(পর্ব-৮)
আজকের জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। ওই সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি বা বাংলা বিভাগের লাইব্রেরি নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। এ জন্য ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের তথ্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনা করতেন।
এ সব নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তার আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘বহে জলবতী ধারায়’। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘‘ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের তথ্য বিভাগের এই অফিসটি তখন ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউর (তৎকালীন জিন্নাহ এভিনিউ) কোনো এক ভবনের তিনতলার এক প্রশস্ত কামরায়। বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত বইয়ের পাশাপাশি গত ত্রিশ বছরের বাংলা বইয়ের এক অসাধারণ সংগ্রহ ছিল তাতে। মনের আছে বিকেলের পর বিকেল কী আত্মবিস্মৃতের মতো নানানরকম বইয়ের ভেতরে ডুবে থাকতাম সেখানে। কী উচ্ছ্বসিতভাবে আবদুল ওদুদের ‘কবিগুরু গ্যেটে’ বইটা মাত্র পাঁচ দিনে শেষ করে উঠেছি, তার ‘শ্বাশত বঙ্গ’ বইটায় চিন্তার নিজস্বতা দেখে অবাক হয়েছি। মনে পড়ে, এই লাইব্রেরিতে বসে জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির’র ব্যথিত শব্দগুলোর ওপরে কীভাবে মুগ্ধ হয়ে থেকেছি। এখনও মনে আছে সেই লাইন— ‘তোমার সৌন্দর্য চোখে নিয়ে আমি চলে যাবো পৃথিবীর থেকে’— আর আমার সেই অবাক হওয়ার অনুভূতি, কী করে এত সহজে ভেতরের বেদনাগুলোকে একজন কবি অন্যের মনের স্বপ্নের মতো জাগিয়ে দিতে পারেন। মনে আছে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ পড়ার সময় কী অচিন্ত্যনীয় মানসিক অভিঘাত; ‘রক্তকরবী’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘মালঞ্চ’ পড়ার বিস্ময়; বুদ্ধদেব বসুর ‘ভাসো আমার ভেলা’; সমর সেন, সুধীন্দ্রনাথ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো কতজনের কত কবিতা, কত গল্প-উপন্যাস হৃদয়কে জ্বলিত করে গিয়েছে— বাংলা সাহিত্যে ওইসব ঐশ্বর্যের খবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের লাইব্রেরি থেকে পাওয়ার সুযোগ ছিল না।’’
এরপর তিনি লিখেছেন, ‘বছর পাঁচ-ছয় আগে একটা বইয়ের খোঁজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠকক্ষে যেতে হয়েছিল। পাঠকক্ষের দুরবস্থা দেখে সত্যি সত্যি মায়া লাগলো। ঘরটাকে মনে হলো পুরোদস্তুর একটা ছাদ-খোলা রেস্টুরেন্ট। চেয়ারগুলো দখল করে ছাত্র-ছাত্রীরা বাজারের মতো আড্ডা জমিয়েছে। একটি ছাত্রও পড়ছে বলে মনে হয় না। হয়তো সম্ভবও নয় ওই পরিবেশে পড়া। আমাদের সময় কিন্তু এর চেহারা ছিল ঠিক উল্টো। লাইব্রেরি ছিল একটা নিঃশব্দ সমাহিত শব্দহীন জায়গা, প্রায় ধর্ম মন্দিরের মতো—যে পরিবেশের ভেতর তপস্যার মতো জ্ঞানসাধনাই কেবল সম্ভব।’
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বাবা ছিলেন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। বাড়িতে তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে ছিল বিশাল সংগ্রহ। বাবার লাইব্রেরি থেকেই সায়ীদের বই পড়ার শুরু। তিনি লিখেছেন, ‘‘শেক্সপিয়ার পড়ার পর আমার মন ইংরেজি কবিদার সৌন্দর্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আব্বার কাছে ইংরেজি কবিতার শ্রেষ্ঠ সংগ্রহ ‘গোল্ডেন ট্রেজারি’ ছিল। এছাড়াও ছিল গোটা দুই ভালো ইংরেজি কাব্যসংগ্রহ। এবার শুরু হলো সেগুলোর আনন্দে বুঁদ হওয়া।… ওজস্বী মিল্টন থেকে নিক্কনমুখর টেনিসন, মননভুক ড্রাইডেন বা পোপ থেকে প্রেরণাপ্রাণিত ব্লেক বা শেলি, গীতিমধুর বার্নস থেকে সংহত ব্রাউনিং আমাকে যেন কবিতার বিচিত্র মদির রহস্যময়তায় স্নাত করে গেলো। একে একে পড়ার সুযোগ হলো টমাস গ্রে, কোলরিজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বায়রন, রসেটি-এর মতো আরও বেশিকিছু কবির কবিতা, যা আববার লাইব্রেরি থেকে ঘেঁটে বের করে করতে পেরেছিলাম।’
কলকাতার লেখক ভবানীপ্রসাদ সাহু ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, বাংলা একাডেমি এবং শেষে গিয়েছিলন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে।
বাবার লাইব্রেরিতে বই পড়ার তৃপ্তি, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনে বই পড়ার অতৃপ্তি থেকে কিনা জানি না, ১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের উদ্যোগে যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের। গত ৪২ বছর ধরে আলোকিত মানুষের খোঁজে অব্যাহত রয়েছে তার পথচলা।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এখন কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এখন ‘আলোকিত মানুষ চাই’ দেশব্যাপী একটি আন্দোলন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘একটি ছোট্ট স্বপ্ন নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর পথ হাঁটতে হাঁটতে সে স্বপ্ন এক সময় বড় থেকে বিশাল হয়েছে। এখন আমরা যেখানে এসে পৌঁছেছি আমাদের স্বপ্ন তার চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। তার পেছনে এখন ছুটতে হবে। এ চলার কোনো শেষ নেই।’
কলকাতার লেখক ভবানীপ্রসাদ সাহু ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, বাংলা একাডেমি এবং শেষে গিয়েছিলন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে। কেন্দ্রের একটি ছোট্ট পুস্তক তালিকায় ভারতীয় সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিকদের নাম এবং কেন্দ্রে তাদের লেখা বই দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। দেশে ফিরে গিয়ে লিখলেন ‘দুই বাংলা, হায় ধর্ম!’, বইটি সে বছরই প্রকাশিত হয়। তাতে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বৈচিত্র্যময় লেখার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘‘পশ্চিম বাংলার লেখক-পাঠক ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে এসবগুলো লেখাই আনন্দের ও লজ্জার। আনন্দের, কারণ এ সবগুলো লেখাতেই—বিশেষত সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে, দেশ বিভাগপূর্ব বাংলার ও দেশ বিভাগ পরবর্তী পশ্চিম বাংলার সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকারদের যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত ও আলোচনা করা হয়েছে। লজ্জার, কারণ ‘দুই বাংলা, দুই বাংলা’ করে হেদিয়ে মরলেও পশ্চিম বাংলার প্রবন্ধকারেরা এমন মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের কবি-ঔপন্যাসিক-গল্পকার-চলচ্চিত্রকারদের আলেচনায় স্থান দেন না বললেই চলে। […] পশ্চিম বাংলার সত্যজিৎ, সুনীল, শংকরেরা বাংলাদেশের শিক্ষিত মানুষদের ঘরে ঘরে, কিন্তু বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদ-আবু ইসহাক-রশীদ করীম বা বশীর আল হেলালদের পশ্চিম বাংলায় খুঁজে পেতে গেলে লোহার চটিও ফুটো হয়ে যাবে।’’
‘মুসলিম নারীমুক্তি’ নামে এক নিবন্ধে বই পড়া নিয়ে সুফিয়া কামাল বলেছেন, ‘‘আমরা ছিলাম সম্ভ্রান্ত ঘরের পর্দাশীন মহিলা। তাই উর্দু, ফারসি পড়াই যথেষ্ট ছিল—বাংলা, ইংরেজি পড়া তো দূরের কথা। কিন্তু শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের মেয়ে হিসেবে আমি অনেক সুযোগ পেয়েছি। আমাদের বাড়িতে ইংরেজি, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুর চর্চা হতো। পড়াশোনা ও আলোচনা হতো। আর আমরা ছিলাম সাহিত্য বিষয়ে উৎসাহী। একইসঙ্গে ধর্মীয় পরিবেশ ছিল। আমাদের নামাজ-রোজাও করতে হতো।
আমাদের পরিবারে আমার আম্মাই আমাকে বাংলা শিখিয়েছেন। ওই সময় থেকে আমার সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের শুরু। জমিদার বাড়ি বলে আমাদের বাড়িতে পাইক-পেয়াদা থাকতো। ওরা সন্ধ্যাবেলা বেহালা বাজাতো, পুঁথি পড়তো। আর আমি দোতালায় বসে বসে পুঁথি শুনতাম।
কলকাতায় গিয়ে সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি আগ্রহ করে লেখা নিলেন ছাপাবার জন্য। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের বাড়িতে আসতেন। তিনি আমাকে লেখার জন্য উৎসাহ জোগাতেন। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম দিনে আমি একটি কবিতা লিখে পাঠাই। কবিতাটি পড়ে উৎসাহ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমাকে একটি চিঠি লেখেন। এরপর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি তার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যাই। বোরকা পরেই তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। সিঁড়ি দিয়ে যখন উঠছি তখন রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমাদের পরিবারে বোরকা ছিল। এখন আর নেই। এখনও তোমাদের পরিবারে আছে।’ তিনি আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিলেন।’’
উল্লেখ্য, সুফিয়া কামাল ১৯২৩ সালে রচনা করেন প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’, যা বরিশালের ‘তরুণ’পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আর তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ ছাপা হয় ১৯২৬ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সওগাত পত্রিকায়।
এদিকে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ‘বাঙালি মুসলমানের নবজাগৃতি’ নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘‘সওগাতে প্রথম থেকেই মহিলাদের ছবি ও লেখা ছাপা হতে থাকলে বিরোধী পক্ষের গাত্রদাহও দিগুণ বেড়ে যায়। এমনকি আমাকে মারের ভয় পর্যন্ত দেখানো হয়। আমারও জেদ চেপে যায়। সওগাতের ‘বিশেষ মহিলা সংখ্যা’ বের করার সিদ্ধান্ত নেই। এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া এস হোসেন আমাকে উৎসাহ ও সাহায্য করেন। কিন্তু মুশকিল বাধে ফটো নিয়ে। অনেকেই লেখা দিতে চাইলেও ফটো দিতে অস্বীকার করেন। বাধ্য হয়ে আমি আমার স্ত্রীর ফটো তুলি। এছাড়াও যাদের ছবি ছাপা হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন— বেগম সুফিয়া এন হোসেন এবং ফজিলাতুন্নেসা। এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া, সুফিয়া এন হোসেনের (সুফিয়া কামাল) স্বামী নেহাল হোসেনের অবদান ছিল যথেষ্ট।
কবি টেড হিউসের সঙ্গে কবি সিলভিয়া প্ল্যাথের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। আত্মহত্যা করেছিলেন টেড। আমৃত্যু বই এবং বইয়ের জগৎকে ভালোবেসে গেছেন তিনি।
মেয়েদের ছবি তোলা নিয়ে তখন ভীষণ বিতর্ক। আমার স্ত্রীর ছবি তোলা হলেও ভাবলাম আরও ছবি দরকার। সুফিয়ার কথা মনে হলো। তার বরিশালের বাড়িতে গেলাম। আমি সুফিয়ার স্বামী নেহালের কাছে (তার স্ত্রীর) ফটো তোলার কথা বলতেই তিনি বললেন, ‘আপনার হাতে ওকে সঁপে দিলাম।’ … সুফিয়াকে নিয়ে আমি ফটো তুলতে বেরিয়ে পড়লাম। আমি তখন যুবক এবং সুফিয়া যুবতী। কিন্তু নেহাল এ ব্যাপারে একটুও অস্বস্তি প্রকাশ করেননি। বেছে বেছে আমরা ‘শ্রীগৃহ স্টুডিও’তে ঢুকি। স্টুডিও’র মালিক হিন্দু ভদ্রলোকও আমাকে বললেন, ‘কী করতে এসেছেন? ঠ্যালা সামলাতে পারবেন তো?’ আমি ফটো তুলতে বললাম। এভাবে সওগাত মহিলা সংখ্যায় সুফিয়া এন হোসেনেরও ছবি ছাপা হয়।’’ (সূত্র: স্বরূপ অন্বেষা, সম্পাদনা: মাহফুজ উল্লাহ)
অরওয়েলের বিখ্যাত নিবন্ধ হচ্ছে, ‘আমি কেন লিখি’। এতে তার সাহিত্যচিন্তার প্রকাশ ঘটেছে সুস্পষ্টভাবে। অরওয়েল ঠিক কোন কারণে এই নিবন্ধটি লিখেছিলেন, সেটি না জানা গেলেও লক্ষণীয় যে, তিনি ‘আমি কেন লিখি’ রচনা করেছিলেন ১৯৪৬ সালে, মৃত্যুর চার বছর আগে। অর্থাৎ, ততদিনে তিনি ইউরোপের বেশ নামকরা লেখক। আত্মকথামূলক এই নিবন্ধে অরওয়েল জানিয়েছেন যে, তিনি মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লেখক হওয়ার। সেই বয়সে জীবনের প্রথম কবিতা রচনা করেছিলেন। এগারো বছর বয়সে নিজের প্রথম কবিতা প্রকাশ করেন পত্রিকায়। এগুলো জানাবার কারণ অরওয়েল মনে করেন যে, একজন লেখককে বুঝতে হলে তার শৈশবকাল ভালো করে জানা দরকার
‘আমি কেন লিখি’ নিবন্ধে অরওয়েল দাবি করেন, মোটামুটি চারটি কারণে লেখকরা লিখে থাকেন। প্রথমটি হচ্ছে নিছক অহমিকা, অর্থাৎ আমি লেখালেখি করতে পারি সেটি অন্যকে দেখানো। তবে, অরওয়েল এও মনে করেন যে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই অবস্থানটি কমতে থাকে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নান্দনিক কারণে। অর্থাৎ বাহ্যিক দুনিয়ার সৌন্দর্য দেখে লেখকরা বিমোহিত হয়ে যান, সেটিকে ভাষার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে তাদের মনে এক ধরনের তোলপাড় শুরু হয়। সেই তাড়না থেকে লেখকরা লিখে থাকেন। তৃতীয়টি হচ্ছে, ঐতিহাসিক অনুপ্রেরণা। অর্থাৎ যে সময়ের ভেতরে লেখকরা বসবাস করেন, সেই সময়টিকে ভবিষ্যতের জন্য লিপিবদ্ধ করে রাখতে চান, সময়ের দলিল হিসেবে। চতুর্থ কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক। যদিও ‘রাজনৈতিক’ শব্দটি অরওয়েল এখানে খুবই বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে বলেছেন। নিবন্ধে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ স্বীকারোক্তি প্রদান করেছেন, সেটি হচ্ছে: ‘কোনো গ্রন্থই সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত নয় এবয় শিল্পের সঙ্গে রাজনীতির কোনও লেনদেন নেই—এ ধরনের মতামতও আসলে একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।’
জর্জ অরওয়েল তার ছদ্মনাম। আসল নাম এরিখ আর্থার ব্লেয়ার। ১৯০২ সালে ভারতের উড়িষ্যা প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা ব্রিটিশ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে আফিম অধিদফতরে চাকরি করতেন। জন্মের পরই অরওয়েলের মা তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান শিক্ষা গ্রহণের জন্য। মজার বিষয় হচ্ছে, ১৯২২ সালে সেই এরিখ ব্লেয়ার বা জর্জ অরওয়েল মাত্র ২০ বছর বয়সে বার্মা পুলিশে চাকরি নিয়ে ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। আর ১৯২৭ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বার্মায় তার পাঁচ বছরের ভিন্ন অভিজ্ঞতা অরওয়েলকে এক জগৎ এবং এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় কারয়ে দেয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ঘৃণা করতে শুরু করেন অরওয়েল। বার্মার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি রচনা করেন উপন্যাস ‘বার্মিজ ডে’ ও ‘শ্যুটিং অ্যান এলিফেন্ট’-এর মতো আত্মজীবনীমূলক নিবন্ধ। বার্মা নিয়ে তারা সাহিত্যকর্মের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি মোহভঙ্গতা, অপরদিকে এক ধরনের রাজনৈতিক র্যাডিক্যালিজমের জন্ম হচ্ছে অরওয়েলের মনোজগৎ-জুড়ে। (এই উদ্ধৃতিটি অরওয়েল সম্পর্কে লেখক ও গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদ আল জায়িদের ‘ভিন্ন চোখে জর্জ অরওয়েল’ শীর্ষক নিবন্ধের চুম্বক অংশ)
কবি টেড হিউসের সঙ্গে কবি সিলভিয়া প্ল্যাথের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। আত্মহত্যা করেছিলেন টেড। আমৃত্যু বই এবং বইয়ের জগৎকে ভালোবেসে গেছেন তিনি। বইয়ের কাছ থেকেই লেখার প্রেরণা পেতেন, সে কথা ‘জার্নালস’ গ্রন্থে লিখে রেখে গেছেন এই রাজকবি।
পাদটীকা:
কোনো বই বা কোনো রচনার চুম্বক অংশের নোট রাখার অভ্যাস বা ধৈর্য আমার নেই। শুয়ে শুয়ে পড়া আমার অভ্যাস। হয়তো বইয়ের কোনো একটি লাইন বা অংশ ভালো লেগে গেলো, যেটা টুকে রাখা বা আন্ডারলাইন করে রাখার মতো। কিন্তু তখনই রাজ্যের সব আলসেমি এসে এমনভাবে ভর করে যে, নোট রাখা বা মার্কিংয়ের কাজটি আর করা হয় না। এছাড়া অনেক বই আছে, যা ধার করে পড়া। ফলে এই ধারাবাহিক লেখায় ব্যবহৃত অনেক উদ্ধৃতিই স্মৃতি-নির্ভর, সুনির্দিষ্ট রেফারেন্স উল্লেখ করা যাচ্ছে না বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
চলবে…