যখন সামনের সিটে লাগার উপক্রম হয় তখন জাগা পাই। বুঝতে পারি আরেকটা হার্ডব্রেকের কবলে পড়েছিলাম। এবারের মাত্রাটা আগেরবারের চেয়েও বেশি। আবার শুরু হযে যায় হই চই। ড্রাইভারকে গালাগাল করতে শুরু করে সবাই।
ঘুম কেটে গেছে একেবারেই। ভালোভাবে বসলাম সিটে। লক্ষ করলাম ছেলেটি নেই। কী হলো ওর? নেমে গেছে? তাহলে কী ওর গন্তব্য পেয়ে গেছে? সিট থেকে উঠে এদিক-সেদিক তাকালাম। না, তাকে দেখা যাচ্ছে না। আরও ভালো করে এদিক সেদিক, সামনে পেছনে তাকালাম। পেয়ে গেছি তাকে। পেছনের দিকে যাত্রীদের দাঁড়ানোর জায়গায় মাথা নিচু করে বসে আছে।
আমি ডাকলাম, এই।
সে তাকালো না। অন্য যাত্রীরা তাকানো শুরু করলো আমার দিকে। আমি আবার ডাকলাম, এই ছেলে।
এবার সে তাকালো। চোখ লাল, ফোলা ফোলা। বললাম, এই তুমি ওখানে কেন?
সে আবার মাথা নিচু করলো। আমার ডাকে সে এলো না কিন্তু হেলপার তড়িঘড়ি করে চলে এসেছে।
সার কী হইছে আমারে কন? ওই হালা আবার বেদ্দবি করছে নাকি আপনের লগে? বদের বদ। টিকিট কাটে নাই, আবার কয় কাটছি। টিকেট চাইলে বলে হারাই হালাইছি। কীরম মিত্যে কতা। ভাড়া চাই বলে নাইক্যা। দিছি চারডে চর লাগাইয়া। লাথি দেওন লাগতো। দেই না। আমার আবার লাথি মারলে পোরোবলেম হয়।
হাসির একটা রোল পড়ে গেল বাসের মধ্যে।
একজন বলে উঠলো, কী পোরোবলেম হয় গো কনডাকটর সাব?
আমি সিট থেকে উঠলাম। বললাম, এই ছেলে এখানে এসো।
হেলপারের চোখ এবার কপালে। আরে করেন কী সার? হেরে পালিশমেন দিছি। ওইহানে বয়ে বয়ে হের শেষ পর্যন্ত যাওন লাগবো।
শেষ পর্যন্ত মানে কী? হেলপার গন্তব্যের নাম না বলে শেষ পর্যন্ত বলছে কেন? চকিত মাথায় এটা খেলে গেল। কিন্তু তখন মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু যেন ওই ছেলেটিই।
আমি হেলপারকে ধমক লাগালাম। ছেলেটির চোখে তখনও অবিশ্বাস। আমি আবার বললাম, এই ছেলে এখানে এসো।
সিটে এসে তার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো বহুগুন। দুই হাত দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। সবাই রীতিমতো চোখ কপালে তুলে আমাকে দেখতে থাকলো।
আমিও তাদের একনজর চোখ বুলিয়ে দেখলাম। তখনো আমার চোখের ভেতর থেকে বিনোদন পার্কের ওই ছেলেটি বাসের জানালার কাঁচ বরাবর দৌড়াচ্ছে। তখনো অন্য জানালার কাঁচে দেখা যাচ্ছে ঘূর্ণি-বিনোদনের ওই দৃশ্যটি। কেমন কেমন করে যেন চলে এসেছে ওই দম্পতিও। দেখা যাচ্ছে লেকের ভেতরে নৌকার ওপর মাছের লাফালাফি। আবারও এক আঁশটে গন্ধে আমার দম বন্ধ হওয়ার জোগার। পায়ের কাছে লাফালাফি করা ওই মাছটি এখন অ্যাকুরিয়ামে সাঁতার কাটছে। বড় আপার ধমক কানে বাজছে ‘উঠ তাড়াতাড়ি। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়’। মা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে চলে যাচ্ছেন আমার সামনে থেকে। বাবা অতি পুরোনো এক পাঞ্জাবি পরে আমাকে আর আমার ছোট ভাইকে নিয়ে মাঠে ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছেন। কাউকে না জানিয়ে উত্তরের এই বিনোদন পার্কে আসার আগের রাতে দেখা স্বপ্নের মাছটি আমার চোখের পাতায় পানির ঝাপটি দিচ্ছে।
কাঁদতে থাকা ছেলেটির মাথায় আমি এবার হাত রাখলাম।
বাস চলতে থাকলো বাসের মতো।
চলতেই থাকলো চলতেই থাকলো। চলতেই থাকলো, চলতেই থাকলো।
আমি লক্ষ করছি আশিক আবারও একই কথার পুনরাবৃত্তি করছে। তার মানে সে খেই হারিয়ে ফেলেছে। আমি আশিককে বললাম, আশিক, চলতেই থাকলো, চলতেই থাকলো মানে কী? তুই তো একই কথা বলে যাচ্ছিস বারবার।
আশিক বলল, হ্যাঁ, বাসতো চলতেই থাকালো। চলতেই থাকলো।
আমি বললাম, বুঝলাম বাসটা চলতেই থাকলো। কিন্তু অবশেষে থামলো কোথায়?
আশিক বললো, আমারও তো একই প্রশ্ন তারপর থামলো কোথায়!
তুই একথা বললেই কী হবে? কারণ বাসে তুই ছিলি। বাস কোথায় থামলো তুই বলতে পারবি না?
এখানেই তো বিস্ময়। আমি বাসে ছিলাম ঠিক আছে। যুক্তি অনুযায়ী আমারই বলার কথা কোথায় বাস থামলো। কিন্তু আমি জানি না। সত্যি বলছি আমি। তুই বিশ্বাস কর। আমি জানি না বাসটা কোথায় এসে থামলো। হয়তো হেলপার বলতে পারত। হয়ত ড্রাইভার বলতে পারত। যাত্রীরা কী বলতে পারত? হয়তোবা ওরা সবাই বলতে পারত। কেবল আমিই বলতে পারতাম না। কারণ আমার মনে পড়তে লাগল হেলপারের কথা। হেলপার বলেছিল শেষ পর্যন্ত। বাসটি না কি শেষ পর্যন্ত যেত। শেষ পর্যন্ত জিনিষটা যে কী, শেষ পর্যন্ত গন্তব্যটা যে আসলে কোথায় তা আমার জানা হয়নি। জানা হলে বলতে পারতাম। কেন যে ওই সময় হেলপারকে জিজ্ঞাসা করিনি। কেন যে ওই সময় ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করিনি! কেন যে যাত্রীদের জিজ্ঞাসা করিনি!
আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম আবারও। তুই না হয় জানিস না যে শেষ গন্তব্যটা আসলে কোথায়! হয়তো তা কেউই জানে না। একটা দার্শনিক ব্যাপার এখানে আছে। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। আমি বলতে চাচ্ছি বাসটা তো কোথাও না কোথাও থামলো। সেটা কোথায়? বাস কোথায় থামলো! তারপর তুই কোথায় গেলি! কী করলি! এখানেই বা এলি কেমন করে!
আশিক বলল, সত্যি আমি জানি না বাস কোথায় থামলো। আমি কোথায় গেলাম তাও জানি না। আমি কী করলাম তাও জানি না। আমি এখানে এলাম কী করে তাও জানি না। কিন্তু এখানে যখন এসেছি, যখন এই জোসনা বিধৌত চরাচরে যখন আমি আমাকে আবিষ্কার করেছি, তখনই একটা কথা আমার মনের ভেতরে উঁকি দিতে শুরু করেছে।
কী সে কথা?
মনে হলো আমি এখানেই ছিলাম। এখানেই আছি। আমি আগে কোথাও ছিলাম না। আমি কোথাও যাইনি।
আমি বললাম, পাগলের মতো কী এসব বলছিস। তুই এখানেই ছিলি মানে? তাহলে তোর সঙ্গে আমার দেখা হলো কিভাবে? তুই আগে কোথাও ছিলি না তো উত্তরবঙ্গের ওই বিনোদন পার্কে কে গিয়েছিল? তুই যে বিশাল ভ্রমণের কথা বললি তা কার কথা তাহলে? তুই যে শিশুটির কথা বললি তাহলে সে কে? সবকিছুই তোর কাছে অস্তিত্বহীন হয়ে গেল? সবকিছুই তোর কাছে কাল্পনিক হয়ে গেল? তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে জীবনটাই এক কাল্পনিক মঞ্চ।
আশিক বললো, আমি জানি না। তুই আমাকে এভাবে বলিস না। আমি কিছু জানি না। তবে আমার কাছে মনে হয়, জীবনটা শুধু কাল্পনিক মঞ্চই নয়, তারও অধিক। কারণ সত্য মাঝে মাঝে কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়।
আশিকের এ কথা শুনে আমি কিছু বললাম না। আসলে আমি কিছু ভাবতে পারছি না। আমার মাথায় কিছু খেলছে না। আমি আশিকের কথা শুনে খুব নীরব হয়ে গেলাম। বোধ করি আমার এ নীরবতা আশিককে খুব স্পর্শ করলো। আশিক অনেকক্ষণ পর এই নীরবতা ভাঙলো। কিন্তু ঠিক কতক্ষণ পর তা বুঝতে পারলাম না আমি।
আশিক বললো, তোকে আরেকটি কথা বলা হয়নি।
আমি বললাম, কী কথা?
আশিক বললো, যখন আমি বাসে উঠলাম দ্বিতীয়বারের মতো তখন একটু আগে ঘটে যাওয়া বিশাল প্রান্তরের ছবিগুলো ভেসে উঠতে লাগল। একে-একে সবগুলো দৃশ্য। একসময় মনে হলো, যে মানুষটিকে বাঁদরমুখোদের দখলে দেখেছিলাম তাকে আমি চিনি। তার জন্য খুব মায়া হতে লাগলো আমার। মনে হতে লাগলো তাকে আমি খুব চিনি। সে আমার জনম জনমের চেনা। সে আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতো কাছের। সে আমার চোখের পাপড়ির মতো কাছের। সে আমার গায়ের গন্ধের মতো চেনা। বুকের পাঁজরে ক্ষণে ক্ষণে নতুন যে নিঃশ্বাস জন্মে, তার প্রবাহের মতো সে আমার আকাঙ্ক্ষিত।
চলবে…
মিথ্যামানব: পর্ব-১৪॥ এমরান কবির