[পর্ব-২৮]
পৃথিবীর নতুন নাম,শামসুন্নাহার হল।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত, স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্রী আমি। স্বপ্ন? আসলেই আমারজন্যে তা স্বপ্নের সোনালি সূর্যোদয়ের রাঙাপ্রভাত।
কোথাকার কোন্ অজোপাড়া গাঁয়ের মেয়ে আমি, আমার কি এতদূর আসার কথা! মোটেই না। তবু এসেছি মায়ের দুরন্ত স্বপ্নের সওয়ার হয়ে। এই জার্নি, এই জার্নি আমার আকাশ-পাতাল-মাটি ছুঁয়ে দশ দিগন্তের ওড়াউড়ি, নীলপদ্মের মধুক্ষরা। এপার-ওপার জল উজিয়ে জলের হাওয়ায় দিব্যকান্তি। আমি কি আর আমিতে আছি? এ আমি অন্য আমি, শ্যামল ছায়া পেছনে ফেলে বালিকা বেলার খোলসমুক্ত। এর বদলে চাকচিক্যময় নগর জীবন, নিয়ন বাতির ঝলমলে সব দাপাদাপি, বিজ্ঞাপনের মহামারি, দেখে দেখে আশ মেটে না আজগুবি সব ছায়াছবি, দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অবধি জ্ঞান গরিমার ছড়াছড়ি। উদীয়মান নিত্য নতুন জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত—এ আমি অন্য আমি। নিজের কাছে অচেনা এক স্বাতন্দ্র্যবোধ। এই আমি ব্যক্তি আমি, আমিত্বের অহংবোধে মেঘের মতো নীল আকাশে পরিযায়ী পাখির উড়াল। এ আমি সুদূরেরও পিয়াসী মন, নিজের কাছে নিজেই যেজন, আত্মপ্রেমের ঝর্ণাতলায়।
এই যে নিজেকে নিয়ে নিজের এতো উচ্ছ্বাস—তার কিন্তু হেতু আছে। আছে বৈকি! বানানো নয়, নিরেট সত্যকথন।
তাহলে তার সামান্যই বলি।
আমার পিতা মাতার আরাধ্য পুত্র সন্তানের বয়স যখন ছয় মাস, সব চিকিৎসা পায়ে ঠেলে সেই পুত্র সন্তান ফারুক কলেরারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এলাকার বড় ডাক্তার নন্দীও তাকে বাঁচাতে পারেননি। শোকে মা পাথর, বাবা অগ্নিকুণ্ড। এর দু’বছর পরে আমার জন্ম, মেয়ে সন্তান বলে মায়ের অভিযোগ ছিল না, শোকসন্তপ্ত মায়ের কোলে শীতল জলের মতো প্রবহমান ছিলাম বটে, প্রবাসী পিতা বহুদিন অভিমানে আমার মুখ দর্শন করবেন না বলে ঢাকা থেকে বাড়িতেও আসেননি। বাবার উপেক্ষাআর অভিক্ষেপ নিয়ে আমি তবু বেড়ে উঠেছি নির্জীব লতাটির মতো।
আমার বয়স আড়াই তিন বছরের মাথায় আমার মা দ্বিতীয়বারের মতো পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে সেই যে আঁতুড় ঘরে প্রবেশ করেছিলেন, সেই মুহূর্ত থেকে মায়ের সঙ্গলাভ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়েছি। রাতে নানিমার বিছানায় থাকি, সারাদিন তিনিই আমার দেখভালের পুরোপুরি মালিকানা পেয়ে যান। ফলে মাতৃভালোবাসাও পূর্ণতা পায়নি আমার বেলায়। ভাই-বোনের খেলাধুলা, খুনসুটি, মারামারির এক পর্যায়ে বুঝে গেছি বিচারক হিসেবে তুলাদণ্ড হাতে আমার মায়েরও পুত্র সন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্বের ঝোঁক। কাজেই সংসারে মেয়ে সন্তান যে কত অপাঙ্ক্তেয় ছেলে সন্তানের পাশাপাশি তা আমার চেয়ে কেউ বেশি বলতে পারবে না।
তবে একথা শিরোধার্য করে আমাকে বলতেই হবে, আমার মায়ের বাড়াবাড়ি রকম স্বপ্ন বুনুনের ফলেই ওই আমার নিষ্প্রদীপ অজোপাড়া গাঁয়ের হারিকেন, কুপি আর জোনাকির আলোতে আড়মোড়া ভেঙে রাজধানী শহরের পাদপ্রদীপে বসে জ্ঞানার্জনের সুযোগ হয়েছিল। অভিজাত বংশীয় আমার মায়ের সমবয়সীরা যখন বিএ, এমএ পড়ে বা পাস করেছে, তখন পিতৃহীন আমার মা স্বামীগৃহে সংসারের জোয়াল কাঁধে ২/৩ জন সন্তানের মা হয়েছেন। নিজে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি বলে খুব আক্ষেপ ছিল। কন্যা সন্তানের মধ্যে দিয়ে আসলে নিজের অপূর্ণ সেই স্বপ্ন পূরণের বাসনাকে পূর্ণ করেছেন। আমার উচ্চতর লেখাপড়ার স্বীকৃতি ও পথ প্রশস্ত হয়েছে মূলত মায়ের স্বপ্নরথের সারথি হয়ে।
দুই.
১৯৭৩-৭৪ সেশনে ঢাকা বিশিববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম ৯ জুন। ভর্তি পরীক্ষার পর থেকে ভর্তির বিভিন্ন নিয়মের খোঁজ খবর জানতে ভরসা বাংলা বিভাগের একমাত্র সহকারী তালেব ভাই। কাজেই তার সঙ্গে কথা বলে জেনে নিলাম মেয়েদের দুটি হোস্টেলের কথা। রোকেয়া হল ও নব-নির্মিত শামসুন্নাহার হলের যেকোনো একটিতে সংযুক্ত থাকতে হবে আমাকে। আমি তো এমনিতেই হোস্টেলে সিট পেতে মুখিয়ে আছি। কেবল প্রক্রিয়াগুলো জানার অপেক্ষায় ছিলাম। প্রথমে খোঁজ নিলাম বেগম রোকেয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ছাত্রী হোস্টেল সম্পর্কে। এই হলের অভিযাত্রাও অভিনব।
এই সব ঘটনা সবই অবিভক্ত ভারতেই ঘটেছে, যখন বাংলাদেশের মুসলিম বাঙালিরা আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কলকাতাকেই বেছে নিয়ে ছিলেন উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হিসেবে।
চামেলি হাউজে মাত্র ১২ জন নারী শিক্ষার্থী নিয়ে ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আবাসিক নারী শিক্ষার্থী হল হিসাবে যাত্রা শুরু হয় রোকেয়া হলের। ১৯৬৪ সালে এর নামকরণ করা হয় ‘রোকেয়া হল’। সেই সময়ে বেগম রোকেয়া ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের নারী জাগরণের একমাত্র অগ্রদূত। মিসেস আক্তার ইমাম ছিলেন এই হলের প্রথম প্রভোস্ট। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা ও দালালদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তৎকালীন আবাসিক ছাত্রীরা। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে রোকেয়া হলের ছাত্রীরা সক্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন—সেটি জানতাম আগেই। আমার সহপাঠীদের কেউ কেউ ধারণা দিয়েছিল যে, এই হলে সিট পেতে অনেক সময় লাগবে।
কাজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য নির্মিত দ্বিতীয় ছাত্রী হোস্টেলে সিট পাওয়া অধিকতর সহজ হবে বলাই বাহুল্য। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কবি শামসুন নাহার মাহমুদের নামে এই হলের নামকরণ করা হয়। বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ (১৯০৮—১৯৬৪) ছিলেন এই দেশের নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং সমাজসেবিকা৷ তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্নেহধন্য ছিলেন। কবির ব্যাপক অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা পেয়ে তিনি কবিকে নিয়ে লিখেছেন তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘নজরুলকে যেমন দেখেছি’।
মুসলমান সমাজে নারী শিক্ষা প্রসার ও অবরোধপ্রথা রহিত করার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাদের মধ্যে তার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্রী হল এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হল তার নামে নামকরণ করা হয়। সহজে সিট পাওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখেই শামসুন নাহার হলেই আবেদন করে দিয়েছিলাম।
আপাতত জয়কালি মন্দিরে আতাহার মামার বাসায় থেকে কোনোমতে ক্লাস করছি বটে, কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকা সম্ভব নয় কিছুতেই। মামির ছয় মেয়ে চার ছেলে নিয়ে বিরাট বহরের সংসার। তার মধ্যে আমিও এক অতিথি। আমার দুই বছরের বড় রেহেনা আপা, এরপর মনি, পটু, বেবী, লালু ভাই, বুলু ভাই দুজনেই আমার বড়ভাই তুল্য। বাকি বাবু জমশেদ, মন্টু সবাই আমার চেয়ে ছোট ছিলো। ওদের সবার কাছেই আমি স্নেহ আদর ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছি বিস্তর, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়ার কোনো পরিবেশ নেই। তিন কামরার বাসা। আতাহার মা তখন শিক্ষাভবনে এডিপিআই চাকুরে ছিলেন। সেই জামানায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্রাজুয়েট। স্বভাবে ভীষণ চুপচাপ। অফিস থেকে ফিরে এসে তার শোবার ঘর সংলগ্ন বারান্দায় একটা চেয়ার পাতা ছিল। শুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই তাকে বসে থাকতে দেখতাম মৌনব্রতে। মামি অথবা রেহেনা আপা কিংবা মনি নিজ হাতে চা তৈরি করে মামাকে বিকেলের নাস্তা পরিবেশন করতো। রাতের খাবার ওই চেয়ারে বসেই খেতেন একটা টেবিল টেনে। বড় একটা রান্না ঘর ছিল। আমরা সবাই সেখানে মাদুর পেতে বসে খেতাম। দু’জন রাঁধুনী মিলে এত মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতো। মামি কখনো রান্না ঘরমুখী হতেন না। তার খাবারও তার বেডরুমে নিয়ে দিতে হতো। মামির বড় ছেলে লালু ভাই তখন ফিল্মে ক্যামেরা পরিচালনার কাজ করতেন, আয় উপার্জন ভালো ছিল। বাড়ির রান্না মাছ মাংসের ওপরে ও বাইরে থেকে শিক কাবাব, বটি কাবাব কিংবা টিকিয়া বা ভূনা গরুর মাংসের রেজালা নিজের জন্যে নিয়ে আসতেন। বুলু ভাই কিংবা বাবু সবাই কিছু না কিছু নিজের মতো করে বাইরে থেকে এনে খেতো। যে যাই খেতো, আমার জন্যে রাখতো তার কিছুটা, আমি যে অতিথি। কাজেই আমাকে ছাড়া কেউ কিছু খেতো না পারতপক্ষে।
মামি বাংলা-উর্দু মিশিয়ে ক্যালকেশিয়ান উচ্চারণে কথা বলতেন। মামির কথায় আমরাও খুব মজা পেতাম। কলকাতার ক্রিস্টোফার রোড়ে প্রতিষ্ঠিত পীর বাড়ির মেয়ে ছিলেন তিনি। এই পীর বাড়িতে হিন্দু মুসলিম সব সম্প্রদায়ের মুরিদদের আসতে দেখেছি আমিও। আমার নানাভাই রাশেদ খান সাহেব কলকাতার বড় বাজারে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। এই পীরবাড়ির প্রথম মুরিদ ছিলেন তিনি। নানার সঙ্গে তার ছেলে আতাহার মামাও যেতেন মাঝে মধ্যে। গৌরবর্ণের চেহারার মামা দেখতে বেশ সুদর্শন ছিলেন উপরন্তু পড়াশেনায় এগোনো। সঙ্গত কারণেই হয়তো পীরের সুনজরে পড়েছিলেন তিনি। আতাহার মামা ইতোমধ্যে তখন বিয়ে করেছেন দেশের বাড়িতে তার বৌ-সন্তান বাস করে।
তাকে দেখে পীর সাহেব আমার নানাকে বললেন তোমার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ে জমিলার বিয়ে দিতে হবে। পীরের হুকুম। কাজেই অন্যথা করার সাহস নেই তার মুরিদানের কারও। নানা ভাই তবু বলার চেষ্টা করলেন যে, সে বিয়ে করেছে।
পীর বলে বসলেন, ওহি কুছ নেহি বাদ। আজই বিয়ে দিতে হবে। ব্যস হয়ে গেলো বিয়ে। কিছুদিন কলকাতায় থেকে পরে মামা পীরবাবার নির্দেশ মতো তাকে ঢাকায় বাসা নিয়ে রাখলেন, অন্যজন রয়ে গেলেন সেই জাবরা গ্রামেই। গ্রামে বড় মামির তিন মেয়ে দুই ছেলে নিয়ে দীর্ঘশ্বাসময় এক অভাগা সংসার। মামা ২ মাসে একবার আসতেন গ্রামের সংসারে। বড় মামি এভাবেই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, কেননা সন্তানদের নিযে কেথায় আর যাবেন!
তার কোনো ভাই ছিল না, ফলে বাবার বাড়ির তরফ থেকে অনেক সম্পদ পেয়েছিলেন, সেসব নিয়ে ব্যস্ত থেকেই জীবন পার করে দিয়েছেন কোনোমতে। এর কিছুদিন পরে পীরের হুকুমে আমার মায়ের বড় বোন কিন্তু সাজি খালার ছোট রাশেদা খালাকে কলকাতায় ডেকে নিয়ে তার বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলেন।
আমার এই রাশেদা খালার গর্ভে এক মাত্র কন্যা সন্তান আবেদা। এই সন্তানকে রেখে তিনি যৌবনেই ইন্তেকাল করেছেন বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায়। এই সব ঘটনা সবই অবিভক্ত ভারতেই ঘটেছে, যখন বাংলাদেশের মুসলিম বাঙালিরা আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কলকাতাকেই বেছে নিয়ে ছিলেন উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হিসেবে।
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-২৭॥ দিলারা হাফিজ