॥১১॥
এরপর তো আর কিছু বলা যায় না। আমি লাইনে এসে দাঁড়ালাম। অনেক উচ্চস্বরে গান বাজছে। আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন ধন্য করো, এ জীবন ধন্য করো…।
গানের সুর এসে মনে ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। গানের সুর এসে মননে ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অতি দূর থেকে ভেসে আসছে এই সুর। নির্জনতম গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে অতি দূর থেকে হালকাভাবে ভেসে আসা গানের সুর যেমন লাগে, সে রকম লাগছে। যেন কোনো এক কুহরণ, মায়ার ভেতরে ডেকে যাচ্ছে আত্মার নিঃশ্বাস। যেন আমার ভেতরের সকল অন্তঃস্থ আমি আমাকে ডেকে যাচ্ছে সুগভীর দূরত্ব থেকে। দূরাগত সে জায়গায় যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে আমার সব বাহ্যিক আমি।
কিন্তু এই ক্ষণ তো নির্জন রাত নয়। দুপুরের খাঁ খাঁ রোদ। বহু বছর আগে শৈশবে মায়ের নিষেধ অমান্য করে, বহু বছর আগে মায়ের উদ্বেগ উপেক্ষা করে, বহু বছর আগে মায়ের শাসন অগ্রাহ্য করে টই টই করে ঘোরা রোদেলা দুপুরের স্নিগ্ধ ছায়া যেন। কিন্তু সেখানে তো এত মানুষ ছিল না। টই টই দুপুরের সে-সব দিনে দেখা যেত বিরল মানুষের হাঁটাচলা। আর কতিপয় ছন্নছাড়া শৈশব। গাছের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া লুকোচুরি খেলা। আর হঠাৎ হঠাৎ মায়ের মুখখানা মনে পড়ায় বাড়ি ফেরার আন্তঃতাড়না।
কিন্তু এখানে তো হাজারো মানুষের পদচারণা। এখানে তো হাজারো মানুষের আনন্দ, এখানে তো হাজারো মানুষের উল্লাস। এখানে তো হাজারো মানুষের চিৎকার। এখানে তো হাজারো মানুষের কলতানে বিদ্ধ দুপুরের নির্জনতা। তার ভেতরে বেজে চলা এই গান তো সুদূর থেকে ভেসে আসার মতো মনে হওয়ার নয়!
কিন্তু হচ্ছে। কেন হচ্ছে! তাহলে কি এতসব আয়োজন ও কোলাহলের ভেতরে চলে এসেছে সেই সব শৈশব। তাহালে কি এতসব উল্লাসের ভেতরে চলে এসেছে অন্তঃস্থ আত্মার উল্লাস!।
লাইনে দাঁড়ালাম আবার। দেখি ওই দম্পতি চলে গেছে। ওদের আনন্দ দেখতেই আমার ভালো লাগছিল। ভেতরের আনন্দ দেখতে ইচ্ছাই করলো না আর। তবু অজান্তেই কখন যেন চোখ চলে গেলো ওদিকে। দেখি ওই বাউন্ডারির ভেতরেও ওই ছেলেটি ওই চক্রাকার দোলনাকে ঘিরে দৌড়াচ্ছে। এবার সে পিছিয়ে যাচ্ছে। কারণ তার দৌড়ের চেয়ে ঘূর্ণনের গতিবেগ বেশি। তবু সে নিবিষ্ট মনে এক দৃষ্টিতে ওই আনন্দকেন্দ্রের কেন্দ্রে চোখ রেখে দৌড়াচ্ছে।
আমি এবার আরও একটু বেশি অবাক হলাম। কারণ ওই ছেলেটি কোনো আসনে বসে আনন্দ না নিয়ে দৌড়াচ্ছে শুধু। কিন্তু কেন! টিকিট না কেটে এখানে ঢোকানোর কথা নয়। অন্যভাবে তার ঢুকতে পারার সম্ভাবনাও নেই। আসলে সুযোগই তো নেই। যদি টিকিট কাটেই, তাহলে তো সিট না পাওয়ার কথাও না। কারণ সব টিকিট সিট অনুযায়ীই বিক্রি হয়। উপরন্তু, সিটে না বসে এভাবে দৌড়াতে দেওয়ার কথাও নয় এখানকার কর্মীদের। তাতে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যায়। তাতে দুর্ঘটনা ঘটবার আশঙ্কাও থাকে।
সে কি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে? তা কিভাবে সম্ভব? আর যদি ঢুকে পড়েই, তাহলে এখন ঘূর্ণন শুরু হওয়ার পর তাকে এরকম ঘুরতে দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেউ কি বিষয়টা দেখছে না! কারও কি বিষয়টা নজরে আসছে না!
আমি এবার লাইন থেকে সরে এলাম। ভাবলাম এখানকার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলি। কাউন্টারের সামনে গিয়ে কথা বলব, বলে মনস্থির করেই আমি সামনে এগুতে শুরু করেছি। তখনই হইচই শুরু হলো। টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়ানো এক তরুণী অভিযোগ করেছে এক তরুণ তার সৌন্দর্যে হাত দিয়েছে। অভিযুক্ত তরুণ অস্বীকার করছে সে-অভিযোগ। কিন্তু ইতোমধ্যেই তরুণীর পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে আরও তরুণ। ঠেলাঠেলি শুরু হলে আমি চলে এলাম সেখান থেকে। অথবা ভিড়ের ঠেলাঠেলি আমাকে সেখানে থেকে বের করে দিলো। এ রকম পরিস্থিতি হঠাৎই তরুণদের দু’ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
আমি ওই জায়গা থেকে একটু দুরে যেতে না যেতেই কোলাহল বেড়ে গেল। হইচই আরও বেড়ে গেল।
ততক্ষণে আমি সরে এসেছি আরও কিছু দূর। আমি সরে এসেছি ওই আনন্দ ঘূর্ণন থেকে। চলে এসেছি চক্রাকারে ঘুরতে থাকা অবিরত বালকের পায়ের ছাপ থেকে।
জানা হলো না শিশুটির কথা। প্রথম প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হলো আমার।
বিচ্ছিন্নভাবে এখানে সেখানে উদ্দেশ্যহীন হাঁটি। মানুষ দেখি। নানা রকম মানুষ। অফুরন্ত আনন্দ দেখি। কী কী যেন ভাবি। সব মনে রাখতে পারি না। হয়তো বা আমার চেতন মন কাজ করছে না। তাই স্মৃতি হয়তো বা সেগুলো সংরক্ষণ করতে পারছে না। আমার অবচেতন মনটাই হয়তো বা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে এখন। তাও ঠিক জানি না। হাঁটি আর হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে এখানে সেখানে যাই উদ্দেশ্যহীনভাবে। গান বাজছে উচ্চ ভলিয়মে। কিন্তু আরেকটা বিষয় আমাকে অবাক করছে। সেটা হলো কর্তৃপক্ষ কেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো গান এই আনন্দ কেন্দ্রে বাজিয়ে চলছে। এখানে তো বাজনযন্ত্র সমৃদ্ধ উৎফুল্লকর গান বাজানোর কথা। কিন্তু আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণের মতো গান কেন বাজাচ্ছে। আনন্দ করতে এসেছে যারা তাদের তো এই গান ভালো লাগার কথা নয়! পরিবেশ অনুযায়ী যেকোনো পরিবেশনা প্রযোজ্য। পিকনিক স্পট বা বিনোদন কেন্দ্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজবে সেটা একটু হলেও অপ্রত্যাশিত।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লক্ষ করলাম একই গান বাজছে এখানে। ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটাই বাজছে শুধু।
আমি একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। ক্লান্তি তো ছিলই। তদুপরি উদ্দেশ্য ঠাণ্ডা মাথায় লক্ষ করা যে একই গান বাজছে কি না। আমার বিক্ষিপ্ত মন ভুল করতে পারে।
গান শেষ হলো। অপেক্ষার পালা চলছে আমার। পরের গানটি যেন আর শুরুই হতে চায় না। শুরু হলো অবশেষে। হ্যাঁ, একই গান। ভাবলাম পরপর দু’বার হতে পারে। পরেরবার দেখি। তখন নিশ্চিত হওয়া যাবে পুরোপুরি। কিন্তু এই গানটা তো শেষই হতে চায় না। যেন ক্ষণে ক্ষণে গানটি আরও শ্লো মোশনে বাজতে শুরু করেছে।
তখন হঠাৎ অনুভব করি পায়ের কাছে কী যেন নড়ছে। চকিত চেয়ে দেখি একটি মাছ লাফাচ্ছে। লাফাতে লাফাতে আমার পায়ের কাছে এসে মাছটি স্থির হলো। আমি কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। কারণ বিনোদন পার্কের এই জায়গায় মাছ আসবে কিভাবে? এখানে জলের কোনো সংযোগ নেই। মাছের বাজার নেই আশেপাশে। প্রবল বৃষ্টিপাত নেই কয়েকদিনব্যাপী। রুক্ষ এই দুপুরে, গনগনে রোদের ভেতরে খানিকটা শীতলের সন্ধান করা মানুষের বসবার জায়গায় বিভাবে একটি জীবন্ত মাছ এসে লাফালাফি করে! আমি মাছটিকে লক্ষ করি। তখনই মনে পড়ে গতকাল রাতে আমি একটি মাছের স্বপ্ন দেখেছি। কোনো এক বিনোদন পার্কে আসব, সেটা কয়েকদিন আগেই ঠিক করে ফেলেছিলাম। রাতে স্বপ্নটি দেখার পর ভাবলাম, এটা নিছক একটা স্বপ্নই। যেহেতু ওখানে যাব, তাই মস্তিষ্ক ওগুলো নিয়ে ভেবেছে। তারই প্রতিক্রিয়া হলো এই স্বপ্ন।
কিন্ত স্বপ্নে মাছ দেখার বিষয়টি কিভাবে এই বিনোদন পার্কের সঙ্গে জড়িয়ে গেল সেটা খুব সামান্য বিষয় বলে মনে হলো না। ফলে স্বভাবতই আমি স্বপ্নে দেখা মাছের সঙ্গে এই বিনোদন পার্কের ঘাসের ভেতরে দেখা মাছটির একটি যোগসূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করলাম। তার আগে স্বপ্নটা আরেকবার মনে করার চেষ্টা করলাম।
স্বপ্নে দেখেছি আমি এক বিনোদন পার্কের লেকে নৌকা চালাচ্ছি। বিশাল লেক। ঢেউ আছে সামান্য। লেকের নোংরা পানির ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে আমার নৌকা। নৌকা মাঝ বরাবর যেতেই লেকের পানি থেকে একটি মাছ লাফ দিয়ে আমার গায়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নৌকার ভেতরে পড়ে গেল। তারপর লাফাকে শুরু করলো। আমি দেখলাম মাছটি আমার পায়ের কাছে এসে পড়েছে। পায়ের কাছে এসেও লাফাতে লাগলো মাছটি। জল থেকে ডাঙায় তোলা মাছেরা যেরকম করে আর কি! আমি কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে পাশ কাটিয়ে যেই মাছটিকে ধরার জন্য একটু হেলে হাত বাড়িয়েছি তখনই নৌকায় বসা এক তরুণী বাঁজখাই গলাই চিৎকার দিয়ে উঠলো। খবরদার ওই মাছে হাত দেবে না। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। এরকম কোনো তরুণী আমার নৌকায় বসা ছিল সেটা আমার জানাই ছিল না। আমার নজরেও আসেনি। আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। সোনালি রঙের শাড়ি চোখে পড়লো প্রখমে। কারণ সে শাড়িতে ছিল অপরূপ ঝিলিক। শাড়ির ভেতরে অপরূপ তরুণী। ঝিলিকের ভেতরে ঝিলিকের চমক-ঝুরি। থেমে যাওয়া কিন্তু দুলতে থাকা নৌকাটিকে আরও দুলুনিতে ভরে দিয়ে, সে হেলেদুলে পেছন থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসলো। কোত্থেকে বিকট আঁশটে দুর্গন্ধ নাকে এসে আঘাত করল আমার। দুর্গন্ধে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এ রকম পরিবেশেও মাথায় প্রশ্ন খেলে গেলো। এই আঁশটে দুর্গন্ধের উৎস কী! পায়ের কাছে লাফাতে থাকা মাছ! কিন্তু মাছটি তো জীবন্ত। জীবন্ত মাছের এরকম গন্ধ হয়! আর একটা মাছ এসে পায়ের কাছে লাফালেই এত দুর্গন্ধ হবে! তাহলে কি তরুণীই এই? আঁশটে গন্ধের উৎস! কিভাবে সম্ভব। তার শরীরে তো থাকবে মাতাল করা গন্ধ। থাকবে মাতাল করা অন্ধ গন্ধ। না না গন্ধ নয়। থাকবে সুবাস। যে সুবাসে মাতাল হয়ে যায় পবিত্র পুরুষ।
সোনালি শাড়ির তরুণী পাশে বসে কোমল স্বরে বলল, রাগ করেছ? তার এই কথায় এমন একটা সুর ছিল, যে সুর কেবল আপনতম মানুষের ক্ষেত্রেই চলে আসে হৃদয়ের গভীর থেকে। আমি আর কী বলব, শুধু বিস্ময় বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। একটু আগের বাজখাই গলা ও এখনকার মিষ্টি সুর একটুও মেলাতে পারছি না। গাঢ় লাল টকটকে লিপস্টিকে তার ঠোঁট গনগনে কামনার আগুন যেন। আমি বোধহয় আবারও তার ঠোঁটের দিকে তাকালাম। তখন তার ঠোঁটগুলোকে লাগলো রক্তপিপাসুদের মতো। যেন অনেক রক্তের পিপাসায় কাতর সে। কিন্তু তার ভেতরে কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ণ সৌন্দর্য রয়ে গেছে। ফলে ঠোঁট দুটো রক্তপিপসুর মতো মনে হলেও তাকে ভয়ঙ্কর মনে হলো না। তাকে মনে হলো বিস্ময়কর। আমি হয়তো বা তার দিকে বিস্ময়-বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম। অথবা তাকাইনি। অনুভবে কল্পনা করেছিলাম মাত্র। অথবা হয়তো বা তাকিয়েছিলাম অন্যভাবে। কিন্তু ঠিক কিভাবে! বলতে পারি না।
মিথ্যামানব: ১০ম পর্ব ॥ এমরান কবির
চলবে…