[পর্ব—৮: মরণ রে তহু মম শ্যাম সমান]
এক.
ফুলের রেণুর মতো হারানোর খেলা আমার জীবনের প্রথম প্রভাতেই শুরু হয়েছিল। যখন আমার বয়স ছয় কিংবা সাত। ছোট বোন রানুর পরে জন্মেছিল মানু।
অসামান্য এক সুন্দর শিশু ছিল সেই বোনটি আমার। মাত্র ১৭ দিন বয়সে মৃত্যুবরণ করে ধনুষ্টংকারে। দাইমা তাকে বাঁশের নেইলে বিচ্ছিন্ন করেছিল মায়ের প্লাসেন্টা থেকে। সেই ইনফেকশন বাঁচতে দেয়নি তাকে। কিন্তু নানাবিধ কুসংস্কারের ডাল-পালা উড়িয়ে সেই সব দিনে রোমান্স রহস্যের মতো নানা গল্প প্রচলিত ছিল।
কারও কারও মধ্যে তখন এমনো ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, শিশুটি সুন্দরী হয়েছিল বিধায় জিনে ভূতে ধরেছে তাকে। এজন্যে কত যে ঝাঁড়-ফুঁক-তুক-তাক, তবু কী আর শেষ রক্ষা হয়? এক আলোক উজ্জ্বল সূর্য ওঠা ভোরের বেলা মাকে বিলাপ করে কাঁদতে শুনে হুড়মুড় করে জেগে উঠি। বাড়ি ভর্তি মানুষ আর মানুষ।
আমার শিশু মনে উৎসব, উৎসব আমেজ এলো তখন। আমাদের বড় ঘরের মেঝের মাটিতে হাত চাপড়ে কাঁদছেন মা। জানি, মৃত্যু কোনো উদ্যত সঙ্গীন নয়, তবু যেন মহালয়ার উৎসবে মহালগ্নের আনন্দময় মুহূর্তের মতো মনে হচ্ছিল সেই সময়ে আমার।
জীবনে প্রথম মৃত্যুর সঙ্গে দেখা, এই দেখা যেন সেই প্রথম প্রেমের মতো। আনন্দ কান্নায় বিহ্বল। শিরায় শিরায় বয়ে যাচ্ছিল ঝিরিঝিরি বাতাসের আহ্বান। এক বয়স্ক ভদ্রলোক যখন একটা পাটখড়ি হাতে নিয়ে শিশুর উচ্চতা অনুযায়ী কবর খোঁড়ার মাপ নিতে ঘরের মধ্যে এলেন, তখন মা আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
মনে হলোম ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’। আমি অপলক নেত্রে আমার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কান্নার ধরন বুঝতে চেষ্টা করছিলাম। সারা বাড়ি যেন কান্নার অদ্ভুত এক আলোতে ভরে উঠেছে।
মায়ের সুরাপিত কান্নার কম্পনে প্রথম শুনেছিলাম ভৈরবী, ধীরে ধীরে সেই স্বরে শুনতে পাচ্ছিলাম যেন সানাইয়ের বিরহ বিচ্ছেদ। কন্যা বিসর্জনের সুগভীর হাহাকারে নিমজ্জিত আমার মাকে চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ভীষণ অচেনা এই যে মা, তাকে যেন চিনতে পারছি না। তিনি তো আমাদের প্রতিদিনের সেই চেনা চিরকালের মা নন, যিনি আমাকে প্রতিদিন ডেকে সহাস্য মুখে খই মুড়ি খেতে দেন, ভাত বেড়ে দেন দেবী অন্নপূর্ণার মতো।
তবু বুঝতে চেষ্টা করছিলাম মা কেন কাঁদছেন এমন করে। তাকে তো এভাবে কাঁদতে দেখিনি আগে। সেই আমার মৃত্যুর সঙ্গে প্রথম দেখা। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবিষয়ক কবিতা তখনো পড়িনি, পড়র কথাও না। ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান’ অথবা ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই/এই সূর্যকরে পুষ্পিত কাননে/জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।’
এরপর আমি কালিগঙ্গার ধারে ভেজা বালুতে পা ডুবিয়ে কড়চা বনে ঘুরে ফিরে, আকাশপানে কাশফুল উড়িয়ে দিয়ে যখন আরও একটু সাবালিকা সময়ের বাসিন্দা, ঠিক তখন পাঁচ মাস বয়সী ছোট ভাই আলীমকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে পারি। বোতলে দুধ খাওয়াতে পারি। বুঝতে পারি, এভাবে ভাইকে কোলে করতে করতে নিজের ভেতরে অচেনা এক মাতৃত্ববোধের তৃষ্ণাতৈরী যেন হচ্ছে ধীরে ধীরে। সেই জরাসন্ধ সময়ে হুট করে ‘দুধের বাতাস’লেগে বড়ভাই ফারুকের মতো আলীম নামের ভাইটিও হারিয়ে গেল আমাদের।
এরপর তাকে পুনরায় বিয়ের কলেমা পড়ানো হয়েছিলো ওই সোনা মিয়ার সঙ্গেই। দেখতে ছোটখাটো মতন একজন মানুষ ছিলেন বটে, প্রাণশক্তি ছিল তার ঈর্ষণীয়।
আবার মায়ের হাসিমাখা মুখ শোকাচ্ছন্ন বিষাদে মলিন হয়ে গেলো অকস্মাৎ। অথচ প্রতি মুহূর্তে আমি মায়ের হাসিখুশি মুখদেখতে ব্যাকুল হয়ে থাকি। প্রকৃতির সবুজে, আকাশের অসীম নীলে মায়ের অনিন্দ্য কান্তিময় নির্ভরতার সেই পরম আশ্রয়ের মুখটি খুঁজে ফিরি বারবার। আমাদের সারা বাড়ি বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে বেশ কিছুকাল। মায়ের বিষাদাক্রান্ত মুখ দেখলেই নিজেকে কেমন এতিম এতিম লাগে। আমার তখন খেলাধুলাও আর ভাল্লাগে না। আমাদের মা-জননী সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন মোট নয় জন।
তিন জন মারা যায় ছয় মাসের মধ্যেই। বেঁচে আছি আমরা মায়ের ছয় সৈন্যবাহিনী। মাকে ছেড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছি আজ আরব উদ্বাস্তুদের মতো।
দুই.
সেকালে পরিবার-পরিকল্পনার কোনো পদ্ধতি ছিল না। কাজেই স্বামী-স্ত্রী যতদিন সক্ষম থাকেন, ততদিন সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে জীবন থেকে ঝরে যেতো, তাদের যত উর্বর সোনালি সময়। আমাদের গ্রামের জমাদ্দার পাড়ায় সোনা মিয়ার বউ ছিলেন, জীবিত-মৃত্যু মিলে কুড়িটি সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। এরপর তাকে পুনরায় বিয়ের কলেমা পড়ানো হয়েছিলো ওই সোনা মিয়ার সঙ্গেই। দেখতে ছোটখাটো মতন একজন মানুষ ছিলেন বটে, প্রাণশক্তি ছিল তার ঈর্ষণীয়।
একই স্বামীর সঙ্গে দ্বিতীয় বার কলেমা পড়ানো কেন? মৌলিভীরা হাদিসের দোহাই পেড়ে বলতেন, কুড়িজন সন্তান জন্মদানের পরে তাদের বিয়ে খারিজ হয়ে যায়, কাজেই পুনরায় কলেমা দেওয়া ইসলামে জায়েজ। এই সত্যাসত্যের ভিত্তি ইসলামে কতটা মজবুত তা অবশ্য আমার জানা নেই।
জমাদ্দার পাড়ায় ছিল আমার সইয়ের নানাবাড়ি এবং আমাদের সমবয়েসী অন্য এক বালিকা বন্ধু শেফালীদের বাড়ি। শেফালী প্রথমে ছিল সই পপির বন্ধু। পপির সঙ্গে আমার সই পাতানোর ফলে ওদের পাড়ায় ঘন-ঘন যাতায়াত বেড়ে যায়, পপির সঙ্গে শেফালীও আমাদের বাড়িতে আসে যখন তখন। যেহেতু শেফলী স্কুলে যেতো না, কাজেই পপির সমবয়েসী প্রিয়জন হিসেবে আমার সঙ্গেও তার গভীর বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়। যা অতীত গড়িয়ে বর্তমানেও সমানভাবে বর্তমান। কিন্তু বছর তিনেক হলো আমার প্রাণের সই পপি হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্যে।
স্বামী, দুই কন্যা ও এক পুত্র রেখে সুখের ঘরের দরোজা বন্ধ করেছে সেই যে! শেফালীদের বাড়ির পরেই ওদের বড়ঘর ঘেষে সোনা মিয়া দাদার শরিকি বাড়িটি ছিল, সম্পর্কে তিনি ছিলেন ওদের শরিকি দাদা। তাকে আমরা দেখিনি, কিন্তু সোনা মিয়া দাদার বউ তখনো বেঁচে ছিলেন। তখনই শেফালীদের বাড়িতে আম-দুধের দাওয়াত খেতে যেতাম ওই দাদিকেও তখন দেখতাম, কৌতূহলী মন নিয়ে অপার বিস্ময়ে আমি তার মুখের শিরা-উপশিরাগুলো যেন সমূলে পাঠ করতে চাইতাম।
শেফালীর দিকে মুখ ফিরিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করতাম, সত্যিই কুড়িজন সন্তান জন্ম দিয়েছে? এখন কতজন, আছে রে শেফালী? এখনো চৌদ্দজন জীবিত আছে। আজ ভাবি, আহা, আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথও ১৪ নম্বর সন্তান। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন, বাংলা সাহিত্যের বড় ক্ষতি হয়ে যেতো। রবীন্দ্রনাথের হয়তো জন্মই হতো না। কী সর্বনেশে কথা। আমরা তাহলে বাঁচতাম কী নিয়ে? ভাবাই যায় না।
ভাগ্যিস পরিবার পরিকল্পনার ‘দ্য পিল’: সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে আবিস্কৃত হয় এবং সেই দশক থেকে পরিবার পরিকল্পনায় ব্যাপক অবদান রাখে। বাংলাদেশের তথা সারা বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পৃথিবীকে বসবাসের অনুপোযোগী এবং সমস্যাসংকূল করে তুলছিল। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ অথবা পরিমিত সন্তান জন্মদান করে পৃথিবীর ভারসাম্য আনয়নে পরিবার পরিকল্পনা সেই সময়ে আবশ্যক হয়ে পড়েছিল।
বর্তমানে যদিও আমাদের দেশে মেয়েদের সন্তানধারণের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ বছর। কিন্তু সুদূর অতীতে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, সেই সময়ে ১৩/১৪/১৫ বছর বয়সেই মা হয়ে যেতো অনেক মেয়ে। যে কারণে আমাদের দেশে প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি ছিল এই কিছুকাল আগেও।
অন্যেরা দড়ির অন্য প্রান্তের গিট শক্ত করে ধরে আছে। তখনো ফুট্টোর চিঁ চিঁ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অনেক কসরতের পরে জীবন্ত অবস্থায় নয়াম্মা সেদিন ফিরে পেয়েছিলেন তার কোলের সন্তানকে।
পরিবার পরিকল্পনার ফলে মাতৃত্ব সংক্রান্ত মৃত্যুর হার যেমন কমে এসেছে, তেমনি শিশু মৃত্যুর হার কমেছে অনেকটাই। তবে সর্বাংশে নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। পাশাপাশি বছরে এখনো প্রায় ৫০ হাজার নবজাতকের মৃত্যু অবশ্যই মর্মান্তিক অকালমৃত্যু। তবে, এর জন্যে দায়ী আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, অশিক্ষা ও কুসংস্কার। যা কোনোমতেই সমূলে নির্মূল করা যাচ্ছে না। যতক্ষণ না জনগণ শতভাগ শিক্ষিত হচ্ছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের কালে ছিলাম সাত কোটি, স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছর পরে জনসংখ্যা আজ ১৮ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে।
তবে আশার কথা হলো, এই জনসংখ্যা আজ জনসম্পদে পরিণত হয়েছে, দেশটি মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন হয়েছিল বলেই।
তিন.
আমার সেজো চাচা আফছার উদ্দিন আহমেদের স্ত্রীকে ডাকতাম নয়াম্মা। চার ছেলে দুই মেয়ের জনক-জননী তারা। তাদের বড় কন্যা সন্তানকে ডাকতাম রেণু আপা। আমার বড়’পারও বড় ছিলেন তিনি। সুন্দরী রেণু আপার বিয়ে হয়েছিল তাদের নতুন বাড়িতে। পুরনো বাড়ির সবাই ও মায়ের সঙ্গে আমিও আছি সেই বাড়িতে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হই-হই রবে লাল পাগড়ি মাথায় বর এলো বাড়িতে। মুখে রুমাল। চেহারাখানা পুরো দেখা যাচ্ছে না। বাংলা ঘরের বেড়ার ফাঁকা দিয়ে বরকে এক নজর দেখেই নয়াম্মা ঘরে এসে হঠাৎ ফিট হয়ে গেলেন।
সুন্দরী মেয়ের জামতা হিসেবে দেখতে শর্ট ছেলেকে তার ভালো লাগেনি, উপরন্তু কেউ তার কানে লাগিয়েছিল, বরের আগে একটা বিয়েও ছিল, আর যায় কোথা—‘যেই না কাঁঠালের বিচি,তা পোড়াতে আবার আইলসে।’
বলেই, নয়াম্মা সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে জ্ঞান হারালেন। সবাই তাকে ঘিরে আছে। আমার মা তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছেন। আমিও তার পেছনে দাঁড়ানো।
নয়াম্মার বিছানার খাট থেকে বড় জোড় এক বিঘৎ উঁচুতে আমার ছোট্ট মুখখানা। ঘাড় উঁচু করে বিস্ময়ের সঙ্গে সব কিছু দেখতে চেষ্টা করছি আমি। হঠাৎ জ্ঞান ফিরেই নয়াম্মা পা ছুড়ে দিয়েছেন, তার পায়ের ধাক্কায় আমি খাটের পায়ার নিচের ইটে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম। কবিতার সার্থক একটি চিত্রকল্পের মতো এখনো পুরো ঘটনাটি দোল খায় মনে।
আমার থুতনী কেটে দর দর করে রক্ত পড়ছে। মা আমাকে তুলে নিয়ে বাড়িতে এলেন। ওষুধপত্র লাগিয়ে খাটে শুইয়ে দিলেন। আজাহারের মাকে পাহারায় বসিয়ে রেখে মা আবার যখন চলে যাচ্ছেন, আমি তখন অসহিষ্ণু রকমের এক কান্না জুড়ে দিলাম।
কিসমিশ খেতে খুব ভালোবাসতাম বলে হরলিকসের বয়াম-ভর্তি কিসমিশ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তবে মা বেরিয়ে গেলেন। সেই কিসমিস খেতে খেতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। রেণু আপার বিয়ে সেদিন ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল। অত্যন্ত সুখী দম্পতি ছিল তারা। কিছুদিন পরেই রেণু আপাকে নিয়ে করাচি চলে গেলেন। আবদুল মজিদ দুলা ভাই চমৎকার গান গাইতেন। করাচি রেডিও ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশ বেতারেও অ্যানলিস্টেড আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে গান করেছেন আমৃত্যু।
রেণু আপার ছোটভাই আফতাব আহমেদ করাচিতে এই বোনের কাছে থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশে ফেরেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বেতারে চাকুরি করেছেন আমৃত্যু।
করাচি থেকে দেশে ফেরার পরে রেণু আপা মিরপুর সরকারি স্কুলে হেড মিস্ট্রেস ছিলেন দীর্ঘদিন। অসম্ভব মানব দরদি ছিলেন আপা। এদের প্রত্যেকের এত ভালোবাসা পেয়েছি যে, সে ঋণ কখনো শেষ হওয়ার নয়। এই তিনজনই জগৎ ছেড়ে চলে গেছে অনন্তবাসে।
রেণু আপার একমাত্র পুত্র ফরিদ স্যুইজারল্যান্ডবাসী। মেয়ে ডেইজি ঢাকায় মিরপুরে মা বাবার বাড়িতেই আছে। রেণু আপার ছোট বোন চায়না আপারও বিয়ে হয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যে। বর্ষাকালে লঞ্চভাড়া করে বরযাত্রী এসেছিল আপাকে নিয়ে যেতে। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর সময় ছোট ভাই-বোনদের সঙ্গে পাঠানোর নিয়ম ছিল সেই সময়। টুটু ভাই আর আমাকে পাঠানো হয়েছিল চাহেনা আপার সঙ্গে। সেই প্রথম লঞ্চ ভ্রমণের উৎসব আনন্দে নেচেছিল আমার মন।
আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ-ছয় মাইল দূরে পুটাইল ইউনিয়নে বিয়ে হয়েছিল চাহেনা আপার। তখন জসিম দুলা ভাই ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলেন। বিয়ের পরে ডিগ্রি ও এমএ পাস করার পরে যখন ইনকাম টেক্স অফিসার হিসেবে চাকরি পেলেন, তখন আপাকে নিয়ে ঢাকার লালবাগে বাসা নিয়ে থাকতেন।
অদম্য উৎসাহী চাহেনা আপাও বিয়ের পরে পড়াশোনা শেষ করলেন। স্কুলে চাকরি পেলেন। তার মেয়ে রীতা ও নিপু দু’জনেই সরকারি স্কুলের শিক্ষক।
একমাত্র পুত্র সন্তান নাসিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কিছুদিন দেশেই সাংবাদিকতা করেছে। বর্তমানে সপরিবারে মন্ট্রিয়েলে বাস করছে দীর্ঘদিন।
—আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন দুলা ভাই মাঝে-মধ্যেই শামসুন্নাহার হলে এসে ছুটির দিনে আমাকে নিয়ে যেতেন বাসায়, আপা ভালো রান্না করতেন, এত ভালো আচার বানাতেন যে, আমার বিয়ের পরে আপার হাতের সেই আচার না হলে রফিক আজাদের খাওয়া কিছুতেই জমতো না।
একবার বিরিশিরি থেকে এক বস্তা জলপাই পাঠিয়েছিলেন, চাহেনা আপার হাতে আচার তৈরির জন্যে, সারা বছর যেন খেতে পারেন সেই আচার। কবির এতটাই পাগলামি ছিল, আপার হাতের আচারের জন্যে।
জসিম দুলা ভাই ইংরেজি গ্রামার খুব ভালো বোঝাতে পারতেন, তার কাছেও শিখেছি অনেক কিছু। আমার ছয় মাসের বড় টুটু ভাই, পুটু তারপরেই রেণু আপার সবচেয়ে ছোট ভাইটির নাম ছিল ফুট্টো।
নতুন বাড়িতে তখন সিমেন্টের চাক বসানো কুয়া তৈরি করছে মিস্ত্রিরা। সেই সময়ে টিউউবয়েলের প্রচলন ছিলই না প্রায়। নিচ থেকে এক এক করে ওপরের মাটি পর্যন্ত প্রায় শ’খানেক চাক বসানো হয়ে গেছে। মিস্ত্রিরা খেতে বসেছে, এরমধ্যেই ঘটলো সেই বিপত্তি।
দেড় বছর বয়সের শিশু ফুট্টো খেলতে খেলতে সেই চাক ও মাটির মধ্যবর্তী ফাঁকা দিয়ে পড়ে গেছে গভীর খাদে। খবর শুনে পুরনো বাড়ির সবাই ছুটে গেলো সেখানে। ইতোমধ্যে শখানেক লোক জড়ো হয়ে হয়ে গেছে। নয়াম্মা কপাল চাপড়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করে কাঁদছেন, কয়েকজন তাকে ধরে আছে, পাছে সন্তানকে তুলে আনতে পাছে নিজেই না সেখানে নেমে পড়ে যান—সেই আতঙ্কে আছে সবাই।
ইতোমধ্যে মিস্ত্রিদের একজন মোটা দড়ি বেয়ে প্রায় ১০০ ফুট নিচে নেমে গেছে। অন্যেরা দড়ির অন্য প্রান্তের গিট শক্ত করে ধরে আছে। তখনো ফুট্টোর চিঁ চিঁ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অনেক কসরতের পরে জীবন্ত অবস্থায় নয়াম্মা সেদিন ফিরে পেয়েছিলেন তার কোলের সন্তানকে।
গ্রামের মধ্যমণি আমাদের নামকরা এই পরিবারের দুর্ভাগ্য এই যে, সেই ফুট্টো যখন তাগড়া জোয়ান পুরুষ, ডাকাবুকো এবং পরিবারের অন্যান্য ছেলেদের চেয়েও সাহসী, তার জীবনের এই অত্যুজ্জ্বল সময়ে ঘটে গেলো সেই নির্মম ঘটনাটি। তখনো তার মা বেঁচে আছেস। আমার চাচা মারা গেছেন কিছুদিন আগে। চার ভাইয়ের মধ্যে তখন আব্বাই কেবল জীবিত আছেন।
ফুট্টোদের নতুন বাড়ির তিন বাড়ি পরেই নদীভাঙা এক বসতি বাস করে। বাড়ির মালিকের নাম ডালিম মিয়া। কালিগঙ্গার ভাঙনে ‘বিলনালাই পাড়া’ থেকে আমাদের পাড়ায় এসে তারা নতুন বসতি গড়েছে।
বিলনালাই বা নদীভাঙা সাগরদীঘির পাড়ায় আমাদের কোনো যাতায়াত ছিল না। আত্মীয়তার তো প্রশ্নই ওঠে না। কেননা, এই দুই পাড়াকেই নিরক্ষর ও অশিক্ষিতজনের পাড়া বলেই জানতো সবাই।
প্রতিবেশী হিসেবে ডালিমের পরিবার নয়াম্মার বাড়িতে খুব যাওয়া আসা শুরু করে।তাদের মধ্যে খাদ্যখানার বিনিময়ও চলে হরহামেশা। কিন্তু কখনো আমার আব্বার গলার আওয়াজ পেলে দেউড়ি বেড়া থেকেই ফিরে যায়, পারতপক্ষে সামনে আসে না এই ডালিম মিয়া। তবে, আমার ছোট চাচার একমাত্র কন্যা আলেয়ার বিয়ে হয়েছিল ডালিমের স্ত্রীর ভাইয়ের সঙ্গে। সেই সূত্র ধরে ধীরে ধীরে আমাদের পুরোনো বাড়ির ছোট চাচার অংশেও মাঝে-মধ্যে আসতো তারা।
তবু আমার পরিবারের সন্তান এভাবে তুচ্ছ কারণে খুন হলো, এই পরাজয় কিভাবে মানবো? আমার বেঁচে থাকা, না থাকা সবই তো আজ সমান। মা, আমি কারে বলবো মনের এই দুঃখ?
ইতোমধ্যে জমাদ্দার পাড়ার খালেক চেয়ারম্যান ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার মায়ের নামে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করে এই ডালিম মাস্টারকে নিয়োগ দিয়েছিল। আমাদের ‘চরগড়পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর মাঠের পশ্চিম পাশেই ‘আরজু বানু হাইস্কুল’ নামে সেই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকেই ডালিম মাস্টার নামে সবাই তাকে নানাভাবে চিনতে শুরু নানাজনে।
ভিলেজপলিটিকস্ বলতে যা বোঝায়, এই ডালিম মাস্টারের ভেতর-বাইরে তার কদাকার প্রলেপটি ছিল সাংঘাতিক। আমাদের পাড়ায় তার আসার পূর্ব-পর্যন্ত সবুজে শ্যামলে ঘেরা গ্রামের শান্তশ্রী এক অতুল বৈভব ছিল, যে নিসর্গ রূপের ছবি মানুষ আজীবন মনের মধ্যে বয়ে বেড়ায়। কিন্তু এই লোকটি মাস্টারের মহৎ পদবিকে ব্যবহার করে নানা রকম হীনস্বার্থের বর্জ্যে গ্রামের সহজ-সরল ভাবমূর্তিটিই নষ্ট করে ফেলেছিল।
একটি ছেলের আশায় এই ভদ্রলোক ইতোমধ্যে পাঁচটি মেয়ের জন্ম দিয়েছে। বড় মেয়েটির নাম মেরী। ফুট্টোর কাছাকাছি বয়স। দুই বাড়ির অনায়াস যাতায়াতের ফলে কোন ফাঁকে তাদের মধ্যে প্রণয়ের বীজটি উপ্ত হয়েছিল, আমরা তখনো তা জানতাম না।
কিন্তু ডালিমের ইচ্ছে নেই ফুট্টোর সঙ্গে প্রেম বা বিয়েতে। কাজেই ফুট্টোর হাত থেকে মেয়েকে নিরাপদ করতে আমার এই ভাইটিকে সে ভাড়া করা লোক দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল।
এই প্রথম আমাদের গ্রামে কোনো হত্যার ঘটনা ঘটে। এবং তা আমাদের বাড়ির সন্তান। স্তব্ধতার এক কালো কৃষ্ণ চাদরে মুহূর্তেই ‘মিয়াবাড়ির সূর্যকে ঢেকে দিলো কেউ। ভাবা যায়!
জীবনে এতটা অসহায় ও এতটা ক্ষোভ নিজের মধ্যে কখনো আবিষ্কার করিনি। চোখের জলে নয়, সেদিন রক্তের কান্নায় ভেসে গেছিল আমাদের অতীত বর্তমান, ভবিষ্যৎ।
১৯৮২ সালের দিকের ঘটনা। আমি তখন ইডেন কলেজে প্রভাষক হিসেবে সবে যোগ দিয়েছি। ছুটিতে তখন বাড়িতেই ছিলাম। ভোরের সূর্য না ফুটতেই আমাদের কাছে খবর এলো, আমাদের বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে বৈকুণ্ঠপুর এক বাড়ির গোয়ালঘরে আটকে রেখে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
সেখান থেকেই সরাসরি পোস্টমার্টেমের জন্যে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। একটা চাটাইতে পেঁচিয়ে সেই লাশ যখন বাড়িতে এলো, আব্বা ঝরঝর করে কাঁদছেন। আমি তার পাশে গিয়ে কাঁধে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
মা, আমি সারাজীবনে রাজনীতি করলাম না, ছেলে-মেয়েদের রাজনীতি করতে দিলাম না। তবু আমার পরিবারের সন্তান এভাবে তুচ্ছ কারণে খুন হলো, এই পরাজয় কিভাবে মানবো? আমার বেঁচে থাকা, না থাকা সবই তো আজ সমান। মা, আমি কারে বলবো মনের এই দুঃখ?
চলছে…
বালিকার চরৈবেতি-৭॥ দিলারা হাফিজ