(পর্ব-৬.)
লেখক তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। সফল কোনো লেখার কারণে সংবর্ধনা, পদক, সম্মান সবই পেয়ে থাকেন। এ সবই লৌকিক। যাদের লেখা-ই একমাত্র পেশা, তাদের মাঝে খুব অল্প সংখ্যক লেখকের ভাগ্যে আর্থিক সফলতা ধরা দেয়। বেশিরভাগ লেখকেরই জীবনে বিত্ত-বৈভবের সুখ জোটে না। ক’জন পাঠকই-বা এ খোঁজ রাখেন যে, প্রিয় লেখকের ব্যক্তিগত জীবন-সংসারে আর্থিক অনটন-হতাশা নিত্যদিনের সঙ্গী। কেউ কেউ সাহিত্য জগতে ‘তারকা’খ্যাতি লাভ করেও মারা গেছেন চিকিৎসার অভাবে। এমন ঘটনা অনেক আছে।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’-এর স্রষ্টা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কথাই ধরা যাক। আজ থেকে ৬৫ বছর আগে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তিনি। ৪৮ বছর বয়সে রেখে গেছেন তার অমর সৃষ্টি—প্রায় ৪০টি উপন্যাস, ১৯২টি গল্প, একটি নাটক ও একটি কাব্যগ্রন্থ।
কবি শঙ্খ ঘোষের বয়স যখন ঊনিশ বছর, তখন একবার মানিকের বাড়িতে গিয়েছিলেন দেখা করার জন্য। ‘সময়ের জল ছবি’ গ্রন্থে শঙ্খ ঘোষ জানাচ্ছেন, ‘‘বসার ঘরে উপকরণহীন একটি চৌকি, একটি চেয়ার, একটি টেবিল—বইখাতা শূন্য।’ শঙ্খের মাথায় তখন প্রশ্ন—‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’—তার সঙ্গে এই ঘর! শঙ্খের মনে সন্দেহ হয়েছিল সত্যি তিনিই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি না? তাকে অপ্রস্তুত ও নীরব দেখে মানিক বলেছিলেন, ‘কী ভাবছেন? লেখকের ঘর এমন ফাঁকা কেন? আপনারা পাঠকরা কিছু দেন না, সেই জন্য ফাঁকা! পাঠকরা কেউ বই কিনবেন না, প্রকাশক বলবেন—বই বিক্রি হয় না, টাকাটা আসবে কোত্থেকে? লেখকের ঘরটা তাই এরকমই থাকবে। দুঃখ পেলে চলবে কেন?’’
শুধু মনে আছে, ইমার্জেন্সির টেবিলে পরীক্ষার পর যখন স্ট্রেচারে করে তাকে উডবার্নে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁ চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছিল।
মানিকের মৃত্যুর পর লেখক ও গুণীজনেরা পত্রপত্রিকার তার স্মরণে যেসব নিবন্ধ লিখেছেন, পরে তা নিয়ে ‘মানিক বিচিত্রা’ নামে একটি বই সম্পাদনা করেন বিশ্বনাথ দে। ওই বইয়ে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ‘‘ডিসেম্বর ২, ১৯৫৬। বোবার গানের মতো একটা কথা বারবার আমার মনে জান্তব আর্তনাদের আঁচড় কাটছিল—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মরে যাচ্ছেন। কী চিকিৎসা হয়েছিল, তার প্রমাণ পাচ্ছি টেবিলে ওষুধের শিশি ক’টা দেখে। কী পথ্যি তিনি পেয়েছেন, তার প্রমাণ মিলেছে বৌদির মুখের অসতর্ক একটি কথায়। মানিকবাবুর স্ত্রীকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় অভিযোগ করে বলছিলেন—‘এমন অবস্থা, আগে টেলিফোন করেননি কেন?’ উত্তরে তাকে হাসতে হয়েছিল! আর তারপর অস্ফুটে বলে ফেলেছিলেন—‘তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই।’’
দীপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘মিউনিসিপ্যালিটির ভাঙা অ্যাম্বুলেন্স এলো। যে মানুষটাকে খাট থেকে নামালে হার্ট ফেল করার সম্ভাবনা, তাকে এই গাড়িতে ‘নীলরতন সরকারি হাসপাতালে’ নিয়ে যেতে হবে। অর্থাভাবে ভালো গাড়ি আর মুরব্বির অভাবে বড় হাসপাতালের ব্যবস্থা করা যায়নি।…ডাক্তার বাবু একটা ইনজেকশন দিলেন। দেখলাম, হাতের ওপরে স্পিরিট মাখা তুলে ঘষতেই মানিক বাবু অল্প চোখ মেললেন। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। তাতে যেন কিছুটা ভয়, কিছু বেদনা। ধরাধরি করে তাকে স্ট্রেচারে তোলা হলো। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি ছাড়লো। মেঝেতে স্ট্রেচারের ওপরে তিনি শুয়ে। মাথার কাছে আমি। দরজার কাছে বেঞ্চির ওপরে বসে আছেন বৌদি ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ড্রাইভারকে আস্তে আর সাবধানে চালাতে বলা ছিল। অথচ গাড়িটা প্রায় বাতিলের পর্যায়ে পড়ে। রাস্তাও খারাপ। থেকে থেকে ঝাঁকুনি লাগছে। সবাই এক-একবার মানিকবাবুর মুখের দিতে তাকাচ্ছেন। তারপর ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন।’’
তিনি আরও বলছেন, ‘মৃত্যুর এত কাছে এর আগে আমি আসিনি। মানিক বাবুর কপালে কয়েকটা শিরা ফুলে উঠেছে। ডিসেম্বর মাসে ঝরঝর করে ঘামছেন। আমার কপালেও বিনিবিনি ঘাম। আবারও গাড়িটা ঝাঁকানি দিলো। তিনি নির্বাক। হাতটা আর নাড়াচ্ছেন না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত নিশ্চল হয়ে গেছে। গাড়ি ততক্ষণে বিটি রোডের মাঝামাঝি এসেছে। আমি পাগলের মতো হাতড়েও মানিক বাবুর সেই শিরাটি খুঁজে পেলাম না। ডাক্তার পালস দেখছেন। তারপর হাতল ঘুরিয়ে অক্সিজেনের সিলিন্ডারে চাপটা বাড়িয়ে দিলেন। গাড়ি যখন হাসপাতালে পৌঁছলো, মানিকবাবুর মুখও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি আর কথা বলেননি। শুধু মনে আছে, ইমার্জেন্সির টেবিলে পরীক্ষার পর যখন স্ট্রেচারে করে তাকে উডবার্নে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁ চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছিল। আর মনে আছে, উডবার্নের বারান্দায় একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী দেয়ালের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করছিলেন—‘দু’দিন আগে যদি আনা যেতো, তাহলে হয়তো মানুষটা বেঁচেও যেতে পারতেন।’’
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়তো এ কারণেই বলে গেছেন, ‘‘আমাদের বড় লোকেরা যদি অন্তত সামাজিক কর্তব্য হিসেবেও বই কেনেন, অর্থাৎ যাতে দেশের লেখকদের সাহায্য হয়—এমন চেষ্টা করেন, তাতে সাহিত্যের উন্নতিই হবে। লেখকরা উৎসাহ পাবেন, পেটে খেতে পাবেন, নিজেরা নানা বই পড়বার অবসর পাবেন। এর ফলে তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি হবে, তবে তো তারা ‘জ্ঞানগর্ভ’ বই লিখতে পারবেন।’’
আবু সয়ীদ আইয়ুব ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’ বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ সর্বদেশকালের সৎসাহিত্যে স্থান পাওয়ার যোগ্য।
আজীবন অর্থকষ্টে ভুগেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তাই বলে লেখালেখি বন্ধ রাখেননি। মৃত্যুর পর পাওয়া গেছে ট্রাংকভর্তি অনেকগুলো অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি। কবি শেষবার যখন হাসপাতালে ভর্তি হলেন, বিছানায় শুয়ে কন্যা মঞ্জুশ্রীর হাত ধরে কেঁদেছিলেন। শেষের দিকে স্ত্রী আর হাসপাতালে যাননি। মৃত্যুর সময়েও পাশে ছিলেন না। মৃত্যুর পর জীবনানন্দের লাশ বাড়িতে আনা হয়। স্ত্রী লাবণ্য দাশ কবির ভক্ত ভূমেন্দ্র গুহকে ডেকে বলেছিলেন—‘অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, সজনীকান্ত দাস এসেছেন, তাহলে তোমাদের দাদা নিশ্চয়ই বড়মাপের সাহিত্যিক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের জন্য তিনি অনেক কিছু রেখে গেলেন হয়তো। আমার জন্য কী রেখে গেলেন, বলো তো!’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন কৃত্তিবাসের তরুণ সম্পাদক। জীবনানন্দের লাশের খাটিয়া যারা কাঁধে করে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনিও ছিলেন তাদের একজন। কবির লাশ যখন পোড়ানো হচ্ছিল—সেদিনই জীবনে প্রথম সিগারেটে টান দেন সুনীল।
তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়ের বড় মেয়ে অসুস্থ, ঘরে টাকা নেই। ছুটে যান আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে, লেখার সম্মানী পঁচাত্তর টাকা পাওনা ছিল তার। লেখকের এই ঘোর বিপদের দিনেও আনন্দবাজার তাকে একটি টাকাও দেয়নি। ফেরার পথে মনের কষ্টে কেঁদেছিলেন তারাশংকর। এ নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘প্রকাশক, সম্পাদক কাগজের কর্ণধার যারা, তারা যেন এই নবীন লেখকদের মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেন। শুকনো মুখ, দৃষ্টির বেদনা—এ দু’টো চোখে পড়বেই। যদি এমন ক্ষেত্র হয় যে, লেখা পছন্দ নয়, তবু ফিরিয়ে দেবেন না। সে লেখা না নিয়েও তাকে সাহায্য করবেন। বলবেন, নতুন লেখা এনে দেবেন, তাতে তারা ঠকবেন না। বেদনাকাতর দৃষ্টি দেখলে লেখকদের সম্মান করে সহৃদয়তার সঙ্গে তাদের সাহায্য করবেন। লেখকরা বড় অভিমানী। তাদের আত্মমর্যাদাবোধ একটু বেশি প্রখর।’
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়তো এ কারণেই বলে গেছেন, ‘‘আমাদের বড় লোকেরা যদি অন্তত সামাজিক কর্তব্য হিসেবেও বই কেনেন, অর্থাৎ যাতে দেশের লেখকদের সাহায্য হয়—এমন চেষ্টা করেন, তাতে সাহিত্যের উন্নতিই হবে। লেখকরা উৎসাহ পাবেন, পেটে খেতে পাবেন, নিজেরা নানা বই পড়বার অবসর পাবেন। এর ফলে তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি হবে, তবে তো তারা ‘জ্ঞানগর্ভ’ বই লিখতে পারবেন।’’
অনেক উঁচু মানের লেখা রচনা করেও বেঁচে থাকতে সেসবের খ্যাতি ও সুনামের সৌভাগ্য হয় না অনেকের। অথচ মৃত্যুর পর সেই লেখককে নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। লেখার চর্চা হয়, লেখককে নিয়ে গবেষণা হয়। দুর্গতি যে কেবল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা জীবনানন্দ দাশের জীবনে ঘটেছে তা-ই নয়, এরকম উদাহরণ আরও আছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি প্রথম যে প্রকাশককে দিয়েছিলেন, তিনি সেটি হারিয়ে ফেলেন। আবারও স্মৃতির জগতে সাঁতার কেটে উপন্যাসটি দাঁড় করান তিনি। আংশিক ছাপা হয়েছিল মওলানা আকরাম খাঁ’র মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায়। তারপর দীর্ঘ আর্থিক অনটনের মাঝে টিবি রোগে ভুগে মারা যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস পারের সন্তান অদ্বৈত মল্লবর্মণ। মৃত্যুর পর বই আকারে প্রকাশিত হয় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। আজ কত সুনাম, কত আলোচনা লেখককে নিয়ে। মৃত্যুর আগে এসবের কিছুই দেখে যেতে পারেননি তিনি।
গত ছয় মাস ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী। এর আগে বাংলা একাডেমি পদকও পেয়েছেন তিনি। আমরা ঠিক জানি না, কতটা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন তিনি!
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস সম্পর্কে অধ্যাপক সুবোধ চৌধুরী বলেছেন, ‘‘আমি তিতাস দেখেছি। আমি সমুদ্র দেখেছি, পাহাড় দেখেছি। অনেক বিচিত্রতর মানুষের সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু অদৈত মল্লবর্মণের ছিল মানুষ সম্পরেক সুগভীর ইনসাইট, এমনটি আমাদের ছিল না। আমরা দেখেছি, দর্শকের মতো, ভালো হয়তো লেগেছে। তবে অদ্বৈত দেখেছেন শিল্পীর চোখে। তার সত্তার সঙ্গে তিতাস ছিল মিশে। এটা পৃথক করতে পারেননি তিনি, চানওনি। তার ওপরে ছিল উদার দৃষ্টিভঙ্গি। প্রথম যখন পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলেন, আমি বলেছিলাম—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ আর কি তোমার বই নেবে? অদ্বৈত বললেন—সুবোধ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বড় আর্টিস্ট, মাস্টার আর্টিস্ট কিন্তু বাওনের পোলা, রোমান্টিক। আর আমি তো ‘জাউয়ার পোলা’। আর কিছু বলেননি। পরিচয়ের এ প্রত্যক্ষতাই ছিল তার গৌরবের ভিত।’’
দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘যুবক বয়সেই অর্থাভাব মেটানোর জন্য লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি। প্রথমে ভাবলেন—জর্জ সাঁদ ও বালজাকের রচনা অনুবাদ করে নিজে ছাপাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হলো না প্রাথমিক অর্থের অভাবে। তারপর নিজের একটি ছোট উপন্যাস লিখলেন—সেটাকে নিজেই প্রকাশ করার পরিকল্পনা তার। এমনকি তার শুভানুধ্যায়ীরা যখন বলেছিল, নিজে প্রকাশ করার অনেক অসুবিধা, তার চেয়ে কোনো পত্রিকায় পাঠাতে। তখন তরুণ লেখক দস্তয়েভস্কি অহঙ্কার করে বলেছিলেন—আমি তো নাম কিংবা হাত-তালির জন্য লিখছি না। আমি লিখছি টাকার জন্য। বেশি টাকা পেতে চাই। এবারেও শেষ পর্যন্ত বই ছাপানোর মতো অর্থ পাওয়া গেলো না। সুতরাং, যেতেই হলো প্রকাশকের কাছে। সদ্য শেষ করেছেন সেই ছোট উপন্যাসটি, নাম ‘পুয়োর ফোক’। বইটি ছাপা হওয়ার পর প্রকাশক লেখককে আড়াইশো রুবল পারিশ্রমিক দিলেন। কেবল লেখক মহলেই নয়, সাধারণের পাঠকদের কাছেও ‘পুয়োর ফোক’ ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। খ্যাতি দস্তয়েভস্কিকে বিমুঢ় করেনি। একরাতে একটি গল্প শেষ করে পরদিন সকালে ত্রিশ রুবলে সেটা বিক্রি করেন, গল্পটির নাম—‘নয়টি অক্ষরে একটি উপন্যাস’। পরপর কয়েকটি গল্পের পর আবার উপন্যাস লিখলেন—‘দ্য ডবল’। সেই সঙ্গে লেখক হিসেবে দস্তয়েভস্কির স্থান দৃঢ় হয়ে গেলো।’’
আত্মজীবনীতে প্রখ্যাত অভিনেত্রী সোফিয়া লোরেন বলেছেন, ‘ছিলাম একেবারে গরিব, দিন-আনা দিন-খাওয়া ঘরের মেয়ে, কিংবা তার চেয়েও দুরবস্থার। ষোল বছর বয়সে মডেল এবং পরে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হওয়ার দৌলতে ভাগ্য খুলে যায়। কার্লোর (পরে তার স্বামী কার্লো পন্টি) কল্যাণে ও দয়ায় ছবিতে আসি।’ জাতিসংঘের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে তিনি ইথিওপিয়া, সোমালিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করেছিলেন। জার্মান প্রবাসী কবি দাউদ হায়দার এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘গরিব-দুঃখির পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে অসহায় ভেবেছেন?’ সোফিয়ার জবাব ছিল এরকম, ‘গরিব দুঃখির সঙ্গে একাত্ম হতে চাই। আমি জানি, দারিদ্র্য কী জিনিস, কাকে বলে। অভিনয় ছেড়ে এদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারলে সবচেয়ে সুখী হই। আমি তো ওদেরই একজন হতে পারতাম। ভাগ্যের ফেরে বিচ্ছিন্ন, এই বিচ্ছিন্নতায় এক ধরনের বিষাদও আছে।’
লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ সবদিক থেকে ছিলেন সফল। মৃত্যুর আগে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি। এতে অন্তত স্বজনদের আফসোসের পরিমাণটা কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। বাঁচাতে পারেননি, কিন্তু চেষ্টা তো করেছেন। গত ছয় মাস ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী। এর আগে বাংলা একাডেমি পদকও পেয়েছেন তিনি। আমরা ঠিক জানি না, কতটা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন তিনি!
চলবে…
আরও পড়ুন: বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব-৫॥ আনোয়ার পারভেজ হালিম