পর্ব-২০
বিপ্লবী রবি নিয়োগী ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে হালের স্বৈরাচার এরশাদ সরকার পর্যন্ত জীবনের ৩৪টি বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি আমৃত্যু কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে তাঁকে আন্দামানেও নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘রাজশাহী জেল থেকেই আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো আন্দামান জেলে। ১৯৩৩ সালে আমরা ওই জেলে কমিউনিস্ট কাউন্সিল গঠন করলাম। অনিল মুখার্জি, বক্রেশ্বর রায়, পরে এলো খোকা রায়— এরা সবাই এতে যোগ দিলো। ইংরেজরা আমাদের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের পথ থেকে সরাতে মার্কসবাদী বইপত্র সরবরাহ করতো। দেখা গেলো, জেলখানায় সবাই মার্কসবাদ পড়ছে। আমরা আন্দামান জেলখানাকে ঘোষণা করলাম ‘মার্ক্সিস্ট ইউনিভার্সিটি’ হিসেবে।’’ (সূত্র: বিশেষজনের বিশেষ সাক্ষাৎকার, সম্পাদনা: রোবায়েত ফেরদৌস ও ফিরোজ জামান চৌধুরী)
ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারের লাইব্রেরিতে রয়েছে অনেক দুষ্প্রাপ্য বই। ব্রিটিশ আমল থেকে এ পর্যন্ত রাজনীতিকসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি গ্রেফতার হয়ে এই কারাগারে থেকেছেন, তাদের কেউ কেউ জ্ঞানে আরও সমৃদ্ধ ও আলোকিত মানুষ হয়ে বের হয়েছেন। কেবল ঢাকায় নয়, বিশ্বের সব দেশের কারাগারে বন্দিদের জ্ঞান অর্জনের জন্য রয়েছে লাইব্রেরি।
ঢাকা জেলের লাইব্রেরি প্রসঙ্গে অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন প্রয়াত কামরুদ্দীন আহমদ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সামরিক আইনে তিনি গ্রেফতার হয়ে ঢাকা জেলে ছিলেন। ছাড়া পান ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। জেলে বসেই তিনি ‘বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি শেষ করেছিলেন। বইটির সূচনায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘কারাগারের গ্রন্থশালায় বহু মনীষীর লেখা পুস্তক রয়েছে এবং আমি প্রায় সবই পড়েছি বলে আমার মনে হয়। কিন্তু এরা সবই নিরাপত্তা আইনে বন্দি ছিলেন। মার্শাল ল’তে বা ফৌজি আইনে বন্দিদের মধ্যে কিছু লিখেছেন— এমন কোনও লেখকের লেখা অন্তত জেল লাইব্রেরিতে আমি পাইনি।।’
১৯৬৩-৬৫ সালে ঢাকা কারাগারে বন্দি ছিলেন সিরাজুল আলম খান, যিনি নিউক্লিয়াসের মূল নেতা, স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও জাসদের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি লিখেছেন— ‘‘ঢাকা জেলের লাইব্রেরিটি ছিল অতি উন্নত মানের। ব্রিটিশ আমল থেকে যেসব স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবীরা ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন, তাঁদের পড়াশুনার মান যে কত উন্নত পর্যায়ের ছিল, জেল লাইব্রেরির বইগুলো দেখলে তা সহজে বোঝা যায়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটলের রচনা, পরবর্তীকালের ইউরোপীয় পণ্ডিত ও দার্শনিক যেমন- কার্লাইল, হিউম, ভলতেয়ার, রুশো, লক এঁদের লেখা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রগুলোর উত্থানের ইতিহাস, রাশিয়ার ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের ইতিহাস, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, ট্রটস্কি, প্লেখানভের রচনা— এসব পড়ার সুযোগ হয় আমার জেলখানাতে বসেই। যুদ্ধবিগ্রহের ওপরে আমি প্রথম যে বইটি পড়ি তা ছিল থুসিডাইডিসের ‘পেলোপনেশিয়ান ওয়ার’। পড়ি হেগেলের জার্মান ফিলোসফিসহ আরও অনেক বইপত্র। তা ছাড়া ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের নানা বই, যেমন- ইবনে খালদুনের ভারততত্ত্ব, উইনস্টন চার্চিলের হিস্ট্রি অব দ্য ইংলিশ স্পিকিং পিপল, হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি প্রভৃতির সঙ্গেও আমার পরিচয় ঘটে জেলেই।’ (আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য, অনুলিখন: শামসুদ্দিন পেয়ারা)
কিন্তু নভেল পড়ার দায়ে পণ্ডিত মশাইয়ের বেত আর মার্কসবাদী বই রাখার দায়ে মিলিটারির বেত— এই দুইয়ের মাঝে যে কতখানি তফাৎ তা বেত্রাঘাতের পর বারী ভাইকে যারা সচক্ষে দেখেছেন, কেবল তারাই হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। নয়টি বেত খাওয়ার পর বারী ভাই বলতে গেলে পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন।
রাজনীতিক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। সেসময় ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গ্রেফতার হন। সেটাই তার প্রথম কারাবাস। এরপর আরও অনেকবার তিনি জেলে ছিলেন। শেষবার জেল খাটেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথমবার যখন জেলে ছিলেন একই সময় ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাবা কফিলউদ্দিন চৌধুরী ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বাবা প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমেদ। তার ছেলে দারাও একই সময়ে কারাগারে ছিলেন। বাবা ও ছেলে জেলের একই কক্ষে থাকতেন। বন্দিরা স্বভাবতই বাইরের খবর জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। তাদের খবর জানার প্রধান উপায় হচ্ছে খবরের কাগজ। সে সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন শাহ মোয়াজ্জেম তার ‘ছাব্বিশ সেল’ নামের গ্রন্থে। (বলা বাহুল্য, দেশের শীর্ষ রাজনীতিকদের যারাই কারাগারে গেছেন, তাদের অনেকেরই জায়গা হতো ঢাকা জেলের ২৬ নম্বর সেলে। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনও ছিলেন এই সেলের বাসিন্দা)। তিনি লিখেছেন, ‘‘মানিক ভাই সংবাদপত্র জগতের মানুষ। সেলে কাগজ এলে সর্বাগ্রে সবক’টি তার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি সবগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে তার নিজস্ব পত্রিকা ‘ইত্তেফাক’ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। অন্য দু’জন (কফিলউদ্দিন চৌধুরী ও আবুল মনসুর আহমেদ) আর সব কাগজে মনোনিবেশ করেন। আমাদেরও পত্রিকা পড়ার ব্যাকুলতা কম নয়। কিন্তু ওখানে গিয়ে কাগজ আনা অসম্ভব। আমরা দারাকে ধরি, তুমি আমাদের ম্যানেজার বটে। পিতার টেবিল থেকে কাগজ এনে দাও। দারা বলে, ‘ভাই, তার চাইতে আমাকে দুই- চারটি চড়-থাপ্পড় মারুন, সেটাও অনেক ভালো। ওখানে গিয়ে কাগজ আনার চেয়ে সেটা হজম করা সহজতর।’’
শেষবার যখন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন জেলে ছিলেন, সে সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন তিনি— ‘জেল লাইব্রেরিতে আমার লেখা ‘নিত্য কারাগারে’ বইটি রয়েছে। বইটির আগ্রহী পাঠকের অভাব নেই। অতিরিক্ত ব্যবহারে প্রথম দিকের কয়েকটি পৃষ্ঠা বিনষ্ট হয়েছে। লাইব্রেরিয়ান আমাকে সে কথা জানালে সালেহাকে (স্ত্রী) বলেছিলাম, নতুন সংস্করণের দুটি বই জেল লাইব্রেরিতে দিও। সে বই নিয়ে আসে। ওরা নোকতা তোলে, একটা দরখাস্ত দিয়ে বই দুটি লাইব্রেরিতে দানের জন্য সুপারের অনুমতি চাইতে হবে। বলি, এই বই আপনাদের লাইব্রেরিতে ক্যাটালগভুক্ত। নতুন বই নয়। এর জন্য আবার দরখাস্ত কেন? তারা বলে, দরখাস্ত দিন। আমি জানিয়ে দেই, দরখাস্ত দেওয়ার অভ্যাস আমার নেই। তারা বই দুটি অবশ্য ফেরত দেয় না। যতদূর বুঝি, পরিবার-পরিজন নিয়ে তা পড়ছে। তবু পড়ুক, দুই নম্বরী করে হলেও বই পড়া ভালো।’
১৯৬৪-৬৫ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ছিলেন রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো। জেলের ভেতরে পড়াশুনা এবং এই লাইব্রেরির বিষয়ে তিনি জানাচ্ছেন, ‘জেলখানায় বেআইনিভাবে একটা বই এসেছিল— নাম ‘এসেন্সিয়াল লেফট’। এই বইটি ছিল তিনটি কী চারটি রচনার সংকলন। তার মধ্যে ছিল কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো, এঙ্গেলসের সোশ্যালিজম সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইউটোপিয়া, লেনিনের স্টেট অ্যান্ড রেভ্যুলুশন। এই রচনাগুলো ছিল আমাদের পাঠ্য। কমরেড রবি নিয়োগী খুব চমৎকার পড়াতে পারতেন। কারাজীবনে একবছর একটা বিরাট অবসর সময়। তাস খেলে গল্প করে সময় কাটালেও ফাঁকে ফাঁকে বেশ পড়াশুনা করেছি। জেলা লাইব্রেরিটাও ভালো ছিল। তাছাড়া বাইরে থেকে বই আনিয়েছি। সাহিত্যের বই ছাড়াও আমি অর্থনীতি, দর্শন ও ইতিহাসের ওপরও কিছু পড়াশুনা করেছি।’
সিরাজ সিকদার গ্রেফতার ও নিহত হলে সর্বহারা পার্টি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ব্যাপকহারে খুনোখুনিতে পরিণত হয়। সিকদারের ঘনিষ্ট কেন্দ্রীয় নেতা রইস উদ্দীন আরিফ এ সময় গ্রেফতার হয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ছিলেন। বর্তমানে তিনি রাজনীতি ছেড়ে মুক্ত জীবনযাপন করছেন। সর্বহারা পার্টির রাজনীতি নিয়ে নব্বইয়ের দশকে তিনি ‘আণ্ডার গ্রাউন্ড জীবন’ নামে দুই খণ্ডের বই লিখেছেন। প্রথম খণ্ডে জেলে এবং জেলের বাইরে তার বইপড়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘জেল জীবনে সেলে বসবাস করার ফলে যেসব বাড়তি সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে— নিরিবিলি পরিবেশে বইপড়ার সুযোগ। আগেই উল্লেখ করেছি, অতীত ও বর্তমানে বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক বন্দিদের উদ্যোগে বলা যায় ‘পুরুষানুক্রমিক’ভাবে জেলের ভেতরে কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে গড়ে উঠেছে মার্কসবাদী সাহিত্যের গোপন সংগ্রহশালা। সেই সুবাদে জেলের নিরিবিলি পরিবেশে মার্কস-লেনিন-মাও’র লেখা বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনা নতুন করে পড়ার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘পঞ্চাশের দশকে কলেজ জীবনে পা দিয়ে ‘সাম্যবাদের ভূমিকা’ আর ‘ছোটদের অর্থনীত’ পুস্তিকা দুটো মার্কসবাদ অধ্যয়নে আমার হাতে খড়ি। কমিউনিজম ও মার্কসবাদের ওপরে বই-পত্র আজকাল যেমন ফুটপাতেও গড়াগড়ি করে, তখনকার দিনে আমাদের দেশে এমনটি ভাবতেই পারা যেতো না।
১৯৫৮-৫৯ সালের কথা মনে পড়ে, আইয়ুব খানের মার্শাল ল জারি হওয়ার পর ময়মনসিংহের সংগ্রামী কমিউনিস্ট নেতা কাজী বারী (বারী ভাই) আইয়ুব শাহীর মিলিটারির হাতে গ্রেফতার হয়ে সামরিক বেত খেয়েছিলেন, শুধুমাত্র মার্কস-লেনিনের কয়েকখানা বই রাখার অপরাধে। ছেলেবেলায় গ্রামের স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়াকালে সম্ভবত শামসুদ্দীন আবুল কালামের লেখা ‘কাশবনের কন্যা’ উপন্যাসটি ক্লাসে বসে পড়ার দায়ে একবার শশাঙ্ক পণ্ডিতের হাতে বেত খেয়েছিলাম। কিন্তু নভেল পড়ার দায়ে পণ্ডিত মশাইয়ের বেত আর মার্কসবাদী বই রাখার দায়ে মিলিটারির বেত— এই দুইয়ের মাঝে যে কতখানি তফাৎ তা বেত্রাঘাতের পর বারী ভাইকে যারা সচক্ষে দেখেছেন, কেবল তারাই হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। নয়টি বেত খাওয়ার পর বারী ভাই বলতে গেলে পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। বাকি জীবন ধুকতে ধুকতে সেই পঙ্গুত্ব তিনি ঘুচিয়েছিলেন অকাল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। সে সময় কাজী বারীর মতো কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত একজন রাজনৈতিক কর্মীকে এত নিষ্ঠুর নির্যাতনটি ভোগ করতে হয়েছিল শুধুমাত্র মার্কস-লেনিনের দুইখানা বই ঘরে রাখার দায়ে। তবে ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছিল প্রগতিমনা তরুণদের মনকে। আজ মনে পড়ে, আইয়ুব খানের বেতের ভয়কে উপেক্ষা করে আমরা সেদিন মার্কস-লেনিনের একখানা বই পড়ার জন্য দানা-পানি বন্ধ করে বই সংগ্রহের জন্য ছুটোছুটি করেছি। আর এখন? প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের জেলখানায় মার্কসবাদী পুস্তকের লাইব্রেরি, শহর-নগর-বন্দরের ফুটপাতে মার্কস-লেনিন-মাওয়ের লেখা বইয়ের ছড়াছড়ি।’’
আমি হয়তো কিছু বলছি। কিন্তু ’৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে শুরু করে ’৫৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বন্দি রাজনৈতিক কর্মী আর তাদের নেতৃত্বের অবদানের কথা বাদ দিলে পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক বিকাশ বুঝতে পারবেন না।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে দেখা হয় একজন সুবিধাবাদী রাজনীতিক হিসেবে। পদ আর ক্ষমতার জন্য বারবার দল বদল করার কারণে দেশে অনেকেই তাকে অপছন্দ করতেন। আবার এই মওদুদই যখন লেখক হিসেবে হাজির হন, তখন তিনি পাঠকের কাছে বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক হিসেবে এমনকি তার শত্রুরাও তাকে প্রশংসা করেন। কারণ, তিনি যখন লিখতে বসতেন তখন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। নেতানেত্রী, দল ও গোষ্ঠী প্রীতির বাইরে থেকে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ঘটনার বিশ্লেষণ ও তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন তিনি। হতে পারে এজন্যই নোম চমস্কি মওদুদ আহমদের লেখাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘অন্ধাকারে আলোকসংকেত’ বলে। উইলিয়াম শোক্রসও তার লেখা পছন্দ করেন। ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক জন পিলিজার ওয়ান-ইলেভেনের সময় মওদুদের পক্ষে শুধু লিখেই ক্ষান্ত হননি, তার জামিনের জন্য ফখরুদ্দীন আহমদকে ইমেইল করেছিলেন, যা তখন আদালতেও উপস্থাপন করা হয়েছিল। মজার ব্যাপার এই যে, মওদুদ আহমদ যে কয়বার জেলে গেছেন, সময়টাকে তিনি লেখার কাজে লাগিয়েছেন। পরে তা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
মওদুদ আহমদের বিষয়ে প্রবীণ সাংবাদিক আমানুল্লাহ বলেছেন, ‘হি ইজ আ লার্নেড পারসন। অ্যাকাডেমিক্যালি ব্রিলিয়ান্ট। হি ইজ আর ভেরি গুড রাইটার। উনার রাইটিং পারসোনালিটি, সেটা কিন্তু ওয়েল প্রটেক্টেড ফ্রম হিজ পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স।’ তিনি আরও বলেন, ‘মওদুদ আহমদ একজন অথর। অ্যাজ আ রাইটার অব পলিটিক্যাল হিস্ট্রি, পলিটিক্যাল অ্যানালিসিস, এ ব্যাপারে হি কিপস ডার্টি পলিটিকস অ্যাপার্ট। আমি তো উনার একাধিক বই পড়েছি। আমার কালেকশনেও আছে। অ্যাজ অ্যান অথর হি উইল বি রিমেম্বার্ড। আর অ্যাজ পলিটিশিয়ান, হি উইল বি ডিজলাইকড অ্যান্ড রিমেম্বার্ড।’ (ইতিহাসের যাত্রী: মহিউদ্দিন আহমদ।)
সরদার ফজলুল করিম ‘কমিউনিস্ট’— এই অভিযোগে পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকায়। প্রথমে ঢাকা জেল, তারপর সিলেট এবং সেখান থেকে রাজশাহী জেলে পাঠানো হয়। সেখানে বন্দিদের সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে বই পড়ার একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন তিনি তাঁর ‘নানাকথা এবং নানাকথার পরের কথা’ শীর্ষক গ্রন্থে। তাঁর বর্ণনাটি এরকম— ‘আমি তখন রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে আবব্ধ। যে ওয়ার্ডে থাকি সেটার নম্বর হয়তো পাঁচ। এখন ভুলে গেছি। একটা লম্বা হল ঘর। পাশে কম। দুটো লোহার চৌকি পাতলে মাঝখান দিয়ে এক ফালি হাঁটার পথ। রাতে এক ঘরের মধ্যে তালাবদ্ধ থাকতাম। ওয়ার্ডের মধ্যে পঞ্চাশ কী ষাট জন বন্দির বাস।… যারা বয়স্ক তারা লেখাপড়া তেমন জানে না।’
‘‘… এই সময় আমার হাতে এলো একখানা রাজনৈতিক ইংরেজি উপন্যাস। যুদ্ধের সময়কার সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ইংরেজ সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্কের পটভূমিকায় একজন অস্ট্রেলিয় সাংবাদিকের লেখা প্রায় হাজার পৃষ্ঠার বই নাম ‘ডিপ্লোম্যাট’। স্টালিন তখন সোভিয়েট রাশিয়ার রহস্যময় পুরুষ। তাঁর সঙ্গে সেদেশের কিংবা বিদেশের কোনো নেতা বা সাংবাদিকের সাক্ষাতের এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। সেই রহস্য পুরুষকে ঘিরে এ উপন্যাসের কাহিনি। আমি ঠিক করলাম, এ উপন্যাস আমি কৃষক কর্মীদের নিয়ে যৌথভাবে পড়বো। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রোজ দুপুরে খাওয়ার পরে আমরা গোল হয়ে এই বই পড়তে বসতাম। আমি কয়েক লাইন ইংরেজি পড়তাম। তারপর সেই কয়েক লাইনের বাংলা অনুবাদ করতাম। আবার কিছু দূর ইংরেজি পড়তাম। আবার সেটুকুর বাংলা করতাম।… এমনই করে রোজ চলতো ‘ডিপ্লোম্যাটের’ কথকতা। হাজার পৃষ্ঠার বই হাজার দিন না লাগলেও পাঁচশ’ দিনের কাছাকাছি নিশ্চয়ই লেগেছিল।’’
সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন, ‘এখন আমরা বই পড়ি একা একা। কেউ কারু মনের আনন্দের খোরাক অন্যকে দেইনে। আমরা বলিনে কাউকে ডেকে— এই বইখানা পড়েছেন? এই দেখুন না এই জায়গাটাতে কেমন লিখেছে! কিন্তু একদিন ছিল যখন আমরা এমন পরস্পর বিচ্ছিন্ন একটি আত্মদ্বীপে বিচ্ছিন্ন আর নির্বাসিত হয়ে যাইনি। এক জনের মনের জ্ঞানের আনন্দ অপরকে না দিতে পারলে নিজেকে অতৃপ্ত মনে হতো।’
আরেক সাক্ষাৎকারে সরদার বলেন, ‘জেলখানা এক ভিন্ন জগৎ। বাইরের পৃথিবীর চেয়ে কঠিন। জেলখানায় বন্দি রাজনৈতিক কর্মীদের অবদানের এই অধ্যায়টা সুবিনস্তভাবে লেখা হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো কিছু পাচ্ছেন আব্দুস শহীদের লেখায়। গাজীউল হকের বক্তৃতায়। আমি হয়তো কিছু বলছি। কিন্তু ’৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে শুরু করে ’৫৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বন্দি রাজনৈতিক কর্মী আর তাদের নেতৃত্বের অবদানের কথা বাদ দিলে পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক বিকাশ বুঝতে পারবেন না। ভাসা ভাসা একটা রূপরেখা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু নিবিড় অনুধাবন কখনোই সম্ভব না।’
‘‘কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতার যে আন্দোলন শুরু হয়, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী তাতে অংশগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে সিরাজীর ‘অনল প্রবাহ’ বাজেয়াপ্ত করে এবং সিরাজীকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। ‘অনল প্রবাহ’ সম্ভবত প্রথম কাব্যগ্রন্থ, যা সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং সিরাজী প্রথম কবি যিনি কবিতা লেখার জন্য প্রথম দণ্ডিত হন। সেই হিসেবে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী একজন পয়লা কাতারের দেশভক্ত বীর।’’ (ইতিহাস কথা কয়: মোহাম্মদ মোদাব্বের)
চলবে…