॥পর্ব-৮॥
শীতের সকালে উঠব উঠব করেও নটা বেজে যায়। কিন্তু সকাল আটটা না বাজতে গোলাম মোর্শেদ এসে ডেকে তুলল।
কী, ভাই? ঘুম হলো কেমন?
খারাপ না। হাসল মশি। রাজকীয় ঘুম। ঘুমের চোটে স্বপ্ন দেখারও সময় পাইনি।
হা হা হা করে রীতিমতো গলা ফাটিয়ে হাসল গোলাম মোর্শেদ। স্বপ্ন দেখার দরকার কী? মানিকছড়িতে আসছেন। খোদ রাজার বাড়ি আছে এখানে। একদিন আপনাকে রাজবাড়িতে নিয়ে যাব। স্বপ্নে যা দেখবেন না, তার চেয়ে বেশি দেখবেন রাজবাড়িতে।
বলেন কী? কী এমন জিনিস আছে রাজবাড়িতে, যা স্বপ্নেও দেখা যায় ন।!
জিনিস নয় রে, ভাই। মানুষ। জলজ্যান্ত মানুষ।
ধের ভাই। মশি ঠোঁট ওল্টাল। মানুষ দেখতে আবার রাজবাড়িতে যেতে হয় নাকি? কত মানুষ মানিকছড়ি বাজারে।
মেয়ে। চোখ মটকাল গোলাম মোর্শেদ। রাজবাড়ির মেয়ে। বোঝেন কিছু?
মেয়ে তো বুঝি। কিন্তু রাজবাড়ির মেয়ে বুঝি না। তাদের হাত চারখানা নাকি? মুখ বুঝি দুইটা?
গোলাম মোর্শেদ জবাব দিল না। হো হো করে হাসল।
মুখ ধুয়ে মাথা আচড়ে তৈরি হয়ে নিল মশি। সকালের নাস্তা খাওয়ানোর জন্যে কালকের সে চায়ের দোকানে নিয়ে বসাল গোলাম মোর্শেদ। গতকালকের মতোই পরোটা আর গরুর গোশতের অর্ডার দিল। প্রচুর খদ্দের দোকানে। বয়-বেয়ারাদের হাঁকডাকে সরগরম। কাপ তশতরি আর গ্লাসে গ্লাসে ঠোকাঠুকি। মাঝে মধ্যে সওদাগরের চিল-চিৎকার, এই বিল কত? সবগুলো এক জায়গায় গোল হইয়া কী করতাছস তোরা?’
শীতের সকালে মনোরম রোদ। পুবের পাহাড়গুলোর গায়ে কুয়াশার হালকা আস্তরণ। মরা মনশ্রীতে জল নেই এখন। কোথাও কোথাও বালুচর জেগেছে। তার মাঝ দিয়ে এঁকে-বেঁকে গেছে ক্ষীণ পানির ধারা। পাহাড়ীদের নৌকো বাঁধা। বাজারে এসেছে তারা।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মশি দেখছে এসব দৃশ্য। হিলট্রাক্টস ওর কাছে নতুন না হলেও ওখানে ওর অবস্থানটা এখন নতুন। আগে হিলট্রাক্টসে ছিল ও লেবার; নৌকোর নাইয়া। ওটা ছাড়া আর কোনো পরিচয় ছিল না তার। কিন্তু এখন এখানে সে অন্য এক পরিচয়ে। চায়ের দোকানের এসব বয়-বেয়ারা, লেবার, সাধারণ মানুষজনের চেয়ে ভিন্ন একজন। ও এখন নৌকোর মাঝি নয়। ও একজন সাংবাদিক, লেখক। পাহাড়িকা পত্রিকার নিয়মিত লেখক হিসেবে পত্রিকার সম্পাদক-মালিক তাকে হিলট্রাক্টসে সেনাবাহিনীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আর বর্তমান হিলট্রাক্টসের বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রম সরেজমিনে দেখাতে নিয়ে এসেছে নিজের খরচে। মশি এসব দেখবে, কথা বলবে অনেকের সঙ্গে নিজের চোখে দেখবে সব কিছু। তারপর পাহাড়িকা পত্রিকায় লিখবে বিভিন্ন বিষয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন।
নাস্তা শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়াল তারা। গোলাম মোর্শেদ বোর্ডিংয়ে যেতে বলল ওকে। আমি একটু পরে আসছি। বলে চলে গেল বাজারের ভেতর। বাজার টাজার করবে মনে হয়, মশি ভাবল। বোর্ডিংয়ের দিকে এগোল।
বোর্ডিংয়ের সামনে একটা মাঠ। বোর্ডিংয়ের পাশে যে কয় ঘর পাহাড়ি আছে, তাদের ছেলে মেয়েরা মাঠে বসে রোদ পোহাচ্ছে। একটা দুটো শুকরের বাচ্চা চরছে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে। পাহাড়ী শিশুরা ওর দিকে তাকাচ্ছে। তাদের চোখে কৌতূহল। ও এখানে নতুন মানুষ। অপরিচিত। কৌতূহল নিশ্চয় সে জন্যে। একটা ফোলামুখো শিশুর দিকে চেয়ে চোখ মটকাল মশি। ভেবেছিল পিচ্চিটা হেসে দেবে। তবে পিচ্চির অটুট গাম্ভীর্যে চিড় ধরল না। গোমড়া মুখ আরো গোমড়া করে ফেলল।
নিজের রুমে ঢুকল ও। খাটের ওপর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা লেপটা গুছিয়ে একপাশে রাখল। টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজপত্র গোছাল।
কাল রাতে পল্লবীর কথা অনেক দিন পর অনেকক্ষণ ভেবেছে সে। মেয়েটার চেহারা এখন অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। আটবছর সময় নেহাত কম নয়। এতদিন ধরে একটা মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে স্মৃতির অনেকটাই ফিকে হয়ে আসে। মশি অবাক হয়ে খেয়াল করল, পল্লবীর কথা অনেকটাই মনে করতে পারছে না ও। আচ্ছা, কোথায় এখন পল্লবী? ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে? কার সাথে হয়েছে? ওর বর কি ওরই মতো লেখাপড়া জানা হয়েছে, নাকি অশিক্ষিত কাউকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে? হয়তো সেটাই। বিলাইছড়ির ধানগোদা পাড়ার সেটলারদের মধ্যে বিয়ে করার জন্যে শিক্ষিত ছেলে কোথায় পাবে ও?
পল্লবীর সঙ্গে বিয়ে হলে, মানে পল্লবীকে বউ হিসেবে পেলে জীবনটা কেমন হতো! ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে মশি। স্পষ্ট কোনো চিত্র ফুটে ওঠে না। অথবা যা ফোটে, তার সাথে মেলে না তার বর্তমানের অবস্থার সাথে। পল্লবীর সঙ্গে বিয়ে হলে সে কখনো হিলট্রাক্টস থেকে ফিরে আসত না। আর ফিরে না এলে কোথায় থাকত এখন এ লেখক, সাংবাদিক কবি মশি মোহাম্মদ!
বাহ! মনে মনে হেসে উঠল মশি। লেখক, সাংবাদিক, কবি! তাই বটে। সামাজিক এবং পেশাগত পরিচয় দেয়ার জন্যে যুৎসই শব্দগুলো। তবে এসব শব্দ অর্থনৈতিক অবস্থার সঠিক পরিচয় দিতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের কবি পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিশাল জমিদারির কথাটাও এসে পড়ে। কিন্তু নজরুলের কথা বললে কেন যেন চোখের সামনে ফুটে ওঠে দারিদ্র্য আর খামখেয়ালিপনার বিষয়টা। বিদ্রোহীর কবি গ্রামোফোন কোম্পানির অফিসে গিয়ে গানের রয়্যালটির জন্যে বসে আছেন চুপটি করে, ভাবাই যায় না। আর জীবনানন্দ! বনলতা সেন পড়ার সময় গভীর রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন হওয়া যায়, ছাতার ডাঁটের ব্যবসায়ী, বীমার দালাল কিংবা প্রাইভেট কলেজের স্বল্প বেতনের শিক্ষকের কথা চিন্তাই করা যায় না। লেখক, সাংবাদিক, কবি পরিচয়ধারী মশি মোহাম্মদের অবস্থা তো আরো খারাপ। সে তো পেটেভাতে থাকা একজন গৃহশিক্ষক মাত্র। মাসশেষে বাকির দোকান এড়িয়ে চলা মানুষ। তবে লেখক, সাংবাদিক, কবি—এই তিনটি পরিচয়ের আলাদা একটা মরতবা আছে। কেউ এভাবে পরিচয় করিয়ে দিলে প্রথমে মানুষ একটু হলেও তাকিয়ে দেখে। কেউ কেউ হয়তো ভদ্রতার খাতিরে কিংবা এমনও আছে, যারা সমীহের সঙ্গে বলে, আচ্ছা, তাই নাকি?
কিন্তু সে লেখক, সাংবাদিক, কবি মশি মোহাম্মদের পায়ে এক জোড়া কম দামি স্যান্ডেল। সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে গট গট করে উপস্থাপন করার মতো একজোড়া দামি জুতো কিংবা শু তার নেই। গোলাম মোর্শেদকে এবার আসার সময় বলেছে, তার এক জোড়া শু দরকার। গোলাম মোর্শেদ তাকে কথা দিয়েছে, শু কিনে দেয়া হবে। তবে কিনে দেবে এমন লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
পল্লবীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ারও কোনো কারণ ছিল না। কারণ সে সময় মশি ছিল নৌকোর মাঝি মাত্র। বিয়ে থা করে সংসারী হওয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি তার ছিল না। তাছাড়া লেখাপড়া জানা মেয়ে পল্লবী একজন নৌকোর মাঝিকে বিয়ে করবে কিনা এটাও একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু মশি মেয়েটাকে ভালবেসেছিল। ওর সাথে কিছুদিন একত্রে কাটানোর সুযোগও হয়েছিল। তবে পল্লবীর দিক থেকে কোনো আভাস না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে কাপ্তাই চলে এসেছিল।
গোলাম মোর্শেদ এল আধঘণ্টা পরে। এসেই হৈ চৈ। আরে ভাই, আপনি কী করেন? ওদিকে তো মারাত্মক ব্যাপার ঘটে গেছে। চলেন চলেন। অনেক কাজ।
কী কাজ! সকালে তো কিছুই বলেননি? কোথায় যেতে হবে?
কাজ! কাজ আর কোথায় পাবেন। এখন তো সব চলছে অকাজ।
রেপ চার্জ। যেন বোমা ফাটাল গোলাম মোর্শেদ।
রে-ওে, কী বললেন, রেপ চার্জ! কো-কোথায়? তোতলাতে শুরু করল মশি।
মারাত্মক ব্যাপার ঘটে গেছে ভাই। স্বয়ং উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ। নিজের কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে ম্যাজিস্ট্রেট। লোকজন খেপে গেছে। মেয়েটাকে নিয়ে থানা অফিসে আটকে রেখেছে দারোগা। চলেন চলেন। রিপোর্ট করতে হবে।
উত্তেজনা বোধ করছে মশি। পাহাড়িকা পত্রিকায় এর আগে ক্রাইম রিপোর্ট করেনি সে। ছোটখাট কোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলে সেটা গোলাম মোর্শেদ নিজেই করেছে। কিন্তু ধর্ষক যখন স্বয়ং উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, তাহলে এটা একটা বড় ধরনের রিপোর্ট হবে।
তৈরি হয়ে নিল মশি। চামড়ায় বাঁধানো ডায়রিটা বের করে হাতে নিল। তারপর এগোল গোলাম মোর্শেদের পিছু পিছু। গোলাম মোর্শেদ সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটানে গিলে নেয়া ধোঁয়া নাক আর মুখ দিয়ে এক সঙ্গে বের করতে করতে বলল, জানেন, এই উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটটা বড় খতরনাক। কাউকে মানুষ মনে করে না। এইবার ব্যাটাকে পাওয়া গেছে। এমন রিপোর্ট করবেন, যেন ডিটেলস সব কিছু উঠে আসে।
মশি এর আগে কখনো থানায় যায়নি। গোলাম মোর্শেদের পিছু পিছু থানা ভবনে গিয়ে ঢুকল। গোলাম মোর্শেদকে দেখে হাসল ওসি। কী সাংবাদিক সাব, খবর পেয়ে এসেছেন নাকি? বসেন। ইনি?
গোলাম মোর্শেদ মশির পরিচয় দিল। বলল, ইনি হলেন মশি মোহাম্মদ। আমাদের পাহাড়িকা পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক। এই কেসটা উনিই দেখবেন। আপনি যদি ওনাকে হেল্প করেন…
অবশ্যই। হাত বাড়িয়ে দিল ওসি। বলেন, মশি সাহেব। কী জানতে চান?
বছর চল্লিশেক বয়স হবে ওসির। গাট্টাগোট্টা চেহারা। নাকের নিচে একজোড়া বেমানান গোঁফ। টকটকে ফরসা রঙ। কালো গোঁফজোড়া তাই বড় বেশি স্পষ্ট।
মশি কিছু বলার আগেই বাধা দিল ওসি। দাঁড়ান, আগে একটু চা টা খেয়ে নিন। সকাল থেকে এই নিয়েই আছি। আপনি আসার আগেই আরো দুজন সাংবাদিক এসেছিল। তাদের সাথে অনেক কথা বলতে হয়েছে। নানাধরনের প্রশ্ন। কথা শুনে মনে হয়েছে, যেন রেপটা আমিই করেছি। বুঝলেন, ভাই। একটা থানার ওসি হওয়া বড় যন্ত্রণার। কোথায় কে কী অপরাধ করেছে, সেটার জবাব দেয়া লাগবে ওসির। ওপরঅলার কাছে তো বটেই, সাংবাদিকদের কাছে।
মশি হাসল। তবে গোলাম মোর্শেদ হৈ হৈ করে উঠল। আরে, আপনি এসব কী বলেন। আপনার দোষ হবে কেন? রেপটা তো এখানে আপনি করেননি। এখানে একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তার নামে এ অভিযোগ এসেছে। পাবলিক খেপে উঠতে চাইছে। ওসি হিসেবে আপনার দায়িত্ব, দুদিকটাই দেখা। আমার পত্রিকা উল্টাপাল্টা সংবাদ প্রচার করে না। আপনি নিশ্চয় জানেন। জানেন না?
হেসে পা নাচাতে নাচাতে মাথা দোলালো ওসি। একজনকে ডেকে চা আর সিগারেট দিতে বলল। মশির মনে হলো গোলাম মোর্শেদের মিঠে কথায় খুশি হয়েছে। সে আমি জানি, মোর্শেদ সাহেব। আপনার পত্রিকায় আলতু ফালতু কিছু আসে না। আপনি যা সত্য, তা-ই তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ভাই, আমি আছি বিপদে। একদিকে একজন সম্মানিত সরকারি কর্মকর্তা, অন্যদিকে অশিক্ষিত, মূর্খ সেটলারের দল। খেপে একদম বোমা হয়ে আছে এক একটা। মেয়েটিকে তাই হাজতে এনে রেখেছি।
চলবে…
মনশ্রী: পর্ব-৭॥ মাসুদ আনোয়ার