[পর্ব-২৩]
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
এক.
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষপর্যায়ে মানিকগঞ্জ শহরে তখনো পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করেনি। তাদের প্রবেশের আগে ৫/৭টি হেলিকপ্টারের সাহায্যে ঢাকা-আরিচা সড়কে বানিয়াজুরিতে বিপুল-সংখ্যক ছত্রী-সেনা নামাতে শুরু করেছিল।এই বানিয়াজুরির প্রধান সড়ক থেকে আমার নানাবাড়ি জাবরা গ্রামের দূরত্ব মাত্র আধা কিলোমিটার। আমাদের গ্রামেও দ্রুত খবর পৌঁছে যায়, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ঢাকা-আরিচা সড়ক শত শত সাঁজোয়া গাড়িতে পূর্ণ হয়ে গেছে। পাকিস্তানি সেনারা মানিকগঞ্জ প্রবেশ না করে উত্তরবঙ্গ দখলের জন্য সরাসরি আরিচার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। বিনা বাধায় আরিচা দখল করে নিয়েছিল। তবে, কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনীর এক সদস্য জাবরা গ্রামে ঢুকে যায় জামাই আদরে। তাদের দোসরদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে।
আমার নানাবাড়িতে তখন ঢাকাবাসী আতাহার মামার ছেলে-মেয়ে-বৌ-ঝিরা অবস্থান করছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে সমবয়সী আমার মামাতো বোনদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মামি। কারণ আমাদের বাড়িটি মানিকগঞ্জ সদর থেকে অনেক ভেতরের দিকে ছিল। জাবরা গ্রামটিতে একটু শহুরে মেজাজ ছিল বরাবর।
বর্ধিষ্ণু এই গ্রামটি এক সময় কলকাতাবাসী ব্যবসায়ীদের গ্রাম হিসেবে নাম-ডাক ছিল। জাবরার তিন পাশ ঘিরে বর্ষাকালের উত্তাল কালিগঙ্গার এক ভয়ার্ত রূপচিত্র আজো গেঁথে আছে আমার মনে। অধিকাংশ সময়ে বর্ষাকালে উত্তাল তরঙ্গময় নদী পার হয়ে যেতে হতো মায়ের সঙ্গে। তীরহারা ও ঢেউয়ের সাগর পারি দেওয়ার সংকল্প নিয়ে নৌকায় উঠতে হতো। গ্রামটির যে ঘাটে নৌকা বাঁধলে মাটিতে পা রাখতে পারতাম, তার দুই পাশ ঘিরে কামার-কুমারদের ঝকঝকে মাটির ঘরগুলো বিপুল হাসিতে যেন অভ্যর্থনা জানাতো আমাদের। দেবদারু, বাঁশ ও বেতঝাড়ে ছায়াময় স্নিগ্ধরূপের গ্রামটি খুব বেশি বড় নয়। মূল সড়ক থেকে নামতেই প্রথমেই বড় বাড়ি বলে পরিচিত আমার নানা রাশেদ খান সাহেবের বাড়ি। এর ৭/৮ বাড়ি পরেই বিচারপতি নূরুল ইসলামের নানা দানেজ খান সাহেবের বাড়ি। আরও একটু পূর্বদিকে গেলে কবি জাহানারা আরজুর নানাবাড়ি। জাহানারা আরজুর মেজো মামা ছিলেন আমার পুলিশ খালু। তাদের পাশাপাশি নিকট প্রতিবেশী বলতে যা বোঝায়—সেই বাড়ির মেয়ে মিনিকে বিয়ে করে পাকিস্তানি বাহিনীর এক সদস্য। জাবরা গ্রামের কতিপয় লোক বিশেষভাবে মিনির বড় ভাই জ্যোতিও ছিল পাকিস্তানি আর্মির অন্যতম এক দোসর। ব্যাপক লুটতরাজ করে অর্থকড়ি বানাতেই নিজ বোনকে পাকির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাদের আস্থাভাজন হয়েছিল। কয়েক মাসের মধ্যেই লুটতরাজ করে অঢেল টাকা বানিয়ে নিয়েছিল।
তরা, বানিয়াজুরি, জাবরা, শোধঘাটার পাশাপাশি এই গ্রামগুলো ছিল প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল। কাজেই পাশের গ্রাম থেকে লুটতরাজ করে সোনাদানা এনে নববধূকে উপহার দিয়েছিল বিস্তর। ওই বিয়ের কারণে পাকিরা জাবরা গ্রামের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল বটে, কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই বাঙালি বউ-ঝিয়েদের আরও সর্বনাশের আগে মুক্তিযোদ্ধারা এক গোপন অপারেশনে জ্যোতিকে মেরে ফেলেছিল। ইতোমধ্যে আর্মি স্বামীর সঙ্গে মিনি পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিল।
হেলিকপ্টারের সাহায্যে ছত্রীসেনাদের দিয়ে ঢাকা-আরিচা সড়ক দখলের সময় তারা বিপুল সংখ্যক ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং নিরীহ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করে। ঢাকা-আরিচা সড়ক ও আরিচা দখলের দুই-এক দিনের মধ্যে বিপুল সংখ্যক সৈন্য বিনা প্রতিরোধে মানিকগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে দখল করে নেয়।
ইতোমধ্যে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার ভবের পাড়া গ্রামে বর্তমান ‘মুজিব-নগরে’ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীনতার সনদ ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র ঘোষিত এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ গঠনের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে শক্তি ও অসীম মনোবলের সঞ্চার হয়।
বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে মানিকগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা পরিপূর্ণভাবে সংগঠিত হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলার সময় পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার আগস্ট মাসে মাধ্যমিক পরীক্ষা (এসএসসি) নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।অনুষ্ঠিতব্য এই মাধ্যমিক পরীক্ষা যেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হতে পারে, সেজন্য মুক্তিযোদ্ধারা পরীক্ষা বানচালের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
ঘিওর কেন্দ্রের পরীক্ষা বানচালের জন্য একদল মুক্তিবাহিনী সামান্য গোলাবারুদ নিয়ে উপস্থিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ভোর রাতেই অতর্কিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে গুলি ও গ্রেনেড ছুড়তে করে। পাকিস্তানি বাহিনীও গুলি বর্ষণ শুরু করে। স্বল্পস্থায়ী এই যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা আহত হয়। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযোদ্ধাদের মানিকগঞ্জে এটাই পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে প্রথম যুদ্ধ।
১৯৭১ সালে মানিকগঞ্জ জেলায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী ও আবদুল মতিন চৌধুরী। ঘিওর, হরিরামপুর, লেছড়াগঞ্জ, সূতালড়ি, আজিমনগর, বালিরটেক, সাটুরিয়ার নিরালী, সিঙ্গাইরের গাজিন্দা, মানরা গ্রামের বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড অনেক যুদ্ধ হলেও গোলাইডাঙ্গার আক্রমণটি ছিল মানিকগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে খুবই মর্যাদার ও গুরুত্বপূর্ণ।
অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখে সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের গোলাইডাঙ্গা গ্রামের উত্তর-পশ্চিম কোণে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারী সৈন্যদের বহনকারী বেশ কয়েকটি নৌকা আক্রমণ করে এবং নুরুনি গঙ্গায় (কালীগঙ্গানদীর খাল) একটি ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে ২৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং অনেক আহত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার তবারক হোসেন লুডু এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর লুডু গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন। লুডু ভাই ছিলেন আমার মাতুল সম্পর্কিত ভাই। কাজেই তার নির্দেশেই আমি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংগঠকের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি। আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা রাতে আশ্রয় নিয়েছেন নিয়মিত। সূর্যোদয়ের আগেই চলে গেছেন ভিন্ন ভিন্ন অপারেশনে। আব্বা তাদের অর্থ, খাদ্য ও নিরাপত্তা দিয়ে সাহায্য করতেন। মায়ের সঙ্গে আমি রান্না করে তাদের আহারের ব্যবস্থা করেছি বেশ কতক বার।
কেন, কিভাবে, কোন অপারেশনে চান মিয়া শহীদ হলো—সে কথাটি উচ্চারণ করাও যেন বিপজ্জ্বনক এই মুহূর্তে। পাকিস্তানি বাহিনী জানতে পারলে পুরো গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার দেবে মুহূর্তে।
গোলাইডাঙ্গার এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কেউই শহীদ হননি, যা মানিকগঞ্জের পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা যখন অন্যত্র চলে যান, তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা আরও সৈন্য নিয়ে এসে গ্রামের আশেপাশের প্রায় ১৬০০ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। স্থানীয় ৯৯ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে। যাদের বেশিরভাগ ছিল বয়স্ক পুরুষ, নারী ও শিশু। এই সম্মুখযুদ্ধের পরে ১৩ নভেম্বর সিঙ্গাইর উপজেলা পাক অধিকৃত সেনাবাহিনী থেকে মুক্ত হয়। নভেম্বরের ১৪ই ডিসেম্বর তৎকালীন মানিকগঞ্জ মহকুমা (বর্তমানে মানিকগঞ্জ জেলা) হানাদার মুক্ত হয়।
দুই.
আমাদের গ্রামের জমাদ্দার পাড়ার সাত্তার ভাই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের অবসর প্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্য। চরগড়পাড়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের মাঠে গ্রামের যুবকদের একটা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। আমার চাচাতো ভাই আফতাব ভাইয়ের নেতৃতে আমাদের পরিবারের উঠতি বয়সের ভাই-ভাগনে-ভাতিজা সবাই সেখানে ট্রেনিং করতে যেতো। আমার বড়’পার বড় ছেলে আট বছর বয়েসী ভাগনে ডিটোও বড়দের সঙ্গে ট্রেনিং নিতে যেতো নিয়মিত। আমাদের গ্রামের পাশের দক্ষিণ ডাউলি, বৈকুণ্ঠপুর, হরগজ, আকাশি, তিল্লী, চরতিল্লী, তসবী ডাঙাসহ পুরো এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ইউনিট গড়ে উঠেছিল দক্ষিণ ডাউলির আফতাব ভাইয়ের নেতৃত্বে। এই দলের বিভিন্ন অপারেশনে আমার চাচাতো ভাই আফতাব ভাইয়ের বিশেষ অবদান রয়েছে।
আমার ছোট ভাই সেলিম ও আমার প্রাইমারি স্কুলের সহপাঠী চান মিয়া যেতো নিরানী ক্যাম্পে ট্রেনিং নিতে। সেলিম খুব ছোট ছিল বলে ট্রেনিং শেষে ওকে ইনফরমার হিসেবে নিযুক্ত রেখেছিল। আমার সমবয়সী চান মিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের এই ইউনিটের হয়ে কাজ করছে পুরো সময়জুড়ে। মাঝে মধ্যে সিনিয়রদের সঙ্গে অপারেশনেও অংশ নিতো। এসব কথা কেউ কাউকে ঘটা করে না বললেও চাপা থাকেনি মোটেও। সত্যের সূতো যেন হাওয়ায়-হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় আকাশে।
দেখতে শ্যামলা, লম্বা, একহারা গড়নের চান মিয়া প্রাইমারি স্কুল থেকে আমার সহপাঠী এবং আত্মীয়তার সূত্রে সে আমাকে ফুপু ডাকতো। আব্বার চাচাতো চাচা হযরত আলী দাদার মেয়ে ফুপু চম্পার বিয়ে হয়েছিল চান মিয়ার বড় ভাইয়ের সঙ্গে। বিয়ের দশ বছরের মাথায় দুটি সন্তান রেখে কলেরা রোগে হঠাৎ মারা যায় চম্পা। আমাদের শিশু বেলায় এই চম্পাফুপু কোলে-পিঠে করে আদরে স্নেহে বড় করেছে সেলিম ও আমাকে। এ কারণে আমাদের বাড়িতে চম্পার স্বামী-গৃহের আত্মীয়-স্বজনের সাদর যাতায়াত ছিল। সেই সূত্রে কোনো কোনো দিন চান মিয়া আমার সঙ্গে কেরাম খেলতে আসতো। রাতে যায় অপারেশনে, সে কথা গোপনে থাকে। যেদিন আসে চান মিয়া অনেকটা সময় নিয়ে খেলাধুলা, কথাবার্তা বলে সময় কাটিয়ে যায়। কেরামের গুটিতে তর্জনি রেখে ছক্কা মারার ছলে চান মিয়া মনের অজান্তেই একদিন বলে ফেলে যে, আজ রাতে ওর অপারেশনে যেতে হবে। ফিরে আসতে পারে, নাও বা আসতে পারে। প্রথম দিকে আমিই ওকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে প্রণোদিত করেছি, কিন্তু সত্যি যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে তা আমাকেও বলেনি এতদিন। ওর মুখে কথাটি শুনে চান মিয়ার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়।
কেরামের লাল স্টাইকারে হাত রেখেই চান মিয়া বলতে থাকে, দেখো ফুপু, আমি একটা গরিব কৃষক পরিবারের ছেলে, অর্থাভাবে তোমাদের সঙ্গে গিয়ে কলেজেও ভর্তি হতে পারিনি। আমাকে কে চেনে? আমার জীবনের মূল্যই বা কী? বরং আমি যদি দেশের এই স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধে প্রাণও দিতে পারি, সেটি অনেক গৌরবের হবে আমার জন্যে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিলেন যে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনি পাকিস্তানের জেলে না জানি কেমন আছেন! তার কথা ভাবো। তার পরিবার কোথায় কিভাবে আছে, কে জানে? দেশের অধিকাংশ জেলায় পাকিস্তানি-বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন চলছে। সেদিন সিঙ্গাইরের গাজিন্দা গ্রামে পলায়মান পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিরোধ করলে দুই দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘেরাও করে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর আধুনিক সমরাস্ত্রের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর দুর্বল হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ করে পেছন দিক থেকে আক্রমণের ফলে মুক্তিযোদ্ধা মো. আনিসুর রহমান (গাজিন্দা), আক্কেল উদ্দিন (গাজিন্দা), শরিফুল ইসলাম (গাজিন্দা), রমিজ উদ্দিন (গাজিন্দা) ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়েছেন। চার জন মহান মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিলেন এভাবে দেশের জন্যে। আমি ওই অপারেশনে থাকলে হয়তো আমিও শহীদ হতে পারতাম।
কোনো গ্রামে মুক্তিবাহিনীর খোঁজ পেলেই গ্রাম কি গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করছে। গ্রামের পুরুষদের ধরে নিয়ে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে ব্রাশ ফায়ার করে মারছে। এই অন্যায় আর সহ্য করা যাচ্ছে না। মরতে হলে মরবো, তার আগে দেশ-মায়ের বন্দি দশা ঘোচাতে চাই। স্বাধীনতা অর্জনের এই পবিত্র যুদ্ধে যদি শহীদ হয়ে যেতে পারি, তবে সেটি হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা। কথাগুলো বলেই চান মিয়া সরাসরি তাকালো আমার চোখের দিকে—আমি যেন কিছু বলি।
-শোন্ চান, দেশের কাজে নিজের ক্ষুদ্র জীবন উৎসর্গ করতে পারার মধ্যেই তো জীবনের মহত্ব ও বিরাটত্ব নিহিত আছে। সে কথাকে না জানে? আমিও তো তোমাদের মতো অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে চাই। কিন্তু পারছি কই?
মা বাবার অমতে যেতেও তো সাহস পাচ্ছি না। আমার জন্যে তাদেরও জীবন বিপন্ন হতে পারে, সেই বিবেচনা বোধে সারাক্ষণ অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছি।
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে খবর দেওয়া-আনা ও রাতে যে সব মুক্তিযেদ্ধারা আসেন তাদের খাওয়া-দাওয়ার তদারকি এবং তাদের সাহায্য সহযোগিতা করে যেটুকু কাজ করতে পারছি, দেশের জন্যে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
চানকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলেই কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিলাম, হয়তো এ দেখাই হতে পারে চানের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। ভাবতেই চান মিয়ার জন্যে হঠাৎ করে বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। শত সহস্র কাক এক সঙ্গে ডেকে ওঠে কা-কা রবে। মন কু ডাকে। চোখের জল বাঁধ মানে না আমার। চান মিয়ার জন্যে মনটা ভীষণ পুড়তে থাকে অজানা আশঙ্কায়।
‘ভালো থেকো’বলে চান মিয়া খুব দ্রুত বেরিয়ে যায় যেন তার জন্যে অনেকেই অধীর অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ আছে দ্বারের বাইরে। পরের দিন রটে গেলো মানরা গ্রাম থেকে ঢাকার দিকে পলায়ণপর পাকিস্তানি আর্মিকে নিকেশ করতে গিয়ে তাদের পাল্টা গুলিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন আহত হয়েছে। চান মিয়া শহীদ হয়েছে। দুপুরের দিকে চান মিয়ার লাশ নিয়ে এলো গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাঠে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সকল সাহস যেন হারিয়ে ফেলেছে সবাই। মেঘের মতে উবে গেছে মুহূর্তে। আকাশ, বাতাস, সবুজ পত্রালি, শূন্যমাঠ, মানুষের চারপাশ ঘিরে কেবল ফিসফাস আওয়াজ। মুখ ফুটে কেউ কোনো কথা উচ্চারণ করতে যেন ভুলে গেছে। কেন, কিভাবে, কোন অপারেশনে চান মিয়া শহীদ হলো—সে কথাটি উচ্চারণ করাও যেন বিপজ্জ্বনক এই মুহূর্তে। পাকিস্তানি বাহিনী জানতে পারলে পুরো গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার দেবে মুহূর্তে। সেই ভয়েই কাতর গ্রামবাসী। একমাত্র স্বজন ছাড়া কেউ যেন লাশটি দেখতে আসতেও ভয় পাচ্ছে।
স্কুলের মাঠেই বীর শহীদ চান মিয়ার দাফন শেষ হলো রাতের অন্ধকারে। আমার মা কিছুতেই স্কুলের মাঠে গিয়ে লাশ দেখতে অনুমতি দিলেন না। যুবতি মেয়েদের নিরাপত্তা চিন্তায় এমনিতেই অভিভাবকেরা চিন্তিত। আলবদর, আলশামস বাহিনীর বেঈমানেরা সুযোগ বুঝে পাক-আর্মিদের হাতে মেয়েদের তুলে দিয়ে অনেকেই নিজ নিজ আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। কে জানে কে কোথায় ঘাপটি মেরে কার সর্বনাশ করবে। কাজেই পারতপক্ষে বাবা-মায়েরা যুবতী মেয়েদের ঘরের বাইরে যেতে কিছুতেই অনুমতি দিতে চাইছেন না।
তবু সান্ত্বনা এই যে, সামান্য এই উদ্যোগটুকু মানিকগঞ্জ শিশু ফোরাম নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তিনি ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতায় মারা যান।
সারাক্ষণ ট্রানজিসটারের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাংলাদেশ বেতারে গানি শুনি। এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র শুনে মনে সাহস সঞ্চয় করি। বিশেষভাবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উদ্দীপ্ত রাখতে যেসব দেশাত্মবোধক গান, সেসব গানের বাণী আর সুরে যেমন ছিল সাহসের কথা, যুদ্ধ জয়ের সম্ভাবনার মন্ত্র, তেমনি ছিল দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আকুতি। সেই গানেই মন পড়ে থাকতো। এরমধ্যে একটি গান ছিল, গোবিন্দ হালদার রচিত ও আপেল মাহমুদের সুরারোপিত দেশাত্মবোধক গান, ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে মোরা যুদ্ধ করি।’
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধজয়ের অনুপ্রেরণা জোগাতে এই গানটি রচনা করেন কবি ও ভারতের আকাশ বাণী বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার গোবিন্দ হালদার। ২০০৬ সালে এটি বিবিসি কর্তৃক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান হিসেবে শ্রোতা মনোনীত ২০ সেরা গানের মধ্যে ৭ম অবস্থানে অর্ন্তভুক্ত হয়েছিল। গানটির কয়েকটি চরণ উল্লেখ করছি, জানি অনেকেরই তা মনে আছে। তবু,
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরিযে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা
যার নদী জল ফুলে ফলে মোর স্বপ্ন আঁকা
যে দেশের নীল অম্বরে মন মেলছে পাখা
সারাটি জনম সে মাটির দানে বক্ষ ভরিমোরা নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি
মোরা নতুন একটি গানের জন্য যুদ্ধ করি।
এই গানটি ছাড়াও, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘লেফট রাইট লেফট রাইট’, ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘চলো বীর সৈনিক, হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার’ বাংলার মাটি অন্যতম। গোবিন্দ হালদার কবি ও ভারতের আকাশবাণী বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যতবার বেজেছে, দেশাত্মবোধক এই গানগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে
বাঙালি তরুণ-তরুণীদের যুদ্ধে যেতে প্রাণিত করেছে, আকুল করেছে দেশপ্রেমে।। এছাড়া, তার আরও দুটো গান আমাদের চেতনায় রক্তপদ্মের মতো ফুটে আছে।
‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’—পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মপক্ষ সমর্থনের খবর পাওয়ার পরপরই সন্ধ্যায় ১৬ই ডিসেম্বর প্রচারিত হয় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে গানটি যা সুর দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদ ও মূল কণ্ঠ দিয়েছিলেন স্বপ্না রায়।
২০১১ সালে আমরা জানতে পারি, গোবিন্দ হালদার অসুস্থ অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অর্থাভাবে সুচিকিৎসার আওতায় আসতে পারছেন না। খবরটি জেনেই মানিকগঞ্জ শিশু ফোরামের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক আমার কাছে দ্রুত ছুটে আসে ও করণীয় বিষয়ে আলাপ করে। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মানিকগঞ্জ শিশু ফোরাম দেশের আপামর সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করলেও জনহিতকর বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে মাঝ-মধ্যে। সম্পাদক সালাউদ্দিন কুটু কলকাতায় গিয়ে তাকে এক সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি সম্মতি জানান।
এই মহত শিল্পী শেষ জীবনে অসুস্থ হয়ে অবর্ণনীয় অর্থ কষ্টে জীবনাপাত করেন। এই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে টালিগঞ্জ অতন্দ্র সাংস্কৃতিক সংসদ ও মানিকগঞ্জ শিশু ফোরামের যৌথ উদ্যোগে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্জনের পথে আমরা তার কাছে গভীরভাবে ঋণী। অসামান্য এই গীতিকারের জন্যে আমাদের উদ্যোগ ধুলিকণার সমান। তবু সান্ত্বনা এই যে, সামান্য এই উদ্যোগটুকু মানিকগঞ্জ শিশু ফোরাম নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তিনি ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতায় মারা যান।
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-২২॥ দিলারা হাফিজ