॥পর্ব-সাত॥
চারিদিকে সুনসান নীরবতা। বেদেবহরের নৌকা থেকে ধোঁয়া ওঠে সন্ধ্যায়। সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী ক্রমে আকাশে উঠে গেলে বিষু মান্তা বাজখাঁই গলায় ডাক দেয়, হারু, সুবলে কই গেলি? হারু আর সুবলে পড়ি-মরি ছুটে আসে—জ্বি-সর্দার। বোস, কামের কথা আছে—দুশ্চিন্তার চাপ সর্দারের চোখেমুখে। হারু আর সুবলে সর্দারের সামনে বসে। ন্যামৎ কই—জানতে চায় সর্দার।
আসে নাই।
তা তো দ্যাখতে পাইছি।
হারুই উত্তর দেয়—ন্যামৎ গঞ্জের চাতালে টাবুস হইয়া পইরা রইছে। আই পরবো ওস্তাদ।
আইলে আর কী হইবো? হে তো আর কথা শোননের মতো তালে থাকব না। ভাকুজল খাবি খা, ক্যাম্মাই খাবি খা বাপু খামুরের চাতালে যাইতি হবি ক্যারে এইডাও একখান ঘডাইবো।
সর্দার হারুকে নির্দেশ দেয় মোস্তককে ডাকতে। নির্দেশমতো মোস্তাক এসে হাজির হয়। বয়স্ক মান্তা-ঝন্টু মাল-বিষু সর্দারের বাপ। সে ওখানেই বসে ছিল কারোই বুঝতে বাকি থাকে না যে, এখানে সিদ্ধান্ত হবে। এবং তা চূড়ান্তভাবেই। বিষু সর্দার বাপের দিকে তাকায়—বাজান, তুই ক-ছাম এখন কী করতাম। তো-মাথায় কিছু কাম করে ন। ঝণ্টু মাল মাথা নাড়ায় না, সে যেমনি বসে ছিল, তেমনি বসে রইলো। হারু-সুবল মস্ত কেউ কোনো কথা বলে না। পাশের ধইঞ্চা ক্ষেত থেকে ভেজা বাতাস এসে তাঁবুতে ঢোকে। চিরপরিচিত সোঁদাগন্ধ এসে ঝণ্টু মালের নাকে লাগাতেই বুকের ভেতরটা তার কেমন করে ওঠে। বিশ বছর বয়সে সে প্রথম সর্দারী পায়। একটা দলের নয়। ছোট অমরপুরের সবদলের সে প্রধান হয়। কমসে কম পনেরোটা দল ছিল তার। প্রায় চল্লিশ বছর সে সেই সর্দারী করছে। কখনো এমন ঘটনা ঘটে নাই। এমুন কাম ছোট অমরপুরের কেউ কোনো দিন করে নাই। কী সিদ্ধান্ত দেবে ঝণ্টু মাল? দুনিয়ার তামাম বেদে গোষ্ঠীর কেউ কোনো দিন যা করে নাই, সেই কাম তার নাতি খলিল কেমনে করলো—এই ভাবনাটাই সে ভাবতে পারে না। ঝণ্টু মাল কিংবা বিষু সর্দার বোঝে এই বিচার নিখুঁত হওয়ার ওপর নির্ভর করবে বিষু সর্দারের সর্দারী পোক্ত হওয়ার বিষয়টিও। তামাম বেদে পাড়ার সব বাইদ্যা জানে ঝণ্টু মাল বা বিষু মাল দু’জনই বেদের সমাজ সংস্কার ছাড়া আর কিছু বোঝে না। বাইদ্যার দলের জন্য তারা জান দিতে পারে। কিন্তু যে ঘটনা খল্লা ঘটাইছে, তাতে পরান পোড়ে কিন্তু পরান দেওন যায় না। পাপের শাস্তি বেদে সমাজে কঠিন কিছু না। কারও জেবন নিতে হলে বেদে তাতে কসুর করে না। আজ কি করবে ঝণ্টু কিংবা বিষু?
মালতী গুম মেরে বসে ছিল নৌকায়। কোলের মেয়েটা হাপুস হয়ে ঘুমুচ্ছে পাশে। রান্না হয়নি। দু-দিন ধরে তার রান্না বন্ধ। গাওয়ালেও যায় না সে। ক্ষুধা পেলে চারমাসের মেয়েটি চিল্লায়। মালতী ধমক দেয়। কালনাগের ছাও চুপ যা। মেয়েটি পা দাপায় আর নিচের ঠোঁট উল্টে জোরে কেঁদে ওঠে। মেয়ের এই কান্না সে সইতে পারে না। হ্যাঁচকা টানে ডানা ধরে কোলে নেয়। মেয়ের মুখে স্তনের চুঁচি পড়তেই শূকর ছানার মতো ঘোৎ ঘোৎ টানতে থাকে। মালতীর শরীর ও মন কেমন নিস্তেজ হয়ে আসে। সে শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়ে। চন্দনার পাড়ে তখন সন্ধ্যা নামে।
তামাম বহরে রাত। ক্লান্ত বেদেনীরাও ঘুমে কাদা। কেবল ঝণ্টু মন্তার চোখে ঘুম নেই। সে তাঁবুর এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। ভবিতব্য জানে না সে। তবু অমঙ্গল আশঙ্কায় তার সারা শরীর কেঁপে ওঠে। কাল দুপুরে জুম্মার পরে বৈঠক বসবে। ঝণ্টু মাল চোখ বুজে পড়ে থাকে। বহুদিন পর তার-মাহিনের কথা মনে পড়ে। সেই প্রথম যৌবনে মাহিন তার নজরে পড়ছিল। দেমাগী পাও ফেল সে গাওয়ালে যেতো। কনসার গায়ের ওস্তাদের বেটি সে। গদাধর মান্তার নাতনী। এলাকায় কেউ তার দিকে ফিরে তাকানোর সাহস পায় না। মাহিনকে নিয়ে বাপ-বেটার সে কী দেমাগ। গদাধর বলেছিল, নাতনী তার মাচুম্মা। সাক্ষাৎ মনষা। ঝণ্টু মালাও কম যায় না। সুরৎ ভালোই। তবে অংটা মা কালীর। গদাধর রাগ করেনি বরং গর্বের সঙ্গেই বলেছিল—এই তো খাঁটি বাইদ্যার জাতসাপের মতো অং। অস্বীকার করে না ঝন্টু। বাইদ্যার কুলে ফর্সা মেয়ের চেয়ে ময়লা মেয়ের ডিমান্ড বেশি। তার চায়া মাহিনের ডিমান্ড। সেই ডিমান্ড ধার্য করেছিল মাহিনের দাদা গদাধর। ডিমান্ড অনেক। এক হাজার রুপাইয়া আর একটা শর্ত। ভাঙলে টেকা ফেরত। ওলা-মাহিনও ফেরত। শুনে খুশিতে চকচক করে উঠেছিলো ঝণ্টু মালের চোখ। মাহিনের জন্য তার জানকবুল। মুখে বলে, হ দাদা, যা কও আমি রাজি। কিন্তু মাহিন তারে পছন্দ করবে কি। গদাধর হাসতে হাসতে তাড়ি ভর্তি টিনের গেলাস তুলে এগিয়ে দেয় ঝণ্টুর দিকে, দায়িত্ব হামাকু। ঝণ্টু তাড়ি খেয়ে সোজা ডেরায় ফেরে। দু’পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে সে। চোখ জোড়া লাল হয়ে ওঠে। তখন তার বয়স আর কত, আঠার কি উনিশ। কোনোকালেই সে সর্দার হওয়ার স্বপ্ন দেখেনি। মাহিনের জন্য সে স্বপ্ন দেখে। একখান দলের নয় ছোট অমরপুরের তাবৎ বাইদ্যা দলের সর্দার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। শেষে কুড়ি বছর বয়সে কী থেকে কী হয়ে যায় সর্দার হয় এই ঝণ্টু। তাবত বাদ্যাদলের সর্দার। না কোনো দাঙ্গা নয়। সকলে এক হয়ে তারে সর্দার বানায়। কোনো অন্যায় বরদাশত করে না সে। কত বছর যায়। মাহিনের দাদার গড়িমসি। একদিন সে হাজির হয় কনসার হাঁয়। গদাধর তখন তাঁবুতে বসে ঝিমাচ্ছিল। ঝণ্টুকে দেখে সে নড়ে না। গামছাটা পা দিয়ে হিঁচড়ে কাছে আনে। বলে, বসো। মাথার চুলগুলো কেমন উসকো-খুসকো। চোখেমুখে বয়সের ছাপে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। ঝণ্টু তাগড়া যুবক। কিছুটা দূরত্ব নিয়ে বসে। গদাধর মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। বোঝার চেষ্টা করে ঝণ্টুর ভেতরের বাইদ্যা মন। বিব্রত ঝণ্টু বলে, এখানে চাই রইছ ক্যারে দাদা? গদাধর মাথা নাড়ে। তারপর হাঁটুর ভাঁজ খুলে উঠে দাঁড়ায়। ঝণ্টুও উঠে দাঁড়ায়। পাশের ডেরায় বুড়ি বেদেনী চিৎপাত শুয়ে আছে। তার মুখের ওপর মাছি ভনভন করে উড়ছে। ওপাশে হাঁসের ছাওর মতো তিনটা বাইদ্যার ছাও-কাদা-মাটিতে খেলছে। উদোম গাও। আদম নবীর সাক্ষাৎ বংশধর। সববাইদ্যা আদমেরই বংশ। নানীর কাছে শুনেছিল। আল্লাহর অভিশাপ। আদমের ছাওয়াল কাবিল হাবিলরে খুন করছিলো। আল্লাহ কাইছিলো, তোর আর সোয়াস্তি নাই। ডাঙ্গা চাড়ি নায় নায় ঘুইরা বেড়াবি তামাম দুনিয়া ঠাঁই নাই। কোথাও ঠাঁই নি হব। কাবিল সেই থাকি ঘুইরা বেড়ায় নায় নায়। জমির ফসল তার কাল হয়। ইনি, কাবিল খুন করছিল ক্যারে? কাবিল ফসল ফরাইতো আর হাবিল উট, দুম্বা চড়াইতো। আল্লা কইলো, কোরবানি দে। হাবিল কোরবানি দিলো কাবিল দেবে কি? কাবিল দিল ক্ষেতের ফসল। আল্লা হাবিলের কোরবানি কবুল করলো। কাবিল গেলো রেগে। সে ভাইকে ডাকি নিযাই খুন করলো। আল্লা বেজার হইলেন অভিশাপ দিলেন। সেই থিকা কাবিলের ডাঙ্গা গেলো-ফসল গেলো-গইলো মাটির মানুষ। আমরা সিই কাবিলের বংশ।
ঝণ্টুর পিঠে হাত রাখে গদাধর। বলে, চলো মিয়া ওধারে যাই বসি। ম্যালা কথা আছে। ঝণ্টুর চমক ভাঙে। তারও কথা আছে, মাহিনের লই কথা। গদাধর বিড়ি ধরায়, ঝণ্টুকে সাধে একটা, সে নেয় না। গদাধর বিড়িতে টান দেয়, দূরে ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে বলে, তোমার অর বয়স কয়দিন? চকখে তোমার তামাম দুনিয়ার রঙ। সিরঙ সরাইয়া বাস্তব দুনিয়া দেখার সোময় নাই তোমার। কি বাস্তব দাদা—মুখে প্রশ্ন তোলে না কিন্তু চোখে সেই প্রশ্ন প্রকাশ পায় ঝণ্টুর। গদাধর তা বুঝতে পেরে বলে, তুমি আছ আমি আছি। এর চায়া আর বাস্তব নাই। আছে? ঘোর প্রশ্ন করে গদাধর। মাহিকে বিয়ে করতে গিয়ে ৯০ বছরের এক বুড়ার কাছে যে বাস্তবের পাঠ নিতে হতে তা সেদিন বোঝেনি ঝণ্টু। বিরক্ত হয়েছিল কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার এ দাদা তো আর তার দাদা নয়। মাহিনের দাদা। অতএব মুখে কলুপ এঁটে থাকে। ‘হ্যাঁ’-‘না’সূচক মাথা নেড়ে যায়। কিন্তু মন দিয়ে শুনছিল সব কথা। যদি আবার পড়া ধরে? উত্তর না দিতে পারলে যদি মাহিন হাতছাড়া হয়। ঝণ্টুর বরাবরই বিচক্ষণতা নজরে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত হাজার ট্যাকা পণ দিয়ে মাহিনের দাদার শর্ত মেনে মাহিনকে বিয়ে করেছিল সে। শর্ত একটা পরান থাকতে বাইদ্যা সোমাজে অবিচার হতে দেবে না। সে সোমাজের নিয়ম মাইন্যা যা করন যায় তা-ই করতে হবে। কোনো আপস নাই, কারুর সাথে না। চল্লিশ বছরের সর্দার জীবনে ঝণ্টু বাইদ্যা, কথার বরখেলাপ করেনি। মাহিন করছে তোউ ঝণ্টু তার দিকে আঙুল তোলেনি। আইজ খইল্লা এইডা কী করলো? কী করলো খইলা? ঝণ্টু মান্তার চোখ জ্বালা করে ডুকরে একবার কেঁদে ওঠে মাহিন। মাহিনরে তুই দেখবার পাইছস্ বুকডা যে ফাইডা যায় মাহিন, ছন্টু বাইদ্যার মাথার কাছে কে যেন এসে দাঁড়ায়। বাদলা দিনের অন্ধকারে কেমন যেন পাথরের মতোন লাগে। অন্ধকারে ছায়ামূর্তি যেন নড়ে ওঠে—কেডা! ভারী গলায় জানতে চায় ঝণ্টু। ছায়ামূর্তি খানিকটা সরে যায়। ফের জানতে চায় ঝন্টু—কেডা? এবার খুব সাবধানী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—দাদা। ঝণ্টু উঠে দাঁড়ায়। মাথা কেমন ভোঁ করে ওঠে। তারপর খুঁটি ধরে সোজা হতে চেষ্টা করে। ছায়ামূর্তি আরেকটু সরে আসে এ পাশটায় একটা জলজাম গাছের কাছে, বেশ আড়ালে। ঝণ্টু বের হয়ে আসতেই ছায়ামূর্তিটা আচমকা তার সামনে দাঁড়ায়, ননা! ঝণ্টু বুঝতে পারে কী বলতে এসেছে মালতি এতরাতে! ঝণ্টু আকাশের দিকে তাকায়। একখানি কালো মেঘ ঢেকে ফেলছে পূর্ণিমার চাঁদ।
নাতবৌকে সে বলে, তুর যেমন ঘুমে ধরে না, আমারও তাই। ঘুম আসে না। চোখ বুজলে ক্যাল তোর নানির মুখটা মনে পড়ে রে নাতবউ। এ জন্মে কুনো আকাম করি নাই। সোমাজের যেন ভালো হয়, তা-ই করছি। আইজ আল্লায় কিবা পরীক্ষায় ফালাইলো।
নানা! একমাত্তর তুই পারবু তারে বাঁচাইতে। মানুষটার কুনো দোষ আছিল না। মদ খাইয় তো কামডা কইরা ফালাইছে। নানা! ও নানা— মালতী খপ করে পায়ে ধরে কাঁদে। এতক্ষণ পর চমক ভাঙে ঝণ্টুর অদূরে ডুমুর গাছের কাছে কে একজন বসে আছে। বুঝতে বাকি থাকে না, সে খইল্লা। ঝণ্টু বলে, পা ছাড়, নাতবউ। মালতী পা ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। অন্ধকার হাতড়ে ঝণ্টু মাল এসে দাঁড়ায় ডুমুর গাছের গোড়ায়। ফিসফিস গলায় ডাকে, হোই গোদরের নাত ওঠ। শালা গোমূর্খ। তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় খলিল। নানাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর বলে, আইজ দুইডা দিন ধইরা কেউভি হামার সাথ্ একটা কথা কয় নয়। নানা তুইও না, মালতীও না। ঝণ্টু মালের কঠিন হৃদয় নড়ে ওঠে। মালতী এসে পাশে দাঁড়ায়। স্বামীর কান্নায় সে মুখে হাত চাপা দেয়।
চলবে…