[পর্ব-২৬]
জীবনের মুক্তিযুদ্ধ ও একজন রোকেয়া ফুপু
রাতেও ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি মুক্তিযুদ্ধ চলছে, আত্মরক্ষার্থে পরিখা খনন করছি, পাকসেনার ভয়ে পালাচ্ছি গ্রাম থেকে গ্রামে, অনুভব করছি আমার পাশে কেউ শুয়ে আছে। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে তার হাতের ওপর আমার হাত পড়তেই মনে হলো তার গায়ে অনেক লোম। পুরুষ মানুষ নাকি? পরিবারের জীবন বাঁচাতে, আমাকে তবে কি পাক-আর্মির কাছে তুলে দিয়েছে কেউ?
পাশের মানুষটিকে সত্যি একজন পুরুষ মানুষ ভেবে আঁতকে উঠে আমি দৌড়, মাকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করলাম, মা, ঘুমের সময়তো আমি একা শুয়েছি। আমার খাটে কে শুয়েছে?
-তোমার রোকেয়া ফুপু? তখন মনে হলো, হুম।
তাই তো রোকেয়া ফুপুর হাতে-পায়ে-গায়ে পুরুষের মতো বড় বড় লোম দেখেছি। কিন্তু কোনোদিনও তিনি আমাদের বাড়িতে রাত্রিযাপন করেননি। তবে আজ কেন?
-পাশের বাড়ির রোকেয়া ফুপু আমাদের বাড়িতে কেন? তার স্বামীর বাড়ি ডাউলিতে থাকেন তিনি। হানাদার বাহিনী আক্রমণ করেছে নাকি তাদের বাড়ি?
আমার মা ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বললেন, আরে না, স্বামীর অত্যাচার থেকে জান বাঁচাতে, বর্ষাকালের পানি ভেঙে, আধা মাইলসাঁতরে তবে তোমার আব্বার কাছে এসে আশ্রয় চেয়েছে। এত রাতে আর কোথায় যাবে, তাই তোমার পাশে আমিই ওকে শুতে বলেছি। মা খুব নির্বিকার চিত্তে কথা ‘টি বলেই পাশ ফিরে শুলেন।
-ওহ, এই ব্যাপার, বলেই আমি আবার আমার খাটে এসে শুয়ে পড়লাম। পাশে রোকেয়া ফুপু অঘোরে ঘুমুচ্ছে নিশ্চিন্তে। মৃদু নাক ডাকছে তার। ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত চোখের পাতা কিছুতেই আমি আর এক করতে পারিনি সেদিন। স্মৃতি এসে হানা দিচ্ছিল চোরের মতো।
রোকেয়া ফুপু বয়সে আমার বড়’পার চেয়ে সামান্য বড় ছিলেন। ফুপুর সব থেকে ছোটভাই এমদাদুল হক বাবু আমার সহপাঠী। তাদের তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন রোকেয়া ফুপু। মুন্সী বাড়ির মেয়ে বলে গ্রামের লোকে সমীহের দৃষ্টিতে তাকাতো। আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে আব্বার চাচাতো ভাই ওয়াজউদ্দিন চাচার বাড়ি। তাদের বাঁশবাগান লাগোয়া পরবর্তী বাড়িটি মুন্সীবাড়ি হিসেবে পরিচিত। জুম্মাবারে গ্রামের অনেকেই নামাজ পড়তে যায় ওই মুন্সীবাড়ির জুম্মা ঘরে।
রোকেয়া ফুপুর গায়ের রঙ খুব ফর্সা ছিল, ষাটের দশকের সেই সময়ে কোনো মেয়ের চামড়া খানিকটা ফর্সা হলেই তাকে সুন্দরী বিবেচনা করা হতো। এই সংজ্ঞা অনুসারে রোকেয়া ফুপু সুন্দরীই বটে, তবে তার উচ্চতা চার ফিটের বেশি ছিল না। বেঁটে-খাটো হলেও আমাদের গ্রামের মধ্যে তিনি সৌন্দর্যের রানি। ১৩/১৪ বছর বয়সেই এই সুন্দরীর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের চার দিনের মাথায় তার স্বামীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেলো অকস্মাৎ। পুলিশের মুখ থেকে জানা গেলো, পেশায় সে একজন দক্ষ চোর।
মাগী, তুই আমাকে ছেড়ে যাবি? তোর যৌনাঙ্গে কলকে পুড়িয়ে এমন ছাপ দিয়ে দেবো, সারাজীবনে কোনো পুরুষ তোকে ছুঁয়েও দেখবে না, বিয়ে তো দূরের কথা। সেই ব্যবস্থা করেই তোকে ছাড়বো বুঝলি?
এত দক্ষ না হলে কি রোকেয়া ফুপুর মতো সুন্দরীকে এত সহজে চুরি করতে পারতো? দেখতে অবশ্য খুব সুদর্শন ছিল
সেও, ভদ্র পরিবারের সন্তান বলেই মনে হতো তাকে। সেদিনের এই ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে গ্রামের এমাথা ওমাথায় অগ্নি স্ফূলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে যেতে আধা ঘণ্টাও সময় লাগেনি। স্বামী বেচারা তো চলে গেলো থানা-হাজতবাসে কিন্তু দলে দলে নারী পুরুষ মিলে দেখতে এলো রোকেয়া ফুপুকে। মুন্সীবাড়ির আলাদা একটা ইজ্জত আছে, কাজেই বিয়েটি ভেঙে গেলো অচিরেই। বছর খানেকের মধ্যেই পাশের গ্রাম হরগজ থেকে নতুন প্রস্তাব এলে রোকেয়া ফুপুর বিয়ে হয়ে যায় চটজলদি, প্রায় চোখের পলকে। এই স্বামীর সঙ্গে ৮/১০ বছরের সংসার, কিন্তু কোনো সন্তান হলো না। বাঁজা নারী ভেবে রোকেয়া ফুপুকে রেখেই তার স্বামী ভদ্রলোক পুনরায় দ্বিতীয় বিয়ে করলে, সতীনের সংসার ছেড়ে রোকেয়া ফুপু বাপের বাড়ি চলে এলেন চিরতরে। ধারণা করি, এই সময়ে তার বয়স ২৪/২৫-এর বেশি ছিল না।
রোকেয়া ফুপু গল্প করতে খুব ভালোবাসতেন। সুন্দর করে কথা বলতেও জানতেন। পরিপাটি করে গুছিয়ে চলতেন। কিন্তু উপায়ন্তরহীন মানুষের গল্প করে তো জীবনের সময় শেষ হয় না। কোনো একটা কাজ থাকতে হয়। তিনি পড়াশোনার কাজ খুঁজে নিলেন। আগে পঞ্চম শ্রেণী পাস দিয়েছিলেন, এবার এসএসসি পাসের স্বপ্ন নিয়ে গ্রামের মধ্যে সদ্য প্রতিষ্ঠিত আরজুবানু হাই স্কুলে গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। পাঠে মনোনিবেশ করেন গভীর আগ্রহ নিয়ে। আমাদের আব্বা-মাও তাকে উৎসাহ দিলেন। তিনিও সকাল-বিকাল আমাদের বাড়ি আসেন, মা ও আব্বার সঙ্গে গল্প করেন, আমরাও যান তাদের বাড়িতে। বিশেষভাবে তাদের বাড়ির লাল পেয়ারা এবং আমের দিনে আম কিনতেই বেশি যেতাম। গ্রামের একটু কম সচ্ছল অন্যান্য পরিবারের মতো মৌসুমি ফলমূল, মুরগি ও হাঁসের ডিম, বাড়ির শাক-সবজি-লাউ-কুমড়া বেচে একটু বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা ছিল তাদের। এছাড়া বাবু ও আমি যেহেতু দুজনেই নবম শ্রেণীর ছাত্র, সেজন্যে মুন্সী বাড়িতে আমাদের যাতায়াত ছিল নিকট আত্মীয়ের মতো। তারাও খুব সজ্জন মানুষ ছিলেন। আমার জ্ঞান হওয়া অবধি বাবুর মাকে তাদের বারান্দায় একটা চৌকিতে শুয়ে শুয়ে দিন-রাত্রি কাটাতে দেখেছি। হাঁটা-চলা করতে পারতেন না কারও সাহায্য ছাড়া। তিনি আমাকে দেখলেই এক গাল হাসি দিয়ে সই সই ডাকতেন।
পঙ্গু এই মাকে দেখাশোনা ছাড়াও পড়াশোনা ও পরীক্ষায় ভালো ফল করতেন রোকেয়া ফুপু। এক বছর পরে সপ্তম শ্রেণীতে উঠতেই রোকেয়া ফুপুর মতো সুন্দরী ছাত্রীর প্রেমে পড়ে গেলেন ক্লাসের এক শিক্ষক, গাঁয়ে তাকে সাইজুদ্দীন মাস্টার নামেই চিনে সবাই।
দুই.
সাইজুদ্দীন মাস্টার বিবাহিত, ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী, মা-বাবাকে নিয়ে তাদের সংসার। গ্রামের বাড়িতে সাইটাল গৃহস্থ বলতে যা বোঝায়, তার সবই আছে। জমাজমির পরিমাণও বেশ ভালো। শস্য উৎপাদন যতটুকু হয়, সারা বছর চলে যায় তাতে।
পড়াশোনা বলতে, ইন্টারমিডিয়েট পাস। এতকাল বাড়িতেই, জমাজমি দেখে কাটছে সময়। একার্থে বেকার মানুষ ছিলেন এতদিন। গ্রামে সদ্য প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলে সবে যোগ দেন প্রতিষ্ঠাতা খালেক চেয়ারম্যানকে ধরাধরি করে। প্রতিদিন ক্লাসে ও ক্লাসের বাইরেও দেখা হয় ছাত্রী রোকেয়ার সঙ্গে। অতিরিক্ত আগ্রহ নিয়েই ছাত্রীকে পড়াশোনায় নানাভাবে সাহায্যের ছলে কাছে আসেন তিনি। কালো-শ্যামলার মধ্যে লাবণ্যময় চেহারা বসানো সাইজুদ্দীন মাস্টারের প্রতি রোকেয়া ফুপুর মতিভ্রম হওয়া খুব অস্বাভাবিক ছিল না।
ফলে, চমৎকার কথা বলতে পারা সুন্দরী ছাত্রী রোকেয়ার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতে বেশি সময় লাগেনি তারও। কৌশলের নানা ফাঁক-ফোঁকর গলিয়ে তাদের প্রেম যখন সৌজন্যের বাঁধ ভেঙে খোলামেলা বাতায়নে এসে দাঁড়ালো, তখন জেনে গেলো গ্রামসুদ্ধ।
কী হবে এই প্রেমের পরিণতি—এই ভাবনায় যখন গ্রামবাসীর চোখে ঘুম নেই, তখন জানা গেলো সাইজুদ্দীন মাস্টার দ্বিতীয় স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তাকে ঘরে তুলেছেন। বাহ্ খুব ভালো কথা। ইসলামি শরিয়া মতে পুরুষের চার বিয়ে পর্যন্ত জায়েজ। কাজেই সমস্যা নেই। সামাজিক দর্পণের নিদ্রাহীন খোলা চোখ-মুখ এবার টেনশন ফ্রি হলো।
আরও সুখবর এলো, এক বছরের মাথায় রোকেয়া ফুপুর একটি সন্তান হলো, তবে বাঁচলো না। সন্তানটি না বাঁচলেও বাঁজা নারী হিসেবে রোকেয়া ফুপুর এতদিনের যে দুর্নাম ছিল, তাও ঘুচে গেলো। এই পর্বের মাস ছয় পরের ঘটনা যখন দুর্ঘনায় রূপ নিলো, তখন তিনি স্বামীগৃহ ত্যাগ করে হঠাৎ এসে আমার আব্বার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলন। একদিকে মুক্তিযুদ্ধ উজিয়ে বেঁচে থাকার উদ্বেগ, অস্থিরতা, ক্ষুধার সংগ্রাম; অন্যদিকে ব্যক্তি জীবনের সংগ্রামেও বিপন্ন মানুষ ঘরেঘরে নানা মাপের দুর্গ গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও ঈগলের থাবা এসে তছনছ করে দিচ্ছে কারও সাজানো সংসার-শোকেস।
আব্বাকে যেহেতু গ্রামের সালিশ বিচার সবই করতে হয়, কাজেই আব্বাকে প্রথম জানানো তিনি কর্তব্য মনে করেই এসেছেন। ঠিক কী হয়েছিলো কিংবা কার দোষ বেশি—সেসব জানি না। শুনেছি, বেশ কিছুদিন থেকে রোকেয়া ফুপুর প্রতি স্বামী সাইজুদ্দীন মাস্টার এবং তার প্রথম স্ত্রীর যুগপৎ ব্যবহার ছিল সতীন ঠ্যাংগানোর মতো। বন্ধ্যা নারী ভেবে শুধুই মজা লুটার জন্যে বিয়ে করেছিল মাস্টার মশাই, কিন্তু পরে যখন দেখা গেলো সে সন্তান জন্মদানে সক্ষম, এতে সংসারে বাড়তি খরচের রাস্তা খুলে গেলো—এটি একটি ভয়ের কারণ। রোকেয়া ফুপু দ্বিতীয় বার সন্তান নিতে চাইলে স্বামী তার অনিচ্ছার কথা স্পস্টভাবে জানালো তাকে।
আসি রে দিলু, বলেই আমার আব্বা-মাকে কদমবুচি করে আমার ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকালেন দু’বার, কন্যা ক্যামেলিয়ার মা ডাক শুনে দ্রুতই সমুখে বাড়িয়ে দিলেন তার পদযুগ।
রোকেয়া ফুপুর স্পস্ট উত্তর, তাহলে তোমার সংসারে ঝি-চাকর হয়ে থাকবো কেন?
মাগী, তুই আমাকে ছেড়ে যাবি? তোর যৌনাঙ্গে কলকে পুড়িয়ে এমন ছাপ দিয়ে দেবো, সারাজীবনে কোনো পুরুষ তোকে ছুঁয়েও দেখবে না, বিয়ে তো দূরের কথা। সেই ব্যবস্থা করেই তোকে ছাড়বো বুঝলি?
স্বামীর এই নিষ্ঠুর কথা ও প্রস্তুতির ধরন-ধারণ দেখে তিনি অশনিসংকেত কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিলেন। হয়তো আজরাতেই তার স্বামী ঘটাবে জীবনের চূড়ান্ত সেই দুর্ঘটনা। এরকম আগাম আশঙ্কা থেকেই ভয়ে, ভীতিতে রাতের অন্ধকারে পায়খানায় যাওয়ার নাম করে গু-মুত মাড়িয়ে রোকেয়া ফুপু সেদিন বন্যার জলে ভিজে, সাঁতরিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন আমাদের বাড়িতে এসে। এই প্রথম জানলাম, নারীকে অবদমনের জন্যে এরকম একটি কুপ্রথাও নাকি প্রচলিত আছে সমাজে। অবাধ্য স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার আগে পাষণ্ড স্বামীরা নাকি, সত্যিকারের হুকার মাটির কলকে আগুনে পুড়িয়ে লাল করে স্ত্রীর যৌনাঙ্গে চেপে ধরে জায়গাটি পুড়িয়ে দেয়। সারাজীবনের জন্যে যৌনাঙ্গের এই কলঙ্কিত দাগ তাকে একজন ব্যাভিচারিনী নারীর পরিচয়ে উৎকীর্ণ করে।
হায় পুরুষতন্ত্র, হায় পুরুষপ্রধান সমাজ!
যুগ যুগ ধরে নারীর প্রতি এত নিষ্ঠুরতা কিভাবে সহ্য করে এই প্রকৃতি, আজও কেন তার কোনো সমাধান নেই, তা বুঝতে পারি না। সঙ্গত কারণেই তার নিজের বাবার বাড়িতে ওঠার সাহস পাননি তিনি। তার বড় ভাই বাদশাহ মামা হয়তো স্বামীগৃহ ত্যাগ করা এই বোনকে ফেরত পাঠাবে আবার সেখানেই, কাজেই আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না তার।
আমাদের বাড়িতে দুদিন আত্মগোপন করে থাকার পরে তৃতীয় দিন রাতের অন্ধকারে আব্বা তাকে নৌকা ভাড়া করে তার ছোট ভাই বাবুকে সঙ্গে দিয়ে রোকেয়া ফুপুর বড় বোন আঙ্গুরী ফুপুর দূর গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামী সাইজুদ্দীন মাস্টার যেন কিছুতেই তার নাগাল খুঁজে না পায়।
পরে জেনেছিলাম সেখান থেকে ছোট ভাই বাবু তাকে ঢাকায় নিয়ে যায়। কিছু দিনের মধ্যে উগান্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের সঙ্গে ঢাকায় বিয়ের ব্যবস্থা করে বোনের।
স্বামীর সঙ্গে সেও দ্রুত উগান্ডায় চলে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। বোনকে পগারপার করতে পেরে ভাইয়েরাও যেন হাফছেড়ে বাঁচে। তবে যতটুকু জেনেছি স্বদেশে ও বিদেশে থাকাকালীন পুরো সময়ে ছোট ভাই বাবু তার পাশে থেকেছে।
এরপর অনেক বছর আমরা কেউ রোকেয়া ফুপুর কোনো সংবাদ জানতে পারিনি। আমি যখন নিজেও পারিবারিক জীবন শুরু করেছি, আমার প্রথম সন্তান অভিন্নের বয়স দুই বছর, সেই সময় যোগাযোগ করে রোকেয়া ফুপু আমার আজিমপুরের পার্টি হাউজের বাসায় এলেন একদিন।
আমার আব্বা ও মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন মনে করেই এসেছেন মূলত। সেই রাতে তার জীবন বাঁচানোর ঋণ স্বীকার করতেই যেন এই দেখা করার আকুতি ছিলো তার মনে। আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পেয়ে এখন যে তিনি অসম্ভব রকম জীবন পাল্টে ফেলতে পেরেছেন তার বুদ্ধি ও ভাগ্যগুণে—সে কথাটিও মেজোমিয়া সাহেবকে না জানালে কেমন হয়? এরকম একটি ধারণা আমার হলো রোকেয়া ফুপুর গল্প বলার ছন্দোবদ্ধ গঠনশৈলী থেকে।
সঙ্গে ক্যামেলিয়া নামে তার একমাত্র কন্যাকেও নিয়ে এসেছিলন। চা-নাস্তা খাবার পরে আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললেন, শোন দিলু, আমি যে তোমার এখানে এসেছি, আল্লাহর কসম গড়পাড়া গ্রামের কেউ যেন জানে না, বুঝলে।
-ঠিক আছে কেউ জানবে না, কিন্তু বলো তো কেমন আছ তুমি?
-খুব ভালো আছি, উত্তরায় একটা তিনতলা বাড়ি করেছি। আমার স্বামীর আগের ঘরের পাঁচ ছেলেমেয়ে যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উগান্ডায়। আমার স্বামী ডক্টর সাব এবং মেয়েটা নিয়ে আমি একেবারে চলে এসেছি দেশে। একবার তুমি যেও আমার উত্তরার বাসায়।
-ফুপু, তুমি আর কোনোদিনও যাবে না গ্রামে?
সাইজুদ্দীন মাস্টারের সঙ্গে তোমার ডিভোর্স কি হয়েছিলো শেষ পর্যন্ত?
-না, হয়নি। আমার দুই ভাই চেষ্টা করেছে। শয়তানটাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি।
কাজেই জন্মভূমির ওই গ্রামে আর কখনো যাওয়া হবে না আমার। কোনো উপায় নেই যে দিলু। আমি তো ডক্টরকে বলিনি আমার অতীত জীবনের এই ক্লেদাক্ত এই ইতিহাস। তার চোখে আমি অন্য এক মহত রোকেয়াকে প্রতিষ্ঠিত করেছি তিলতিল করে। আমাকে সে বিশ্বাস করে। তাছাড়া তার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছো তো এই বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে।
তিনি তখন প্রতিবছর দেশে একবার করে আসেন এবং যাবার সময় এক এক করে ছেলেদের নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রতিষ্ঠিত করতে। শেষবার দেশে এসে যখন দেখলেন তার স্ত্রী অন্য কারও দ্বারা গর্ভবতী হয়েছে, এটা তো ডক্টর সাহেব মানতে পারেননি। সেজন্যে তৎক্ষণাৎ ডিভোর্স করে আমাকে বিয়ে করে নিয়ে গেছিলেন সঙ্গে করে।
বোঝই তো, আমি দেশে গেলে যে কেউ তার কানে তুলবে কথাটি, তাছাড়া ওই মাস্টারও ব্ল্যাকমেইল করতে পারে, এখন আমার এতটাকা-পয়সা হয়েছে, আমার মেয়েটা বড় হচ্ছে, স্কলাসটিকায় পড়ছে, ওর সামনেও তো মা হিসেবে আমার ইজ্জত ধরে রাখার ব্যাপার আছে।আমার ছোট ভাই ছাড়া আমি তো কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখি না। কেউ আমার ঠিকানা জানে না বাবু ছাড়া।
-ওহ্, তাই বুঝি।
-তার মানে, সত্য-মিথ্যেয় তৈরি তোমার সুরম্য প্রাসাদে তুমি পুরোপুরিই স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে আছ নিজেই! বুঝতে পারছি কোনো পথ খোলা নেই এই সোনার খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসার। তবু তোমার স্বামী সন্তান নিয়ে তুমি ভালো থেকো ফুপু।
-আসি রে দিলু, বলেই আমার আব্বা-মাকে কদমবুচি করে আমার ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকালেন দু’বার, কন্যা ক্যামেলিয়ার মা ডাক শুনে দ্রুতই সমুখে বাড়িয়ে দিলেন তার পদযুগ।
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-২৫॥ দিলারা হাফিজ