দ্বিতীয় কিস্তি
জন্মস্থান
লালন শাহের জন্মন্থান নিয়েও মানুষের মাঝে কৌতূহলের শেষ নেই। কোথায় লালন শাহের আসল জন্মস্থান হরিশপুর না ভাড়ারা গ্রাম। এ জন্মস্থান নিয়েও চলে গবেষকদের মাঝে নানা মতবিরোধী লেখা চলাচালি। তবে ব্রিটিশ সরকারের রেজিস্ট্রেশন বিভাগে কর্মরত খান ওয়ালী (১৮৫৫–১৯২৬) অত্র অঞ্চলের ফকিরদের সম্পর্কে তথ্য আহরণ করতে গিয়ে লালন ও সিরাজ সাঁই সম্পর্কে অবহিত হন। ১৮৯৮ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির এক সভায় পাঠকৃত এবং ১৯০০ সালে
Journal of the Anthropological Society of Bombay (1900 Vol, No.V.4. Readon 30.09.1898.) তে প্রকাশিত `On curious tenets and practices of certain class of Fakirs in Bengal’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন—Another renowned and the most melodious whose `Dhwayas’ (ধুয়া) are the rage of the lower classes and sung by boatmen and others, was the far famed, `Lalon Shah’; He was disciple of `Siraj Shah’ and both were born at the village Harishpur, Sub division Jhenaidah, district Jessore.
অর্থাৎ আর একজন বিখ্যাত এবং সবচেয়ে সুরেলা গানের রচয়িতা ছিলেন লালনশাহ। তাঁর রচিত ধুয়াগান নিম্নশ্রেণীর মানুষের নিকট অতি প্রিয়, এবং মাঝি মাল্লারাও এই গান গেয়ে থাকে। তিনি ছিলেন। সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্য এবং উভয়ই যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার (বর্তমান ঝিনাইদহ জেলা)হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সখের বাউল কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬) তাঁর ব্রহ্মাণ্ডবেদ দ্বিতীয় ভাগ প্রথম সংখ্যায় যোগতত্ত্বের আলোচনা প্রসঙ্গে এক উপ পাদটিকায় লালন সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন—
অনেক ভক্ত ফকিরের বৃত্তান্ত অনেকেই অবগত আছেন।… নদীয়া জেলার অন্তর্গত কুষ্টিয়া বিভাগের নিকটবর্তী ঘোড়াই গ্রামে লালন সাঁই নামে যে ফকির বাস করতেন। তিনিও পরম যোগী। তাঁহার গুরু সিরাজ সাঁই সিদ্ধযোগী ছিলে।
ঘোড়াই গ্রামে লালনের বাস করার কথা কাঙাল তাঁর লেখায় উল্লেখ করলেও অনুসন্ধানে জানা যায় যে ওই গ্রামে লালন নামে কোনো ব্যক্তি কোনো আখড়া স্থাপন করেননি বলে আবুল আহসান চৌধুরী উল্লেখ করেছেন। তবে খোন্দকার রফিউদ্দিন তাঁর ‘ভাবসঙ্গী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—‘লালনের জন্মভূমি জাতি এবং জীবনী লইয়া কি একটা আন্দোলনের সৃষ্টি হইয়াছে। দুঃখের বিষয় প্রকৃত তথ্যানুসন্ধান না করিয়াই পরস্পর শ্র“ত কাহিনির উপর নির্ভর করিয়া যাহা খুশি লিখিয়া কত মনীষী প্রতিযোগিতার অভিনয় করিতেছেন। ফকির লালন শাহের জন্মভূমি যে যশোর জেলার হরিণাকুণ্ডু থানার অধীন হরিশপুর গ্রামেই ছিল, ইহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই। এই দীন লেখকের জন্মভূমি এই হরিশপুরে। আমার পিতা মরহুম পাঞ্জুশাহ বহু বৈঠকে লালন শাহের সঙ্গে একত্রে বৈঠক করিয়াছেন, আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মরহুম খোন্দকার শামসুদ্দীন কৈশোরে ইহাকে বৃদ্ধাবস্থায় বর্তমান দেখিয়াছেন। লালন শাহের ভ্রাতুষ্পুত্রী, কলমের কন্যার নিকট আমি নিজে বিস্তারিত শুনিয়াছি। ইঁহার ভ্রাতৃষ্পুত্রীর এক দৌহিত্রী আজিও এই হরিশপুরে স্বামী পুত্রসহ বসবাস করিতেছেন। এই হরিশপুরের বাসিন্দা ১২৫ বছর বয়স্ক মরহুম আহাদালী মণ্ডলের নিকট ইহাদের তিন ভ্রাতার বাড়ী এবং তথ্য শুনিয়াছি এবং ইনি তাহাদের বসবাসের ভিটায় নির্দেশ দিয়াছেন। হরিশপুর প্রবীণ শিক্ষক মুনসী ভাজনালী সাহেব লালনকে দেখিয়াছেন, তাঁহার কাছেও অনেক শুনিয়াছি। এই মুনসী সাহেবের ভ্রাতুষ্পুত্র মুনসী আব্দুল আজিজ সাহেবের পাঠ্যবস্থায় লালন শাহকে দেখিয়াছে।’
বাংলাদেশের প্রথম লালন গবেষক ড. আনোয়ারুল করিম (জ.১৯৩৭)। তিনি তাঁর ‘বাউল কবি ও লালন শাহ’ গ্রন্থে লালনের জন্মস্থান কুলবেড়ে হরিশপুরের এক মুসলিম তন্তুবায় পরিবারের বলে উল্লেখ করেছেন। আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর ‘লালন শাহ’ গ্রন্থে আনোয়ারুল করীমের সম্পর্কে বলেন- ‘পরবর্তীকালে তিনি তাঁর এই মত পরিবর্তন করেছেন’
আমি দীর্ঘ ২০ বৎসর লালন ফকিরের জীবনী সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করে বেড়িয়েছি। কিন্তু তাঁর জাতিত্ব অথবা জন্মস্থান সম্পর্কে সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে আজও উপনীত হতে পারিনি।
কিন্তু ড. আনোয়ারুল করিম আমার কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবুল আহসান চৌধুরীর দেওয়া তথ্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং বলেন আমি তো আমার কাজ আমার গবেষণায় দেখিয়েছি ওর (আবুল আহসান চৌধুরী) কাছে তো এমন কোনো কথা উল্লেখ করিনি। আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর ‘লালন শাহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন মুহম্মদ আবু তালিব, এস এম লুৎফর রহমান ও খোন্দকার রিয়াজুল হক এই মত মেনে নিয়েছেন যে, লালনের জন্মস্থান হরিশপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে। তাদের মতে লালনের বাবা দরিবুল্লাহ দেওয়ান ও মাতা আমিনা খাতুন। এ মতের সমর্থনে তারা প্রমাণ হিসেবে দাখিল করেছেন লালন শিষ্য দুদ্দু শাহ লালন জীবনীর একটি কলমী পুঁথি। তিনি তাঁর গ্রন্থে এ পর্যন্ত উল্লেখ করে এবার তিনি পুঁথীটার অকৃত্রিমতা সম্বন্ধে সংশয় পোষণ করেন এবং লালনের প্রথম জীবনীকার বসন্তকুমার পাল-এর বরাত দিয়ে জানান—বসন্তকুমার পাল এক পত্রে তাকে জানান হরিশপুরে লালন ফকির নামে যিনি প্রকট হইতেছেন তিনি আমার লিখিত পুস্তকের মহাত্ম লালন ফকির নহেন। যাহাতে দুই লালন এক মিশিয়া না যায় এজন্য (তারাপদ) শাস্ত্রী মহাশয় আমাকে সাবধান করিয়ে দেন।
ভাড়ারাতেও একাধিক লালনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় যা অনেক সংকটের সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। ড. আনোয়ারুল করীম আমাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি মাঠ সমীক্ষায় গিয়ে দেখেছি এবং অনেকের মতামত নিয়ে বুঝেছি ঐ ভাড়ারাতেও একজন লালন ছিল তবে এই লালন আমাদের হরিশপুরের লালন নয় যিনি ভাবসাধক ছিলেন।‘ আবুল আহসান চৌধুরী লালনের জন্মস্থান যে কোথায় তার কোনো পরিষ্কার তথ্য আমাদের নিকট সঠিকভাবে উপস্থাপনও করেননি যা স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবেই তিনি এড়িয়ে গেছেন। যে তথ্যকে আমরা লালন জন্মস্থানের বর্ণিত প্রথম রচনা বলে উল্লেখ করেছি। আব্দুল ওয়ালী সাহেবের ইংরেজি প্রবন্ধকে তিনি তাঁর যুক্তিতে খারিজ করে দেওয়ার জন্য সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন। শুধুমাত্র জাতের বিষয় পরিষ্কার করার জন্য তিনি ওয়ালী সাহেবের নাম ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তিনি যে এরও আগে উল্লেখ করেছেন লালন শাহ এবং উভয়েই যশোর জেলার (বর্তমান ঝিনাইদহ) ঝিনাইদহ মহকুমার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লালনকে হিন্দু এবং ভাড়ারার লালন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই সচেতনভাবে ওয়ালী সাহেবের লেখা উল্লেখ করেননি শুধুমাত্র নিজের পক্ষের উদ্ধৃতটুকু ব্যবহার করেছেন। বলা চলে যে আব্দুল ওয়ালীর আগে প্রকাশিত ‘হিতকরী’ বা অন্য কোনো রচনায় লালনের জন্মস্থান বর্ণিত হয়নি। এতবড় সত্যকেও আবুল আহসান চৌধুরী ধামাচাপা দিয়েছেন। আজ যা সবার কাছে প্রকাশিত। এস.এস লুৎফর রহমানও তাঁর ‘লালন শাহ : জীবন ও গান’ গ্রন্থে লালনের জন্মস্থান হরিশপুরে বলে উল্লেখ করেছেন। ১৯২২ সালে সতীশ চন্দ্রমিত্র (১৮৭২-১৯৩১) তাঁর ‘যশোর খুলনায় ইতিহাস’ গ্রন্থের ২য় খণ্ডে উল্লেখ করেছেন যে লালন ফকির ও ঈশান ফকির যশোরের মানুষ। লালন যে যশোর (বর্তমান ঝিনাইদহ) বা হরিশপুরের মানুষ তা আজ সর্বজন স্বীকৃত ও প্রমাণিত। অধ্যাপক আফসার উদ্দিন শেখের মতে লালন শাহ এই গ্রামের উত্তর পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
লালন জীবনের নকল কথা
লালন জীবন সম্পর্কে সঠিক তথ্য না পাওয়ার কারণে একজন প্রবন্ধকার বা জীবনী লেখক জনশ্রুতির ওপর ভিত্তি করেই রচনা করে থাকেন তার প্রবন্ধ বা জীবনী। লালনের জীবনেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও তাঁর চাক্ষুস প্রমাণ মেলে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এক ভাষণের শ্রুতিলিখন থেকে যেটি মনোমহন বসু কর্তৃক পরিগৃহীত-
‘আর একটি বিষয় যেটা আমার বিশেষ ওৎসুক্যের বিষয়। সেটা ছোট ছোট নতুন ধর্ম প্রচারকদের জীবনী ও বক্তব্য বিষয় সংগ্রহ করা, মফস্বলে ভ্রমণ করিতে করিতে দেখিতে পাই যে হয়ত পল্লীর নিভৃত ছায়ায় কোন ব্যক্তি এক নতুন ধর্ম সম্প্রদায় সংগঠন করিতেছেন। তাছাড়া সমাজে বিশেষ পরিজ্ঞাত নহেন, কিন্তু সমাজের মধ্যে তাহারা কি বলিতে এসেছেন, কি বলিছেন এটা জানা উচিৎ এইগুলি সংগ্রহ করিতে পারিলে সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে যে সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মমত প্রচলিত হইতেছে অজ্ঞাতে ও অলক্ষিতে যে সমস্ত শক্তি সমাজের মধ্যে কাজ করিতেছে তাহা অনেকটাই বুঝা যাইবে। আমি এইরূপ একজন ধর্ম প্রচারকের বিষয় কিন্তু জানি তাহার নাম লালন ফকির। লালন ফকির কুষ্টিয়ার নিকট হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন এরূপ শোনা যায় যে তাঁহার বাপ মা তীর্থ যাত্রা কালে পথিমধ্যে তাহার বসন্ত রোগ হওয়াতে তাঁহাকে রাস্তায় ফেলিয়া চলিয়া যান। সেই সময় একজন মুসলমান ফকির দ্বারা তিনি পালিত ও দীক্ষিত হন। এই লালন ফকিরের মতে মুসলমান জৈন মত সকল একত্র করিয়া এমন একটি জিনিস তৈয়ার হইয়াছে যাহাতে চিন্তা করিবার অনেক বিষয় আছে। এ বিষয়ে সকলেরই মন দেয়া উচিৎ।’
রবীন্দ্রনাথের এই লালন সম্পর্কে জীবনী তথ্য একান্তই স্থানীয় লোকশ্রুতির ওপর নির্ভর করে লেখা হয়েছে যা লেখার মাধ্যমেই প্রমাণিত যাকে আমরা প্রথম লালনের জীবনীকার হিসেবে আখ্যায়িত করি। সেই বসন্তকুমার পালও কি লালনের জীবনী রচনায় কম কল্পনা বা লোকশ্রুতির আশ্রয় নিয়েছেন! তিনি অনেক রং ঢং মাখিয়েই লালনের জীবনী প্রস্তুত করেছেন যা তার লেখনীর মধ্যেই প্রতীয়মান হয়েছে। তিনি মিথ্যার আবরণে সত্যকে সব সময় ঢাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সত্যকে ঢাকতে গেলে কি তা সব সময় ঢাকা কি পড়ে থাকে, না কখনো না কখনো মাথা চাড়া দিয়ে জানায়, না আমিই সত্য এটাই বস্তব চিত্র। তিনি যেভাবে তার গ্রন্থে লালন সর্ম্পকে লালনের জীবনী হাজির করেছেন তার কাহিনি সংক্ষেপ-
সাঁইজির বাল্য নাম লালন দাস। তিনি যে পাড়ায় বাস করিতেন তাহা অদ্যাপি দাস পাড়া নামে খ্যাত। সাঁইজি এই দাস বংশের বাউল। দাস নামক কোন প্রতিবেশির সহিত তিনি শহরে গঙ্গাস্নানে যাত্রা করেন তখন রেল ছিল না তীর্থ যাত্রীগণ নৌকাযোগে যাতায়াত করিতেন। লালন দাস গঙ্গাস্নান সমাপণ করিয়া স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন কালে বসন্তেরোগে গুরুতর রূগে আত্রান্ত হন। রোগের আক্রমন এতই বর্ধিত হয় যে ক্রমে তাহার সংজ্ঞা লোপ পায় এবং দুরন্ত ব্যধির প্রকোপে তিনি মৃত্যুবৎ অসাড় হইয়া পড়েন সঙ্গীগণ তাহাকে মৃত মনে করিয়া যথা বিহিত আন্তোষ্টিক্রিয়া সমাúণ করিয়া মুখাগ্নি দ্বারা গাঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করিয়া স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। (এখানে উল্লেখ যে- যে লালন মারাই যায় নি সেখানে তার মুখাগ্নি করা আমাদের মনে প্রশ্নের উদ্বেগ করে, আবার নদীতে ফেলে দেয়াও) লীলাময়ের ইচ্ছায় পতিতোদ্ধারিণীর স্নিগ্ধ লহরে অন্তোষ্টিকৃত লালনের অন্ত: সংজ্ঞাহীন দেহ তীরে উঠিয়া পড়ে; এই সময়ে তাহার কণ্ঠ হইতে অস্ফূট স্বর উত্থিত হয়। কোন দয়াবতী মুসলমান রমনী তখন নদীতে জল লইতে আসিয়া গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত শবটিকে দর্শন করিয়া জানিতে পারেন তাহাতে প্রাণবায়ু তখনও বহমান স্নেহপ্রবন রমনীর হৃদয় এই নিদারুন দৃশ্যে গলিয়া গেল। তিনি মৃতগণ্য মানব বস্তুটিকে টানিয়া তুলিলেন এবং স্বগৃহে প্রত্যাগমন করিয়া স্বকীয় পরিজনবর্গের নিকট এই আশ্চার্য শবের বৃত্তান্ত জ্ঞাপন করেন। কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া সকলেই নদীর তীরে আসেন এবং মমতা বিগলিত হইয়া এই জীবনমৃত ব্যক্তিকে বাড়ীতে লাইয়া যান। এই মুসলমান রমনী তন্তুবায় বা জেলে …অবশেষে লালন সম্পূর্ণ রূপে আরোগ্য লাভ করিল। তাহার আশ্রয়দাত্রীর প্রাণের প্রচ্ছন্ন মমতার সজীবমূর্তি মেঘমুক্ত সূর্যের ন্যায় লোকচক্ষের উদ্ভাসিত হইল। সুস্থ হইবার পর লালন তাহার জীবনদাত্রী জননীর নিকট স্বীয় পরিচয় ও তীর্থ পর্যটনের আনুপূর্বিক অবস্থা যথাযথ বিবৃত করিলেন। অনন্তর সবল হইয়া পদব্রজে আপন গৃহাভিমুখে যাত্রা করিলেন। যে সব গুনধর সহযাত্রী মৃত লালনের মুখাগ্নি ক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, তাহারাই গ্রামে আসিয়া তীর্থ স্থানে ভাগ্যবান লালনের গঙ্গাপ্রাপ্তির সৌভাগ্যের কথা তদীয় জননী ও সহধর্মীনির নিকট সুললিত ভাষায় প্রকাশ করিয়া আপনাপন দায়িত্ব হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিলেন। …
সংসারে ‘পদ্মাবতী’র আর এমন কেহ অন্তরঙ্গ নাই একমাত্র বিধবা পুত্রবধূ; অতিকষ্টে তাহার দিনে পাত হইতেছে। এই সময় সহসা এক দিন অপরাহ্নে কোন অপরিচিত যুবক ‘পদ্মাবতী’র দ্বার দেশে আসিয়া পরিচিত কণ্ঠে মা বলিয়া ডাকিয়া দাঁড়াইল। ‘পদ্মাবতী’ স্বপ্রচকিতের ন্যায় শিহরিয়া উঠিলেন, তাহার প্রাণের সমুদ্র অনন্ত লহরীতে গজাইয়া উঠিল…
লালনের স্ত্রী [ যিনি বৈধব্যাচার পলিন করিয়া কঠোর ভাবে জীবন নির্বাহ করছিলেন ] ও ‘পদ্মাবতী’ উভয়েই তাহাদের সম্বলকে চিনিয়া ফেলিলেন। পরদিন ‘পদ্মাবতী’র গৃহে লোকে লোকারণ্য হইল, রাত্রি মধ্যেই সর্বত্র সংবাদ প্রচারিত হইয়াছে যে লালন দাস যমপুরী হইতে লোকালয়ে ফিরিয়া আসিয়াছেন। বসন্তের চিহ্ন লালনের মুখশ্রী কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হইয়াছে; তথাপি সম্মুখে আসিলে সকলেই স্পষ্টরূপে লালনকে চিনিতে পারিল … সে যে মুসলমানের অন্নে জীবন রক্ষা করিয়াছে, তাহা নিজ মুখেই কৃতজ্ঞতা গদগদ চিত্তে প্রকাশ করিতেছেন। যাহার পর তার মুখাগ্নি ক্রিয়া শেষ করিয়া তাহাকে গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করা হইয়াছিল এবং তাহার পারলৌকিক ক্রিয়াদিও যথারীতি সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। এই সকল কথা লইয়া লোক সমাজে খুব গুরুতর আলোচনা ও সমালোচনা চলিতে লাগিল… কেহ বলিল যবনান্নভোজীকে সমাজে আদৌ গ্রহণ করা যায় না; আবার কেহ কেহ মিষ্টান্নম ইতরে জনা:র ব্যবস্থা দিতে লাগিল। দুঃখিনী ‘পদ্মাবতী’ নিরূপায় তাহার এমন সঙ্গতি নাই যে রসনা তৃপ্তিকর অন্ন ব্যঞ্জনাদি দ্বারা সমাজকে পরিতৃপ্ত করাইয়া পুত্র ঘরে লইবার জন্য তখনই অনুমতি লইতে পারেন… ‘পদ্মাবতী’ প্রাণের বেদনায় উন্মাদিনী। পথম দিনের মত আজও তিনি আপন হারানিধিকে কদলীপত্রে ভোজন করিতে দিলেন।
আপন বাড়ীতে আপনার জননীর হস্তে লালনের এই শেষ অন্ন গ্রহণ… এই সময় যশোহর জিলায় ফুলবাড়ী গ্রামে সিরাজ শাহ নামক জনৈক দরবেশ বাস করিতেন। লালল যখন তাহার জীবনদাত্রী জননীর বস্ত্রবয়ন গৃহে শায়িত, ঘটনাক্রমে সেই সময় এই দরবেশও পর্যটন করিতে করিতে এই গ্রামে আসিয়া লালনের বৃত্তান্ত শুনিতে পান এবং অচিরে তাহার রোগ পাশে আসিয়া সমাসীন হন। লালন যখন প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন তখন হইতে সিরাজ শাহ তাহাকে উপদেশ দিতে আরম্ভ করেন। সিরাজের প্রাণস্পর্শী উপদেশে লালনের হৃদয় এক অভিনব ভাবের আবেশে আবিষ্ট হইয়া পড়ে। এই উপদেশ রাশি তাহার যাতনাকিষ্ট মনে এক নব-পর্যায় আনিয়া দেয়। ইহার পর গৃহে প্রত্যাগমন কারিয়া সমাজের অবৈধ নিগ্রহ ও অসহ্য অবজ্ঞার নিবিড় কৃষ্ণ মেঘরাশি যখন তাহার সম্মুখে পুঞ্জিভূত হইতে লাগিলে তখন তিনি আপন হৃদয়ের গোপন ভাবে আপনিই উন্নত্ত হইয়া পড়িলেন… জননী ও অর্দ্ধঙ্গিনীর নিকট শেষ বিদায় গ্রহণ পূর্বক জন্মের মতন গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। ইহার পর লালন ছেঁউড়িয়া গ্রামে আখড়া স্থাপন করেন। কয়েকদিন পর লালনের স্ত্রী এবং মাতার মৃত্যু হয়।
তাহার পিতৃকুলের পরিচয় সংগ্রহ করিতে পারি নাই, তবে মাতৃকুলের দিক দিয়া তাহার পরিচয় প্রদান করিতে সক্ষম হইব। ইহা তাহার মাতৃষ্মমা বংশীয়া কোন বৃদ্ধ মহিলার নিকট হইতে প্রাপ্ত… সাঁইজির মাতামহেয় নাম ভষ্ণদাস। তাহার দুই পুত্র ও তিন কন্যা, পুত্রদয়ের নাম কৃষ্ণদাস ও রাজুদাস। কন্যাত্রয়ের নাম রাধামনি, নারাষণী ও ‘পদ্মাবতী’ ইত্যাদি।
চলবে…
মানবতাবাদী লালন: জীবন অন্বেষা-১॥ বঙ্গ রাখাল