॥এক॥
স্থূলকোণী বাঁকটা পেরিয়ে বাস চড়াই বেয়ে উঠতে শুরু করল। দু’দিকে পাহাড়; লাল মাটি সবুজ ঝোপঝাড় আর লতায়-পাতায় ঢাকা। পাহাড় না বলে টিলা বললেই ভালো হতো। কিন্তু দু’দিকেই তার বিস্তার চোখের সীমানা ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর, একদম দিগন্তে কালো পাহাড়ের সঙ্গে মিশে গেছে। অতএব পাহাড়ই ভালো।
বাসের গতি যেন হঠাৎ বেড়ে গেছে। জানালার কাঁচের কাঁপন আর ইঞ্জিনের আওয়াজে সে রকম মনে হচ্ছে। সচকিত হলো মশি। পশ্চিমের কালোপাহাড় থেকে দৃষ্টি নামিয়ে পথের দিকে তাকালো। বাস চড়াই ভাঙছে। পিচঢালা পথ পিছিয়ে যাচ্ছে তার নিচ দিয়ে। ইঞ্জিনের গোঁ গোঁ শব্দ শুনতে শুনতে মশি ‘গোঁয়ার’ শব্দটার কথা ভাবলো। হাসলো মনে মনে। এ মুহূর্তে শব্দটা বাসটার প্রাপ্য। বিশেষণ হিসেবে। চড়াই সে ভাঙবেই।
ভাঙলই। চড়াইর মাথায় উঠে ড্রাইভার গিয়ার পাল্টালো। বাসের গতি সামান্য মন্থর হলো। মশির মনে হলো, চড়াই ভাঙার ক্লান্তি সামাল দিতে একটু যেন দম নিল ওটা—তারপরই পিছলে নামতে শুরু করলো। মশি সামনে তাকালো। হলুদ রঙের সাইনবোর্ডটা পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে এলো যেন। ওটার গায়ে লেখা গুটিকয়েক কালো অক্ষর, স্পষ্ট হয়ে উঠল আস্তে আস্তে—স্বাগতম খাগড়াছড়ি।
গোলাম মোর্শেদ এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। দূরপাল্লার যাত্রায় এরকমই হয়। কথা বলতে বলতে হঠাৎ এক সময় ঠাণ্ডা মেরে যায় সবাই। কতক্ষণ আর বক বক করা যায় বাসের ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে!
লোকটা অবশ্য কম করেনি। বহদ্দার হাট থেকে হাটহাজারী পর্যন্ত প্রচুর কথা বলেছে। সিগারেট খাইয়েছে। পত্রিকার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ করেছে। উৎসাহের শেষ নেই তার।
মশির নিজেরও উৎসাহের কমতি ছিল না। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছে সেও। নানা বিষয়ে নিজের অভিমত জানিয়েছে। গোলাম মোর্শেদের পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন নেই, এ নিয়ে সে আগেও কথা বলেছে, আজও আলোচনার সূত্র ধরে সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু গোলাম মোর্শেদ মশির উদ্বেগকে পাত্তা দেয়নি, হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে, সেটা কোনো ব্যাপারই না। লাখ পাঁচেক টাকা অ্যাকাউন্টে দেখিয়ে জায়গামতো টোকা দিলেই পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন পাকা আপেলের মতো কোলে এসে পড়বে।
মশিও সেটা জানে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পাঁচলাখ টাকার। গোলাম মোর্শেদের কাছে পাঁচ লাখ টাকা আছে কি না, সেটা সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না। তাছাড়া জিজ্ঞেস করবেই বা কী? লাখ লাখ টাকা ব্যাংকে থাকা লোকের মতো চলন-বলন যে তার নয়, সেটা দেখলেই বোঝা যায়। গোলাম মোর্শেদও বোধ হয় সে ব্যাপারে সচেতন। কথা প্রসঙ্গে আজ নিজে থেকেই বলেছে, পাঁচ লাখ টাকা তার অ্যাকাউন্টে নেই, তবে করে নিতে পারবে।
মশি জিজ্ঞেস না করে পারেনি, কিভাবে?
গোলাম মোর্শেদ চট করে জবাব দেয়নি। পকেট থেকে গোল্ডলিফের প্যাকেট বের করে জানালার ফাঁক দিয়ে হু হু করে ঢোকা বাতাসের ঝাপ্টা বাঁচিয়ে কায়দা করে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। তারপর মশিকে একটা অফার করে ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে গালভরা ধোঁয়া নাক দিয়ে ছাড়তে ছাড়তে বলেছে, সোর্স আছে। পাঁচ লাখ টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে মাসখানেক রেখে শো করিয়ে তারপর ফেরত দিলেই চলবে।
সেটা সম্ভব। মশি আর প্রশ্ন করেনি। একটা জিনিস সে আগেই আঁচ করতে পেরেছে, গোলাম মোর্শেদ একা নয়।
তার খুব ভালো লাগছে। এই প্রথম একটা পত্রিকার কাজে পত্রিকার খরচে বাইরে বেরিয়েছে সে। স্বয়ং মালিক-সম্পাদকই তাকে নিয়ে যাচ্ছে সঙ্গে করে। বোঝা যাচ্ছে, তাকে কাজ করতে হবে, ঘুরতে হবে অনেক জায়গায়। অনেক লোকের সঙ্গে কথাবার্তাও বলতে হবে। মোট কথা, পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার প্রায় সবটা অঞ্চল ঘুরে ফিরে দেখেই এবার তাকে গোলাম মোর্শেদের ‘পাহাড়িকা’ নামের মাসিক পত্রিকার বর্ষপূর্তি সংখ্যার জন্য অন্তত পনেরোটা লেখা তৈরি করতে হবে।
ব্যাপারটা হাস্যকর। মশির কাছে অন্তত সে রকমই। একই লেখকের পনেরোটা ফিচার কিংবা নিবন্ধ। মশি নিজের নাম ব্যবহার করবে একটায়। বাকিগুলোর লেখক হিসেবে আরও চৌদ্দটা নাম তাকে ব্যবহার করতে হবে, লেখক হিসেবে যাদের অস্তিত্ব পৃথিবীতেই নেই। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। পাঠক লেখা পড়েই সন্তুষ্ট, লেখকদের ব্যক্তিগত খোঁজখবর নিয়ে মাথা ঘামানোর অবসর তাদের নেই। এছাড়া এমন ঝানু পাঠকও আছে নাকি, যারা স্রেফে লেখার বিষয়বস্তু ছাড়া লেখার ভঙ্গি, বাকবিন্যাস—এক কথায় স্টাইল নিয়ে মাথা ঘামাবে? সেটা থাকলে অবশ্য বিপদের আশঙ্কা থাকত। পাঠকেরা হয়তো পত্রিকা অফিসে এসেই হামলা চালাতো, ওই লেখকের মাথা ভেঙে চৌদ্দভাগ করত, যে লেখক তাদের চৌদ্দবার ঠকাতো।
কিন্তু মশির ধারণা, সে ঠকাচ্ছে না। একসঙ্গে চৌদ্দটা লেখা সে লিখবে বটে, কিন্তু প্রত্যেকটা বিষয়ে সে আন্তরিক থাকবে। তার সাধ্যমতো প্রতিটি লেখায় বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করবে, কোনো লেখাই দায়সারা ভাবে শেষ করবে না। এ রকম সে ‘পাহাড়িকা’ পত্রিকার বিগত সংখ্যাগুলোতেও করেছে। প্রতি সংখ্যায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আটটা থেকে দশটা লেখা তারই। বিভিন্ন ছদ্মনামে লেখা। চেষ্টা করেছে লেখনভঙ্গি বিভিন্ন রকমের করতে, চেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি। তবে সেটা সে-ই জানে। আর কে জানবে?
চেষ্টা সফল হয়নি বলে কি সে দুঃখিত? মশি হাসলো আপন মনে। মোটেই না। বরং সফল হলেই সে অবাক হতো। একজন লেখকের লেখনভঙ্গি এক রকমেরই হয়। চেষ্টা করলে হয়তো বড় জোর দু’রকমের। কিন্তু দশ রকমের হয় না। একই লেখক দশ রকম ভঙ্গিতে লিখতে পারে, পৃথিবীতে এমন কারও আগমন হয়নি। হতেই পারে না। সুতরাং লেখক হিসেবে নিজের যোগ্যতার ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ নেই। আর ওই যে পনেরো নামের আড়ালে একজন হয়ে সে পাঠককে ঠকাচ্ছে, এটাও মানার কোনো কারণ নেই। ওর টাকার দরকার। প্রতি লেখায় তিনশ টাকা করে পনেরো জনের সাড়ে চার হাজার টাকার কাজ সে একাই করে দিচ্ছে, রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে।
‘স্বাগতম, খাগড়াছড়ি’ লেখা সাইনবোর্ডটা চোখে পড়তেই গোলাম মোর্শেদ নড়ে উঠলো। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। এবার আর মশিকে অফার করলো না। মশি নিজের প্যাকেট বের করলো। স্টার ফিল্টার। একটা ধরিয়ে নিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গোলাম মোর্শেদের দিকে তাকালো। গোলাম মোরশেদ হাসলো—মশি সাহেব, চট্টগ্রামকে গুডবাই জানানোর জন্যে তৈরি হোন। সামনেই শুরু হতে যাচ্ছে খাগড়াছড়ি।
মশিও হাসলো একটু, কিছু বললো না। ততক্ষণে বাস সাইনবোর্ডটাকে পাশে রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সাইনবোর্ডটার সামান্য পেছনে আরেকটা সাইনবোর্ড। বড় একখণ্ড টিনের পিঠে কালো রং লাগিয়ে তাতে শাদা অক্ষরে লেখা। মশি পড়লো বড় বড় ইংরেজি অক্ষরে লেখা হেডিংটি: ATTENTION FOREIGNERS
তার নিচে কিছুটা ছোট অক্ষরে আরও কিছু লেখা। মশি পড়তে পারলো না সবটুকু। তবে যতটুকু পড়তে পারলো, তাতে বোঝা গেল, ওখানে বিদেশিদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢোকার আগে কিছু পরামর্শ। কী কী করতে হবে, আর করতে হবে না—তার তালিকা।
টিলার ওপর একটা চেকপোস্ট। একজন সেন্ট্রি নেমে এসে বাসে উঠলো। বাসের সিটের তলায় আর ছাদের সঙ্গে আটকানো লোহার মাচায় রাখা ব্যাগ-সুটকেসগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলো ওগুলোর সঙ্গে আপত্তিকর কিছু আছে কি না। যাত্রীরা কেউ সিগারেট ধরিয়েছে আর কেউ নড়ে চড়ে হাত-পায়ের খিল ছাড়াচ্ছে। একসময় চেকিং শেষ করে সেন্ট্রি নেমে গেল। শেষবারের মতো পুরো বাসের ওপর চোখ বুলিয়ে হাত তুলে ইঙ্গিত দিল। বাস আবার চলতে শুরু করলো।
গোলাম মোর্শেদও কথা চালানোর চেষ্টা করলো। বলল, এখান থেকে মানিকছড়ি ঘণ্টা আধেকের পথ। পাহাড়ি পথ না হলে অর্ধেক সময় লাগতো। দেখেন, চারদিকে তাকিয়ে দেখেন। মানুষের জীবনযাত্রা দেখেন। এখনকার হিলট্রাক্টসের জীবনযাত্রা অনেকটা গোছানো, আর্মি আসার পর থেকে।
মশি তার কথায় কান দিচ্ছে না। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে মুখে আগ্রহ। টিলার ওপর পাহাড়িদের ঘরদোর, গেরস্তালি। শুয়োর চরছে, মুরগি মাটি খুঁটছে ছানাপোনাসহ। পাহাড়িদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে হা করে। ন্যাঙটো, আধ ন্যাঙটো পিচ্চিগুলো বাস দেখছে, মানুষ দেখছে।
মশি এসব খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছ্। তবে এই প্রথমই যে সে এসব দেখছে, তা নয়। এসব সে আগেও দেখেছে। হিলট্রাক্টসের জনজীবন, ভূ-প্রকৃতি, সামজিক অবস্থা—কিছুই তার কাছে নতুন নয়। এসব সে এখন থেকে আরও আট বছর আগে প্রায় সাত বছর ধরে দেখেছে। গোলাম মোর্শেদ তাকে আর নতুন করে কী দেখাবে? বরং গোলাম মোর্শেদকেই সে পরিষ্কারভাবে আরও অনেক কিছ বলতে পারবে। তবে তার আগ্রহের কারণ, আগে দেখা জিনিসগুলোকে নতুন করে দেখতে পাচ্ছে বলে।
সম্পূর্ণই নতুন রূপে। মশি আট বছর আগে তার সাত বছর ধরে থাকা হিলট্রাক্টসের কথা ভাবে।
চলবে…