[পর্ব-২২]
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
এক.
মুক্তি ও স্বাধীনতা—এই দুটি শব্দজালে মোহাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল পূর্ব-পাকিস্তানের ৭ কোটি মানুষ। তখন মানিকগঞ্জ ছোট্ট মহকুমা মফস্বল শহর। পদ্মা-যুমনা-ধলেশ্বরী-ইছামতি ও কালিগঙ্গার জল ছলছল অববাহিকা অঞ্চলের পলিভূমিতে ঋদ্ধ তার সোনালি দোআঁশ মাটি। শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। সেই মাটির সন্তানেরা কেউ কেউ ভুবনবিখ্যাত। হিন্দু-মুসলিমে সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান। দেশ ও দেশমাতৃকার সেবায় তারা ক্ষুদিরাম।
সাতটি উপজেলা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আজকের মানিকগঞ্জ জেলার স্বীকৃতি এসেছে ১৯৮৪ সালে, মহান স্বাধীনতার সুফল হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানিকগঞ্জ শুধু ছোট্ট একটি মহকুমা শহর। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তেজদীপ্ত ছিল শিক্ষা-সংস্কৃতির আলাদা একটি পরিমণ্ডল হিসেবে।
বৃটিশ আমলে (১৮৪৫ সালে) মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রথমে ফরিদপুর জেলার অধীন ছিল। পরবর্তী সময়ে প্রশাসনিক নানা জটিলতার কারণে ১৯৫৬ সাল থেকে ঢাকা জেলার অধীনে ছিল ১৯৮৪ সালের ১ মার্চের আগেরদিন পর্যন্ত। শত মানিকের জন্ম দিয়েছে এই মানিকগঞ্জের মাটি। এই মাটির ঋণ আমাদের কখনো শোধ হওয়ার নয়। আমরা সেই জীবনপ্লাবী সংগ্রামের কথক মাত্র।
৭ মার্চের ভাষণের আগে আমি বাড়িতে চলে এসেছিলাম। চারদিকে থৈ থৈ উত্তেজনা, সংগ্রামের আহ্বান পথে-প্রান্তরে। কলেজ প্রদক্ষিণ করে মিছিল মিটিং চলছিল প্রতিদিন। ক্লাসও ঠিক মতো হচ্ছে না। ছাত্র-শিক্ষক মিলেই এক কাতারে। কাজেই কলেজ ছুটির আগেই নতুনবস্তি থেকে বাড়িতে চলে এসেছি।
এ সময়ে মানিকগঞ্জের আপামর জনসাধারণ তাদের থাকা খাওয়াসহ সব ধরনের সহযোগিতা করে এক উল্লেখযোগ্য নজির সৃষ্টি করে।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো মানিকগঞ্জের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বপ্রস্তুতির পটভূমি তৈরি গেছে ইতোমধ্যেই।
এ সময়ে দেবেন্দ্র কলেজ থেকে সংগৃহীত ইউ.ও.টি.সি-এর ড্যামি রাইফেল নিয়ে জাতীয় পরিষদ সদস্য মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়ার বাসার সামনে ছাত্রদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণ ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলেছিল। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ অবস্থার পর্যালোচনা ও বিধি ব্যবস্থা নিতে প্রায়ই সভা-সমিতিতে মিলিত হতেন। সারাদেশ অশান্ত। দেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ধারণ করে প্রত্যেকেই যেন এক উদ্দীপিত অগ্নিপিণ্ড, বাংলার আকাশ-বাতাস-জল—প্রকৃতি-নিসর্গ, সবই যেন উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করে আছে সেই বিশেষ মুহূর্তটির জন্যে।
স্বাধীনতা শব্দটি কবে আমাদের হবে?
এলো সেই ২৫ মার্চের কাল রাত্রি। ১৯৭১-এর এই দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী বাঙালি নিধনে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ড চালালো। রক্তগঙ্গায় ভেসে গেলো রাজধানী ঢাকার রাজপথ অলিগলি সব। সব।
২৫ মার্চ রাতেই মানিকগঞ্জের অদূরে তরাতে অবস্থিত তৎকালীন ই.পি.আর.টি.সি.ডিপোতে চাকরিরত সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলা ও বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগের ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ওই রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী যেন আরিচা ফেরীর সাহায্যে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে পারাপার না হতে পারে সেজন্য সব ফেরী সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযোদ্ধারা। সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর করা হয়। পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্যারিকেডের সৃষ্টি করা হয়। অস্ত্র চালনায় অভিজ্ঞদের দিয়ে নয়ারহাটে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা করা হয়। ওই রাতেই মানিকগঞ্জের ট্রেজারিতে রক্ষিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ বের করে নিয়ে ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এখনো মনে হলে শিউরে উঠি, ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানের এক বেতার ঘোষণায় সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণাসহ নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়। সে সংবাদ শুনে সবাই হায় হায় করছি, যেকোনো সময়ে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নেবে আমাদের সবাইকে, সেই ভয়াবহ পরিণামের জন্যে তৈরি হচ্ছে সবাই মনে-প্রাণে।
২৮ মার্চ সকালে হঠাৎ করে প্রখ্যাত ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মনি মানিকগঞ্জে আসেন। তার মাধ্যমে জানা যায়, আওয়ামী লীগের নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, তোফায়েল আহমেদ ও সিরাজগঞ্জের ডা. হেনা লঞ্চযোগে মানিকগঞ্জ এসেছেন। সিরাজগঞ্জে যাওয়ার নিরাপদ রাস্তা খুঁজছেন।
২৯ মার্চ সান্ধ্য আইন শিথিল করা হলে দলে দলে মানুষ ঢাকা ত্যাগ করে পায়ে হেঁটে মানিকগঞ্জের ওপর দিয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে রওয়ানা হয়। এ সময়ে মানিকগঞ্জের আপামর জনসাধারণ তাদের থাকা খাওয়াসহ সব ধরনের সহযোগিতা করে এক উল্লেখযোগ্য নজির সৃষ্টি করে।
দুই.
৩০ মার্চ লকেট ভাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন আমাদের বাড়িতে। তাদের গ্রাম জাবরা থেকে আমাদের গড়পাড়া গ্রামের দূরত্ব প্রায় তিন মাইল। লকেট ভাইয়ের ফর্সা মুখখানি রক্তাভ লালে রক্তিম হয়ে উঠেছে, দরদর করে ঘাম ঝরছে। তাকে বারান্দায় বসতে দিয়ে লেবুর শরবত করে দিলাম, খইমুড়ির সঙ্গে একবাটি দুধ খেতে দিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, যুদ্ধের কিছু খবর পেলেন?
আর বলো না, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। এজন্যেই তোমাকে খবরটা দিতে এলাম ছুটে। তোমার তো মনে আছে নিশ্চয়, তোমার সহপাঠী বন্ধু নীলু, বড় নীলু, জাভেদ, বাবু—ওদের সবাইকে না মেরে ফেলেছে!
আঁতকে উঠে বললাম, কিভাবে?
২৫ মার্চের রাতে বাঙালি নিধনের বদলা নিতেই ভৈরব বাজারের বাঙালিরা এক হয়ে, রেলওয়ে কলোনির সব বিহারি, উর্দুভাষীকে একটা ট্রেনে তুলেছে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে। এরপর মেঘনার তীরে নিয়ে এক এক করে দা, কুড়াল, বটি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছে।
অস্ত্র তো এখনো হাতে আসেনি বাঙালিদের, কাজেই হাতের কাছে যে যা পেয়েছে, তাই দিয়ে ওদের হত্যা করে ডুবিয়ে দিয়েছে মেঘনার পানিতে। ফেরৎ ট্রেনে তল্লাশি করে নীলুর সেই ছোট্ট সাত বছরের বোনটিকে পেয়েছে, সে ভয়ে পালিয়েছিল ট্রেনের ওপরের বাংকারে। পরে ওকে থানা হেফাজতে রেখেছিল ওই রাতে। শেষাবধি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বা কী করেছে, জানতে পারিনি আর।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো, তার গভীর আকূতিময় সেই কথা, যে কথা নিজে বলতে না পেরে আমার বন্ধু নীলুর মুখে বলে পাঠিয়েছিল—আমি যদি ডাক্তার হই, তবু কি ওর মা-বাবা আমাকে মেনে নেবে না?
একটানা লকেট ভাই বলে গেলো গল্পটি, ওদের প্রত্যেকের মুখখানি এক এক করে ছায়াছবির পর্দায় যেন ভেসে উঠছিল আমার চোখের সামনে। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল, আমি বোধ হয় লকেট ভাইয়ের সঙ্গে বসে কোনো যুদ্ধের পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি দেখছি। তাদের প্রত্যেকের মুখে বেদনাকাতর একটি প্রশ্ন ছিল যেন।
-আমরা তো কোনো দোষ করিনি, কোনো বাঙালি ভাইয়ের গায়ে টোকাও দেইনি, বিনে অপরাধে আমাদের কেন এভাবে মরতে হবে পরিবার-পরিজনসুদ্ধ?
যুগ যুগব্যেপে এটাই তো যুদ্ধের নিয়ম হিসেবে দেখি। হয় মরো, না হয় মারো। যুদ্ধের ময়দানে এই একটি তো মূল্যবোধ। সামাজিক জীবনের প্রচলিত মূল্যবোধ যুদ্ধক্ষেত্রে ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়! এখানে মানবতা, সহমর্মিতা, করুণা, ভালোবাসার কবর রচিত হয় পরস্পরের, দুই সম্মুখযোদ্ধার। শিখা অনির্বাণের মতো জেগে থাকে, ঘৃণা, আক্রোশ, জিঘাংসা, অহমিকা আর ক্ষমতার দম্ভ।
ভয়ার্ত নীলুর ছোট বোনটির ভবিষ্যৎ ভেবে ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তে। ধর্ম, গোত্র, ভাষার ব্যবধানে পৃথিবীতে কত কত যুদ্ধ, কত কত প্রাণের সংহার—পৃথিবী কত সইবে আর!
জাভেদের যাতনায় পীড়িত হয়ে যে আমি ভৈরব বাজার ছেড়ে এসে খুব হালকাবোধে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম, তিন-সাড়ে তিন বছরের ব্যবধানে হঠাৎ মনপাখি কেঁদে উঠলো তার জন্যে। যাকে একদিন খুব নিষ্ঠুরভাবে এড়িয়ে গেছি, পালিয়ে বেড়িয়েছি ওর চোখের আড়াল খুঁজতে—সেই জাভেদের জন্যে, যে আমাকে দু’হাত ভরে একদিন প্রেম দিতে চেয়েছিল—বিনিময়ে প্রত্যাখ্যানের ভাষায় যাকে জর্জরিত করেছি, হৃদয় উজাড় করা নিবেদনের ভাষায় লেখা চিঠিটি পর্যন্ত আমি শুনিনি, তবু সেই ছেলেটির মৃত্যুদৃশ্য কল্পনা করে, বন্ধু নীলুর কথা মনে করে আমার চোখের জল আজ আর কোনো শাসন মানলো না। লকেট ভাইয়ের সামনেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো, তার গভীর আকূতিময় সেই কথা, যে কথা নিজে বলতে না পেরে আমার বন্ধু নীলুর মুখে বলে পাঠিয়েছিল—আমি যদি ডাক্তার হই, তবু কি ওর মা-বাবা আমাকে মেনে নেবে না?
ওকে তো বলতে পারিনি, অবাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো সুপুত্রকেও আমি ভালোবাসতে পারবো না, আমি যে ততটাই বাঙালি মনে এবং প্রাণেও।
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-২১॥ দিলারা হাফিজ