॥পর্ব-৪॥
বেদে বহরে সুনসান নীরবতা। কুচফলের মতো লাল সূর্যটা ওঠার আগেই গাওয়ালে বের হয় বেদেনীরা। ছোট ছোট দুই তিনটা দলে গাওয়ালে যায় তারা। আজ মায়ের সাথে কুশনিও বের হয়েছে। ডুকনি বুড়ি এসে রামলাল মান্তার নায় ওঠে। ও আর ওর বউ গেছে গাওয়ালে। অবিয়াত পোয়াতি মেয়েটা মল্লরী কেবল কোঠিতে। ডুকনি চন্দনার জলে পা দুখানি ঘষে ঘষে ধোয় তারপর পা তুলে বসে নৌকায়। ডুকনি বাহ্নিকে দেখে একটু গুছিয়ে বসে মল্লরী। কোলে তার তিন দিনের মেয়ে ‘কালসপ্পের মতো গতরের রঙখান হইছে’—ডুকনি মন্তব্য করে। মেয়ের মুখের দিকে একবার তাকায় মল্লরী। কোনো কথা বলে না। ডুকনি তার বাম হাত খানা মল্লরীর পিঠে রাখে। একটু হাসতে চেষ্টা করে বলে—কেমন বিহুচ্ছে তু ডুকনি মা? জালের মতো ডুকনির মুখে অসংখ্য দাগ। সেই দাগ সংকুচিত করে দিয়ে বুড়ি হাসে।
কেমনও নাই রে, কেমনও নাই।
কেন ডুকনি মা-কি হইছে?
এবার বুড়ি কুশনির অমঙ্গল আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে—
ও সোমাজের মান রাখপি নেরে। সোমাজের মান রাখপিনি।
কেডা মান রাখপিনি?
কুশনি। জানস কিছু?
মল্লরী নৌকার ছইয়ের অন্যপ্রান্ত দিয়ে তাকায় যেখানে আকাশ আর চন্দনা মিলে গেছে। মল্লরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে ভাবে, ডুকনি আজ কেন মল্লরীর কাছে এসেছে? মল্লরীর কাছে সে কি কুশনির কোনো গোপন খবর জানতে চায়? কিন্তু বাইদ্যাদের নিজেদের কাছে তা গোপন বলে কিছু নেই। সে তো ক্যাল খামুরদের কাছে। গেরস্থদের কাছে। মল্লরী কথার কোনো উত্তর দেয় না। বাতাসে তার মাথার রুমালটা উড়তে থাকে। একবার রুমালে হাত রেখে সে সোজা হয়ে পা টান করে বসে। কোলের মেয়েটা ঈষৎ নড়ে ওঠে। সেদিকে তাকিয়ে ডুকনিকে মায়েল বিড়ির ডিব্বাটা এগিয়ে দেয় মল্লরী। আজ প্রায় পাঁচ মাস মাথায় অপমানের রুমালটা বেঁধে রেখেছে মল্লরী। কিছুতেই সে এটা মেনে নিতে পারছে না। প্রথম খবরটা যখন এলো, তখন সে তিন মাসের পোয়াতি। বাইদ্যাপাড়ার বাজারে এক খমুরে বাড়িতে মল্লরীর অবাধ যাতায়াত ছিল। ‘বিয়া করব, বিয়া করব’ কইয়া মল্লরীর সঙ্গে সম্পর্ক। রসের নানা গল্প বাইদ্যা পাড়ায় চালু হলেও তা নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ। বাইদ্যাদের চরিত্র অমন ঠুকনো নয় যে, কোথাও গেলে চট করে চরিত্র গেল বলে পাড়ায় ঢিঁ ঢিঁ পড়বে। পুরুষের গায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়ালেও সন্মান যায় না। উদোম বুকে বাচ্চাকে যেখানে-সেখানে দুধ খাওয়ালেও ক্ষতি নেই। বাইদ্যার চরিত্র অন্য জিনিস, সে কাচের চুড়ি নয় একটু চাপেই মচ্ করে ভেঙে যাবে। মল্লরীরও যায়নি। কিন্তু সেদিন সে কানে একটা কাঠগোলাপ গুঁজে নিয়ে যখন খামুরের বাড়ির সামনে গেলো কথায় কথায় জানতে পারলো, মল্লরীর মনহরণকারী বাবুটি বিদেশ চলে গেছে। ছুটতে ছুটতে সে ডেরায় ফিরে আসে। উদ্ভ্রান্তের মতো সে কাঁদতে থাকে। এতদিন বাচ্চা পেটে নিয়েও সে দিব্যি সমস্ত লক্ষণ গোপন করে ঘুরে বেড়িয়েছে, গাওয়ালে গেছে। কোমরটা ক্রমে প্রশস্ত হলে বিছাটা খুলে ফেলছে। দৃষ্টিকটু লাগেনি কারো। কিন্তু বাবুটির বিদেশ যাওয়ার খবর শুনে মল্লরীর কান্নার সঙ্গে গুলে বমি আসে। ওয়াক করে সে বমি করে। এ খবর বেদেপাড়ায় ছড়িয়ে পড়তে দেরি হলো না। যতবার মল্লরীর বাবুটার কথা মনে আসে, ততবারই গা গুলে কান্না ও বমি হয় তার। গোপনে ডুকনি এসে জানতে চায়, ক্যাডা করছে এই কাম ক’দিকি?
মল্লরী দাঁড়াশ সাপের মতো সোজা হয়ে থাকে। না, কিছুতেই বলবে না সে নাম। এগারো বছর বয়সে তো এই ডুকনি তাকে শিখিয়েছিল, খামুরদের সাথে খাবি শুবি বিশ্বাস করবি নে। মল্লরী সেটা কি করে ভুলে গেল। কী করে বিশ্বাস করলো খামুর বুবুরে? এখন সে কী করবে? কোথায় যাবে? ডুকনি আবার জানতে চায়। মল্লরী কেঁদে ওঠে। মল্লরী জানে, বাইদ্যার সব নিয়মকানুন সে জানে। ভুল তো তারই। পানগাছের শেকড় আর আনারসের কচিপাতার রসে তৈরি বড়ি তো ছিলই তার কাছে খেয়ে নিলে এই বিপদে পড়তে হতো না তাকে! নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য গালাগাল করে মল্লরী। একবার তলপেটে হাত রাখে। সারা শরীরের রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়। সেই রক্তের মধ্য দিয়ে ঘাড়ের শিরা বেয়ে স্তনের বোঁটায় এসে থামে। চোখ বুজে মল্লরী আক্কুর সদ্য সন্তান হওয়া বুটার কথা মনে করে। খোলা বুকে সে যখন তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায় সেই মুহূর্তটা কল্পনা করে সে রোমঞ্চ অনুভব করে। চুলোয় যাক খামুরের পোদলি, চুলোয় যাক সব। মল্লরী কোঠির ছইয়ে হেলান দিয়ে চোখ বোজে। এই সময় বাইরে হল্লা শুরু হয়। মল্লরীর মা আসে। সোমাজ খাওয়ার জন্য সে কটা দিন মল্লরীকে যাচ্ছেতাই বলেছে। তবু খামুরের নাম নেয়নি সে। আজ তাই বিচার বসেছে। বেদে সম্প্রদায়ের আইন অমান্যের বিচার। বিয়ের আগে মা হওয়া বেদে সমাজের জন্য লজ্জার, অপমানের। সমস্ত বেদে সমাজের এই অপমান তুলে নিতে হবে মল্লরীর নিজের মাথায়। চাইলে বাচ্চাটাকে খালাস করতে পারে ডুকনি বুড়ি। পারে মল্লরীর মাও। কিন্তু কিছুতেই আর একটা অন্যায় করতে পারবে না তারা। খামুরের পোদলীর মতো জারজ সন্তানকে ফেলতে পারে না তারা। যা ব্যবস্থা নেওয়ার অগেই নেয়। এটাই নিয়ম। মল্লরীকে কুমারীর মাতৃত্বের অপরাধে রুমাল বাঁধতে হবে মাথায়, নোয়া পড়তে হবে হাতে। বেদে সমাজে মাথায় রুমাল বাঁধা মেয়ে ভ্রষ্টা বলে বিবেচিত হয়। বাচ্চা জন্মের সাত দিনের মাথায় খুলে ফেলা হয় রুমাল। মল্লরী সেই রুমালের গিঁট ঠিক করতে করতে বাচ্চাটাকে বুকের কাছে তুলে নিয়ে আসে। শাড়ির পাশটা সরিয়ে স্তনের মাথায় থু থু দেয়। তারপর এক হাতে স্তনের বোঁটা তুলে মুখে পুরে দেয় বাচ্চাটার। দুটো ঠোঁট নড়ে ওঠে। ডুকনি সে দিকে চেয়ে বলে, ভাউ, কুশনি কিছু কয়নি তোরে?
এবার মল্লরী মুখ খোলে। বলে, দেখ বুড়া মা, বয়সের চেয়ে বাইদ্যানীর অভিজ্ঞতা বেশি। তার ওপর তু হলি ডুকনি মা। তু বল কুশনি আমারে কিছু কলি পর আমি তোরে কইতাম না? ডুকনি ফের বাম হাত নাড়ে। রাগ হস ক্যারে? এখন আমাগো সেই সোনার সময় নাই। বাইদ্যার নিয়ম কানুনের ধার ধারে না কেউ। যার যা খুশি করে। তা করুক। কিন্তু তোর মতো একটা ভুল কইরা ফানাইলে এই দলের আর কিছু থাকে ক তুই? মল্লরী তার কোলের বাচ্চাটার হাত নাড়তে নাড়তে ডুকনি বুড়ির মুখের দিকে তাকায়। কুশনিকে মল্লরী সেই কথা বলেছে। কিন্তু লাভ তাতে হয়নি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে সে। বলে কিনা, ‘তু বিলকুল বলদ ছিলিরে। বিলকুল বলদ ছিলি। ‘ আমি সেই ভুল করবনিঠু। তুড়ি মেরে সে হাসতে থাকে। মল্লরী বলে, ‘যা করবি কর, খুমুরের বতন খা, বিংগা খা, গাওটি খা; দেখিস ঢিলই বড় ভি না হয়। অর্থাৎ গৃহস্থের ভাত, টাকা শরীর সবখাবি খা কিন্তু পেট যেন বড় না হয়।
কুশনি হাসে। ভেঙে যায়া কাচের টুকরোর মতো মল্লরী সেই হাসির মধ্যে ভয়ের বীজ অঙ্কুরিত হতে দেখে আর বলে, দেখ কুশনি, খামুরা বাচ্চা হলি ফেলতে পারে আমরা পারি না। ওরা ভদ্দর নোক আমরা ওদের কাছে বিরকিনি-বেশ্যা। ওরা আমাদের এর চায়া বেশি কিছু ভাবে না।
কুশনি চোখ নাচায়। বেণির আগা এক হাতে ধরে অপর হাতের তালুতে ছুড়ে মারতে মারতে বলে, ‘ছন্দ কর মল্লরী। তোর খামুর বোজনা খাইকে মর গেল।’ মল্লরী বিরক্ত হয়, যাহোক লোকটাকে সে বকএব গালাগাল করবে কিন্তু কুশনি কেন? আঙুল তুলে মল্লরী শাসায়। ‘খবরদার ওকে ফালতু মানুষ বলবি না।’ এবার কুশনি হেসে ফেলে যেন, এই বয়সেই সে ডুকনি বহ্নির অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফেলেছে। মল্লরী জানে কুশানিকে কিছু বলে লাভ নেই। ডুকনি বহ্নিকে বললে কথার খেলাপ হবে। মা মনসার নামে সে দিব্যি দিয়েছে কুশনিকে। তাই চুপ থাকাটা মঙ্গলজনক ভাবছে সে। ডুকনি কথা বাড়ায় না। নীরবে সে মল্লরীর কোঠি থেকে নেমে যায়।
চলবে…