॥পর্ব-৬॥
পল্লবী শতরূপা ইয়াসমিনের স্মৃতিটা মনের অনেক গভীরে চলে গেলেও ওর সঙ্গে কাটানো সময়টা ভোলেনি মশি। অবশ্য তেমন গভীর কোনো অন্তরঙ্গ সময়ও ছিল না সেটা। কাপ্তাই জেটিঘাট থেকে নিয়ে যাওয়া শরণার্থীদের জন্যে ত্রাণসামগ্রী বোঝাই নৌকোটা যদি তার পরের দিন আনলোড হয়ে যেত, তাহলে পল্লবীর সঙ্গে কখনো দেখা হতো না। কিন্তু সে রাতে ঘোর বৃষ্টি নামলো আর তা থামলো পরদিন সন্ধের পরে। সারারাত আর দিনভর মশিরা নৌকো থেকে পানি ফেলতে ফেলতে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেল। গমের বস্তাগুলো কোনোমতে তেরপল দিয়ে ঢেকে বৃষ্টিতে ভেজা থেকে রক্ষা করা গেল। সন্ধের পর বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক, আগামীকাল সকালে মাল ঝেড়ে ফেলে কাপ্তাইয়ের উদ্দেশে নৌকো ছাড়া যাবে।
রাতের বেলা টিলার ওপর সেটলারদের দোকানগুলো জমে ভাল। দিনভর কাজ করে লোকজন সন্ধের দিকে দোকানে বসে আড্ডা মারে। নিজের দেশ-বাড়ি ছেড়ে পাহাড়ে এসে বসতি করা মানুষগুলো ধীরে ধীরে নিজেদের অভ্যস্ত করে নিচ্ছে নতুন পরিবেশের সঙ্গে। দোকানে চায়ের কাপে টুংটাং চামচ নাড়ার শব্দ। ক্যাসেটে হাসান হোসেনের জারিগান। দেখে কে বলবে এরা এখানে নতুন।
সকাল সকাল ভাত খেয়ে মশি নিজেও ওপরে উঠল। এখনো ঘুমানোর সময় হয়নি। সেটলারদের সঙ্গে কিছু সময় আড্ডা মেরে কাটানোর ইচ্ছে হলো ওর।
টিলার ওপরে উঠতেই একটা চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এল একজন। আন্তরিক ভঙ্গিতে আপ্যায়ন করল, আরে মাঝি ভাই যে! আসেন আসেন।
লোকটাকে দেখল মশি। চিনতে পারল। কাল যে দুজন লোক কাপ্তাই জেটিঘাট থেকে গমের বস্তা নিয়ে এসেছিল তাদের একজন। গলায় গতকালের মতোই লাল মাফলার জড়ানো। মশিকে প্রায় টেনে নিয়ে চায়ের দোকানে বসাল। আপ্যায়িত বোধ করল মশি। সবাই বেশ সমীহের চোখে চাইছে ওর দিকে। ওদের জন্যে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এসেছে যে নৌকোটা, সে নৌকোর মাঝি সে। তাকে তো ইজ্জত করতেই হয়। দোকানদার চা এনে দিল। সঙ্গে গোল্ডলিফের একটা আস্ত প্যাকেট।
প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে ঝোলাল মশি। প্যাকেটটা ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে দোকানদারের দিকে বাড়িয়ে ধরতে হা হা করে উঠল লোকটা। আরে না না, মাঝিভাই। ওটা আর ফেরত দিতে হবে না। ওটা পুরোটাই আপনার জন্যে। নৌকোয় নিয়ে যান। খাবেন ধীরে সুস্থে।
লোকটার ভদ্রতায় মুগ্ধ হবে কিনা ভাবছে মশি। কিন্তু আস্ত এক প্যাকেট গোল্ডলিফ অফার করার মতো এতটা ভদ্রতাও কেমন যেন লাগছে। এই লোক নিজে গোল্ডলিফ খাওয়ার মতো অবস্থার নয়। গায়ে সস্তাদরের পাঞ্জাবী, পরনে কম দামি লুঙ্গি। গালভাঙা চেহারা। লোকটার পদ বুঝতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না মশির। এরা গ্রামের এমন এক শ্রেণীর মানুষ, যারা কোনো কাজকর্ম করে না, কিন্তু এদের পকেটে নগদ টাকার অভাব থাকে না কখনো। এদের নানা ধান্দা আছে। ফন্দি-ফিকির করে টাকা কামায়। তবে সে টাকার পরিমাণ খুব বেশি হয় না।
সাধা জিনিস ফেলতে নেই। বিশেষ করে লোকটা এত করে দিতে চাইছে যখন। পুরো প্যাকেটটা পকেটে পুরল মশি। মুখে বলল, ধন্যবাদ, ভাই।
লোকটা হাসল খ্যা খ্যা করে। তারপর বাইরে তাকিয়ে চওড়া গলায় ডাকল, পল্লবী।
বাইরে থেকে একটা মেয়ের গলা শোনা গেল। কী?
এদিকে আস। কতা হুইনা যাও।
কী কতা? কও।
মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে না মশি। তবে অদ্ভুত এক সুরেলা গলা শুনতে পাচ্ছে ও। সেটলাররা নেহাত বিত্তহীন। দেশেও এদের তেমন আদর কদর ছিল না। মানুষগুলো ছিন্নমূল। পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার জায়গা জমি দিচ্ছে শুনতে পেয়ে দেরি করেনি। জন্মভূমি ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেনি। কারণ দেশে মাটির সঙ্গে তাদের কোনো বন্ধন ছিল না।
অশিক্ষিত ভূমিহীন মানুষের দল। এদের মধ্যে শিক্ষিত মানুষ নেই। কিন্তু মেয়েটার গলায় সুরেলা টান ছাড়াও এমন কিছু ছিল, যা মশির কানে আলাদা করে বেজে উঠেছে। একটু উৎসুক হলো ও। এমন সুরেলা গলার মেয়েটা দেখতে কেমন হবে জানি।
একটু পরেই এল মেয়েটা। শ্যামলা, অনেকটা কালোই বলা চলে। মুখ লম্বাটে। খাড়া নাক। গড়পরতা চেহারা। তবু কেমন যেন অন্যরকম লাগল মশির কাছে। হয়তো মেয়েটার গলার সুরেলা টানের জন্যেই্॥
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দেখছে মশি মেয়েটিকে। লোকটা নানারকম প্রশ্ন করছে। ওর বাবা কোথায়? এত রাতে কেন বেরিয়েছে বাজারে এসব। সব প্রশ্নের জবাব দিল মেয়েটা। তারপর ধীরে সুস্থে চলে গেল।
মশির দিকে চাইল লোকটা। বুঝলেন ভাই, মাইয়া ভাল। তয় একটু পাগলা কিছিমের আছে। লেখা পড়া জানে তো তাই।
মানে? কী বলেন? লেখাপড়া জানলে মানুষ পাগলা কিছিমের হয় নাকি?
ওর কথায় কান দিল না লোকটা। বলে চলল, কিন্তু লাভ কী? এখানে পাহাড়ে জঙ্গলে তার লেখাপড়ার মর্ম কে বুঝব?
লোকটার কথায় আর কান দিচ্ছে না মশি। বুঝতে পারছে বেশি কথা বলে লোকটা। বেশি কথা বলা লোকদের বেশি পাত্তা দিতে নেই। তাদের সব কথা শোনা ঠিক নয়।
নৌকো আনলোডের কথা জানতে চাইল সে। কাল সকালেই কিন্তু লেবার লাগিয়ে দিতে হবে, ভাই। বেশি দিন মাল নিয়ে ঘাটে বসে থাকা যাবে না। মালিক ডেমারেজ গুণবে।
অসুবিধা নাই, মাঝিভাই। নৌকা কালকেই খালি হইব। তয়…থেমে গেল লোকটা।
তয়?
না, মানে… চলেন নৌকায় যাই। নৌকায় গিয়া কতা কই।
এখানে কথা না বলে নৌকোয় গিয়ে কথা বলার প্রস্তাবটা ভাল লাগল না মশির। লোকটার সঙ্গে এমন কোনো গোপন কথা নেই, যা দোকানে বলা যাবে না, নৌকোয় গিয়ে বলতে হবে।
গোপন কথা নাকি? ঠাট্টা করল মশি।
না না…গোপন আর কী! হাসল লোকটা। এমনি গিয়ে আড্ডা মারব। আপনে ভাই মাঝি মানুষ। মাল লই আমগো ঘাটে আইচেন, আর কখনো আইবান তার কি ঠিক আছে? আছে কি না কন, ভাই?
লোকটার ভাবভঙ্গি ভাল লাগছে না মশির। ওর মনে হচ্ছে লোকটা নৌকোয় গিয়ে কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু এই লোকের কীইবা বলার থাকতে পারে? কাপ্তাই থেকে সেটলাদের জন্যে গমের নৌকা নিয়ে এসেছে পাহারাদার হিসেবে। ওর কাজ শেষ। কাল সকালে মাল আনলোড করলে মশির দায়িত্বও শেষ। আর সে কখনো আসবে বলে মনে হয় না এখানে। সুতরাং তার সঙ্গে এই লোকের এমন কোনো জরুরি বা গোপন কথা থাকতে পারে না, যা নৌকোয় গিয়ে নিরিবিলিতে বলতে হবে। তবে সরাসরি নাও বলতে পারছে না।
চা খেয়ে দ্বিতীয় সিগারেটটাও শেষ করল মশি লোকটার কথা শুনতে শুনতে। সিগারেটের গোড়াটা চায়ের কাপেই ফেলে উঠে দাঁড়াল। চলেন। আমি এখন নৌকায় যাচ্ছি।
উঠল না লোকটা। বলল, আপনে যান। আমি আইতাছি একটু পরে।
কথা বাড়াল না মশি। উঠে পড়ল। বেরিয়ে গেল দোকান থেকে। বিরক্ত বোধ করছে লোকটার ওপর। লোকটা কী বলবে বুঝতে পারছে না। মতলব ভাল ঠেকছে না। তবে ভয় পাচ্ছে না।
নৌকোয় এসে ছইয়ের ওপর বসল। বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। কালো আকাশে অসংখ্য তারা ফুটেছে আজ। পানিতে তার গাঢ় প্রতিচ্ছায়া। চুপচাপ বসে আছে মশি। নাইয়ারা ঘুমিয়ে পড়েছে। পশ্চিম থেকে সুন্দর বাতাস দিয়েছে। আসলে দখিনা বাতাস। কিন্তু ঘোনার মুখের উঁচু পাহাড়টায় বাধা পেয়ে উত্তরে যেতে না পেরে পুবদিকে মোড় নিয়েছে।
ভাবছে মশি। তবে কী ভাবছে নিজেই বুঝতে পারছে না। এলোমেলো সব চিন্তা এসে জট পাকাচ্ছে মনে। কিন্তু একটু পরে অবাক হয়ে খেয়াল করল, সে টিলার ওপরে দোকানে দেখা সে মেয়েটার কথাই ভাবছে।
ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল। মেয়েটার কথা ভাবার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ দেখছে না সে। কাউকে নিয়ে ভাবতে হলে তার সম্পর্কে জানতে হয়, খুব অন্তরঙ্গ না হোক, একটা মোটামুটি হলেও সম্পর্ক থাকতে হয়। হঠাৎ একটা কথো মনে পড়ল ওর। মেয়েটা লোকটার সঙ্গে কথা বলার সময় একবার চোখ তুলেছিল ওর দিকে। তখন মশির তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, মেয়েটার চোখদুটো অসম্ভব উজ্জ্বল এবং কিছুটা তীক্ষ্ণ। চাউনিতে এমন কিছু ছিল, যা একজন সেটলার মেয়ের চোখে থাকার কথা নয়। কিন্তু পল্লবী নামের এই মেয়েটার চোখে তা ছিল। মশিকে দেখে তার মধ্যে কোনো ধরনের সঙ্কোচ কিংবা লজ্জাভাব আসেনি। মশির মনে হচ্ছে, ওই লোকটাকেও খুব একটা পাত্তা দেয়নি মেয়েটা।
মেয়েটার কথা ভাবা বন্ধ করে দিল মশি। এর কোনো মানে হয় না। একটা সেটলার মেয়ের কথা ভাবার জন্যে সে ধানগোদা পাড়ায় আসেনি। কাল সকালে নৌকো খালি হলেই সে চলে যাবে কাপ্তাই। কখনো আর এখানে আসবে না।
লোকটা মনে হয় আসবে না। মশি বিরক্ত হলো। পাগল নাকি লোকটা? আসব বলেও আসে না? শুধু শুধু তাকে বসিয়ে রাখার অর্থ কী?
আড়মোড়া ভাঙল সে। সিগারেট ধরাল। আর অপেক্ষা করবে না। এবার ঘুমোতে যাবে। কাল সকালে উঠতে হবে।
ঠিক এ সময়ে ওপর থেকে সতর্ক গলায় ডাকল কেউ। মাঝিভাই!
চলবে…