পর্ব-৪
দিনটাই কুফা আজ। সকাল থেকে একটা কাজ যদি ঠিকঠাক হয়। বেহুদা সময় নষ্ট হলো কেবল। ওহ্ বেইবি! গেট রেডি প্লিজ! ইটস ঠু লেট টু গো!
-গ্লোরির ভারী শরীর থেকে ল্যাপটপে চোখ সরিয়ে তাড়া দিলো টোটন।
ইয়েস হানি! জাস্ট টু মিনিটস প্লিজ!
লিপস্টিক ঠোঁটে ঘষতে ঘষতে দারুণ আদুরে ভঙ্গিতে বললো গ্লোরি। কালো, পুরু ঠোঁটে লাল লিপস্টিক আগুন জ্বেলেছে প্রায়। লাল লংস্কার্ট ফুঁড়ে গ্লোরির দোহারা লম্বা শরীর বিদ্রোহ করতে চাইছে যেন। ল্যাপটপে পাওয়ার বাটন অফ করে আবার গ্লোরির দিকে চোখ রাখল টোটন।
ওহ সুইট হার্ট! য়্যু আর লুকিং গ্রেট অ্যান্ড সেক্সি!
ওওও! রিয়েলি হানি?
ইয়েস ডিয়ার!
খুশিতে ঠোঁট সরু করে খানিকটা শিষ দেয়ার মতো শব্দ করল গ্লোরি, কালো মুখ উজ্জ্বল দেখালো তার। টোটন হাতের কাজ সেরে জানালার পাশে চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে গ্লোরির তৈরি হওয়া দেখলো মন দিয়ে। গ্লোরি দারুণ চটপটে, ভীষণ প্রাণবন্ত। দু মিনিটে তৈরি হয়ে টোটনের পাশে দাঁড়ালো এসে। টোটনের হাতের সিগারেটটা টেনে নিয়ে অ্যাশট্রেতে চেপে নিভিয়ে দিলো আগুনটা। বিরক্ত টোটন জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো বাইরে। কপাল কুঁচকে উঠলো তার। গ্লোরি সেসবে পাত্তা দিলো না। চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে পেছন দিক থেকে টোটনকে জড়িয়ে ধরে বললো, অ্যাম রেডি হানি! নাউ লেটস গো!ৎ
আর টাকা নামক বস্তুটার প্রতি তার প্রেম বাড়ে আরও, নেশা ধরে যায়। শালা! টাকা থাকলে অসুন্দরও তাহলে সুন্দর হয়ে ওঠে! সুন্দরও হতে পারে অসুন্দর! থুঃ!
নিজেকে সামলে নিয়ে উঠলো টোটন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো একপলক। ঠা-ঠা রোদ বাইরে। ভরদুপুরে শহরটাকে পোড়াচ্ছে খুব। প্রেতপুরীর মতো খা খা করছে পুরো শহর। ঝিম মেরে আছে। তেরো তলার ফ্ল্যাট থেকে নিচে তাকিয়ে শহরটাকে অলৌকিক লাগছে, মনে হচ্ছে নাচছে বিল্ডিংগুলো। চোখ সরিয়ে ভেতরে তাকাল টোটন। অন্ধকার লাগল প্রথমটা। গ্লোরির দিকে তাকিয়ে মনে হল রাত নামল হঠাৎ। তারপর সয়ে এল। স্পষ্ট হল গ্লোরি। ততক্ষণে সামনে এসে হাসিমুখে টোটনের দিকে হাত বাড়িয়েছে সে।
লেটস গো! -টোটনকে তাড়া দিল আবার।
উঠল টোটন। হাসির প্রত্ত্যুত্তরে হাসল আধফোটা। দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, ইয়েস ডেয়ার! লেটস গো!
এসির শীতলতায় বাইরের গরম অতটা বোঝা যাচ্ছে না। তবু গ্লোরির লাল স্কার্ট আর লাল লিপস্টিকের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে কেমন ঘেমে উঠল টোটন। এই গরমে গ্লোরির কালো শরীরে আগুন লাল পোশাক কেমন অস্বস্তি জাগায় মনে। গ্লোরির কোনো বিকার নেই। লাল তার প্রিয় রঙ। অধিকাংশ দিনই লাল পোশাক পরে সে, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। কেমন লাগছে, মানাচ্ছে কিনা, সেসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না গ্লোরি। মাঝে মাঝে মেয়েটাকে মাথামোটা মনে হয় টোটনের। মনে হয় মাথায় গোবর পোরা আছে মেয়েটার। কিন্তু গ্লোরির অন্যান্য কার্যক্রম, তার দৈনন্দিন জীবনের ক্লিশে রুটিন বলে, গ্লোরি মোটেই অতটা বোকাসোকা নয়। যতই সাদামাটা দেখাক তাকে, মোটেই অতটা হাবাগোবা নয় সে। নইলে সেই সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসে বাংলাদেশের মতো দেশের টাউট-বাটপারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একা একটা মেয়ের পক্ষে গার্মেন্টস ব্যবসা দাঁড় করানো সহজ নয় মোটেই। গ্লোরি সেটা করে দেখিয়েছে। প্রতিমাসে আড়াইশ শ্রমিকের বেতন দিচ্ছে অনায়াসে। প্রতিমাসে আড়াইশ শ্রমিকের বেতন দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয় হে চাঁদু! নিজেকেই কথাটা মনে মনে শোনায় টোটন।
গ্লোরি বরাবরের মতোই টোটনের কাছঘেঁষে বসেছে। টোটনের বুকের সঙ্গে মাথা হেলিয়ে। ব্যাপারটা উপভোগ করে টোটনও। গাড়িতে, রিকশায়, বাসে টোটনের পাশে আফ্রিকান নিগ্রো মেয়ে গ্লোরির লেপ্টে থাকা দেখে দেশের অধিকাংশ মানুষ ট্যারাচোখে তাকায়, ফিসফাস করে, ব্যাপারটা বেশ লাগে তার। নিজের কালো রঙ আর বিশাল বপু নিয়ে তার নিজের মধ্যে হীনম্মন্যতা ছিল একসময়, স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাসে, ট্রেনে, পরিচিত, অপরিচিত প্রায় সবার টিটকারির শিকার হয়েছে সে প্রতিনিয়ত। যেন সে ইচ্ছে করলেই বেশ পছন্দসই একটা বপু আর লাল্টুস মার্কা গায়ের রঙ নিয়ে জন্মাতে পারতো, নেহাত নিজের অনিচ্ছেয় এই না তথাকথিত সুন্দর হয়ে না জন্মানোটা ক্ষমার অযোগ্য একটা ভুল তার, আর তারই শাস্তি তাকে উজাড় করে দিতে কার্পণ্য করত না কেউই।
টোটন মুখ বুজে সহ্য করতো সব অপমান আর টিটকারি। মনে মনে কুঁকড়ে যেতো নিজের মধ্যেই, রাতে বালিশে মুখ গুঁজে বাচ্চাদের মতো কাঁদতো, আর মায়ের কাছে গিয়ে তার এই ‘কদাকার’ চেহারার ব্যাখ্যা চাইতো ছোটবেলায়। মা তাকে কোলে নিতো, কপালে চুমু দিতো, আর সান্ত্বনার স্বরে বলতো, কে আমার ছেলেকে কালো বলে অ্যাঁ? কার এত সাহস? আমার ছেলের চে সুন্দর চেহারা আর কার আছে শুনি? তুমি তো আমার চাঁদের কণাটা, ময়না সোনাটা!
ছোটবেলায় মায়ের আদরে গলতো টোটন। কিন্তু একটু বড় হতেই সে বুঝেছিল, মা যতই বলুক, অন্যদের চোখে সে মোটেই চাঁদের কণাটি নয়। বরং তাদের চোখে সে একেবারেই ‘নিগ্রোদের মতো’। কথাটা যত শুনতো টোটন, ততই গুটিয়ে যেতো নিজের ভেতর, হীনম্মন্যতা জন্মাতো মনে, ক্ষোভ, হতাশা আর অভিমানে মরে যেতে ইচ্ছা করতো তার, আর নিজের প্রতি টের পেতো ঘৃণা। মাকে সে ভালোবাসতো ভীষণ। পৃথিবীতে এই একজন আছে, যার চোখে সে অন্তত কুৎসিত নয়, ভেবে কৃতজ্ঞতায়, ভালোবাসায়, করুণায় চোখে জল জমে যেতো তার।
এই মাঝ বয়সে এসে রাস্তা-ঘাটে গ্লোরির এই আহ্লাদটুকু তাই যতটা না উপভোগ করে সে, তারচে বেশি এক বিকৃত আনন্দে ভরে থাকে তার মন। অচেনা লোকগুলো তাদের দুজনকে নিগ্রো ভেবে আগ্রহ নিয়ে দেখে, তাদের একান্ত হয়ে বসে থাকাটুকুতে নিজেদের অনভ্যস্ততা প্রকাশ করে বিস্মিত দৃষ্টি দিয়ে, আর পরিচিতজনেরা তাদের দেখে কৌতুক আর ঈর্ষার এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে। টোটনের মতো বাতিল একজনের জন্য এমন ‘আফ্রিকান হাতি’ই যথার্থ, ভেবে কৌতুক উপচায় চোখে, আবার গ্লোরির অর্থনৈতিক গুরুত্ব ভেবে ঈর্ষা চলকায় তাদের চোখে, টোটন পরিষ্কার বোঝে। সে কারণে সে উপভোগ করে ব্যাপারটা, আনন্দও পায়। আগে সে সব রকম সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতো, নেহাত বাধ্য না হলে কোনো জনসমাগমে যেতে না। আজকাল যায়। গ্লোরিকেও সঙ্গে নিয়ে যায়। উপযাচক হয়ে পরিচিত হয় সবার সঙ্গে, গ্লোরিকেও পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘লিভ টুগেদার’ করছে তারা, যেচে গিয়ে তথ্যটা দেয় সবাইকে। শুনে সাপ দেখার মতো চমকায় অনেকে, সং দেখার মতো হা করে গেলে তাকে আর গ্লোরিকে। পারলে বয়কট করতেো তাকে, বের করে দিতো এসব অনুষ্ঠান থেকে পরিচিতজনেরা, বোঝে টোটন। কিন্তু দুনিয়া বড়ই আজব জায়গা। তারচে আজব টাকা। টাকায় যে কী হয় আর কী না হয়, আল্লা মালুম। মনে মনে হাসে টোটন। তার হাতে অগাধ টাকা। তার টাকার দিকে তাকিয়ে পরিচিতজনেরা বুকের ভেতর ঘেন্না লুকিয়ে মুখে কেমন ভালোবাসার মাখন মাখিয়ে হাসে, দেখে ভেতরে ভেতরে নিজেই সে ঘেন্নায় মরে। আর টাকা নামক বস্তুটার প্রতি তার প্রেম বাড়ে আরও, নেশা ধরে যায়। শালা! টাকা থাকলে অসুন্দরও তাহলে সুন্দর হয়ে ওঠে! সুন্দরও হতে পারে অসুন্দর! থুঃ!
ঠিক বের হওয়ার মুখে দিদারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো তার। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে, মুখে সিগারেট। তাকে দেখে হাসলো একগাল, ট্যারাচোখে গ্লোরির দিকে একবার তাকিয়ে টোটনকে বলল, হেঁ হেঁ! বেনু জানে তো?
নাজীব খুব করে আপ্যায়ন করে তাদের। হেসে হেসে গ্লোরির সাথে কথা বলে, ভাব জমাতে চায়। দূর থেকে দেখে টোটন, মুচকি হাসে। গ্লোরির পাশে ছোটখাটো বপুর নাজীবকে দেখায় অনেকটা টিকটিকির মতো। গ্লোরি ঝুঁকে অনেকটা নিচু হয়ে কথা বলে তার সঙ্গে। নাজীবের কী একটা কথায় খিলখিল হাসে গ্লোরি, হাসির শব্দে অনেকেই তাকায় ঘুরে। হাসান পাশে বসা ছিল টোটনের। বড় বড় চোখে গ্লোরিকে দেখছিল অনেকক্ষণ ধরে, হাসির শব্দে টোটনের দিকে তাকালো ফিরে। ফিসফিসিয়ে বললো, এই আফ্রিকান মালটারে কেমনে সামলাস, দোস্ত? পুরাই হাতি!
-যেন খুব উঁচুদরের একটা রসিকতা করেছে, চোখ টিপে টোটনের দিকে তাকিয়ে তেমন ঢঙে হো হো হাসে হাসান। টোটন গম্ভীরমুখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে হাসানের চোখে। চোখে চোখ রেখেই নিচুস্বরে বলে, চেষ্টা করে দেখবি নাকি? কথায় বলে, একবার না পারিলে দেখো শতবার!
হাসান আগের মতোই হাসে। অন্য কেউ শুনতে না পায়, তেমন গলায় বলে, মাফ চাই দোস্ত! ও আমার কম্ম নয়! সারেন্ডার!
সারেন্ডার শব্দটা এমনভাবে বলে হাসান,তাতে টোটনও না হেসে পারে না আর। হাসি থামিয়ে চুপ থাকে কিছুক্ষণ। দম ছেড়ে বলে, তোরা ছোটবেলায় আমাকে নিগ্রো হাতি বলে ক্ষেপাতিস, মনে নাই? তো এক নিগ্রো হাতি আরেক নিগ্রো হাতিকে সামলাতে পারবে না সেটা হয় কখনো?
হাসান হাসে। বলে, হ দোস্ত! মানাইছে দারুণ! তোগোরে দেখে যে কেউ ভাববে তোরা খাঁটি আফ্রিকান মাল!
গ্লোরি তো খাঁটিই। আমার মধ্যে যা একটু ভেজাল, তবে দেখে তো বোঝার উপায় নাই। -বলে উঠে পড়ে টোটন। এসব ফালতু প্যাচাল আর এখন পোড়ায় না তাকে। এক সময় পোড়াতো খুব। কষ্ট দিতো ভীষণ। মানুষের উপহাস আর অবজ্ঞা যে কতটা নিঃষ্ঠুর আর অমানবিক হয়, তারচে ভালো কে জানে আর!
ম্যারেজ এনিভার্সারির খাওয়াটা রাতে জমবে আরও। তখন মদ খাওয়া হবে দেদারসে। গ্লোরিকে নিয়ে বের হয়ে পড়লো টোটন। কাজ আছে তাদের, রাতে অন্য জায়গায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে গ্লোরির, ব্যস্ততা আছে টোটনেরও। ঠিক বের হওয়ার মুখে দিদারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো তার। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে, মুখে সিগারেট। তাকে দেখে হাসলো একগাল, ট্যারাচোখে গ্লোরির দিকে একবার তাকিয়ে টোটনকে বলল, হেঁ হেঁ! বেনু জানে তো?
গা জ্বলে গেলো টোটনের। বিষচোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো গ্লোরির হাত ধরে।
চলবে…
বেনু মসলাঘর-৩॥ শিল্পী নাজনীন