[পর্ব-১১]
মরি লো মরি, আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে।
ভেবেছিলেম ঘরে রব, কোথাও যাব না—
ওই-যে বাহিরে বাজিল বাঁশি, বলো কী করি।
এক.
এই প্রথম আমি জ্ঞান অর্জনের জন্যে ঘরের বাইরে এলাম। তখন বর্ষাকাল। আব্বা বজরা নৌকা ভাড়া করলেন। আগের দিনে ধনী লোকেরা শখ করে নৌকা ভ্রমণে যেতেন, আমার আব্বার মধ্যেও এই শখ প্রবল ছিল।
যতদূর জানি, ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল ‘বজরা’ নৌকা। বজরায় তারা এক রকম ঘরবাড়ি বানিয়ে নিতেন। ফলে এতে খাবার-দাবারসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই থাকতো। কোনোটিতে আবার পালও থাকতো। এতে থাকতো চারজন করে মাঝি। বজরা মূলত সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চলে বেশি দেখা যেতো। তবে যেকোনো স্থানে যাতায়াতের জন্যে বজরা ভাড়া পাওয়া যেতো সহজে। মানিকগঞ্জ থেকে মির্জাপুর কেউ নৌকায় যাতায়াত করেছে বলে, তখন-পর্যন্ত জানা ছিল না আমার।
সাত-সকালে মা সব গুছিয়ে নিলেন। নৌকায় উঠলেন। সঙ্গে আমি ছাড়াও ছোট দুই ভাই-বোন। আমার বই-পত্র, জামা কাপড়সহ একটা বাক্স, খাবার দাবারসহ খাজাঞ্চি, টুকরো করা আখের আঁটি, আব্বার গুড়গুড়ি হুঁকা। কলকের আগুনের জন্যে কতগুলো টিক্কা এবং বাটাভর্তি সুগন্ধি তামাক।
এক এক করে সব নৌকায় তুলে নিলো মাঝি, গুলুইয়ে পা দিয়ে আব্বা নৌকায় উঠলেন সবার শেষে। ছইয়ের সম্মুখভাগ থেকে গুলই পর্যন্ত একটা ছোট কার্পেট। তার ওপর একটা চাদর বিছিয়ে পরিপাটি বিছানা করা হয়েছে আব্বার জন্যে। খোলা আকাশের তলায় হুঁকা হাতে ওখানে বেশি সময় আব্বা বসে থাকবেন। প্রকৃতি অবলোকন করবেন, নদীর হাওয়া পান করবেন, ভাসমান জলস্রোতে বিছিয়ে দেবেন যেন ভেতরের অনন্ত উদাসীনতা।
নিজেকেই নিজে সম্ভোগ করবেন ভৈরবী রাগে, সংগীতশিল্পীর স্বভাবজাত রোমান্টিকতায়। তরুণ বয়সে আব্বা সরোদ বাজাতেন বলে জেনেছি, কিন্তু শুনিনি আমরা তার সেই বাজনার ধ্বনি। মাঝে মাঝে মাকে ডেকে বলবেন, শুনছ? শুনছ গো?
কবি রফিক আজাদ হাতের কলম ছুড়ে অস্ত্র হাতে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এই সেক্টরে। তার সহযোদ্ধা ছিলেন কবি বুলবুল খান মাহবুব, কবি মাহবুব সাদিক ও তার ছোটভাই আমার ঢাবির সহপাঠী কবি মাহবুব হাসানও।
মাসহ আমরা সব ছইয়ের তলায়। আখ খাওয়ার সময় আমাদের ডেকে নেবেন ছইয়ের বাইরে, তবে খুব সাবধানে। আমাদের বাড়ির ঘাট থেকে নৌকা যখন ছেড়ে দিলো, লগি থেকে নৌকার রশি যখন খসে পড়লো, তখন আমি নিষ্পলক তাকিয়ে আছি, আমাদের বাড়ির মুখপানে, প্রবেশ পথের ইন্দারার পাশে দাঁড়ানো ফুল-ফলভারে নত মায়াময় কামরাঙা গাছটি থেকে যেন দৃষ্টি ফেরাতে পারছি না। এই গাছটিকে ঘিরে কত শত বাল্যস্মৃতি, যা এক জীবনেও বলে শেষ হবে না। বুকের ভেতর হাতুড়িপেটার শব্দ হচ্ছে, টের পাচ্ছি, চোখ ছল ছল করছে, পরক্ষণেই ভাবছি, কাঁদবো কেন, সকাল-দুপুর যে কামরাঙা গাছে উঠে তার মেলে দেওয়া ডালে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে ছোটভাই সেলিমকে নিয়ে পাকা কামরাঙা খেতাম, এখনো তো সে আমার সঙ্গেই আছে। গাছটি কেবল একা রয়ে গেলো বাড়িতে।
আর সবাই তো আমার সঙ্গেই আছে। কাঁদবো কেন তবে? তবু কিছুতেই যেন বিষণ্নতা ছাড়ছে না আমাকে। মধ্যপথে যেতেই ঝড়ের কবলে পড়লো আমাদের নৌকা। মা সমানে দোয়া দরুদ পড়ছেন। বাতাসের বেগ যত বাড়ছে।
মাঝ দরিয়া থেকে নৌকা কূলের দিকে সরিয়ে বেঁধে রাখতে বললেন আব্বা। আধা ঘণ্টার মতো সময় আমন ধানের ক্ষেতের মধ্যে নৌকা বেঁধে রেখে সবাই খুব আতঙ্ক বুকে নিয়ে বসে থাকলাম। ঝড় থেমে গেলে পুনরায় সাঁই সাঁই করে নৌকা চলতে শুরু করলো। মির্জাপুরের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বংশাই নদী এবং দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে লৌহজং নদী।
সন্ধ্যা রাত পার করে বংশাই নদী তীরে প্রতিষ্ঠিত মির্জাপুর থানার লাগোয়া ঘাটে আমাদের বজরা নৌকাটি ভেড়ালো দু’জন মাঝি মিলে। থানার ঘাট থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটে পথের মোড়েই খালার বাসা। খালু ঘাটেই টর্চ হাতে অপেক্ষা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত পৌঁছলাম আমরা খালার বাড়িতে।
দুই.
টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে অন্যতম মির্জাপুর। এই উপজেলাকে বলা হয় উত্তরবঙ্গের দরোজা। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের যেকোনো উপজেলায় যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটি মির্জাপুরের ওপর দিয়ে চলে গেছে এঁকে-বেঁকে, দুরন্ত সাপের মতো। ঢাকা থেকে ৬৮ কিলোমিটার দূরে এবং টাঙ্গাইল সদর থেকে ২৭ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এই মির্জাপুরের মনোরম অবস্থান।
এই উপজেলার উত্তরে সখিপুর উপজেলা, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এখানে টাঙ্গাইল ১১ নম্বর সেক্টরে কাদেরিয়া বাহিনীর মূল কার্যক্রম পরিচালিত হতো। কবি রফিক আজাদ হাতের কলম ছুড়ে অস্ত্র হাতে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এই সেক্টরে। তার সহযোদ্ধা ছিলেন কবি বুলবুল খান মাহবুব, কবি মাহবুব সাদিক ও তার ছোটভাই আমার ঢাবির সহপাঠী কবি মাহবুব হাসানও।
আমার খাল যে থানায় কর্মরত ছিলেন, সেই প্রশাসন মির্জাপুর থানা গঠিত হয়েছিল ১৯১৩ সালে। এই থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮২ সালে, স্বাধীন বাংলাদেশে। প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নসম্পদ পাকুল্লার তিন গম্বুজবিশিষ্ট প্রাচীন মসজিদ, যা নির্মিত হয়েছিল ১৮ শতকে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মির্জাপুর উপজেলা ও মানিকগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়েছিল একই তারিখে, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। এই উপজেলায় মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৮৪০ জন। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্যে এই লড়াই করে বুকের রক্ত দিয়েছেন ৩৩জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। শিক্ষার দিক দিয়ে মির্জাপুর শুধু টাঙ্গাইল নয়, সমগ্র বাংলাদেশের অন্যতম উপজেলা।
এই উপজেলার সাক্ষরতার হার ৮৫%ও শিক্ষার হার ৮০%। উপজেলার গোড়াই ইউনিয়নের রাজাবাড়ী নামক স্থানে ১৯৬৫ সালে ৯৮ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে‘মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ’। দেশে বর্তমানে মোট ১২টি ক্যাডেট কলেজ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য ও বিশেষ অবদান রেখেচলেছে। বিশেষভাবে সামরিক শিক্ষার ক্ষেত্র-বিশেষে।
পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত ৪টির মধ্যে অন্যতম বৃহৎ মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজেটি ছিল ওই সময় তৃতীয় অবস্থানে। মির্জাপুরের অহঙ্কার এই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞানের দ্যুতিতে ভাস্বর করে তুলেছে এর দুর্জয় মাটি। আলোকিত করেছে আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। কলেজটিকে ঘিরে শাল-গজারের বনভূমি এবং সেই অপার সবুজের ভূ-নৈসর্গিক সৌন্দর্যও তুলনাহীন। এর পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ফুটজানি ও বারিন্দা নদীর মোহনা। নদীদুটি যেন দু’জন দু’জনাতে একাকার। এই কলেজ থেকে মির্জাপুর সদর থানার দূরত্ব মাত্র ৮ কি. মি.। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিখ্যাত সমাজসেবক ও দানবীর ব্যক্তিত্ব রনদাপ্রসাদ সাহা (১৮৯৬–১৯৭১) এই মাটিরই সন্তান। যিনি আর,পি,সাহা নামেই সমধিক পরিচিত। নিজের মেধা ও অধ্যবসায় গুণে দীনহীন দরিদ্র অবস্থা থেকে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে তিনি পৌঁছেছিলেন।
মনে হতো ছোট ভাই সেলিম আব্বার সঙ্গে যতটুকু সরাসরি বা উচ্চকণ্ঠে কথা বলার অধিকার রাখে, আমি মেয়ে বলে সে অধিকার নেই হয়তো। এভাবেই ভাবতাম আমি।
রণদাপ্রসাদ সাহা ১৯৩৮ সালে প্রথম মির্জাপুরে ২০ শয্যাবিশিষ্ট ‘কুমুদিনী ডিস্পেনসারি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৪ সালে সেটিই কুমুদিনী হাসপাতাল নামে পূর্ণতা লাভ করে। ১৯৪২ সালে তার প্রপিতামহী ভারতেশ্বরী দেবীর নামে ‘ভারতেশ্বরী বিদ্যাপীঠ’ স্থাপন করে ওই অঞ্চলে নারীশিক্ষার সুযোগ করে দেন, যা পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে ভারতেশ্বরী হোমস্-এ রূপলাভ করে। ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পিতার নামে মানিকগঞ্জ শহরে দেবেন্দ্র কলেজ স্থাপন করেন।
তিন.
আমি সেই সময়ে আর.পি. সাহার বিখ্যাত ভারতেশ্বরী হোমসে না পড়ে, থানা সংলগ্ন মির্জাপুর এস. কে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে কেন ভর্তি হয়েছিলাম, তারও কারণ ছিল। ওই সময়ে ভারতেশ্বরী হোমসে পড়তে চাইলে আমাকে ভর্তি হতে হবে ক্লাস থ্রিতে। এমনিতে কন্যা সন্তান ধেই ধেই করে বাড়ছি কেবল। আরও দুই ক্লাস পেছনে যাওয়ার পক্ষে কেউই নন, আমার খালুর মতানুসারে থানা সংলগ্ন স্কুলেই ভর্তি হলাম অভিভাবকদের সিদ্ধান্তে। সেই সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবশ্য আমি তো কেউ নই। তাছাড়া, এই শিক্ষা যাত্রার আগে বাড়িতেই আব্বা একদিন আমাকে আর সেলিমকে পাশাপাশি বসিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মা, তুমি কী পড়তে চাও? কতদূর পর্যন্ত পড়তে চাও?’
আমি চুপ করে বসেছিলাম, কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। কিশোরী মনের থরথর ভাবনায় হয়তো ভাবছিলাম, আমি মেয়ে, আমি চাইলেই কি হবে কিছু?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে, আমার ছোট ভাই সেলিম পাশ থেকে বলে উঠলো, বুবু, বল, বল। পড়বিই যদি তবে, বল, এম এ পর্যন্ত পড়বো। ছোট ভাই সেলিমের শেখানো কথাই তোতা পাখির মতো বলেছিলাম সেদিন।
সেদিন হয়তো আমার আব্বা তার কন্যার ভেতরের শক্তি ও উচ্চাশার মন্ত্রটা বুঝতে চেয়েই প্রশ্নটি করেছিলেন। তাৎক্ষণিক সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি কন্যা সন্তানের সাহসহীনতায়। হীনন্মন্যতায় হয়তো।
কিন্তু পুত্রী হিসেবে পিতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কি উপায় আছে আমার? সেদিনের প্রশ্নের উত্তর দিতে এক জীবন চলে গেলো। দুঃখ এই যে, কোনো অসতর্ক মুহূর্তে কিংবা মুখোমুখি বসে কোনো আত্যন্তিক আলাপচারিতার মহেন্দ্রক্ষণে তাকে কখনো বলাই হলো না—আব্বা, আমি আপনার মনের মতোই হতে চেয়েছিলাম, আপনার খুশির তরঙ্গ হয়ে ভাসতে চেয়েছিলাম আকাশ-বাতাস মথিত করে। চেয়েছিলাম আরও অনেক কিছু হতে।
জানি না, কতটুকু কী পেরেছি। তবে মুখে না বললেও আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থেই সে কথাটি বলেছিলাম ‘পিতার উদ্দেশে’ নামের কবিতায়।
আপনাদের সম্মিলিত ইচ্ছের মতোই
আমি হতে চাই সর্বাত্মক
কারু হাতে অনির্বাণ স্বর্ণদ্বীপ;
তবে যেদিন শুনেছিলাম আমার পিএইচডির খবর আব্বা তার গ্রামের নিরক্ষর প্রিয় জনগণের সঙ্গেও শেয়ার করেছেন। বলেছেন, শুনছো তোমরা, আমার মা দিলু, বিদ্যার ডাক্তার হচ্ছে, চিকিৎসার ডাক্তার না। বুঝলা কিছু?
-হ, মিয়াসাব, বুঝছি।
এই খবর শুনে আমারও মনে হয়েছিল, আমার এই সামান্য অর্জন পিতৃহৃদয়ে হয়তো অসামান্য এক দোলা দিয়েছিল। কন্যাসন্তানের পিতা হিসেবে নিশ্চয় সেদিন সামান্য সময়ের জন্যে হলেও সফল ভাবতে পেরেছিলেন নিজেকে। আদৌ পেরেছিলেন কি?
সে কথা তো জানা হলো না, জিজ্ঞেস করা হলো না, আব্বা, আপনি কি খুশি হয়েছেন? কেন যে এত হাইফেন ছিল আমাদের সেই সময়ের অন্তর্লীন কথায় ও জীবন যাপনে, পিতাকে বন্ধু ভাবার সুযোগই পাইনি। মা-বাবার বহুকাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তানের মৃত্যুর পরে কন্যা হয়ে জন্মেছিলাম বলে আজন্ম সেই অপরাধবোধে যেন কুঁকড়ে থেকেছি। চুপ থাকাই আমার ধর্ম বলে জেনেছি। হয়তো আমার মনগড়া। কিন্তু পুরো পরিবেশ থেকে এমনই এক বার্তা উঠে আসতো আমার মনের পর্দাজুড়ে। মনে হতো ছোট ভাই সেলিম আব্বার সঙ্গে যতটুকু সরাসরি বা উচ্চকণ্ঠে কথা বলার অধিকার রাখে, আমি মেয়ে বলে সে অধিকার নেই হয়তো। এভাবেই ভাবতাম আমি।
বন্ধুর মতো সরল রেখা টেনে কখনো কোনো কথা বলাই হলো না তাই জীবনের এই পর্বে। আব্বা আমার গবেষণার শুরুটা জানলেও শেষটুকু দেখে যেতে পারেননি। এই আফসোস রয়ে যাবে আমৃত্যু। তবে, অনুভবের শক্তি দিয়ে বুঝতে পারি আজ, আমার শিক্ষানুরাগী আব্বা হয়তো শেষাবধি আমার প্রতিই খুশি ছিলেন অধিক।
টিউমারটি বড় হতে হতে যখন ভেতরেই ব্লাস্ট হয়ে রক্তপাত ঘটাবে, তখন সব শেষ হবে। তখনই সে মারা যাবে। কাজেই বাবা-মাকে এটা মেনে নিতে হবে, এভাবে যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিনই তার আয়ু।
যা বলছিলাম, মির্জাপুরে যে খালার বাসায় থেকে লেখাপড়ার জন্যে মা-বাবা সঙ্গে নিয়ে এলেন, প্রথম রাত কাটালামও তাদের সঙ্গে।এই খালা ও তার পরিবারের সঙ্গে এই প্রথম পরিচয় আমার। অপরিচয়ের মেঘ কেটে কখন যে সূর্য উদিত হবে, কে জানে।
মায়ের মেজ বোন তিনি, নাম সাজেদা খান। ডাক নাম সাজি। তার অন্যান্য বোনের সন্তানেরা সাজি খালা ডাকতো, কিন্তু প্রথম দিনেই আমাকে জানানো হলো তাকে বড়মা ডাকতে হবে। যেহেতু তিনি আমার মায়ের বড়, কাজেই বড়মা ডাকটি তিনি শুনতে চাইলেন আমাদের মুখে।
এই বড় মার স্বামী, আমাদের খালু তখন মির্জাপুর থানার এসআই।।সপরিবারে থাকেন সেখানেই। তাদের একমাত্র পুত্র সন্তানের ডাকনাম পাশা। পাশা ভাইকে আমি প্রথম যখন দেখি, তার বয়স তখন আঠারো ছুঁই ছুঁই।
মাথায় ব্রেন টিউমারের ফলে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে বছর পাঁচেক যাবৎ সারাক্ষণ ঘরের বিছানায়ই বুদ্ধমূর্তির মতো বসে থেকেই তার অচঞ্চল সময় কাটে। চোখে দেখতে পেতো না কিন্তু অপরিচিত কেউ ঘরে প্রবেশ করলে ঠিক বুঝে যেতো। কে, কে বলে প্রশ্ন করে জানতে চাইতো। পাশা ভাই কথাবার্তা বলতো সুস্থ মানুষের মতো খুব স্পস্ট বাক্যে। মাঝে মধ্যেই একটি নজরুলগীতি গাইতো খুব কোমল কণ্ঠে—
এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি
খোদা তোমার মেহেরবানী।
শস্যশ্যামল ফসল ভরা
মাটির ডালিখানি
খোদা তোমার মেহেরবানী।
অনিরাময়যোগ্য তার এই রোগের কথা ভেবে ভেবে মন যখন খুব ভারাক্রান্ত হতো, তখন জনপ্রিয় সেই শ্যামাসংগীতটি নিজের মনেই গেয়ে উঠতো এক নিবিড় ধ্যানে। নীরবে ঝরে পড়তো তার চোখের যত জল।
মা…
আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল
সকলই ফুরায়ে যায় মা
জনমের সাধ ডাকি গো মা তোরে
কোলে তুলে নিতে আয় মা
সকলই ফুরায়ে যায় মা।
সন্তানের কণ্ঠে এই গান শুনে কোন মায়ের মন ভালো থাকতে পারে? তবু একমাত্র অসুস্থ সন্তানকে ঘিরেই তাদের দু’জনের সংসারের আনন্দ-বেদনা ও বিষাদ হাত ধরাধরি চলেছে একই সমান্তরালে।
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়, হঠাৎ একদিন স্কুলেই অজ্ঞান হয়ে বেঞ্চ থেকে গড়িয়ে পড়ে যায় মাটিতে। ধরাধরি করে পাশা ভাইকে নিয়ে আসে বাড়িতে। এরপর নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষার পরে জানা গেলো তার ব্রেনে বড় আকারের টিউমার আছে। যা অপারেশন করে নিরাময় সম্ভব নয়। অপারেশনের ঝুঁকি নিলেও বাঁচার আশা দশ ভাগের বেশি নয়।
প্রসঙ্গত, আগেও বলেছি, আমার এই খালু ছিলেন কবি জাহানারা আরজুর মামা। কবি জাহানারা আরজু ও বিচারপতি নূরুল ইসলাম দম্পতির সঙ্গে ডা. নন্দীর পরিবারের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
পাশা ভাইয়ের এই সংবাদে তারাও খুব বিচলিত হলেন। ডা. নন্দীকে দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলেন। তখন ডা. নন্দীর চেয়ে বড় এবং খ্যাতিমান চিকিৎসক কেউ ছিল না পূর্ব পাকিস্তানে। তিনিও একই অভিমত জানিয়ে বললেন, অপারেশনে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অপারেশন টেবিল থেকে নাও ফিরতে পারে।
কাজেই, টিউমারটি ব্লাস্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত আশা করা যায়, সে এভাবেই বেঁচে থাকবে। টিউমারটি বড় হতে হতে যখন ভেতরেই ব্লাস্ট হয়ে রক্তপাত ঘটাবে, তখন সব শেষ হবে। তখনই সে মারা যাবে। কাজেই বাবা-মাকে এটা মেনে নিতে হবে, এভাবে যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিনই তার আয়ু।
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-১০॥ দিলারা হাফিজ