॥পর্ব-৫॥
গোলাম মোর্শেদের বউয়ের হাতের রান্না এত চমৎকার! না খেলে বুঝতেই পারত না মশি। আয়োজন এমন আহামরি কিছু নয়। মোরগের মাংসের ঝোল, লাউ আর ফুলকপি ভাজি। চিকন চালের ভাত। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেল। অবশ্য গোলাম মোর্শেদের পীড়াপীড়িরও একটা ভূমিকা ছিল বেশি খেয়ে ফেলার ব্যাপারে। এই সামান্য আয়োজনেও বেশ যত্ন করে খাইয়েছে। একটা ছোট কাজের মেয়ে ভাত-তরকারি এনে দিয়েছে। গোলাম মোর্শেদের বউ সামনে আসেনি। মনে হয় পর্দানশীন মহিলা। মশি তা নিয়ে খুব একটা মাথাও ঘামায়নি। মনে মনে ভদ্রমহিলার চমৎকার রান্নার তারিফ করতে করতে ‘আর না, আর না’ করেও তিন প্লেট ভাত খেয়ে ফেলেছে।
খাওয়া শেষ করে মানিকছড়ি বাজারের বোর্ডিংয়ে থাকার জায়গা করে দিয়েছে গোলাম মোর্শেদ। বোর্ডিংটার কপালে ঝোলানো সাইনবোর্ডটা বিকেলেই খেয়াল করেছে মশি। করোগেটেড টিন আর বাঁশের বেড়ায় তৈরি সাত-আট রূমের বোর্ডিংটার নাম মনশ্রী বোর্ডিং। নদীর নাম হিসেবে মনশ্রী নামটা চমৎকার লাগলেও প্রায় ভাঙাচোরা একটা বোর্ডিংয়ের নাম হিসেবে যুতসই মনে হয়নি মশির কাছে। ওর মনে হয়েছে এমন চমৎকার একটা নামের অপব্যবহার করেছে বোর্ডিংয়ের মালিক। বেচারা হয়তো চাটগাঁর একজন সওদাগর শ্রেণীর লোক। মনশ্রী নামের মানেটাই জানে না। জায়গাটার নাম মানিকছড়ি। জায়গার নামে বাজারটার নামও। বোর্ডিংটার নাম মানিকছড়ি বোর্ডিং হতে পারত। মনে মনে হাসল মশি। চট্টগ্রামের সওদাগর শ্রেণীর মানুষগুলো সাধারণত অশিক্ষিতই হয়। তবে এই সওদাগর হয়তো শিক্ষিত। কিংবা অশিক্ষিত হলেও লোকটার মধ্যে একটা সৌন্দর্য চেতনা রয়েছে। কান আছে বটে লোকটার। মশির মতোই মনশ্রী নামটার গুণমুগ্ধ সেও।
শীতের রাত। নটা বাজতেই চারদিক কেমন সুন সান হয়ে পড়েছে। বাজারের দু’একটা দোকানে বাতি জ্বলছে এখনো। কয়েকটা কুকুর কী নিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়েছে। খুব ‘ঘেউৎকার’ চলছে।
নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল সে। ওর একা রুম। রুমের দু’পাশে দুটো খাট। দু’জন বোর্ডারের থাকার ব্যবস্থা। তবে এখন ও একা। অন্য সিটে লোক নেই। মনশ্রী বাজারে বোধ হয় বাইরের লোক খুব আসে না। পুরো বোর্ডিংটা প্রায় ফাঁকাই পড়ে আছে।
একজনের শোয়ার উপযোগী ছোট খাটটায় পরিষ্কার সাদা বেডশিট বিছানো। এক পাশে একটা লেপ। পাহাড়ি শীতের রাত ভালোই জমে উঠেছে। দীর্ঘ বাসযাত্রায় ক্লান্ত শরীর। এখনই লেপের ভেতরে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করছে ওর। শীতের রাতে জম্পেশ ঘুম হবে।
কিন্তু উপায় নেই। গোলাম মোর্শেদ আসার সময় একগাদা কাগজপত্র ধরিয়ে দিয়েছে ওর হাতে। বলেছে, আজ আর লেখালেখির কাজ নেই। আজ পড়বেন। এগুলো খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়বেন। লেখার সময় কাজ দেবে।
কাগজপত্রের বান্ডিল খাটের সাথে লাগোয়া ছোট্ট টেবিলটায় রাখল মশি। জুতো খুলে খাটের ওপর পা তুলে বসল। সদ্যকেনা প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে ঝোলাল। কাগজপত্রগুলো দেখতে শুরু করল উল্টে পাল্টে। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা বাহিনীর উন্নয়ন কার্যক্রমের ফিরিস্তি। পাহাড়িকা পত্রিকার রুটিন লেখা। প্রতি সংখ্যাতেই থাকে। পড়তে লাগল মশি।
গোলাম মোর্শেদের ‘পাহাড়িকা’ পত্রিকাটি আসলে এক ধরনের প্রচারপত্র। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর নানা অপকর্ম আর সেনাবাহিনীর উন্নয়ন প্রচেষ্টাকেই তুলে ধরাই হলো এটার সম্পাদকীয় নীতিমালা। তাছাড়া ১৯০০ সালের সিএইচটি কমিশনের বিরোধিতা, এই আইনের অযৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, সাধারণ পাহাড়িদের কাছে শান্তি বাহিনীর অগ্রহণযোগ্যতা, শান্তিবাহিনীর চাঁদাবাজি, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্যে নানারকম নেতিবাচক প্রচারণা—এসবই হলো পাহাড়িকা পত্রিকার-লেখার মূল উপজীব্য। গত কয়েক সংখ্যায় এসবই লিখে আসছে মশি।
সব বিষয়ে একমত হতে পারে না সে। তবে শান্তিবাহিনীর ব্যাপারে গোলাম মোর্শেদের সঙ্গে মতপার্থক্য নেই ওর। মানবেন্দ্র লারমা যে উদ্দেশ্য নিয়েই এই বাহিনীর জন্ম দেন না কেন, সন্তু লারমার শান্তিবাহিনীর সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। মশির পার্বত্য চট্টগ্রাম জীবনে শান্তিবাহিনী একটি কালো অধ্যায়।পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী থাকায় একটা সুবিধে হলো, শান্তিবাহিনী দুর্বৃত্তপনা চালানোর খুব বেশি সুযোগ পাচ্ছে না। তবু এরই মধ্যে ভূষণছড়ায় বাঙালি সেটলারদের ওপর বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা। বরকলের ভুষণছড়ায় তাদের ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন বাঙালিরা বসতি করার জন্যে যেতে ভয় পাএ, সেটা নিশ্চিত করা। তবে তাদের সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। হাজার হাজার সেটলার এসে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গেড়েছে, আর পাহাড়িরা বাড়িঘর ছেড়ে পূর্ব আর উত্তর দিকে কালাপাহাড়ের কাছে চলে গেছে। শান্তিবাহিনী তাদের বুঝিয়েছে, ‘বাঙাল’রা তাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা কেড়ে নেবে, ‘ধম্ম’ নষ্ট করে দেবে, মেয়েদের ইজ্জত নষ্ট করতে চাইবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
মানবেন্দ্র লারমা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ‘জুম্ম জনগোষ্ঠী’র জন্যে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন। এক পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রীতি গ্রুপের হাতে মানবেন্দ্র লারমা খুন হয়ে যাওয়ার পর শান্তিবাহিনী দুই ভাগ হয়ে গেল। লারমা গ্রুপের দায়িত্ব পড়ল মানবেন্দ্রর ভাই সন্তু লারমার ওপর।
মানবেন্দ্র লারমা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা। সাবেক পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ এবং বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রাম-১ আসন থেকে নির্বাচিত সদস্য। পাহাড়ীদের নেতা হিসেবে ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠা করে তিনি হঠকারিতার পরিচয় দেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের ডাক দিয়ে রাষ্ট্রকেও ক্ষুব্ধ করে তোলেন। ১৯৭৩ সাল থেকে শান্তিবাহিনী সশস্ত্র লড়াইয়ের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসের যে মহাযজ্ঞ শুরু করেছিল, তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তাদের দমনের পাশাপাশি বাঙালিদেরও পার্বত্য চট্টগ্রামে চালান করতে থাকেন।
মশির বিশ্বাস, শান্তি বাহিনীর হঠকারিতা শুরু না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কখনো দলে দলে সেটলারের আগমন ঘটত না।
ফাইলপত্র একপাশে রেখে মশি সিগারেট ধরিয়ে টানতে শুরু করল। চারদিক এখন নিশ্চুপ, সুনসান। বাজারে কুকুরগুলোর ঘেউৎকার পর্যন্ত নেই। কিছুক্ষণ আগেও পাশের রুমে দু’জন বোর্ডার চাটগাঁর ভাষায় কী নিয়ে যেন গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করেছে, ক্ষাণিক পরে আবার দু’জনে কিভাবে যেন একমত হয়ে খোশগল্প শুরু করেছে আর অট্টহাসি হাসতে হাসতে শীতের রাতকে পর্যন্ত রীতিমতো গরম করে তুলেছে। বাইরে তীব্র শীত। বোর্ডিং হাউসের খড়ের চালে শিশির ঝরার শব্দ। পাশে কয়েকঘর চাকমার বাস, দিনেই খেয়াল করেছে মশি। আচমকা পাহাড়িদের কোনো একটা ঘর থেকে একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গেই তার মায়ের সতর্ক গলা শোনা গেল, ‘আ আ আ… হি হাঁদে লক্কোবা….উঁ উঁ উঁ…’।
একটু পরেই কান্না বন্ধ হয়ে গেল বাচ্চার। মায়ের দুধের বোঁটা মুখে পেয়ে গেছে মনে হয়। আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল। কেবল কোথায় যেন একদল কুকুর ঝগড়া করছে গলা ফাটিয়ে পরস্পরের সঙ্গে, অনেক দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে তাদের ঝগড়াটে গলার আওয়াজ।
শীতের রাত। ধবধবে চাদর বিছানো খাটের পাশে লালরঙের ওয়ার পরানো লেপ। ইচ্ছে করলেই মশি এখন তাতে ঢুকে যেতে পারে। গোলাম মোর্শেদের দেওয়া ‘জরুরি’ ফাইল ওর পড়া হয়ে গেছে। সামনে যেসব বিষয়ে লিখতে হবে বলে ভাবছে, তার সঙ্গে এগুলোর তেমন কোনো সম্পর্ক থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। সেনাবাহিনীর এসব উন্নয়নের ফিরিস্তির কথা সে আগেও লিখেছে। এসব যে কেবলই প্রচারণা তা নয়, কিছু কিছু কাজ যে হচ্ছে, সেটা মশি আগেও দেখেছে। কাল থেকে গোলাম মোর্শেদ তাকে নিয়ে হয়তো নতুন কিছু দেখাবে। সে জন্যেই তো চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে তাকে।
সিগারেট ফেলে দিয়ে জামা খুলে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল সে। লেপ টেনে গায়ে জড়ালো। দীর্ঘ সময়ের বাসযাত্রায় শরীর ক্লান্ত। লেপের উষ্ণ আরামে এক ঘুমে রাত কাবার করে দেওয়ার কথাটা ভাবতেই উৎফুল্ল বোধ করছে।
কিন্তু ঘুম মাথায় উঠল। ধানগোদা পাড়ার পল্লবী শতরূপা ইয়াসমিন নামটা সে অনেক বছর ভুলেছিল। মাঝে মাঝে যে একদম মনে হতো না তা নয়। কিন্তু সে স্মৃতিতে তেমন কোনো জ্বালা ছিল না। অবশ্য জ্বালা হয়ে ওঠার মতো তীব্র কোনো ঘটনাও তা ছিল না। পল্লবীকে ওর ভালো লেগেছিল, একান্ত করে পাওয়ার ইচ্ছেও হয়েছিল। কিন্তু পল্লবীর কাছ থেকে তার সামান্য প্রকাশও পাওয়া যায়নি।
লেপের উষ্ণ আরামেও ঘুম আসছে না। মনের ভেতর অনেক কিছু এসে জমাট বেঁধেছে যেন। এখন থেকে আট বছর আগে ওর বয়স ছিল ২২ বছর। আর এখন ত্রিশ পেরোচ্ছে। পল্লবীকে যখন দেখে, তখন সবে এসএসসি শেষ করেছে সে। কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। ভর্তি হওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতিও ছিল না। কিশোরগঞ্জ থেকে বাবা-মা আর ছোট দুই ভাইসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিল। দেশে তেমন কিছু ছিল না। ঘরের একটা ভিটা, ভিটার পাশে একখণ্ড জমি আর পুকুরের সামান্য অংশ। বাবা দিনমজুর। ছাত্রী ভালো ছিল পল্লবী। তাই স্কুলের বেতন, বইপত্র কেনার টাকার জন্যে খুব একটা আটকায়নি। স্কুল থেকে ফুল ফ্রি, আত্মীয় স্বজনের সহায়তায় লেখাপড়ার খরচ মিটিয়েছে ওর বাবা। প্রথম বিভাগ না পেলেও ভালো নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাস করেছে। কিন্তু কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। ঘরে বসে থাকার সময়টা টিউশনি করত সে। ভাবত, কিছু টাকা টাকা জমলে কলেজে ভর্তি হবে। কিন্তু শিগগিরই অভাবের সংসারে টাকা জমানো যে কতটা কঠিন বুঝতে পারল।
দু’বছর পরে বাবা ওদের নিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে সেটলার হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চলে এলো।
চলবে…