[পর্ব-১৬]
যখন আমি সুন্দর বনের প্রবেশদ্বার খুলনায়
এক.
১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাস।
উত্তুরে বাতাসের সঙ্গে কনকনে শীতের হাড় কাঁপানো ডাক, সে ডাকে সুন্দর বনের বাঘ না কাঁপলেও হালের গরু, ছাগলকে চটের ছালায় ঢেকে রাখতে হয় গোয়াল ঘরে। সন্ধ্যার পরে ঘরে ঘরে মাটির আইলসার আগুনে হাত তাপানো বুড়োবুড়ির সংখ্যাও রাত হতে হতে বাড়ে।
আমাদের বাড়ির পেছনে উত্তরপাড়ায় কালিগঙ্গার তীরঘেঁষে ভূমিহীন, বর্গাচাষিসহ যাদের বাড়ি, তাদের অবস্থা তো খুবই শোচনীয়। পাটখড়ির বেড়া, নয়তো তালাই বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে চোরা বিলাইয়ের মতো ঠাণ্ডা বাতাস আসে আর যায়। ওই পাড়ায় মাঝে মধ্যে আখের গুড় কিনতে গিয়ে হালির মেয়ে, আমার সমবয়সী ধোলির সঙ্গে কুতকুত খেলেছি কয়েকদিন, যদিও যেখানে সেখানে কুতকুত খেলা আমার নিষেধ। তবু এক পায়ে মাটির একখণ্ড চারা পায়ের নখ দিয়ে ঠেসে ঠেসে সমুখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেন আমার নেশা। তাই মায়ের চোখের আড়ালে ধোলিও আমার খেলার সঙ্গী হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে।
ধোলির সহজ সরল অনাড়ম্বর মুখখানা ঘিরে আমার প্রাণের টান যেন বাউলা বাতাসের মতো ওড়ে। শীতের প্রকোপ বাড়লেই মাঝে-মধ্যে হেঁচকা টানে ধোলি আমাকে নিয়ে ওর ছেঁড়া কাঁথার তলায়। রাতে নানির পাশে লেপের নিচে শুয়ে ধোলির দুঃখ-কষ্ট ভাবনায় এসে দোল খায়। মনে মনে ভাবি, ওরা এত গরিব হলো কেন? বিদ্যুৎহীন গ্রামের বাড়িতে দুটো ঋতু সবচেয়ে উচ্চকিত ছিলো। বর্ষা ও শীতকাল।
বর্ষাকালে নৌকা বেয়ে যারা জীবন-যাপন করে তাদের অধিকাংশের বাড়িও নদীঘেঁষা এই উত্তরপাড়ায়। সেই সময়ে বর্ষাকালে যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌকা। প্রয়োজন ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে নৌকায় যাতায়াতের সময় বেশিরভাগ সময় পবনমাঝি তার এক মাল্লাইয়া নৌকা নিয়ে আসতো।
মা বছরে একবার আমাদের নিয়ে তার বাবার বাড়ি যেতেন পবন মাঝির নৌকায়। শান্ত-শিষ্ট বিনয়ী স্বভাবের পবন মাঝিকে আমারও খুব ভালো লাগতো। ছইওয়ালা নৌকা দরকার হলে পবন মাঝিকে ডাকতে আমিই যেতাম তাদের বাড়ি। আমাদের বাড়ির ঘাটেও নৌকা ছিল তবে, তা ছইহীন নৌকা। ছোট ডিঙ্গি তো একটা থাকতোই ঘাটে বাঁধা—আমাদের বাড়ি থেকে বাগান গিয়ে ফলমূল তোলার কাজের জন্যে। এপাড়া ওপাড়ার মধ্যকার যোগাযোগও চলতো তাতে।
মজাদার খাবার বেশি খেতে কারও ইচ্ছে হলেই সালামকে কোট করে বলতো, যা খায় মাইনষে কাপবাসুনে, তাই দিলেন একটুক্কা পেলায়?
বড় নৌকায় করে ধান-পাট কিংবা আখ বিক্রি করতে হাটে যেতো রাখালেরা, ফেরার পথে ইলিশ মাছ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিশেষভাবে রাখালদের তামাক মাখানোর জন্যে নালীগুড়, জ্বালানির জন্যে কেরোসিন তেল আর আমাদের ফার্স্টফুড বলতে বাদামটানা, কদমা ইত্যাদি নিয়মিত থাকতো কেনার তালিকায়।
প্রায় প্রতিদিন সকালবেলা উঠেই আজাহার সেই বড় নৌকা নিয়ে যেতো বাঁশের দোয়াইর থেকে মাছ তুলতে। আমাদের বাগানের কোণাকুণি আজাহারদের বাড়ির সীমানা পর্যন্ত (বাঁশের কাঠি আর পাটের রশি দিয়ে বুনানো) বানার বাঁধদিয়ে আট-ন’টি দোয়াইর পেতে রাখতো আজাহার বেলা ডোবার আগখান দিয়ে।
ভোর-সকালে উঠে সর্বপ্রথম তুলতে যেতো মাছসহ সেই সব দোয়াইরগুলো। আমি আর সেলিম প্রায়ই সেই মাছ তোলার সময়ে নৌকায় উঠে বসতাম। অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম প্রত্যেকটা দোয়াইর পানির নিচ থেকে ওপরে ওঠা পর্যন্ত। আমি আর সেলিম গুনতে চেষ্টা করতাম কয়টা মাছ ধরা পড়েছে একেকটা দোয়াইরে। দোয়াইরের মুখ খুলে আজাহার দ্রুত নৌকার খোলেঢেলে দিতেই চিংড়ি আর বেলে মাছগুলো জোরে ছটফট করে লাফাতে থাকতো যখন, বিভিন্ন প্রকার মাছের এই ঐশ্বরিক রূপদেখার আনন্দে মাছগণনাও ভণ্ডুল হয়ে যেতো আমাদের। তবে কে কোন মাছটি খাবো দুপুরে রান্নার পরে সেই ভাগ-বাটোয়ারা করে ফেলতাম দুই ভাই-বোন মিলে।
শীতকালের কথায় আসি এবার।
ঘাসের ডগায় ওস থাকা ভোর-সকালে আমাদের বাগানের খেজুরগাছ থেকে রস পেড়ে গাছি অর্ধেক নিয়ে বাকিটা দিয়ে যায় মাটির কলস ভরে। আমরা ভাই-বোনেরা মিলে নওল সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে বসে এক গ্লাস কাঁচা রসের সঙ্গে মুড়ি ভিজিয়ে খাই আর কাঁপতে থাকি।বাকি রস জ্বাল করে ঘন করে মা কাঁচের বৈয়ামে ভরে রাখে। সকালবেলা নাস্তায় রুটি-পরোটার সঙ্গে খেতে দেয়। খেজুরের পাটালিগুড়ের পরিবর্তে রাতে দুধ-ভাতেও পাকা রস চলে।
কাঁচা রসের ফিরনি মন চাইলেই সাত-সকালেই রান্না হতো। অনেকেই দুধ বিহনে শুধু কাঁচা রসে চাল ফেলে দিয়ে রান্না করতো। কিন্তু মায়ের হাতে ফিরনি পায়েস যাই হোক দুধ না হলে চলতো না। কার্তিক মাসেই পিঠাপুলির যাত্রা শুরু হতো।
মা প্রথম বানাতেন মুঠাপিঠা। ভেজানো আতপচাল ঢেঁকিগুড়ো করে আনতো আজাহারের মা আর টুলীর মায়ে মিলে। নুন মেখে কাই করে তবে মাকে ডাকতো, ইত্যবসরে এক চুলায় পানি তখন ‘কী দেবে দাও, কী দেবে দাও’ বলে টগবগ করে ফুটতে থাকতো।
মা চুলার পারে বসে খানিকটা কাই ডান হাতের মুঠিতে চেপে বলকপারা পানিতে ছেড়ে দিতেন বলে আঙুলের দাগগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতো পিঠার গায়ে। সামান্য চালের গুড়ো আর অসামান্য নুন দিয়েই কত সহজে তৈরি হতো ছেলে ভোলানো এই মুঠাপিঠে।
ছোটবেলায় কিন্তু ভারি মজাই লাগতো গরম ঠাণ্ডা দুভাবেই। কার্তিকের নবান্নের যাত্রা শুরুতে মুঠাপিঠা অবস্থান সবার আগে। এরপর সেদ্ধকুলি, তিলকুলি, পাটিসাপটা, ভাপা, মোরগ-সংসা—চলতেই থাকে একটার পরে একটা। মেহমান থাকলে একটু বেশি জমে। না থাকলেও ক্ষতি নেই। বাড়িতে আব্বা থাকলেই আমাদের ষোলোকলা যেন পূর্ণ।
এরপর শীত যত গভীর হতে থাকে, তখন আত্মীয়-স্বজন ডেকেই দুধ-চিতই, দুধকুলি—এবং দুধ-লাউ ক্ষীরের জম্পেস আড্ডা। আমাদের মানিকগঞ্জ অঞ্চলের দুধের পিঠাগুলো অধিকাংশ বাড়িতে বেশি দুধ ঘন করেই করে। অন্যান্য অঞ্চলে যেমন বরিশাল, টাঙ্গাইলের পিঠায় দুধের ব্যবহার যেন নামমাত্র।
বড়’পার বিয়ের পর পর তার শ্বশুরবাড়ি টাঙ্গাইলের গয়হাটা গ্রাম থেকে বেটা ভাগনেরা প্রায়ই বেড়াতে আসতো আমাদের বাড়িতে। নতুন আত্মীয় সৃষ্টি হলে প্রথমদিকে যাতায়াত একটু বেশিই চলে। বিশেষ করে মেয়ের বাড়িতে। শীতকালে বড়’পার ননাসের এক ছেলে সালাম এসেছে বেড়াতে, খাওয়া শেষে মা তাকে এক বাটি ঘনদুধের লাউ পায়েশ খেতে দিয়েছেন। সম্ভবত, খাবারটি তার কাছে খুবই উপাদেয় ছিল। খাওয়া শেষ না হতেই মাকে ডেকে বলছেন। ওহ, নানি, কী দিলেন খাইতে এট্টুক। যা খাইবো ম্যাইনষে কাপবাসুনে (বড় প্লেট, রোজ কামলাদের খাবার দেওয়া হয় যে প্লেটে) তাই দিলেন একটুক্কা পেলায়। এতে হয় নাকি! দেন, আর আট্টু দেন।
তার এই উক্তি নিয়ে বহুদিন আমাদের বাড়িতে হাসাহাসি হতো। মজাদার খাবার বেশি খেতে কারও ইচ্ছে হলেই সালামকে কোট করে বলতো, যা খায় মাইনষে কাপবাসুনে, তাই দিলেন একটুক্কা পেলায়?
দুই.
শীতের এক পড়ন্ত বিকেলে দুলাভাইসহ বড়’পা খুলনা থেকে বেড়াতে এলেন আমাদের বাড়িতে। গ্রামের রসের পিঠাপুলি উৎযাপন করতে। ভোজনরসিক হিসেবে দুলাভাইর সুনাম-দুর্নাম দুটিই ছিল জোরদার। নিজে যেমন খেতে পারতেন, মানুষকে খাওয়াতেও খুব ভালোবাসতেন তিনি। ঢাকায় তার মোহাম্মদপুরের বাসা ছিল দুই কুলেরই হোটেলখানা কাম পান্থশালা।
ওখানে গিয়ে ওর ক্লাসও খুব বেশি করতে হবে না। তাকে আমি বলে দেবো। বাসায় কেবল ইংরেজি আর অঙ্কের জন্যে একজন অথবা দুই জন শিক্ষক রেখে দিলেই চলবে।
আমাদের বাড়িতে মাছ ভেজে রান্নার প্রচলন তার জন্যই হয়েছিল। বড়’পাকে প্রায় হাতে ধরে তিনি রান্না শিখিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে আমাদের সবার প্রিয় ও মজার রান্না বড়’পার হাতেই খেয়েছি আমরা। গ্রীষ্মকালে কিংবা রোজার সময়ে বড়’পার হাতের বানানো শরবত ছিল অমৃত সমান। আমাদের সবার কাছেই আবে জমজমের মতো প্রিয় ও পবিত্র ছিল সেই পানীয়।
ইংরেজি সাহিত্যের পঠনপাঠনের অগাধ জ্ঞান নিয়েও দুলাভাই শেষ পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংক অব ইস্ট পাকিস্তান খুলনা বয়রা শাখার একজন ইনস্পেক্টর হলেন।
ততদিনে বড়’পা তিন পুত্র সন্তানের জননী। ডিটো, লিটন ও এক বছর বয়সের টিটো। টিটো ফর্সা, নাদুস-নদুস গোলগাল পুতুলের মতো, দেখতে খুবই কিউট। ছোট ছোট আমার বয়সী সব খালা তাকে খুব কোলে করতে টানাটানি করতো। কার আগে কে নেবে!
সবার কোলেই যেতো, একসঙ্গে এত অচেনা মানুষ দেখে মাঝে মধ্যে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিতো। এই টিটো তিন বছর বয়সে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে-বসে ফেরিওয়ালাদের অনুকরণে একটি বাক্যই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিনের মধ্যে অন্তত শতেক বার বলতো, বাদাম বাদা, বাদাম বাদা।(অর্থাৎ বাদাম ভাজা)।
১৯৬৩ সালে জন্মেছে বড়’পার বড়পুত্র ডিটো।
ডিটো তখন পাঁচ বছর পার করেছিল, আধুনিক পোশাকে সুসজ্জিত, শহুরে চাকচিক্য এবং কথার বুলিতেও এক অচেনা বিভূতি। নানাবাড়ির সবার প্রিয় নাম ডিটো, সৌম্য, সুদর্শন চেহারার আদুরে মূর্তি যেন। সবারই মনকাড়া। আমাদের গ্রামের বাড়ির মলিন ছেলেমেয়ের পাশে তারা অতি উজ্জ্বল দেবদূত প্রায়।
শুদ্ধ ভাষায় কথা, চলন-বলন—সব কিছুতেই আধুনিকতার ছাপ। নানাভাইয়ের সঙ্গ খুব পছন্দ তার। সকালবেলা উঠে নানার সঙ্গে খালি পায়ে কুয়াশা মেখে হেঁটে আসে ক্ষেতের বাতর দিয়ে।গরু বাছুর দেখে উৎফুল্ল হয়ে অনবরত কৌতূহলী প্রশ্ন তার ছুড়ে দেয় তার নানাভাইয়ের মুখপানে চেয়ে। তার নানাভাইও হ্যাঁ মিয়াভাই, হ্যাঁ মিয়াভাই বলতে বলতে উত্তর দিয়ে যান আপনমনে।
আমার আব্বা-মায়ের বড় নাতি হিসেবে নানা বাড়ির আদরে সে অতুলনীয়, সেরা। ডিটোর সঙ্গে আমার বয়সের ফারাক মাত্র আট বছরের। কিন্তু আমি খালামনি হওয়ায় আমার বড় বড় ভাবটা বয়সের চেয়ে ডাবল। লিটন মোটামুটি শান্ত-শিষ্ট। লিটন আবার দুলাভাইয়ের চোখের মণি। আমার ‘রাজা বাবা কইরে’বলে দুলাভাই তাকে আদরে ডুবিয়ে রাখতেন সর্বক্ষণ।
এক সন্ধ্যায় খাওয়া-দাওয়া শেষে আমার পড়ালেখার খোঁজখবর প্রসঙ্গে আব্বা-মাকে বললেন, ‘দিলু তো, সবে সপ্তম শ্রেণী শেষ করলো, সে তুলনায় গায়ে-পায়ে বেশ ডাগর হয়ে উঠেছে। আপনারা চাইলে আমি তাকে ডাবলপ্রমোশনের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। অষ্টম শ্রেণীর পাঠ বাদ দিয়ে সরাসরি নবম শ্রেণীর বই কিনে দেন। আমাদের গ্রামের গয়হাটা উদয় তারা হাই স্কুলে নবম শ্রেণীতে ওর নাম রেজিস্ট্রি করে দিলে দুবছরের মাথায় এসএসসি পাস করে বেরিয়ে আসতে পারবে। স্কুলের হেডমাস্টার আজগর আলী আমার বন্ধু। ওখানে গিয়ে ওর ক্লাসও খুব বেশি করতে হবে না। তাকে আমি বলে দেবো। বাসায় কেবল ইংরেজি আর অঙ্কের জন্যে একজন অথবা দুই জন শিক্ষক রেখে দিলেই চলবে।’
উদ্বেগের সঙ্গে মা বললেন, ‘কিন্তু থাকবে কোথায় বাবা। এখানেও তো তেমন শিক্ষক নেই, ওকে যে পড়াবে!’
-আপনারা অনুমতি দিলে আমরা এবারই দিলুকে সঙ্গে নিয়ে সব ব্যবস্থা করে দেবো। আমাদের সঙ্গে খুলনার বাসায় থাকবে। ইংরেজিটা আমিও দেখিয়ে দিতে পারবো।
ফাতেমার মৃত্যুর পঞ্চম দিনের দিন হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে দুলাভাই বাসায় এসে বড়’পাকে বললেন, ‘চলো, যা কিছু আছে দ্রুত গুছিয়ে নাও। এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে, নইলে আমি অ্যারেস্ট হয়ে যাবো।’
বিদ্বান দুলাভাইর কথা অগ্রাহ্য করার কোনো কারণই নেই। কারণ লেখাপড়ার বিষয়ে তিনি ছাড়া আর কে আছেন, যিনি ভালো পরামর্শ দেবেন! তাছাড়া ধারে কাছে তো কোনো ভালো স্কুলও নেই যে, বিকল্প চিন্তা করবে কেউ।
১৯৬৮ সালের শুরুতেই বড়’পার সঙ্গে চলে এলাম খুলনায়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরে তৃতীয় বৃহত্তম শহর এই খুলনার বয়রা এলাকায় ব্যাংকের বিশাল বড় কোয়ার্টার। সেখানেই তখন থাকেন তারা।
বড়’পার এই পরিবারের একজন হয়ে শুরু হলো আমার নবম শ্রেণীর পাঠপর্ব। আমার মতো আর একজন জায়গীরদার হলো দুলাভাইয়ের বড়ভাই পুত্র খেজমত। সেও তখন এই বাসায় কাকার করুণাপ্রার্থী। আমার চেয়ে বয়সে বড়। আইএ পাম করে চাকরি সংগ্রহের চেষ্টারত।
অফিস থেকে ফিরে এসে দুলাভাই আমাকে ইংরেজি ট্র্যান্সস্লেশন দেখিয়ে দেন প্রতিদিন।
ইংরেজি রচনা মুখস্ত করতে বলেন। খালেদ রশীদ নামে দুলাভাইয়ের এক চিরকুমার বন্ধু আসেন মাঝেমধ্যেই। তিনি এসে আমার বাংলা পড়াও ধরেন কখনো সখনো।
দুলাভাই সেদিন ফেরেননি অফিস থেকে, খালেদ রশীদ এসে আমার পড়ার টেবিলের কাছেই একটা চেয়ার টেনে বসেছেন। বড়’পা তাকে চা দেওয়ার জন্যে রান্নাঘরে ঢুকেছেন। এই ফাঁকে তিনি বইসহ আমাকে খুব কাছে টেনে নিলেন। মনে হলো আমার পুরো তলপেটজুড়ে তার হাতখানা পর্যটনে নেমেছে। এই স্পর্শ কখনো নির্দোষ মনে হচ্ছে, আবার কখনা না। কিন্তু যেই মনের মধ্যে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, তখন তার হাত ছাড়িয়ে বের হয়ে আসতে আমি উসখুস শুরু করছি। সে কেবল বলছে, বুঝলে না দিলু, পড়া মুখস্ত করতে হয়। পড়া মুখস্ত করতে হয়।
-জি বলে এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিয়ে সরাসরি আমি রান্নাঘরে আপার কাছে চলে যাই। কিন্তু আপাকে কিছু বলি না। এরপর তিনি এলে কখনো আমি তার সামনে পড়িনি। দুলাভাইয়ের আর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কমর উদ্দিন নামে। তিনিও নিতান্তই শাদা মনের মানুষ, মাসে ২/১ বার আসতেন বাসায়। দুলাভাইয়ের ঘনিষ্ঠ এক পরিবারের জলি-ডলি নামে দুই কন্যা ছিলো, অসম্ভব লাবণ্যময়ী আর মায়াবী হরিণ চোখের অধিকারিনী তারা।
দুলাভাই ঘটকালি করে কমরউদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন জলির। এই বিয়েতে জলি সুখী হয়নি। দুলাভাইকে মাঝে মধ্যেই জলি বলতো, আপনি যেদিন দেখতে এসেছিলেন আপনার বন্ধুকে নিয়ে, আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো বর। নইলে এই বিয়ে আমি কখনো করতাম না। দুলাভাইয়ের অ্যালবামের অনেকটা জুড়েই জলি-ডলি দুই বোনের ছবি। ওদের বিয়ের ছবিও ছিল কিছু।
এত অসহ্য মায়াবী ডাগর চোখ, সত্যি জলি ছাড়া আর কারও আমি দেখিনি এই জীবনে। ওরা কেন সুখি হতে পারলো না, তখন আমি বুঝতে পারতাম না। এইটুকু বুঝেছি যে, দুলাভাই ওই অসহ্য সুন্দরীর গুণগ্রাহী, আর জলিও স্বামীর চেয়ে স্বামীর বন্ধুকে পছন্দ করতো অধিক।
১৯৬৮ সালের শেষদিকে তিন পুত্রের পরে আপা এক কন্যা সন্তান জন্ম দিলেন, নাম তার ফাতেমা। সে তার ভাইদের চেয়েও খুব সুশ্রী, সুন্দরী হয়ে জন্মেছিল। আমি তাকে কয়েকদিন তেল মেখে কাজলের ফোঁটায় সাজিয়ে ছিলাম। এই প্রথম এত ছোট একটি মেয়ে শিশুকে এত কাছে হাতে নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। ক’দিনেই খুব মায়া পড়ে গিয়েছিল। ঘন ঘন সন্তান জন্মদিয়ে বড়’পাও খুব কাহিল ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। কাজেই বেশিরভাগ সময় আমিই তাকে কোলে রেখেছি। সম্ভবত তার পায়ুপথের সমস্যা ছিল। পানের বোঁটা দিয়ে তাকে পায়খানা করানোর চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে অবশেষে নবম দিনে সে মারা যায়।
সন্তান হারানোর কান্নাকাটিতে বড়’পার অসুস্থ শরীর আরো ভেঙে পড়ে। ফাতেমার মৃত্যুর পঞ্চম দিনের দিন হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে দুলাভাই বাসায় এসে বড়’পাকে বললেন, ‘চলো, যা কিছু আছে দ্রুত গুছিয়ে নাও। এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে, নইলে আমি অ্যারেস্ট হয়ে যাবো।’
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-১৫॥ দিলারা হাফিজ