পর্ব-৫
সালিমা ধীরে আমার হাত থেকে তার হাত মুক্ত করলো। তাকে তখন পুরোপুরি আত্মস্থ মনে হচ্ছে। চোখের জল মুছে বললো, পৃথিবীর সব হারিয়েছি। তাতে যে কষ্ট আমি পেয়েছি, রকেট তোমাকে হারিয়ে তার চেয়ে বেশি দুঃখ পেলাম। তোমার বন্ধু স্নাইপার ছাড়া আমার কেউ থাকলো না আর। তবে স্নাইপারের জন্য আমার আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে, সে যে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লো।
আমি লক্ষ করলাম সালিমার কথা। সে কার নিঃসঙ্গতার কথা বলছে? একটা কুকুরের? তাহলে সে কি? তার নিঃসঙ্গতা তাহলে কতদূর? আমি তার নিঃসঙ্গতার তল খুঁজেতে গিয়ে সেখানে থৈই পেলাম না। অথচ কতই না নিঃসঙ্গ আমি।
অর্ধমৃত সাপটাকে মেরে গাছের বড় বড় কতগুলো পাতায় পেচিয়ে নিলাম। বললাম, রকেটকে কবর দিলে হয় না?
-ছেলেমানুষি করবেন না। ও যখন মরে গেছে, তখন খাদ্যে পরিণত হয়েছে। বিধ্বস্ত নগরীতে খাবারের যে কী অভাব, তা আমি জানি। ও কারও খাবার হোক, সেটা ওর জন্য কবরের চেয়ে ভালো হবে।
সালিমার কথায় আমি অবাক হয়ে গেলাম। এ যেন মুগ্ধতার একেকটি সিঁড়ি, যা পায়ের কাছে এসে আমাকে তুলে নিয়ে আরও সালিমামুখী করে তুলছে।
পাতায় মোড়ানো মৃত সাপ হাতে সালিমার পেছনে আমি। সে আগের মতোই আমার সামনে হাঁটছে। মুখে কোনো ‘রা’ নেই। যে পথে এসেছি সে পথে না গিয়ে সালিমা অন্য পথ ধরলো। এসছিলাম তিন, যাচ্ছি দুজন হয়ে। যোগ-বিয়োগটা অঙ্কের হিসাবে কত সহজ। অথচ জীবনের হিসাবে, হৃদয়ের হিসাবে ততটাই কঠিন। কিন্তু নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ তাও হজম করতে শিখে যায়। জেনে যায় বেঁচে থাকার কৌশল।
সালিমা যেন তারই প্রকৃষ্ট উদহরণ। আমার কথা বললে, আমার তো ছিলই না কিছু। কী হারাবো? যা হারিয়েছি তাও আস্তে-ধীরে, রয়ে-সয়ে। হুট করে হারিয়েছি ওই একটাই ‘মাটাকে’। আর সালিম, তার সব ছিল। হঠাৎ করে, এক ঝটকায় সব হারিয়ে বসে আছে। তো তার হৃদয়ের ক্ষরণ আমি কী করে বুঝবো?
পাতা প্যাচানো সাপের ঠোঙাটি হাত বদল করলাম। এটি আজকের খাবার আমাদের। অনেক দিন পর মংস খাবো। আনন্দ হচ্ছে। ইটসুরকির স্তূপের ওপর হাঁটতে যেভাবে বারবার নাজেহাল হচ্ছি, হোঁচট খাচ্ছি; তাতে আনন্দের খাবারে এক খামচি বালু পড়ার জো হয়েছে।
এর মধ্যে ফিরে এলো আমার সেই ভাবনারা, হাজার বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সভ্যতার ধুলো আমার পায়ের নিচে চিকচিক করছে। বিকেলের ম্লান আলোয় মায়াময় হয়ে উঠেছে দুনিয়া। কারুনের অপার সম্পদের এই চিকচিকে বালুর সঙ্গে যোগ হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্রতম এক দেশের বৃহত্তম সভ্যতার প্রার্যুময় সম্পদ; যা এখন মাড়িয়ে চলেছেন একজন নারী আর পুরুষ; আদম আর হাওয়া।
কষ্টে আমার বুকটা চিনচিন করে উঠলো। প্রিয় সব হারিয়েও আমরা বেঁচে থাকি, খাই এবং প্রেমেও পড়ি। শুধু বেঁচে থাকতেই এমন অসংখ্য সভ্যতার দুঃখের বোঝা বয়ে চলি, প্রয়োজন মতো বুক থেকে নামিয়ে রাখি। আনন্দ করি, হাসি; পুনরায় সভ্যতা নির্মাণে মন দেই। অতপর এগিয়ে যাই সামনে, জীবনের পথে।
সালিমা একটা ধ্বংসস্তূপের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘিয়ে রঙের আধ ভাঙা, আধখাড়া একটা স্থাপনা। কতগুলোর দেয়ালের ভেতর ইট-বালির স্তূপ। বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট বাগান।
দেশি-বিদেশি নানা ফুল ফুটে আছে। হরেক রকম প্রজাপতি বিকেলের সোনালি রোদে সেসব ফুলে হুটোপাটি করছে। অযত্নের ফলে বাগানটি একটি জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বাগানে মধ্যেকার লোহার কারুকাজের বসার চেয়ারগুলো উলটে ঢাকা পড়ে আছে লতাগুল্মে। চায়না ব্যাম্বো, জার্বেরা, শ্বেত রঙ্গনের গাছগুলো তেলাকুচার ঝুপে অদৃশ্যপ্রায়।
খুব সিম্পল, কিন্তু দর্শনীয়ভাবে সাজানো ছোট্ট একটি ঘর। ভাবলাম, এখানেই তো একটা সংসার লুকিয়ে আছে। শুধু বের করে আনতে হবে।
বাগানের মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত একটা ইটের পথ ধরে একটু এগুলেই ঘিয়ে রঙের বাড়িটার ধ্বংসস্তূপ। পড়ে যাওয়া দেয়ালের ফাঁক দিয়ে সালিমা ভেতরে চলে গেলো। আমি এদিক-ওদিকের দৃশ্য দেখে নিতে একটু দাঁড়ালাম। দেখার মতো বলতে সেই ধ্বংসস্তূপ আর বুনো জঙ্গলের মধ্যে লাতাপাতায় জড়িয়ে ধরা আধউল্টে পড়া বসার বেঞ্চিগুলো।
আমি বাইরে আর দেরি না করে সালিমাকে অনুসরণ করলাম। পড়ে যাওয়া দেয়ালের ফাঁকটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। উঁকি দিয়ে দেখি সালিমা দুই হাতে স্তূপ ঘাঁটছে। প্রথম একটু অবাক হয়ে তাকালাম। কিন্তু তাতে তার কোনো ভাবান্তর নেই।
অগত্যা আমিও তার সঙ্গে কাজে নেমে গেলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা গোধূলির কোলে ঝুলছে। যেকোনো সময় টুপ করে ডুব দেবে। বাইরে থেকে ভেসে আসছে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা পাখির কলতান।
সালিমা বিরতিহীন ইটের স্তূপ সরিয়ে যাচ্ছে। যেন এক গুপ্তধন আবিষ্কারের নেশায় পেয়ে বসেছে তাকে। প্রথমে খুব উৎসাহ পেলাম না। কিন্তু এক সময় মজা লেগে গেলো। খুব উৎসাহে আমিও কাজে লেগে গেলাম। বছি, সালিমা যদি এখানে কোনো গুপ্তধন লুকিয়ে রাখে, তাহলে বাইরের পৃথিবীতে একটা স্বাচ্ছন্দ্যের সংসার জীবন অতিবাহিত করা যাবে।
কিন্তু আর কত? একদিকে কুয়ো, অন্যদিকে পাহাড়। শেষ তো হচ্ছে না। রাত আসন্ন, সেদিকে কি সালিমার খেয়াল আছে? বলতেও পারছি না সে কথা। যদি রেগে ওঠে বা অমন কিছু। তাই কোনো কথা না বলে কাজ করে গেলাম।
এক সময় এসব আমার কাছে পণ্ডশ্রম বলে মনে হতে লাগলো। তবু সালিমার শ্রমঘামে উৎসাহ পেতে চেষ্টা করলাম। সালিমা তার কাজে অটল। সালিমার কাজের গতি, উৎসাহ দেখে, যে-কেউ ভাববে, নিশ্চিত সে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। না হলে এভাবে কি কেউ স্তূপ ঘাঁটে?
এদিকে জিজ্ঞেস করতেও পারছি না। কেন এসব? কেমন শোনায় যদি বলি, ‘স্বর্ণ হলে ঠিক আছে। টাকা হলে মাটিতে খেয়ে ফেলে থাকবে এতদিনে। বৃথা শ্রম রাখো, চলো আস্তানায় যাই।’ বলতে পারছি না এ কথা। বাঙালি সেন্টিমেন্ট বলে কথা। স্বার্থও খুঁজে ফিরবে, কিন্তু স্বার্থটাকে শাক দিয়ে আবার ঢাকার চেষ্টাও করবে। আমি ক্লান্ত হয়ে একপাশে গিয়ে বসলাম। তার কিছুক্ষণ পর দেখি, সালিমার হাতে গতি থেমেছে। দৌড়ে এলাম। ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে গিয়ে দেখি, লবণ, আরেকটা শুকনা মরিচের প্যাকেট, তেল আর বিভিন্ন মশলার কৌটা। আর কিছু রান্নার সরঞ্জাম।
বিভিন্ন সময় এসে এসে খুঁড়েছি। তখন হয়তো একটা স্মৃতিচিহ্নের জন্য। কিন্তু আপনার মুখে সংসারের কথা শুনে মনে হলো, তাই তো। সংসারের জন্য তো সাংসারিক জিনিস লাগবে। আর সংসার শব্দটা শুনলে জানেন তো, আমার চোখে পাখির বাসার মতো কিছু একটা ভেসে ওঠে। খুব সিম্পল, কিন্তু দর্শনীয়ভাবে সাজানো ছোট্ট একটি ঘর। ভাবলাম, এখানেই তো একটা সংসার লুকিয়ে আছে। শুধু বের করে আনতে হবে।
কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলো সে, হাতে একটা লম্বা লাঠি; কুটা বলা যায়। ভাঙাবাড়ির ধসে যাওয়া বারান্দা থেকে কোটার মাথায় একটা কাপড় বাঁধাতে চেষ্টা করছিল সে।
এখানে সংসার লুকিয়ে আছে মানে? তখন কেন খুড়তে বললে? বুঝিনি তোমার কথা।
আমার প্রশ্নের জাবাবে সে বললো, গুপ্তধনের জন্য। এখনো সেজন্যই খুঁড়েছি এবং পেয়েও গেছি। দ্রুত হাত লাগান। এগুলোই গুপ্তধন। ধরুন।
আমার হাতে মশলার কয়েকটা কৌটা ধরিয়ে দিলো। হঠাৎ আমার থতমত খাওয়া দেখে সালিমা যেন একটু হাসলো। বললো, দাঁড়ান একটা জিনিস। বলে যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলাম আমরা সেই ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটা কুয়োর পাড়ে একা বসে আছি আমি।
আমি হাসার কোনো প্রশ্ন করিনি। বরং তার কথা শুনেই অনেকেই হাসতে পারেন। কারণ দেখেছি, জীবন্ত মানুষে কানের লতি ছিঁড়ে গহনা নিয়ে যেতে; শুনেছি যুদ্ধের মাঠে লাশের আঙুল কেটে আংটি চুরি হয়। সম্ভবত স্বর্ণের যা দাম, এই করেই তার দাম মানুষ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ এটা না খাওয়া যায়, না লজ্জা নিবারণে ব্যবহার করা যায়। অথচ তার দামেই খাদ্যের মূল্য নির্ধারিত হয়!
তাই একটা ধ্বংস্তূপ ঘাটা আর তাও এভাবে, সেটা সোনা-রুপা-হিরে-জহরত বোঝাই গুপ্তধন মনে করাই তো স্বাভাবিক। আমিও তাই মনে করেছিলাম। ভাবলাম, এই সন্ধ্যায় সালিমাকে এ কোন পাগলামিতে পেলো। সোনা খুঁজলে দিনে খুঁজি, রাতে কেন? কিন্তু এরপরও আমি বলবো সালিমাই ঠিক।
কাজ শেষে যা বেরিয়ে এলো, তা আসলে গুপ্তধনের চেয়ে কোনো অংশে কম কিছু না। আমি বলবো, তার চেয়েও দামি। যেখানে সোনার দামে খাদ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় না, এটি সেই জায়গা।
অন্য কথায় পরিত্যক্ত একটা স্থানে, যেখানে মানুষ নেই, মানুষের কোনো চিহ্নও নেই। নুন নেই, তেল নেই, মশলা নেই, সেখানে সোনা-মুক্তা নয়; এসবই যে গুপ্তধন, তা কেবল যে সে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে, সেই উপলব্ধি করতে পারবে।
সালিমা বাইরে যেতেই কতগুলো পখি কিচকিচ করে উঠলো। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলো সে, হাতে একটা লম্বা লাঠি; কুটা বলা যায়। ভাঙাবাড়ির ধসে যাওয়া বারান্দা থেকে কোটার মাথায় একটা কাপড় বাঁধাতে চেষ্টা করছিল সে। কিছুক্ষণ পর সেটা কোটার মাথায় বাজিয়ে নিচে নামিয়ে আনল। দুটো ঝাড়া দিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে। নীলচে একটা গেঞ্জি।
চলবে…
বিধ্বস্ত নগরী: পর্ব-৪ ॥ রাশেদ সাদী