(পর্ব-০৩)
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক থাকতেন শহীদ মিনারের উল্টোদিকে শিক্ষক কোয়ার্টারে নিচতলার ফ্ল্যাটে। আহমদ ছফা যেদিন তার বাসায় প্রথম গিয়েছিলেন এবং তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, সেই দিনের বর্ণনা খানিকটা তুলে ধরছি, ছফা বলেছেন, ‘ঘরটির পরিসর বিশেষ বড় নয়। চারদিক বইপুস্তকে ঠাসা। ঘরটিতে একটি মাত্র খাট, না, খাট বলা ঠিক হবে না, চৌকি। সামনে একটি ছোট টেবিল। চৌকিটির আবার একটি পায়া নেই। সেই জায়গায় বইয়ের ওপরে বই রেখে ফাঁকটুকু ভরাট করা হয়েছে। চমৎকার ব্যবস্থা। পুরনো বইপত্রের আলাদা একটা গন্ধ আছে। আমি সেই বইপত্রের জঞ্জালে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।’
সেই যে শুরু এরপর অধ্যাপক রাজ্জাকের সঙ্গে আহমদ ছফার সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা ছিল কমবেশি ৩০ বছরের, রাজ্জাকের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এই তিন দশকজুড়ে অধ্যাপক রাজ্জাকের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা থেকে অনেক দুর্লভ বই এনে পড়েছেন ছফা। পড়া শেষে তিনি যতবারই বই ফেরত দিতে গিয়েছেন, ততবারই রাজ্জাক বলতেন, ‘মৌলবি আহমদ ছফা, বই তো পড়েন ফেরতও দেন, দরকারি নোট রাখছেননি। রাইখেন কাজে দেবে।’ মাঝে মাঝে রাজ্জাক এও বলতেন, এই কাজটি নাকি অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান খুব গুছিয়ে করেন। এজন্যই তিনি আনিসুজ্জামানকে পছন্দ করেন। রাজ্জাকের এ কথা শুনে বিবর্ণ মুখে ছফা চুপ করে থাকতেন। কারণ, যত বই নিয়েছেন ও পড়েছেন কোনোটারই নোট রাখেননি। নোট রাখার বিষয়ে তিনি মোটেও অভ্যস্থ নন।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ড. হুমায়ুন আজাদ। ছাপা হয়েছিল সাপ্তাহিক রোববারে, ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে। পরে সেটি অধ্যাপক আজাদের একটি বইয়ে গ্রন্থিত হয়। সেখানে বইপড়া নিয়ে এই দুই গুণী অধ্যাপকের মাঝে নিম্নরূপ কথোপকথন হয়।
হুমায়ুন আজাদ: পড়াশুনার আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করেন কখন থেকে?
আবদুর রাজ্জাক: গ্রামের স্কুলে পড়ার সময়ই। তখন বোধ হয় ফাইভে পড়ি, বই পড়তে খুব ভালো লাগতে শুরু করে।
হুমায়ুন আজাদ: কী বই পড়তেন?
আবদুর রাজ্জাক: গল্পের। একটা বইয়ের নাম এখনো মনে আছে। বইটা পাঁকড়ি দে’র ‘মনোরমার হত্যাকারী কে?’
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র তখন তিনি থাকতেন পিতার কর্মস্থল হুগলিতে। পড়তেন শ্রীরামপুর ইউনিয়ন হাইস্কুলে। ওই সময় নিয়মিত পড়তেন ফরোয়ার্ড, নায়ক, কল্লোল, শনিবারের চিঠি ও কালিকলম ইত্যাদি পত্রিকা। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন শুরু হতে না হতেই একজন তাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন জ্ঞানের জগতে। একদিন তিনি পাঠাগারের বইয়ের আলমারিগুলোর একটু দূরে ঘুর ঘুর করছিলেন। যেখানে সারি সারি বইভরা আলমারি, সেখানে ঢোকার অধিকার ছিল না ছাত্রদের। তিনি তাকিয়ে দেখছিলেন বইয়ের আলমারিগুলো। বুড়ো লোকটি, যিনি ভেতর থেকে বই এনে দিতেন, তিনি জ্ঞানার্থী আবদুর রাজ্জাকের দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকান এবং প্রশ্ন করেন, কী চাও?
ধর্ম ও ঈশ্বরের জায়গা দখল করে নিলো বই। তিনি ভাবতেন,যতদিন বই আছে, তত দিন জীবনের সুখ হাতের মুঠোয়। সার্ত্রের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, চিরকুমারী এবং হোটেলবাসিনী সিমোন এসব কথা লিখেছেন তার আত্মজীবনী ‘মেমোরিয়াস অব এ ডিউটিফল ডটার’ গ্রন্থে।
বই পড়তে চাই। উত্তর দেন তরুণ ছাত্র আবদুর রাজ্জাক।
বেশ দয়ালু কণ্ঠে বুড়ো জানতে চান, ভেতরে ঢুইক্কা বই দেখতে চাও?
হু, ঢুকতে দিলে তো ভেতরে যাই। উত্তর দেন রাজ্জাক।
বুড়ো লোকটি তাকে নিয়ে যান ভেতরে। সেখানে শুধু বই আর বই।
একটা বই দেখতে দেখতে আরেকটার দিকে চোখ পড়ে। সেটা দেখতে দেখতে চোখ পড়ে আরেকটার দিকে। কয়েক ঘণ্টা জ্ঞানের গুপ্তকক্ষে পাগলের মতো কেটে যায় তার সময়। চারদিকে ছড়িয়ে আছে সোনা। তারপর নিয়মিত ঢুকতেন ওই গুপ্তধনের কক্ষে। পৃথিবী ও পাঠ্যসূচি ভুলে পড়তেন বই আর বই।
রাজ্জাকের জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছিল বিলেতে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। ১৯৪৫-৫০ সালে ওই পাঠাগারে অভিযাত্রী বেশি যেতো না। কিন্তু নিয়মিত যেতেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। বুড়ো পোর্টার দুজন তাকে নিয়ে যান বই রাখার কক্ষে, জ্বেলে দেন ফায়ার-প্লে, তিনি জ্ঞানের তাপে তপ্ত হতে থাকেন।
সাক্ষাৎকারের আরেক জায়গায় রাজ্জাক স্যারকে প্রশ্ন করেন হুমায়ুন আজাদ: আজকাল কী ধরনের বই পড়েন?
আবদুর রাজ্জাক: ফ্রান্সে এক ধরনের নতুন ইতিহাস লেখা হচ্ছে। খুব চমৎকার। তার কয়েকটা দেখছি।
হুমায়ুন আজাদ: জীবন যাপন আপনার কাছে বেশি আনন্দদায়ক, নাকি বই পড়া বেশি আনন্দদায়ক?
আবদুর রাজ্জাক: জীবনযাপন করার মধ্যেই আছে ওই বই পড়াটা। বই ছাড়া জীবন অকল্পনীয়।
হুমায়ুন আজাদ: বইপড়ার মধ্যে সুখটা কোথায়?
আব্দুর রাজ্জাক: হা হা হা, আপনি তা একটু বেশি করেই জানেন।
এরপর অধ্যাপক রাজ্জাক বলেন, ‘যে দেশে বইয়ের দোকান নেই সেদেশে লেখাপড়া খুব হয় তা বিশ্বাস করি না। বইয়ের দোকানে গিয়ে কী ধরনের বই পাওয়া যায়, কেমন বিক্রি হয়, তা দেখেই দেশটির জ্ঞান চর্চার বিষয়টি বোঝা যায়। একবার তুরস্কে গিয়েছিলাম। সেখানে বইয়ের দোকান অজস্র, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের বই প্রচুর পাওয়া যায়। সেখানকার দোকানে শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা বই কমিউনিজম সম্পর্কে, শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা ইসলাম সম্পর্কে। সুতরাং, ওই দেশে যে টেনশন থাকবে তা বোঝার জন্য হাফেজ হওয়ার দরকার নেই।’
রাজ্জাককে এই সময়ের জ্ঞানতাপস বলে অভিহিত করেছেন হুমায়ুন আজাদ। তিনি আরও বলেছেন, মোটা মোটা বই লিখেননি, অলঙ্কৃত করেননি জ্যোতির্ময় বিভিন্ন আসন, এমনকি নিজের নামে সঙ্গে তিন অক্ষরের একটি উপাধিও যুক্ত করেননি তিনি। তবু তিনিই হয়ে উঠেছেন আমাদের সাম্প্রতিক জ্ঞানজগতের কিংবদন্তি। এর মূলে আছে সম্ভবত দুটি সহজ কিন্তু অসাধারণ কারণ—প্রাচীন ঋষিদের মতো তিনি নিজের দীর্ঘ ও সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন জ্ঞান আহরণে, এবং ঋষিদের মতোই তিনি অবলীলায় অবহেলা করে গেছেন পার্থিব সাফল্য। জ্ঞানের জন্য এমন তপস্যা-জীবন, সংসার, সাফল্যের কথা ভুলে থাকা—এখন দুর্লভ ব্যাপার, আর তা-ই রূপ লাভ করতে দেখি জাতীয় অধ্যাপক রাজ্জাকের মধ্যে। শুধুই জ্ঞানের জন্য সব ত্যাগ করে তিনি হয়ে উঠেছেন এই সময়ের জ্ঞানতাপস।
হুমায়ুন আজাদের বিখ্যাত নারী গ্রন্থটি শুরুতে সাপ্তাহিক পূর্বাভাসে ধারাবাহিক ছাপা হতো। পরে যখন বই আকারে বের হলো সরকার সেটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নারী লেখার আগে প্রস্তুতি হিসেবে লেখককে একটানা ছয় মাস প্রচুর বই পড়তে হয়েছে। এ নিয়ে ‘যেভাবে লেখা হলো নারী’ নামে এক নিবন্ধে হুমায়ুন আজাদ বলছেন, ‘‘একটির পর একটি বই পড়তে থাকি নারীবাদীদের—সিমোন দ্য বোভোয়ারের মহাগ্রন্থ ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ পড়তে গিয়ে দেখি, জ্ঞান প্রজ্ঞা বিশ্লেষণ ও শিল্পকলার অসামান্য রূপ বইটি, যা বাংলা ভাষায় কখনো হবে না। কয়েক মাসে আমি আনন্দে উল্লাসে প’ড়ে উঠি বিপুলসংখ্যক বই, সম্ভবত চল্লিশ হাজার পাতা এবং আমার মনে হয় আমি প্রস্তুত, এখন একটি বই লিখতে পারি, যে বই এরআগে বাংলায় লেখা হয়নি। আমি পড়তে থাকি এবং লিখতে থাকি, রচিত হয়ে উঠতে থাকে ‘নারী’। নারী লেখা হচ্ছে বিপুলসংখ্যক বই পড়ার ফল।’’
হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ আমার সংগ্রহে আছে। বইটির নিষেধাজ্ঞা আজও বহাল রয়েছে। পাঠকের কথা চিন্তা করে হুমায়ুন আজাদ পরে সিমোন দ্য বোভোয়ারের ‘সেকেন্ড সেক্স’ বইটি ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ নামে অনুবাদ করেছিলেন। ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ কিনেছিলাম ২০০২ সালে, লেখক বইটিতে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। সিমোন সম্পর্কে লেখকের ভাষ্য, ‘‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী—নারী সম্পর্কে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও স্মরণীয়তম এ মন্তব্যটি সিমোন দ্য বোভোয়ারের, যিনি শুধু বিশ শতকের নয়, চিরকালের শ্রেষ্ঠ নারীদের, অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন। ফরাসি ঔপন্যাসিক, দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক সিমোন দ্য বোভেয়ারের মহত্তম গ্রন্থ ‘ল্য দজিয়েম সেক্স’, ইংরেজিতে যা বিশ্বখ্যাত ‘দি সেকেন্ড সেক্স’ নামে, বাংলায় ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’।’’
অধ্যাপক আজাদ সিমন দ্য বোভোয়ার সম্পর্কে যে বিষয়টি উল্লেখ করেননি, সেটি হলো—ছোটবেলা থেকে বই ছিল সিমনের সঙ্গী। তাই বলে সব ধরনের বই পড়ার অনুমতি পেতেন না। কারণ, তার মা ছিলেন খুবই ধার্মিক। বইয়ের যেসব পৃষ্ঠা অবাঞ্ছিত মনে হতো মা সেগুলো সেপটিপিন দিয়ে আটকে দিতেন। সিমোন কোনোদিন সেসব পৃষ্ঠা খুলে দেখেননি। মায়ের কারণে ছোটবেলা থেকে সিমোন ছিলেন ধর্মভীরু। তবে বই পড়া ছাড়েননি। একে একে ফরাসি আর ইংরেজি সাহিত্যের সেরা বইগুলো সব পড়ে ফেললেন এবং ধীরে ধীরে ধর্মের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। ধর্ম ও ঈশ্বরের জায়গা দখল করে নিলো বই। তিনি ভাবতেন,যতদিন বই আছে, তত দিন জীবনের সুখ হাতের মুঠোয়। সার্ত্রের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, চিরকুমারী এবং হোটেলবাসিনী সিমোন এসব কথা লিখেছেন তার আত্মজীবনী ‘মেমোরিয়াস অব এ ডিউটিফল ডটার’ গ্রন্থে।
(চলবে)
বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব-২॥ আনোয়ার পারভেজ হালিম