(পর্ব-৫)
আগের দিনের রাজনীতিকদের বই পড়ার অভ্যাসের কথা অনেকেরই জানা। তবে এর ব্যতিক্রম ছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি মহাত্মা গান্ধী নামে পরিচিত—তিনি পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তেমন একটা পড়াশোনা করতেন না। সে কথা তিনি নিজেই তার আত্মচরিত ‘আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ’গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন একবার গান্ধী জোহানেসবার্গ থেকে ট্রেনে নাতালে যাচ্ছিলেন। তাকে ট্রেনে তুলে দেওয়ার জন্য স্টেশনে গিয়েছিলেন ‘ক্রিটিক’ কাগজের সম্পাদক মি. পোলক। গান্ধীর হাতে একটি বই দিয়ে তিনি বললেন, ‘এই পুস্তক রাস্তায় পড়ার উপযুক্ত, ইহা পড়িয়া দেখিবেন, আপনার নিশ্চয় ভালো লাগিবে।’ গান্ধীর ভাষ্য—এই বলিয়া রাস্কিনের ‘আনটু দিস লাস্ট’ নামক বইখানা তিনি (মি. পোলক) আমার হাতে দিয়া গেলেন। পুস্তকখানা পড়িতে লইয়া দেখিলাম, উহা আর রাখিতে পারা যায় না। উহা আমার মনকে আকর্ষণ করিয়া রইল। জোহানেসবার্গ হইতে নাতাল ২৩ ঘণ্টার মতো রাস্তা। ট্রেন সন্ধ্যা বেলায় ডারবান পৌঁছিয়াছে। সেখানে পৌঁছিয়া সারারাত ঘুম আসিল না। পুস্তকের প্রদর্শিত আদর্শ কার্যত গ্রহণ করিবার জন্য কৃতনিশ্চয় হইলাম।
গান্ধী বলেন, ‘‘ইহার পূর্বে রাস্কিনের কোনো বই আমি পড়ি নাই। বিদ্যাভ্যাসকালে আমি পাঠ্যপুস্তকের বাহিরে কিছুই পড়ি নাই বলা যায়। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিবার পরও খুব কমই পড়িয়াছি। এমন কী আজও বলা যায় যে, আমার পুস্তকের জ্ঞান খুবই কম। এই অনায়াসলব্ধ বা বাধ্যতামূলক সংযম দ্বারা আমার ক্ষতি হয় নাই বলিয়াই আমি মনে করি। যে অল্পস্বল্প পুস্তক পড়িয়াছি, তাহা আমি ভালো রকম হৃদগত করিয়াছি এইকথা বলা যায়। এইসব পুস্তকের মধ্যে এই ‘আনটু দিস লাস্ট’ আমার জীবনে তখন-তখনই মহৎ পথ গ্রহণ করিবার মতো উপযুক্ত মানসিক পরিবর্তন আনিয়া দিয়াছিল। পরে আমি পুস্তকটির অনুবাদ করিয়া ছিলাম ও তাহার নাম দিয়াছিলাম ‘সর্বোদয়’। যে সব গভীর বিশ্বাস আমার হৃদয়ে নিহিত ছিল, এই পুস্তকটিতে তাহারই কতকগুলি প্রতিবিম্ব দেখিতে পাইয়া ছিলাম। সেজন্যই এই বইটি আমার উপর প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল এবং উহার নির্দেশ অনুযায়ী আচরণও আমাকে দিয়া করাইয়া লইয়াছিল।’’
গান্ধীর আত্মজীবনী গুজরাটি ও ইংরেজি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৭ সালের মার্চে। ১৯৯৬ সালে বইটি বাংলায় অনুবাদ করেন সতীশচন্দ্র দাসগুপ্ত। ঢাকায় প্রথম প্রকাশ করে চারদিক প্রকাশনী, ২০১২ সালে।
কোনো লেখক হঠাৎ করে লেখক হয়ে যাননি। লেখা শুরু করার আগে তারা নিয়মিত বই পড়েছেন এবং লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও অনেকে এ অভ্যাস ধরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। রাজনৈতিক সাহিত্যের লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।
সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ার সময়ই বোধ করলাম যে, মুসলমানদের লেখা বই-পুস্তক, পত্রপত্রিকা একেবারেই কম। অঙ্গুলিমেয়ও নয। আমাদের ক্লাসে একটু অবস্থাপন্ন ঘরের একটা হিন্দু ছেলে ছিল। সে প্রায়ই কলকাতা থেকে বই, পত্র-পত্রিকা—এই সব আনতো। সেগুলো নিয়ে সে ক্লাসে আসতো। সে যে অনেক পত্রপত্রিকা আর বইয়ের মারিক—এই রকম একটা মনোভাব দেখাতো। আমি তার কাছে একবার একটা ছোটদের মাসিক পত্রিকা পড়তে চেয়েছিলাম। সে দেয়নি। উপরন্তু অপমানজনক একটা উক্তি করেছিল। বলেছিল, তোদের মুসলমানদের কী আছে! আমার এসব নিযে টানাটানি করিস কেন?’
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বলেন, ‘‘আমাদের লাইব্রেরিয়ান আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমি একদিন তাকে গিয়ে বললাম, স্যার, আমাদের মুসলমানদের লেখা কোনো গল্প-উপন্যাসের বই কিংবা পত্রিকা কিছুই কি নেই? জবাবে তিনি বললেন, বাবা, তোমাদের যদি কিছু থাকতো, তবে আমরা জানতাম। স্কুলপাঠ্য কোনও বইয়েও মুসলমানদের লেখা আমাদের নজরে পড়ে না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সেদিন মনে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। এত বড় একটা জাতি, এত বড় একটা সমাজ, তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে, অথচ তাদের বাংলা কোনও পত্রপত্রিকা নেই! এ নিযে ভাবতে গিয়ে মনটা ভয়ানক খারাপ হয়ে গেলো। মাথায় কেবলই ঘুরপাক খেত ব্যাপারটা। ওই বয়সেই ছবির বই কিংবা পত্রপত্রিকা প্রকাশ করার স্বপ্ন দেখতাম। রাতে ঘুম হতো না। আমাদের লাইব্রেরিতে সাধারণভাবে ইংরেজি বই, ঈশপোর উপকথা জাতীয় বই দেখেছি। তাতে ছবিটবি ছিল। বিলাতি বই তো! এমন সুন্দরভাবে বাঁধাই করা ছিল যে, দেখে চোখ জুড়িয়ে যেতো। পড়ে অনেক সময় সব বুঝতাম না। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে ছবিটবি দেখতাম। খুবই উঁচুমানের বই ছিল সব। আমি ছোটদের বইই বেশি পড়তাম। যেমন ডা. আবুল হোসেনের ‘যমজ ভগিনী কাব্য’ বলে একটা বইযের নাম করতে পারি। ওটা তো মাইকেল ঢংয়ের ভাষায় লেখা ছিল। বেশ মোটা কলেবরের যে ছিল, আমার এখনও বেশ মনে আছে। আরম্ভটা ছিল এরকম: ‘কুক্ষণে রে কাপুরুষম কৃষ্ণ দাস তুই গিয়েছিলি কলিকাতা লযেছিলি ইংরেজদের আশ্রমে আশ্রয়।’ সিরাজউদ্দৌলার শাসনের সময় ইংরেজদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়েই বই লেখা। আসরে ওই সময় অনেক বই পড়েছি। কিন্তু তেমন বুঝতাম না। যেমন মাইকেলের লেখা বুঝতাম না্ তার ‘মেঘনাথবধ কাব্য’ বুঝতাম না। কিন্তু না বুঝেও যেটুকু পড়তাম, ভালো লাগতো।’’
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের লেখা একটি বইয়ের নাম ‘বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ’। তিনি লিখেছেন, ‘এ বইয়ে সেকালে যারা লেখক-লেখিকা ছিলেন, তখন তারা কিভাবে কোন পরিবেশ থেকে লিখতেন, সে কথাও আছে। বইটা এসব কিছুরই সংকলন এবং আমার নিজেরও কিছু কথা আছে তাতে। এভাবেই শেষ করেছি বইটি।’
শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম, কোনো লেখক হঠাৎ করে লেখক হয়ে যাননি। লেখা শুরু করার আগে তারা নিয়মিত বই পড়েছেন এবং লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও অনেকে এ অভ্যাস ধরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। রাজনৈতিক সাহিত্যের লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। ‘এই দেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল’ গ্রন্থে তার আভাস পাওয়া যায়—‘‘জগন্নাথ হলে ছাত্রলীগের একটা নবাগত সংবর্ধনা সভায় আমি গেলাম। সভার প্রধান অতিথি আমার মূল আর্কষণ। তার নাম অনেক শুনেছি। এবার সুযোগ হবে দেখার। প্রধান অতিথি ছিলেন ত্রৈলোকনাথ চক্রবর্তী। তিনি মহারাজ নামেই পরিচিত ছিলেন। তার লেখা ‘জেলে ত্রিশ বছর’ বইটি নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও পাওয়া যেতো। বইটি পড়ে ‘অগ্নিযুগের’ বাংলার বিপ্লবী যুগের আন্দোলনের ইতিহাস অনেকটা জানা যায়। এভাবেই আমি বাঘা মতিন, অরবিন্দ ঘোষ, ক্ষুদিরাম আর সূর্য সেনকে চিনলাম। (…) এ সময় বাজারে চে গুয়েভারার দুটো বই আসে। ‘রেমিনিসেন্স অব দ্য কিউবান রেভল্যুশনারি ওয়ার’ এবং ‘গেরিলা ওয়ারফেরার’। একইসঙ্গে পাওয়া যাচ্ছিল রেজি দেব্রের ‘রেভল্যুশন ই দ্য রেভল্যুশন’। আমাদের তরুণ মনে এই বইগুলোর প্রভাব ছিল বেশ জোরালো। আমার কল্পনার জগতে তখন শুধু চে। তার অনুকরণে অনেকেই দাড়ি রাখা শুরু করে। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। কারণ তখনো দাড়ি গজায়নি। কিন্তু কল্পনার হাওয়ায় ডানা মেলে দিতে কোনো অসুবিধা নেই…।’’
কথাশিল্পী ইসহাক খানের মন্তব্য, ‘লেখাটি ভালো লেগেছে। লেখাটির দুটো দিক, নিবন্ধ ও স্মৃতিকথা। এই ধরনের লেখা বেশি বেশি লেখা এবং পঠিত হওয়া উচিত।’
মহিউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘‘ছাত্রলীগের লীগের ছেলেদের মধ্যে, বিশেষ করে যাদের বলা হতো ‘লাইনের লোক’, তাদের মধ্যে গতানুগতিকতার বাইরে বউপড়ার একটা আগ্রহ তৈরি হয়। এ সময় আমি বদরুদ্দীন উমরের তিনটি বই পড়ি: ‘সংস্কৃতি’, ‘সাম্প্রদায়িকতা’ এবং ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’। এই বইগুলো আমার মধ্যে সেক্যুলারিজমের ধারণার বিস্তার ঘটাতে অনেক সাহায্য করে। বদরুদ্দীন উমরের বইগুলো ছাত্রলগের অনেক ছেলেমেয়ের কাছেই ছিল একটু বেশি রকম প্রথাবিরোধী। এ ধরনের মুক্ত দর্শন ও প্রগতিবাদী কথাবার্তা ছিল অনকটা উচ্চমার্গের। ছাত্রলীগের কেউ কেউ বলতো, বদরুদ্দীন উমরের সেক্যুলারিজম হরো প্রো-জিন্দু সেক্যুলারিজম।… হিটলারের ‘মাইন ক্যাম্প’ বইটাও তখন বাজারে ছিল। আফতাবের হাতে বইটা দেখলাম। তিনি এবং আরও কয়েকজনকে দেখতাম, একটা হাত সামনে তুলে অ্যাটেনশন হয়ে হৃংকার দিচ্ছে—হাইল হিটলার! জার্মানির পতিত নায়ক অ্যাডলফ হিটলারকে একজন জাতীয়তাবাদী বীর হিসেবে দেখতেন কেউ কেউ। (…) এরপর বাজারে আসে শৈলেন দে’র আমি ‘সুভাষ বলছি’ বইটির প্রথম খণ্ড। সুভাষ তখন আমাদের হিরো। ভারতের কুমউনিস্ট পার্টি সুভাষ বসুর কড়া সমাললোচক ছিল বরে আমরা কমিউনিস্টদের ওপর খুব চটা ছিলাম। আমরা অনেকেই বলতাম, ‘আমাদের সুভাষ শেখ মুজিব।’(…) ধীরেন দত্তের ছেলে সুবল আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়। তার আইডল সুভাষ বসু। সুবল একটা দল করে, প্রাউটিস্ট ফোরাম অব ইন্ডিয়া। সুবলের কাছে ‘আমি সুভাষ বলছি’-এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড ছিল। গোগ্রাসে পড়ি। ’’
সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো বই পড়া লোক ক’জনই বা অছেন! ঘরের বাইরে বের হওয়াকে সময়ের অপচয় বলে মনে করতেন তিনি। এমনকি যখন তিনি রোগ শয্যায় তখনো বই পড়ে সময় কাটাতেন। বাইরের লোকজনের সান্নিধ্যও এড়িয়ে চলতেন। কেউ দেখা করতে এলে নিজেই উচ্চ কণ্ঠে বলতেন, ‘বলে দাও, মুজতবা আলী বাসায় নেই।’
বই পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘যে বইগুলো পড়ে আমার ভালো লেগেছে, সেই বইগুলো আরেকবার পড়ে যেতে চাই। তাছাড়া আমার না-পড়া কত ভালো বই যে রয়ে গেলো, তা ভাবলে খুব খারাপ লাগে।’
পাদটীকা:
কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ মাহফুজ পারভেজ ‘বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব’পাঠ শেষে তার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘‘বই পড়ার সঙ্গে জ্ঞানের সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও অপরিসীম । বই পড়লে মানুষের জ্ঞানের দ্যুতি বাড়ে । আমাদের জীবসত্তা জাগ্রত থাকলেও মানবসত্তা জাগ্রত করার সিঁড়ি বই। মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষ বই পড়লেও সবার জ্ঞানের দ্যুতি ও মানবসত্তার বিকাশ সমান হয়, তা বলা যাবে না। এজন্য ‘জীবন্ত পাঠক’ হতে হয়, ‘বিটুইন দ্য লাইন’ পড়তে হয়, ‘অন্বেষার তৃষ্ণা’ বুকে ধারণ করতে হয়। আপনার লেখাগুলো পাঠকদের ‘জীবন্ত পাঠে’র দীক্ষা দেবে। পাঠের পরিধি, গভীরতা ও বহুমাত্রিকতা বাড়াতে সাহায্য করবে। আপনার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মতোই পাঠের অনুসন্ধিৎসা অনেককেই আরও গভীর ও নিমগ্ন পাঠে আকৃষ্ট করবে। যা, জ্ঞানের দ্যুতি ও মানবসত্তা বিকাশেও প্রণোদনা জাগাবে।’’
কথাশিল্পী ইসহাক খানের মন্তব্য, ‘লেখাটি ভালো লেগেছে। লেখাটির দুটো দিক, নিবন্ধ ও স্মৃতিকথা। এই ধরনের লেখা বেশি বেশি লেখা এবং পঠিত হওয়া উচিত।’
চলবে…
আরও পড়ুন: বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব-৪॥ আনোয়ার পারভেজ হালিম