পর্ব-২
এই তুমি বোঝো না নাকি রকেট নেই, স্নাইপরও ওপাশে। মেয়েরা একটু বেশি শীত কাতুরে হয়!
একটা মোটা গেঞ্জি আছে। সেটাও পরে নাও।—আমি ওঠে ব্যাগের চেইন খুলি। সালিমা বলে— এই এক ঝামেলা। আমি দেখেছি, ছেলেরা অদ্ভুত বোকা হয়ে থাকে এসব ক্ষেত্রে। সে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে বের করে ফেলতে পারবে, কিন্তু মেয়েদের মন বুঝতে পারবে না।
আমি বুঝি। সেই তখনই তো বললাম, সোয়েটারে হবে কি না?
তুমি ঘোড়ার ডিম বোঝো! এতে শরীরের শীত যায়, মনেরটা যায় না।
তাহলে?
তাহলে মানে? রকেটের জায়গাটা তুমি নাও না।—হঠাৎ আমি বুঝতে পারি। ততক্ষণে সালিমা কি রিবক্ত। রাতের আধারে তো আর মুখের এক্সপ্রেশন দেখা যায় না। গলা আওয়াজ থেকে অনুমান করে নিতে হয়। সালিমার গলায় মনে হলো রাগ! রাগ নাকি অভিমান?
সালিমার এই ভাবান্তর আমাকে বিস্মিত করে। আমি দুটো গড়ানি দিয়ে সালিমার কাছে চলে আসি।
এই দু মোচড়েরর জায়গাটা সংরক্ষণের জন্য আমি কিনা করেছি। এই দূরত্বকে আমি পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম, যাকে আমি জীবনের পট পরিবর্তনের একটি বড় অধ্যায় বলে ধরে নিয়ে ছিলাম। সালিমার সম্মতিই সেই পবিত্র নগরীতে প্রবেশের শেষ পাসপোর্ট। হঠাৎ তা হাতে এসে পড়ায় আমি যতটা আনন্দিত, তার চেয়ে বেশি যেন বিহ্বল হয়ে পড়লাম।
সালিমার পিঠে পিঠ লাগিয়ে আমি শুলাম। আমার দিকে সালিমার পিঠ ফেরানো।
আমি খেয়াল করলাম, যখন কথা হচ্ছিল, সে আমার দিকে ফিরেই ছিল। আমাকে আসতে দেখে নিশ্চয় সে ওদিক ফিরেছে। আমি ইতস্তত করছিলাম কী করবো? জড়িয়ে ধরবো তাকে? না কি এভাবে কলার ডোমের মতো পিঠে পিঠ লাগিয়ে শুয়ে থাকবো?
জড়িয়ে ধরবো? না না, তা কী করে হয়। সে কি আমাকে বলেছে জড়িয়ে ধরতে। একটা মৃত কুকুরের জায়গায় শুতে বলেছে। কুকুর নিশ্চয়ই জড়িয়ে ধরতো না। আমি সেই অনধিকার চর্চা কী করে করি?
আবার ভাবলাম, আমাকে হয়তো সে পরীক্ষা করছে। জড়িয়ে ধরবো কী, অমনি একটা লাথি মেরে ফেলে চলে যাবে। সব হারানো মানুষের এই এক মন। সব তাতেই খালি হারাই হারাই ভয়।
সালিমার পিঠে আমার পিঠ লেগে আছে। কিন্তু কিছুতেই আমি তাকে জড়িয়ে ধরবো না। ‘দেখা আছে, সব পুরুষকে দেখা আছে।’ এমন একটা কথা যেন সালিমার ঠোঁটে এসে বসে আছে বলে আমার মনে হলো।
আমার ভয় হয়। আসলে যাই বলি না কেন—এত বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার পর কিছুতে বিশ্বাস আনা খুব কষ্টসাধ্য, আমার জন্য তো বটেই। আমার ভেতর যে কথা তখন ঘুরছিল, তা হলো, আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে লাথি খেয়ে তোমাকে হারাতে চাই না। তুমি এমনিতেই লাথি দিয়ে চলে যেতে পারো। তবে এ দায় আমি নিজের কাঁধে নেবো না।
সব হারানো মানুষের এই এক দোষও বটে। একটা অকথিত প্রলেপন যেন। যা সে ক্ষতের ওপর আলতো হাতে বুলিয়ে দিতে ওঁৎ পেতে থাকে। অন্যে কষ্ট দিক, তবু যেচে কেন কষ্ট নিতে যাবো—এই ধরনের আপ্তবাক্য আর কি!
তাছাড়া একটা লাথি, এই তো আমার প্রাপ্য। এর বেশি আসলে আমার কাছে বেশি বেশিই লাগে। পাওয়ার ওজন বইবার ক্ষমতা বোধ হয় প্রভু আমাকে দেননি। তাই আমি আগ বাড়িয়ে কিছু করবো না। সে যা বলবে তাই, আমি তার কট্টোর অনুসারী। তাতে যা হবে তাই সই।
সালিমার পিঠে পিঠ লাগিয়ে শুয়ে—তাকে কিছুতেই জড়িয়ে ধরবো না—এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
ঠিক বলতে পারবো না কেন, মাসের পর মাস পথে ঘুমিয়ে, এই বিধস্ত নগরীতে এসে, রাতের এই মুহূর্তে আমি ভয়ানক দ্বিধান্বিত। আমার কী করা উচিত—রাত তুমি বলে দাও। পালিয়ে যাবো?
এখন আমি আপনার হাতে তুলে দিয়েছি। যে গল্পের নাড়ি-নক্ষত্র আপনার জানা। আপনার বিশ্লেষণী ক্ষমতা এত প্রখর যে, আপনি এর যত ক্ষামতিগুলো ধরে ফেলবেন।
সালিমার পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে আমার শরীরের ঝড়ের পূর্বাভাস পাই। স্নাইপার বা রকেট তো এভাবে শুতেই পারে। আমি তো স্নাইপার না। আমার কাম জাগে। তা মেটাতে না পারলে কষ্ট হয়। ভয়ানক কষ্ট। শারীরিক ও মনসিক এক অত্যাচার সে।
সব অত্যাচার মেনে নিয়েই আমি কলার ডোমের মতো পড়ে থাকলাম। সময় চলে যাচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিও যেন স্বাভাবিক হচ্ছে না। এমন একটা অস্বস্তির ভেতর দুচোখে ক্লান্তি নেমে এলো। বড় সে ক্লান্তি। যার কাছে পৃথিবীর সবাই এসে অস্ত্র জমা দেয়।
কালো কালো কতগুলো গোলক শূন্যে উড়ে যেতে যেতে আমার চেতনা গিলে ফেলে। আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
লা-জবাব
এই শহরের ধ্বংসলীলার কথা ভেবে প্রতিটি পদে পদে আমি চমকে উঠছি। কারণ এমন এক শহর আছে আমাদের, যেটা পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম নগরী। এ কথা শুনে সালিমার প্রশ্ন—আমরা কি ওখানেই যাচ্ছি?
—অবশ্যই না। কারণ আরেকটি ধ্বংসলীলার ক্রীড়নকে পরিণত হতে নিজেদের আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। জানো, শহরটি একটি জীবন্ত বোমে পরিণত হয়ে আছে। মানুষের শরীরের যত শিরা-উপশিরা, শহরের তলদেশে তার চেয়েও বেশি আছে গ্যাস লাইনের পাইপ আর আকাশ ছোয়া প্রতিটি বাড়ি এবং পথ অসংখ্য তাদের দঙ্গলে ঢাকা; যার নাম ঢাকা।
—শহরটির নাম ঢাকা!
—হ্যাঁ।
—এই তারটারে ঢাকা থেকে এই নাম!
—বাস্ততা দেখলে তো তাই মনে হয়?
—শুনেছি তো এই ঢাকার নাম। মাঝে মধ্যেই তো আগুন লাগে ওই শহরে। এই ক্যামিক্যাল গোডাউনে আগুন তো, ওই সর্টসার্কিটে আগুন। আছেই। তোমাদের বাখরখানি নামে একটা খাবার আছে না? আচ্ছা, বাদ দাও। আমার বুঝে আসে না, একটা শহরের মানুষ কতটা অসচেতন হলে এমন হয়—জনপদের মধ্যিখানে ক্যামিকেলের গোডাউন! আচ্ছা…
সালিমা কী নিয়ে যেন একটু ভাবে। তারপর বলে—আচ্ছা, তোমরা কি আমাদের ধ্বংস হওয়া থেকেও কিছু শিখলে না?
তার কথায় আমি নির্বাক হয়ে থাকি। কারণ কোনো উত্তর তো আমার জানা নেই। কারণ কোনো কিছুই তো আমরা কখনো শিখিনি। না ভিয়েতনাম থেকে, না জার্মাান থেকে—আমাদের উদহরণ হচ্ছি আমরাই।
—আমাদের শহরও এসব অপরিকল্পিত বিষয়-আসয়ে ভরা ছিল। দালান আর আদাল। বিল্ডিংয়ের দাপটে শ্বাস ফেলার জায়টা পর্যন্ত ছিল না। রাস্তার ওপর জুল অসংখ্য তার। দুটো একটা গাছ থাকলে, তাও কেটে ফেলা হতো। এতো কিছুর পরও তোমাদের মতো আমাদের এখানে দুর্ঘটনা নামক গণহত্যা ছিল না। কোনো কিছু ঘটলে রাষ্ট্র তার দায় নিজের কাধে তুলে নিত। সেটা মুখের কথা না কিন্তু। একটা প্রাণের বদলে একটা পরিবারকে সব ধরনের সুবিধা দিতে বাধ্য থাকত রাষ্ট্র। এসব আমাদের এখানে ছিল।
—সত্যি কি জানো, আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান ছিল দেশের একটি খুটি। তারও নানা দোষ-গুণ ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন আমাদের নেতা, কারও খেলার পুতুল না। এখানে কৃষকরা পেতে সর্বোচ্চ সম্মান—সেটা তার ফলানো শষ্যে যেমন, তাকে অভ্যর্থনার সময়ও। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা গ্যাস ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। বড় বড় কারখানা বাদে কেউ গ্যাস ব্যবহার করত না। তাও করখানা বসতি থেকে নির্দিষ্ট দুরত্বে করতে মালিকরা বাধ্য। প্রকৃতিক দুর্যোগের কথা ভেবে আমরা এসব ক্ষণিকের ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমাদের ছিল পারমানবিক বিদ্যু কেন্দ্র; তাও সেটা শহরের একপাশে। আমাদের সব চলতো বিদ্যুতে।
—এত কিছুর পরও আমরা আমাদের শহরকে ধরে রাখতে পারিনি। এ থেকেও তোমাদের ওই শহরের লোকেরা কিছু শেখেনি?
আমি শুধু আস্তে করে বলতে পারলাম, না।
ভূমিকা
এখানে ছোট্ট একটা ভূমিকার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। কারণ আমি ছোটখাটো এক লেখক। সাংবাদের বাইরে এই মুক্ত গদ্যটদ্য, ফিচারটিচার লিখি। সেখানে একবারে একটি উপন্যাস লিখে ফেলা? তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
কিন্তু যখন গল্পটি এক গল্পবাজ বুড়োর মুখে শুনলাম, বোনকে শোনালাম এবং আরও কাউকে কাউকে। তখন থেকে তারা আমাকে গল্পটি নিয়ে একটা লেখা লিখতে তাড়া করে ফেরে। আমি জানি, তারা আমার হিতাকঙ্খী। আমাকে দিয়ে তারা লিখাতে চায়।
বলা ভালো, আমারও কম লোভ হচ্ছিল না কিন্তু। লিখে ফেলি। তারপর যা হয় হবে—এমন একটা ভাবনায় লেখাটায় হাত দিয়ে ফেলি। লেখাটা কয়েক বার শুরুও করি। ওপরের খণ্ডাংশগুলো তার নমুনা। কিন্তু ওগুলো শুধু আমার ব্যর্থতারই নমুনা।
মূল লেখা যখন শেষ হয়ে এলো। তখন ওই খণ্ডাংশগুলোর বাদ দিতে আমার কেমন যেন মায়া মায়া হলো। কিন্তু একজন লেখকের লেখা উপযুক্ত, তন্বি করে গড়ে তুলতে এতো মায়া থাকলে হয় না বলে আমি জানি। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করি—আমি তত বড় লেখক নই।
তারও চেয়ে আমি আপনাদের, বিশেষত আপনাকে জানাতে চাই, আমার ব্যর্থ প্রয়াসগুলো কেমন ছিল। তাই উপরের লেখাগুলো আমি ত্যাগ করেও রেখে দিলাম।
এবার মূল গল্পে প্রবেশ করবেন কি না; তা একান্ত আপনার স্বাছন্দ্যের ওপর ছেড়ে দিলাম প্রিয় পাঠক। তার আগে, উপরিউক্ত অংশ যে একেবারে অনর্থক তাও কিন্তু ভাবা যাবে না। কারণ উপন্যাসের ভেতর খণ্ডাংশগুলোর বিভিন্ন যোগসূত্র আপনি খুঁজে পাবেন। তাই একেবারে অচ্ছুত ভাবারও কোনো কারণ নেই অংশগুলোকে।
সম্মানিত পাঠাক, এই প্রচেষ্টা, যা এখন আমি আপনার হাতে তুলে দিয়েছি। যে গল্পের নাড়ি-নক্ষত্র আপনার জানা। আপনার বিশ্লেষণী ক্ষমতা এত প্রখর যে, আপনি এর যত ক্ষামতিগুলো ধরে ফেলবেন। তবে নবীন লেখক নিয়ে আপনার মূল্যায়ন আমার পরবর্তী পথ নির্দেশক হোক।
চলবে…
বিধ্বস্ত নগরী: পর্ব-১ ॥ রাশেদ সাদী