জননী, সর্বংসহা ধরিত্রী
[পর্ব-২৯]
কলকাতা থেকে রাশেদা খালা আমার মাকে সবচেয়ে দামি এবং নিত্যনতুন ডিজাইনের শাড়ি পাঠাতেন। আমার মায়ের সংগ্রহে যত আকর্ষণীয় মনমাতানো রিনিঝিনি শাড়ি ছিল, তার বেশিরভাগই রাশেদা খালার দেওয়া। আদরের ছোট্ট বোনটিকে তিনি পাঠাতেন মূল্যবান সব উপহার। কিন্তু শেষ ইচ্ছে তার পূরণ হয়নি। সেই বেদনাবাহিত শোকে সারা জীবনই মূহ্যমান ছিলেন আমার মা, তার সবচেয়ে আদরের ছোটবোন লেবু। পীরের হুকুমে সেই যে বিনে নোটিশে কলকাতার ক্রিস্টোফার রোডের বাড়িতে নিয়ে তার বিয়ে হলো, বিয়ের পরে পাঁচ বছরের মধ্যে একবারও আর তিনি জাবরা গ্রামে ফিরতে পারেননি। বনের পাখিকে খাঁচায় রাখলে যা হয়, তার অবস্থাও তেমনটি ছিল সব সময়। খুব ইচ্ছে ছিল গ্রামে এসে একবার মা ও ভাই-বোনদের দেখে যাবেন, তার আগেই পরপারে চলে গেলেন তিনি। এই শোক আমার মাও কখনো ভুলতে পারেননি।
স্মৃতির রসায়নে বারবার তিনি উঠে আসতেন আমার মায়ের মুখে, গল্পে ও কথায়। বুঝতে পারতাম, মায়ের এই দুর্বল, নরম জায়গাটির নাম রাশেদা খালা। মায়ের সামান্য সুখৌশ্বর্য ও প্রাপ্তির নামও রাশেদা খালা। কাজেই এই বোনের কথা, বোনের ভালোবাসার কথা শুনতে শুনতে তিনি আমারও ভালোবাসার মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। রাশেদা খালার দেওয়া অনেক রঙবেরঙের সিল্ক সুতার শাড়ি ছিল মায়ের আলমিরায়। সেসব মাকে পরতে দেখিনি, কিন্তু প্রতি ভাদ্রমাসে দু’দিন রোদে উল্টে পাল্টে শুকিয়ে আবার তুলে রাখতেন নেপথলিনের গন্ধ জড়িয়ে।
সেখান থেকে মসলিন সুতোর মনোরম শাদা-মেরুনের ডোরাকাটা একটি শাড়ি আমাকেও মা দিয়েছিলেন স্মৃতি হিসেবে রাখতে। যে খালাকে কখনো দেখিনি, মায়ের মুখে গল্প শুনে যার অবয়ব এঁকেছিলাম মনে মনে, তার সেই স্মৃতি বহন করে চলেছি আত্মার বিবরে। এ যেন শুধু সুতোর শাড়ি নয়, নেপথলিনে জড়ানো আমাদের ত্রিকালদর্শী রাশেদা খালাও সেখানে ছিলেন। অবসর মতো নদীর দুইপারে দাঁড়িয়ে স্মৃতি উৎসারিত সব কথা হতো দুই খালা-বোনঝিতে মিলে। আজ খুব করে মনে হচ্ছে, মানুষ বাঁচে মূলত মানুষের মনেই, যে তার রক্ত-হৃদয়ে গাঁথা অবিনশ্বর এক পরমার্থিক সত্তাও বটে।
একই পীর পরিবারের কন্যা আমাদের জামিলা মামি, তার সাধ্যমতো তিনিও আমাদের আদর স্নেহ করতেন। আমার আব্বা যেহেতু পীরবাড়ির কন্যা হিসেবে তাকে খুব মর্যাদা দিতেন, সেজন্য কি না জানি না, আমার আব্বা ও মাকেও তিনি মূল্য দিতেন অন্য অনেকের চেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে সিট পাওয়ার আগে ৫/৬মাস আমি যখন মামা-মামির বাড়িতে ছিলাম, আব্বা তার ইসলামপুরের ‘দ্য বখসী আর্ট প্রেস’এর কাজ শেষ হলে বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে প্রায়ই জয়কালি মন্দিরে আসতেন আমাকে দেখতে। জ্যৈষ্ঠমাসের দিকে একদিন কাঁঠাল কিনে নিয়ে এলেন। মামী কাঁঠাল ভেঙে হতাশ কণ্ঠে আব্বাকে বললেন, হাফিজ মিয়াসাব, কী কাঁঠাল এনেছেন আপনি, আপনার কাঁঠালের কোয়া মিষ্টি নয়,আবাত্তি কাঁঠাল মনে হয় কিলিয়ে পাকিয়েছে।বিচির গায়ে মাংসল কিছু নেই,পাতলা পর্দার মতো আঁশ যেন, মুড়ির সঙ্গে খাওয়া যাবে না।
আব্বা লাজুক ভঙিতে বললেন, এক্ষুনি আমি ঠাঁটারি বাজার থেকে আর একটা কাঁঠাল নিয়ে আসছি, ভাবিসাব। চিন্তা করবেন না আপনি, ভালো কাঁঠাল আপনাকে খাওয়াবোই আজ। দ্বিতীয় কাঁঠালটির একই অবস্থার হলো, আব্বা তৃতীয়বারে আরও একটি কাঁঠাল কিনে মামির মুড়ি কাঁঠাল খাবার ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন সেদিন।
সর্বোপরি সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞানদানে মানুষ করার অঙ্গীকারসম্পন্ন করেই ২০১০ সালে ৯৪ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের ইতি টেনেছেন।
মামির বড় মেয়ে রেহানা আপা আমার ৩/৪ বছরের বড় ছিলেন। হঠাৎ করেই বিয়ে করলেন আখলাক নামের এক সিলেটি ভদ্রলোককে। পেশায় শিক্ষক। তার সঙ্গে ডুবে ডুবে জল খাওয়া চলেছে অনেকদিন, আমি জানতাম না। ছোট দুই বোন ময়না এবং দীনা বোনের হয়ে ডাক-পিয়নের কাজ করেছে সবার চোখের আড়ালে, বিশেষভাবে মামাকে আড়াল করতেই। আমি ভাবতাম, মামাকে তার ছেলে মেয়েরা যমের মতো ভয় পায়। নিশ্চয় কেউ এরা প্রেম-ট্রেম করার সাহস পাবে না। ওমা, দেখি সে গুড়ে বালি।আমার এই মামার প্রত্যেক কন্যাই তাদের জীবন সঙ্গী তারা নিজেরাই বেছে নিয়েছে, নিরুপায় মামাও যুগের হাওয়া উজিয়ে তাস্বীকার করে নিয়েছেন।
তবে আমার মামাতো বোনদের প্রত্যেকেই বেশ সুশ্রী সুন্দরী ছিলো। ছেলেদের নজরকাড়ার মতো রূপসী তো বটেই।একই চৌহদ্দিরমধ্যে অপেক্ষাকৃত বড় বিল্ডিংটায় থাকতো মিষ্টি মেয়ে আলো, তার মা ভাই-বোনদের সঙ্গে।পাশের মাঝারি আকারের দালানটায় থাকতো আলোর বড় বোন জুলুর পরিবার।
জুলুর প্রথম কন্যা সন্তান রুনুর সঙ্গে অসমবয়েসী খালা আলোর ছিল সখি সখিভাব। খালা-বোনঝি দু’জনেই মহা-সুন্দরী। রুনু ছিল হলিউডের নায়িকা ডিম্পল কাপাডিয়ার মতো। আলো ছিল চিত্র নায়িকা শাবানার ছোট বোন যেন।
রুনু তখন সবে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। ইতোমধ্যেই তার অসংখ্য গুণগ্রাহী জুটে গেছে। এরমধ্যে অন্যতম আমার বোনপুত্র কবি জাহানারা আরজু আপার বড় পুত্র রানাও আসা-যাওয়া শুরু করেছে বলে আলোর মুখেই ফরমালি শুনি। কিন্তু আমার চোখে পড়েনি সে একদিনও।
অবশ্য তার আগেই আমার মামাতো বোন রেহানা আপাসহ মনি, পটুও ফিসফাস গুঞ্জনে এক হাত এগিয়ে ছিল। আলোকে দেখে আমার মনে হতো অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার সে। প্রেম তার পিছু পিছু ছোটে কি না বুঝতে পারি না, তবে সে যে প্রেমের আনন্দে বাস করে তা যেন হৃদয়াঙ্গম করতে পারি অনায়াসে। টেলিফোনের রিং বাজতেই রিসিভারটি হাতে তুলেই যে মধুর ও শৈল্পিকভঙ্গিতে ‘হ্যালো’ বলে, এতে আমি যেন নিশ্চিত হয়ে যাই, আলোকে চোখে না দেখেও যে কেউ তার এই কণ্ঠস্বরের প্রেমে পড়বেই পড়বে।
এদিকে রুনুর মায়ের অনুরোধে মাঝে মাঝে আমি তার বাংলা পড়াটি দেখিয়ে দেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্রীহিসেবে। যেহেতু রুনু আমার সরাসরি ছাত্রী, কাজেই তাকে আমি ভালোইবাসি। তদুপরি পুতুলের মতো নরম রূপের পবিত্র আত্মার এক মেয়ে হিসেবে সে নিজেও খুব আত্মবিশ্বাসী। ঝিনুকের মধ্যে মুক্তোর লাবণ্য যেমন বিচ্ছুরিত হয়ে চারপাশ আলোকিত করে, রুনুর মুখাবয়ব জুড়ে তেমনি আদুরে ও নিষ্পাপ এক রূপ-ঐশ্বর্যের দ্যুতি ঢেউ খেলে যেতো অনুক্ষণ। রুনু, যে কিনা আমার প্রথম জীবনের একমাত্র প্রিয়দর্শিনী ছাত্রী।
মাঝে মধ্যেই বিকেলে আলোদের ছায়া সুনিবিড় উঠোন সংলগ্ন বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে গভীর আড্ডা হতো আমাদের। আলোর মা, ভাই আলমগীর, আলোর মেজো বোন জ্যোৎস্না খালা (যিনি বিয়ের পরেও মায়ের বাড়িতেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন) এবং আলো কখনো কখনো চুনকু মিলে যে আড্ডা হতো, তার প্রণশক্তির ভূমিকায় থাকতেন আলোর মা। যিনি সব সময় শাদা শাড়ি পরতেন, কিন্তু মুখে থাকতো পানের রস। অথচ তার মতো শক্ত, সমর্থ পেটানো শারীরিক গঠনের মধ্যে এত লাবণ্যময় প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার স্নেহশীলা মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।
তিনি বসনে ব্যসনে সব সময় শাদা শুভ্রতার প্রতীক যেমন, তেমনি বাড়ি-ঘর-আঙিনা এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে তকতকে আর ধুলোবালি মুক্ত করে রাখতেন যে, পাদুকা নিয়ে সেখানে যাওয়া রীতিমতো অশুদ্ধ মনে হতো। আলোর মা বিধবা হয়েছিলেন ৩৫ বছর বয়সে। এরপর সাতজন সন্তান নিয়ে সংসারে নিমজ্জন থেকে একক হাতে সামলিয়েছেন জীবনের সব ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা।
বিশাল বিষয়-সম্পত্তি রক্ষার জন্যে আত্মীয়-স্বজনসহ নানাজনের দায়ের করা মামলার-মোকদ্দমার বিপক্ষে লড়ে গেছেন অসীম সাহসী এই স্বশিক্ষিত নারী। স্বামীর ফেলে যাওয়া ব্যবসা বাণিজ্য দেখেছেন শক্ত হাতে। এক সময় হতদরিদ্র জেনে বিরাট বাড়ির পাহারাদার হিসেবে যাকে ঘর তুলে থাকবার জায়গা দিয়েছিলেন পুকুর পাড়ে, তার চক্রান্তে শেষাবধি মুক্তিযুদ্ধের সময় চার পুত্র সন্তানের জীবন বাঁচাতে ১৩ কাঠা জমি তিনি হারিয়েছেন বটে, তবে মাতৃত্বের অঙ্গীকারে রক্ষা করেছেন সন্তানের জীবন। সর্বোপরি সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞানদানে মানুষ করার অঙ্গীকারসম্পন্ন করেই ২০১০ সালে ৯৪ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের ইতি টেনেছেন।
দুই.
আমার মামা আতাহার খান জয়কালী মন্দিরের পশ্চিমাংশের যে বাসাটিতে থাকতেন, সেটি ছিল স্বয়ংসম্পন্ন আলাদা একটি বাড়ি বটে কিন্তু কক্ষ অপ্রতুল। নামমাত্র ভাড়া বাসা। শোবার ঘরও মামির এত সন্তানের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তবু ছিলেন অসহায় এক পরিবারের প্রতি তার অঙ্গীকারের সততা রক্ষা করতেই।
সাড়ে সাত বিঘার এই বাড়িটির পুবপাশে বাঁধাই করা ঘাটলাসহ একটি পুকুরও ছিল। বাড়িটির প্রকৃত মালিক ছিলেন আলোর বাবা জাবরা গ্রামের অপর খান বংশীয় আমার মামাদের আত্মীয় ওয়াজেদ আলী খান, ডাক নাম চান মিয়া। তিনিও সেই যুগের সপ্তডিঙ্গা বহরের পরিবার নিয়ে এই বাড়ির পৃথক এবং বড় বিল্ডিংয়ে বাস করেছেন, তবে মাত্র বছর দশেক। অথচ পূর্বাপর কলকাতায় ছিল তার উঠতি ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়ি, গাড়ি সবই। কিন্তু বিধি বাম হলে যা হয়, তার ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় হয়নি কিছু। মাঝে-মধ্যে আলোর সঙ্গে বিছানা শেয়ার করে একান্তে গল্প আর আলাপচারিতায় জেনেছিলাম এই বাড়ির পুরনো ইতিহাস।
১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় কলকাতায় যখন হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হলো, একইভাবে প্রতিশোধের আগুনে নোয়াখালীতে চলেছিল হিন্দু জাতির নিধন। এই সময়ে মহাত্মা গান্ধী দাঙ্গাপীড়িত এলাকায় শান্তি স্থাপন করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন বটে। এমনকি তিনি সশরীরে এসে নোয়াখালীতে ক্যাম্প করেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নোয়াখালী ও এর আশেপাশের এলাকাগুলো ঘুরে দেখেন। যদিও এই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা খুব বেশি সফলতার মুখ দেখেনি।
অকাল বৈধব্যের মনোযাতনা সত্ত্বেও নিজের জীবন তুচ্ছজ্ঞানে সগৌরবে সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো তবু বেঁচেছিলেন সন্তানদের কল্যাণ কামনায়। জয়তু নারী!
সেই দুঃসময়ে কলকাতায় বসবাসরত অনেক মুসলিম পরিবারের মতো তাদেরকেও সপরিবারে হত্যার পরিরল্পনা চলছিলো, সেটি জানতে পেরে সর্বস্ব ফেলে রেখে আলোর বাবা পরিবার-পরিজনের প্রাণ নিয়ে কোনো রকমে ফিরে আসেন নিজ গ্রাম জাবরায়। আমার খালাতো ভাই প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি তখন সবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করে রেডক্রসে ভলেন্টিয়ার করছিলেন। তার সহযেগিতা ও ব্যবস্থাপনায় আলোর বাবা ওয়াজেদ আলী খান পুলিশের সঙ্গে বড় অঙ্কের টাকায় রফা করে পুলিশের গাড়িতেই গোয়ালন্দ পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন তার পরিবার-পরিজন নিয়ে। এরপর গোয়ালন্দ ঘাট থেকে স্টিমারে চেপে মানিকগঞ্জ হয়ে জাবরা নিজ বাড়িতে এসে পৌঁছান।
কিছু সময় পরে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় আসেন। ঢাকা বলতে তখন গেন্ডারিয়া, সদরঘাট, বাদামতলী, ওয়ারী, ঠাঁটারিবাজার এবং জয়কালী মন্দির এলাকাই প্রধান।
তিন শত বছরের পুরনো ইতিহাসের স্বাক্ষী জয়কালী মন্দির ঢাকার বহুল পরিচিত ঠাঁটারীবাজার ও ওয়ারীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। মন্দিরের নামে নামকরণকৃত ২৪ নম্বর জয়কালী মন্দির স্ট্রিটে প্রতিষ্ঠিত ছিল মন্দিরটি। তার পাশেই অবস্থিত, ২১ নম্বর জয়কালী স্ট্রিটের বাড়িটি ওয়াজেদ আলী খান কিনে নিয়েছিলেন তখন।
এই বাড়ির সদর রাস্তার পাশেও রাম-সীতার একটি মন্দির এখনো বর্তমান। ১৫৯৩ সালে (মতান্তরে আঠারো শতকের শেষ কিংবা উনিশ শতকের প্রথম দিকে) জয়কালীর এই মন্দিরটি তৈরি করেন শ্রী তুলসি নারায়ণ ঘোষ এবং শ্রী নবনারায়ণ ঘোষ। কালি দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই হিন্দু মন্দিরে সব বয়সের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কালিদেবীর পুজো দিতে এখানে আসেন।পরবর্তী সময়ে একটি শিব মন্দিরও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এই আঙিনায়।
বিগ্রহগুলোর সেবা, পূজা, অতিথি অভ্যাগতদের বিশ্রামাগার এবং খাওয়ার ব্যয়নির্বাহের জন্য তৎকালে জমিদাররা বার্ষিক ১ হাজার ২০০টাকা আয়ের সম্পত্তি দান করেছিলেন মন্দিরের অনুকূলে।
মন্দিরের তৃতীয় সেবাইত পঞ্চানন্দের পরে জমিদারগণ দেবোত্তর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিজ নিজ খাসদখলে নিয়ে নেন।
ফলে সাড়ে সাত বিঘার এই জায়গাটি ছিল মুক্তাগাছার জমিদারের অধীনে, তাদের কাছ থেকে কিনেছিলেন তিনি। বিশাল জায়গায় প্রিন্টিং প্রেস ছাড়াও প্রেস রিলেটেড আরও কিছু কারখানা স্থাপন করে স্বাধীন পূর্ব-পাকিস্তানে ভালোই চলছিল দিন-কাল। কিছুদিনের মধ্যেই মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্যে তিনি লন্ডনে যান বটে, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। সেই সময়ে তার নিজের সন্তানেরাও দায়িত্ব নেওয়ার মতো উপযুক্ত হয়নি মোটেও। বিশেষভাবে আমি যখন প্রথম আলোকে দেখলাম, ওই পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে, তারও বয়স ছিল তখন কয়েক মাস মাত্র।
এই পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে তিনি আমার মামাকে সপরিবারে তার বাড়িতে বাস করার জন্যে অনুরোধ করে নিয়ে এসেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই সব চিকিৎসা অসার করে আলোর বাবা ৫৭ বছর বয়সে এই পৃথিবীর মায়া, প্রাণপ্রিয় পরিবার ও সন্তানদের ভালোবাসা ত্যাগ করে চলে যান অনন্তলোকে।
আমার মামা অত্যন্ত সততা ও ন্যায়নিষ্ঠের মতো তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু। তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই বাড়িতেই। ততদিনে আলোর ভাই-বোনেরা প্রত্যেকেই নিজেকে ছাড়াও নিজেদের বিষয় আশায় রক্ষা করার মতোযোগ্য হয়ে উঠেছিল।
আর একজন মানুষ, আলোর মা, যিনি একমাত্র মায়ের পরিচয়ে বেঁচেছিলেন শুধু সন্তানের মুখপানে চেয়ে। সেই মেয়েটি কিন্তু হোগলাকান্দির জোহরা খাতুন, যার একটি ডাকনামও ছিল খুকি—কখন কেন ফাঁকে খুকি হারিয়ে গেছে তারচেনা জগৎ থেকে, আমরা কেউ তা জানতেও চাইনি। কখনো তাকে দেখিনি, ভারী সংসারের ডানার তলে হারিয়ে যাওয়া এই যেমেয়েটি—তার বেদনা কি কখনো অনুভ করেছি কেউ? এমনকি সন্তানেরাও?
অকাল বৈধব্যের মনোযাতনা সত্ত্বেও নিজের জীবন তুচ্ছজ্ঞানে সগৌরবে সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো তবু বেঁচেছিলেন সন্তানদের কল্যাণ কামনায়। জয়তু নারী!
চলবে…