পর্ব-৩
মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বারবার গাড়ির হর্ন চাপে রেজা। দেরি হয়ে যাচ্ছে তার। কখন এরা লাশ তুলবে গাড়িতে, আর কখন সে রওনা দেবে, কখনই বা ফিরবে আবার, সেসব ভাবনা তার বিরক্তিকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে তোলে আরও। জানালা দিয়ে উঁকি দেয় সে, বোঝার চেষ্টা করে আর কতক্ষণ লাগতে তার পারে গাড়ি ছাড়তে। হতাশ হয়ে মুখ ফেরায় অতঃপর।
গাড়ি আপাতত ছাড়ার মতো কোনো সম্ভাবনাই চোখে পড়ে না। মৃত লোকটাকে স্ট্রেচারে রেখে মৃতের স্বজনেরা গেছে হাসপাতালের বিল মেটানো ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সারতে। স্ট্রেচারটা হাসপাতালের জনহীন করিডরের একপাশে দেয়ালঘেঁষে রাখা। পাশের কয়েকটা ফাঁকা চেয়ারের একটিতে বছর পঁয়ত্রিশেকের এক নারী, সম্ভবত মৃতের স্ত্রী, শূন্যচোখে লাশবাহী স্ট্রেচারের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ দেখলে শ্বেতপাথরের মূর্তি মনে হয়। বিরক্তি রেখে নারীটিকে মন দিয়ে দেখে এবার রেজা। শালী মাল এক নাম্বার! মনে মনে রায় দেয় সে। শকুন চোখে নারীটির শরীর মাপে। দুচোখ দিয়ে চেটে নিতে থাকে যতটা পারে। নারীটির চোখের কোণে জল শুকিয়ে ক্ষীণ সাদা দাগ নেমেছে দুগণ্ড বেয়ে। চেহারায় রাত জাগার ক্লান্তি স্পষ্ট, চোখের নিচে কালো দাগ, চোখ লাল, চুল উস্কখুস্ক, পোশাক আটপৌরে, মলিন। তাতে নারীটির সৌন্দর্যে ভাটা পড়েনি, যেন বেড়েছে বহুগুণ। লোভী চোখে দেখে রেজা। খানিকটা করুণা হয়। আহা রে! এই বয়সে বিধবা! বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে জিবে চুক চুক শব্দ তোলে সে, চোখ সরে না নারীটির ওপর থেকে।
নারীটির ষষ্ঠেন্দ্রিয় জেগে ওঠে হঠাৎ। চোখ তুলে রেজাকে দেখে একপলক। ভাষাহীন, শূন্য দৃষ্টি সরিয়ে নেয় লহমায়। কাউকে নিয়ে ভাবার মানসিকতায় নেই নারীটি, উদাস দৃষ্টি বাইরে রাখে। দুচোখ বেয়ে টপটপ জল গড়ায়, পলকহীন দেখে রেজা। ঠিক তখন কোত্থেকে ভোজবাজির মতো উদয় হয় আলেয়া। হাতে মেঝে পরিষ্কার করার বড় বালতি ভর্তি ডেটল মেশানো পানি, ঘর মোছার সরঞ্জাম। রেজার লোভাতুর চোখ দৃষ্টি এড়ায় না তার। স্ট্রেচারে রাখা লাশ আর দেয়াল ঘেঁষে বসা নারীর দিকে এক নজর তাকিয়েই সে বুঝে নেয় যা বোঝার। খরচোখে তাকায় রেজার দিকে। হাত ততক্ষণে মেঝে মোছায় ব্যস্ত তার। চোখও মেঝেতেই রাখে আলেয়া। ক্রোধে ফোঁসে। গলা তুলে রেজাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, কুত্তার স্বভাব আর কবে যাইবো, অ্যাঁ? গু দেখলেই লালা গড়ায়!
রক্তচোখে আলেয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে রেজা, আগুন ঢালে আলেয়ার দিকে, ভস্ম করে দেবে সম্ভব হলে। মুখে কিছু না বলে নারীটির দিকে তাকায় আবার, চোখ সরিয়ে নিয়ে গাড়ির ব্রেকে ঝুঁকে পড়ে, ব্যস্ত হওয়ার ভান করে। আলেয়া তাকে থোড়াই কেয়ার করে মেঝেতে ডেটল, ফিনাইল ঘষতে ঘষতে আবার বলে, বজ্জাত কোনহারকার! লাজ-শরম নাই! নিমকহারাম একটা!
রেজা মনে মনে প্রমাদ গোণে, এ সময় কেয়া এ পথ দিয়ে যায় প্রতিদিন,আলেয়ার এই অমৃতবাণী তার কানে গেলে মান-ইজ্জত সব যাবে, সঙ্গে সুখ-স্বপ্নের সম্ভাবনাটুকুও। উপায়ন্তর না দেখে আবার ঘন ঘন গাড়ির হর্ন চাপে সে, স্ট্রেচারে পড়ে থাকা লাশের স্বজনদের জন্য অধীর আগ্রহে জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেয়। অবশেষে মৃত্যুসনদ আর ছাড়পত্রের বিল হাতে আসতে দেখা যায় লোক দুজনকে। একজন সম্ভবত ভাই, অন্যজন চেনা কেউ, আত্মীয়গোছের। লাশটাকে অ্যাম্বলেন্সের কাছে এনে দ্বিতীয় লোকটা বলে, আর দেরি করে কী হবে! তাড়াতাড়ি তুলে ফেল। অনেক দূর তো যেতে হবে তোদের।
পেছনের মানুষ দুজন তখন শোকে স্তব্ধ, জীবনের উল্টোপিঠ তখন টেনে নিয়েছে তাদের সব আলো, বিছিয়ে দিয়েছে অন্ধকারের কালো কুৎসিত মুখ।
প্রথম লোকটা শুকনো মুখে বলে, হু। রওনা হয়ে যাই এবার।
লাশটাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার আগে দ্বিতীয় লোকটা হাত ইশারায় থামতে বলে হঠাৎ। কাছে এগিয়ে গিয়ে লাশের মুখের ওপর থেকে সাদা চাদরটা আস্তে সরিয়ে দিয়ে বলে, দাঁড়া, শেষবারের মতো দেখি আরেকবার। আর তো দেখা হবে না কোনোদিন। আমারও অনেক কাজ এখন, যেতে পারলাম না সাথে।
লোকটার কথায় প্রথম লোকটা হাউমাউ কাঁদে। বউটা পাথর চোখে তাকিয়ে চুপচাপ দেখে। লাশটার মুখের দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে রেজা। সারামুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ফর্সা মুখটা রক্তশূন্য, সাদা। মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে। বছর চল্লিশের মতো বয়স। মৃত লোকটার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে আবার হর্ন দেয় সে। সুন্দর মাত্রই ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে তার। তা বলে লাশও! নিজের ওপর ভারি বিরক্ত হয়ে ওঠে সে মনে মনে। তখন চোখ যায় ওদিকটায়। কেয়া। ইন্টার্নি চলছে তার গতমাস থেকে, ফিমেল ওয়ার্ডে ডিউটি আজ। গেটে অ্যাম্বুলেন্স দেখে ঝট করে ড্রাইভিং সিটের দিকে তাকালো, রেজাকে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি চলকালো সামান্য, বর্তে গেলো রেজা। হাসলো একগাল। চোরাচোখে বামপাশের করিডরের দিকে তাকালো একবার। নেই। করিডর-মেঝে মোছা শেষ করে কখন অন্যদিকে চলে গেছে আলেয়া। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে কেয়ার ছন্দময় চলে যাওয়া দেখলো রেজা। হেলে-দুলে, ধীরে-সুস্থে হেঁটে গেলো কেয়া, সঙ্গে কণা আর রাসনূভা।
কিছু একটা নিয়ে দারুণ উত্তেজিত তারা, নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে করতে গেলো সেটা নিয়ে, আলোচনার ভঙ্গিতে বোঝা গেল। হাসপাতালের গেটে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স, স্ট্রেচারে দুচারটা লাশ, পাশে কান্নায় ভেঙেপড়া স্বজন, কমবয়সী বউয়ের পাথর চোখ, এসব নস্যি তাদের কাছে, নিতান্তই পানসে গল্প। দেখতে দেখতে চোখ পচে গেছে। বরং এনাটমি ক্লাসের নতুন জয়েন করা স্যার আর তার ক্লাস নেওয়ার নয়া টেকনিক, ইন্টার্নি করতে এসে একেকজনের একেক রকম অভিজ্ঞতা। এসব অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে। আলেয়া আর রেজার কাছেও গল্পগুলো ভারী অনাকর্ষক এখন, আটপৌরে। মৃত্যু যখন প্রাত্যহিক শোক তখন বাতুলতা। জীবনকে উপভোগ করার টেকনিকটা তাই শিখে নিয়েছে তারা, মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে। মৃত্যু, রোগ-শোক, আর সকল অসুখকে ভেংচি কেটে তারা গেয়ে চলেছে জীবনের গান।
অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভিং সিটে বসে ভিউ মিররে মৃত লোকটার বউটাকে দেখার চেষ্টা করলো রেজা। একপাশটা দেখা যাচ্ছে। মূর্তির মতো বসে আছে, আগের মতোই। সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে সামনের দিকে তাকিয়ে। এদের নামিয়ে দিয়ে দ্রুত ফিরতে হবে তাকে, ভিউ মিররে চোখ রেখেই মনে মনে ভাবলো রেজা। সন্ধ্যায় কেয়ার সঙ্গে নির্জনে দেখা করার কথা আছে আজ। অবশ্য সময়মতো ফিরতে পারবে কি না, তা নিয়েই ধন্দে সে এখন। তারচে’ও বড় কথা, কেয়া দেখা করতে চেয়েছে বটে, তবে সেটা নেহাতই কথার কথা কিংবা মস্করা কি না, তা নিয়েও বিস্তর সংশয় আছে রেজার। হাজার হোক ওপরতলার মানুষ কেয়া, হবু ডাক্তার। রেজার মতো ছাপোষা, মূর্খপ্রায় ড্রাইভারের সঙ্গে কেন সে দেখা করবে নির্জনে! জীবন তো আর নাটক বা সিনেমা নয় যে, তার মতো হাভাতে ড্রাইভারের প্রেমে হাবুডুবু খাবে কেয়ার মতো উজ্জ্বল চোখের কোনো হবু ডাক্তার, সুন্দরী নারী! বিশেষত যেখানে সে আছে আলেয়ার মতো শকুন চোখের জোর নজরদারিতে! কোন কুক্ষণে যে আলেয়ার মায়াবী আলোর ফাঁদে আটকে গেছিল সে! আর কী আশ্চর্য! চাইলেও এ ফাঁদ থেকে সরতে পারছে না সে আর! না কি সে চাইছে না আসলে? প্রশ্নটা নিজেই নিজেকে করে রেজা। থম হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। থমথমে মুখে ড্রাইভ করে। মনে মনে শাপশাপান্ত করে নিজেকে, গালি দেয়। শালা শুয়োরের বাচ্চা! মাগনা খাওয়া ছাড়তে পারিস না, না! আলেয়া মাগনা খাওয়ায়, তাকে তাই ছাড়তে মন চায় না আর তোর! শালা শুয়োরের বাচ্চা! কেয়া জানলে মুখ ভরে হাগবেও না তোর, জেনে রাখিস!
নিজের অজান্তেই অ্যাম্বুলেন্সের গতি বাড়িয়ে দেয় রেজা। বড্ড সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছে। পেছনের মরা মালটাকে না নামালে সিগারেটে টান দিতে রুচি হবে না তার। আজ রাতে মাল টানবে সে, বড্ড নেশা চড়েছে। সন্ধ্যায় কেয়া মালটাকে নাগালে পেলে হয়। তাকে দুয়েকটা চুমু টুমু খেতে পারলে রাতের নেশাটা জমবে ভালো। ভেবে মনে মনে অধীর হয়ে ওঠে রেজা। পেছনের মানুষ দুজন তখন শোকে স্তব্ধ, জীবনের উল্টোপিঠ তখন টেনে নিয়েছে তাদের সব আলো, বিছিয়ে দিয়েছে অন্ধকারের কালো কুৎসিত মুখ।
চলবে…