॥পর্ব-১২॥
নতুন জুতো আর মোজা পরে ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এলো মশি। ক্যাপ্টেন সাহেব মানুষ ভালোো। অনেক কথা বললেন, প্রশংসা করলেন মশির লেখার। ভিন্ন ভিন্ন নামে লেখা হয় শুনে হাসলেন কিছুক্ষণ। একসময় চা খেয়ে বিদায় নিলো তারা।
বেরিয়ে এসে অনেক কথা বললো গোলাম মোর্শেদ। বেশির ভাগই সেনাবাহিনীর প্রশংসা। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী থাকাতে কী কী লাভ হয়েছে, তার একটা ফিরিস্তিও দিয়ে ফেললেন মুখে মুখে। মশির কাছে সেসব নতুন কিছু নয়। তবে একটা বিষয়ে সে এক মত। শান্তিবাহিনীর প্রাদুর্ভাব না হলে নিয়মিত সেনা উপস্থিতি ছাড়া এতটা ব্যাপক হারে সেনা মোতায়েন ঘটতো না পাহাড়ে।
ক্যাপ্টেন সাহেব রানী নিহার দেবী হাই স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণও জানালেন মশিকে। তিনি অনুষ্ঠানে থাকবেন প্রধান অতিথি হিসেবে।
আমন্ত্রণটা পেয়ে ভালো লাগল মশির। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো খুব। যে সে লোককে আমন্ত্রণ জানানোর কথা নয় ক্যাপ্টেনের। ‘পাহাড়ের কথা’য় তার লেখাগুলো নিশ্চয় ভালো লেগেছে ক্যাপ্টেনের। মশি বুঝতে পারছে, বেকার একজন কবি হলেও তার কথা গুরুত্ব আছে। এটা তাকে আত্মবিশ্বাস জোগাল।
সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। সেদিনের সে হোটেলটায় ঢুকল গোলাম মোর্শেদ। মশির পায়ে নতুন চকচকে জুতো। হোটেলে ঢুকে একটা টেবিলে বসার আগে পর্যন্ত নিজের পায়ে শুয়ের মস মস শব্দ কান পেতে শুনল সে। হোটেলের বয়-বেয়ারাদের কাছে নিজের গুরুত্ববহ উপস্থিতি অনুভব করল মনে মনে। টেবিলে বসে বাইরে তাকাল। সন্ধে নামছে। মানিকছড়ি বাজারকে অন্যভাবে অনুভব করল সে। মনে হলো, হোটেলে চা-নাস্তা খেতে আসা লোকজনের গুঞ্জন, বয়-বেয়ারাদের কর্মব্যস্ততা, হাঁক ডাক আর বাইরে লোকজনের হাঁটাচলা, ব্যস্ততা, উদাসীনতা—এসবের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করার এক অন্যরকম আমেজ রয়েছে।
খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে গোলাম মোর্শেদ দারুণ দরাজদিল। গরম গরম পরোটা আর গরুভুনা এনে সামনে রাখল টেবিল বয়। খিদে পেয়েছে, বুঝতে পারল মশি। রীতিমতো হামলে পড়ল প্লেটের ওপর। একটু পরোটা ছিঁড়ে নিয়ে এক টুকরো মাংস পেঁচিয়ে ঢোকাল গালের ভেতর। আরাম করে চিবুতে শুরু করল।
গোগ্রাসে গিলছে গোলাম মোর্শেদও। মশি লক্ষ করেছে, খেতে ভালোবাসে লোকটা। চোখ বন্ধ করে পরোটা আর মাংস চিবুচ্ছে সেও। মিনিট খানেক পরে চোখ খুললো—বুঝলেন মশি সাহেব, আগামী সংখ্যাটা খুব গর্জিয়াস করে বের করতে হবে। এখন থেকে ভাবতে শুরু করেন, কী কী লিখবেন? ক্যাপ্টেন সাহেব যাতে খুশি হন।
—লেখার মালমশলা তো আপনি দেবেন। আমি শুধু সেগুলোকে পরিবেশন করব।
—ঠিক বলেছেন। একমত হলো গোলাম মোর্শেদ।
—ভালো কথা, এ সংখ্যা থেকে আপনার নাম যাবে প্রিন্টার্স লাইনে। নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে।
রোমাঞ্চিত হলো মশি। ‘পাহাড়ের কথা’ পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে তার নাম যাবে, এটা যা তা কথা নয়। অবশ্য এটা যে তার যোগ্যতার পুরস্কার, এটাও ঠিক। একটা পত্রিকা সে গত কয়েক মাস ধরে নিজের লেখা দিয়ে চালিয়ে আসছে, এটা পাঠক না জানুক, সম্পাদক তো জানে। সুতরাং এই পদোন্নতি সে পেতেই পারে।
চা খেতে খেতে আরো কথা হলো ‘পাহাড়ের কথা’ পত্রিকার সম্পাদক এবং নির্বাহী সম্পাদকের মধ্যে।
এক সময় সম্পাদক বললো—চলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের বাসায় যাই। সেখানে তিনি হয়তো অপেক্ষা করছেন সাংবাদিকদের জন্যে।
ব্যাপারটা বুঝতে কষ্ট হলো না মশির। খারাপ লাগতে শুরু করলো তার। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, আপনি যান। গোপন কাজ গোপনে হওয়াই ভালো।
—মানে?
—মানে হলো, আমি গেলে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হয়তো সংকোচ বোধ করতে পারেন। মন খুলে কথা নাও বলতে পারেন। বোঝেননি?
এক মুহূর্ত চুপ করে রইল গোলাম মোর্শেদ। তারপর মাথা নাড়ল, হুম, ঠিক বলেছেন। আচ্ছা আপনি বোর্ডিংয়ে যান। যেসব তথ্য দিয়েছি, সেগুলো দিয়ে একটা লেখা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন।
বিল মিটিয়ে বেরিয়ে গেলো গোলাম মোর্শেদ। মশি বোর্ডিংয়ে গিয়ে ঢুকলো। গোলাম মোর্শেদ বলেছে, ‘পাহাড়ের কথা’র আগামী সংখ্যা ‘গর্জিয়াস’ করতে হবে। তার মানে হলো মশিকেই লিখতে হবে ’গর্জিয়াস’ সব লেখা। মনে মনে তৈরি হলো সে। তবে একটা সমস্যাও দেখছে। বিভিন্ন বিষয়ে লিখলেও শেষ পর্যন্ত সব একই কথার পুনরাবৃত্তি হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
সিগারেট ধরিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ও। লেখার বিষয়ে ভাবতে শুরু করল। কিন্তু মন বসাতে পারছে না। বোর্ডিংয়ের পাশে পাহাড়ীদের ঘর। সন্ধের আগমনে মুখর হয়ে উঠেছে। বাচ্চাদের হৈ চৈ আর কান্নাকাটির আওয়াজ, বড়দের হাসি-গল্প। পাহাড়ী নারীদের কলকণ্ঠও শোনা যাচ্ছে। মশির পাশের কক্ষে কয়েকজনের গলা। হাসি-ঠাট্টা আর মাঝে মাঝে তর্ক-বিতর্কও। তাস ফেটানোর শব্দও শোনা যাচ্ছে। মশির একবার ইচ্ছে হলো তাদের সঙ্গে গিয়ে বসে আলাপ-পরিচয় করে। কিন্তু পরক্ষণে বাতিল করে দেয় চিন্তাটা। জানে, একসময় এই শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে ওঠা-বসা থাকলেও এখন আর নেই। এখন সে সাংবাদিক ও লেখক। ওর আলাদা এক শ্রেণি হয়েছে। সেটা ঠিক কী সে স্পষ্ট বুঝতে পারে না। কিন্তু এদের সাথে মিশতে এখন সঙ্কোচ বোধ করে, আর আগের সে স্বতঃস্ফূর্ততা খুঁজে পায় না।
শোয়া থেকে উঠে বসল সে। অস্থির লাগছে। কিন্তু অস্থিরতার কারণ বুঝতে পারছে না। বারবার রানী নিহার দেবী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ইয়াসমিন বেগমের কথা মনে পড়ছে। মেয়েটা যেন ওর মাথার ভেতর ঢুকে পড়েছে। ওর কথা ভাবতে গিয়ে বিলাইছড়ির ধানগোদা পাড়ার সেটলার পরিবারের মেয়ে পল্লবীর কথা মনে পড়ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না মশি। মেয়েটার নাম ইয়াসমিন বলেই কি? কিন্তু দুনিয়াতে তো ইয়াসমিন নামের মেয়ের অভাব নেই। ইয়াসমিন নামটা অনেকটা কমন নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইয়াসমিন নাম শুনলেই কি পল্লবী শতরূপা ইয়াসমিনের কথা মনে পড়তে হবে!
অবশ্য ইয়াসমিন বেগম নামের এই মেয়ের সাথে একটা ব্যাপারে পল্লবীর দারুণ মিল। দুটো মেয়েই প্রতিবাদী। পল্লবীকেও এরকম প্রতিবাদমুখর দেখেছিল রিলিফের গম বণ্টনের ব্যাপারে। ওর কারণেই ওই দুটি লোক রিলিফের গম নিয়ে শেষ পর্যন্ত দুই নম্বরি করার সুযোগ পাইনি।
ধানগোদা পাড়ায় নৌকো থেকে গম খালাস করার পর কাপ্তাই চলে এসেছিল মশি। কিন্তু পল্লবীকে ভুলতে পারছিল না। বার বার মনে পড়ছিল ওর কথা। কেন সেটাও বুঝতে পারছিল না। শেষে একদিন চলে গেল ধানগোদা পাড়ায়।
কিন্তু ধানগোদা পাড়ার ঘাট থেকে টিলা বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে উঠতে মশি ভাবছিল, কেন এসেছে সে। কীভাবে নেবে এরা তাকে? আর যাকে দেখতে এসেছে, সেই বা কী ভাববে? সে যদি জানতে চায়, কী বলবে সে? বলবে কি, না, তোমাকে দেখতে এসেছি?
মেয়েটি হয়তো প্রশ্ন করবে, আমাকে দেখতে কেন?
তখন মশি কী বলবে?
একবার ভাবল, টিলার ওপর না উঠে ফিরে যায় কাপ্তাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পল্লবীকে দেখার আগ্রহের কাছ হার মানল দ্বিধা। টিলার ওপর উঠে ওই দোকানটায় ঢুকল। দুপুরের সময় টিলার বাজারে লোকজন নেই বিশেষ। চায়ের দোকানে দু’একজন অলস লোকের আড্ডা। মশিকে দেখে উৎসুক চোখে তাকাল তারা। একজন বলল, ভাইজান, পরিচয়?
মশি কিছু বলার আগেই দোকানদার বলে উঠল, আরে মাঝিভাই, আফনে। আফনে কখন এলোেন? গমের নৌকা নাকি?
দোকানদারের প্রত্যাশা স্বাভাবিক। হিলট্রাক্টসে সেসময় সেটলারদের জন্যে সরকার জাহাজে জাহাজে গম পাঠাচ্ছে। নানিয়ার চর, মাইনিমুখ, আমতলী, বরকল, বিলাইছড়ি, মারিস্যা সব জায়গায় সেটলারের ভিড়। প্রথম প্রথম তাদের জন্যে খাদ্য সাহায্য না পাঠালে তাদের বেঁচে থাকার উপায় ছিল না। যখন ধীরে ধীরে তারা পাহাড় থেকে গাছ, বাঁশ, শন কেটে, পাথর সংগ্রহ করে নিজেদের জীবিকার নির্বাহ নিজেরা করার সক্ষমতা পেল, তখনই সরকারি সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং যে মাঝি একবার গমের নৌকো নিয়ে এসেছে, তাকে আবার নিজেদের ঘাটে দেখলে তারা সে আশা করতেই পারে।
দোকানদারের প্রশ্নে হাসিমুখে ঘাড় নাড়ল মশি। দোকানদারের প্রশ্নে আরো অনেকেই উৎসুক হয়ে উঠেছিল। মশিকে না-বোধক ঘাড় নাড়তে দেখে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল তারাও।
দোকানদার চা এনে দিল। মশি সিগারেট ধরিয়ে বলল, আপনাদের ঘাটে এসে সেবার খুব ভালো লেগেছিল। আমি এখানে বিলাইছড়িতে একটা কাজ নিয়ে এসেছি। থাকতে হবে মাস দু’তিনেক। আপনাদের দেখতে এলোাম।
মশির চোখ দোকানের বাইরে। নানা লোকজন আসছে। যাচ্ছে। মশি দেখছে ওদের। ওর চোখ আসলে খুঁজছে একজনকে। সে পল্লবী। কিন্তু পল্লবীকে দেখবে সে আশা করছে না। একটা তরুণী মেয়ে নিশ্চয় দুপুর বেলায় বাজারে এসে ঘোরাঘুরি করবে না।
দোকানে এখন কেউ নেই। হাতের কাজ সেরে দোকানদার এসে দাঁড়াল মশির সামনে। একটা বিড়ি ধরিয়ে বলল, আপনার কথা আমরা প্রায় বলি। সেবার আপনি গম এনেছিলেন। যারা গমের সাথে ছিল তদারককারী হিসেবে, তারা আপনাকে কয়েক বস্তা গম চুরি করে বেচতে সাহায্য করার কথা বলেছিল। কিন্তু আপনি রাজি হন নাই। আমরা এসব পরে শুনেছি। পল্লবীর মুখে। ভালো কথা ওই লোকগুলো এখন কোনো কাজে কর্মে নেই। বিশ্বাস থেকে উঠে গেছে মানুষের, বুঝেছেন? আপনার কথা সবাই বলি আমরা। আপনি ইচ্ছে করলে ওদের সাথে তাল মিলাতে পারতেন। ভাই, আপনি মানুষ ভালোা। তো আইছেন যখন, দু’দিন বেড়ান। গরিবের ঘরে থাকবেন। কী বলেন?
মশি খুশি হলো। পল্লবীর কথা ওঠাতে ভালোই হয়েছে। হাসি মুখে বলল, পল্লবী কোথায়? খুব তেজি মেয়ে কিন্তু।
দোকানদার হাসলো—ঠিক বলেছেন। দারুণ তেজি। ওরে সহজে কেউ ঘাটায় না। লেখাপড়া জানে তো। বোঝেন নাই?
হাসল মশিও। ঘন ঘন মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল, হ্যাঁ, বুঝেছে সেও।
চলবে…
মনশ্রী: পর্ব-১১॥ মাসুদ আনোয়ার