পর্ব-১৬
খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন ঢাকা নবাববাড়ির ঘরজামাইয়ের ছেলে। তার মা বিলকিস বানু নবাব সলিমুল্লাহ’র বোন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্ত বাতিলের কারণে ব্রিটিশদের প্রতি অভিমান করে সলিমুল্লাহ রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। তার ছেলে নবাব হাবিবুল্লাহ তখন আমোদ-ফুর্তিতে ব্যস্ত। এই সুযোগে ব্রিটিশ রাজের উদার সহযোগিতায় খাজা নাজিমুদ্দিন এবং তার ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দিন রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন দীর্ঘ সময় রাজনীতি করলেও গণনির্বাচনে কোনোদিনও জিততে পারেননি। কেমব্রিজের ডিগ্রিধারী, উচ্চ শিক্ষিত, ভদ্র ও মার্জিত হলেও তৃণমূলে তার সমর্থন ছিল না। প্রথম জীবনে ব্রিটিশ ও অবাঙালি ব্যবসায়ী মহলের পৃষ্ঠপোষকতা এবং পরবর্তীকালে জিন্নার পৃষ্ঠপোষকতার ওপরেই ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের ভরসা। আরও পরে ফজলুর রহমান (বেক্সিমকোর সালমান এফ রহমানের বাবা) ও ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দিন ছিলেন তার বুদ্ধিদাতা। শাহাবুদ্দিনকে লোকে জানতো ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ বলে, কেউ তাকে বিশ্বাস করতো না। সত্যি বলতে সবাই তাঁকে ভয় করতো। তিনি নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সব সময় বড় ভাই নাজিমুদ্দিনকে ব্যবহার করতেন। খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন আসলেই সরল মানুষ। আবুল হাশিম বলতেন, ‘নাজিমুদ্দিন ওয়াজ ভেরি সিম্পল অ্যান্ড সো সিম্পল দ্যাট হিজ সিম্পলিসিটি কুড বি মেজার্ড ইন টোনস।’ অর্থাৎ এভাবেও বলা যায়, তিনি ছিলেন মূলত বোকা।
নাজিমুদ্দিন রাতেবেলা কিচ্ছা-কাহিনি বলতে ভালো বাসতেন। অফুরন্ত ছিল তার কিচ্ছার ভাণ্ডার, আর সে কিচ্ছা শোনার জন্য তার ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজন সবাই ড্রইং রুমে জমা হতো। গভীর রাত পর্যন্ত চলতো এই কিচ্ছা-কাহিনি। দুর্ভাগ্যবশত এ কারণেই জেনারেল ওয়াউদ্দীন তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলেন। জেনারেলের স্ত্রী ছিলেন স্যার নাজিমুদ্দিনের মেয়ে। আর জেনারেল ওয়াসিউদ্দিন ছিলেন তার ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দিনের ছেলে। স্বাধীনতা লাভের পর লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াসিউদ্দিন পাকিস্তান থেকে ঢাকায় পদার্পণ করলে জেনারেল ওসমানী বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে। ফলে সেনাবাহিনীর মাঝে তখন গুঞ্জন ওঠে—ওসমানীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে ওয়াসিউদ্দিনকে সেনাপ্রধানের পদে বসানো হবে নাতো! পরে যদিও বঙ্গবন্ধু তাকে রাষ্ট্রদূত করে বিদেশে পাঠিয়ে দেন।
নাজিমুদ্দিন প্রায়ই বাড়িতে কাওয়ালির আসর বসাতেন। ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী ও নাজিমুদ্দিন মুরগি, মোসাল্লেম ও জর্দা খেতে খুব ভালোবাসতেন। সোহরাওয়ার্দী ঝাল খেতে পছন্দ করতেন। ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, ফল সবকিছু খেতেন ফজলুল হক। আম খেতে শুরু করলে একঝাঁকি আম খেয়ে ফেলতেন। তবে অপর দু’জন যেমন সাহেবি কায়দায় খেতেন, অর্থাৎ কাঁটাচামচে— ফজলুল হক হাত দিয়েই খেতে ভালোবাসতেন।
টাঙ্গাইলের রায়বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহার (আরপি সাহা) জনহিতকর কাজ সম্পর্কে আগে থেকে অবহিত ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ভারতেশ্বরী হোমস এবং কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পেছনে সোহরাওয়ার্দীর অবদানের কথা লিখেছেন মাহমুদ নূরুল হুদা তার আত্মজীবনীতে। চল্লিশের দশকে নোয়াখালীর এই নূরুল হুদা ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক সচিব। তিনি লিখেছেন, ‘‘সোহরাওয়ার্দী সাহেব আরপি সাহাকে ডেকে বললেন, ‘আমি তোমাকে একটা বড় কাজ দেবো। কাজটি যদি তুমি ঠিকভাবে করতে পারো, তা হলে দেশবাসী উপকৃত হবে। বাংলাদেশের তাঁতিদের হাতে সুতা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি তোমাকে সারা বাংলার সুতার ডিস্ট্রিবিউটর নিযুক্ত করবো। তুমি বেঙ্গল রিভার সার্ভিসের মালিক, তোমার কাছে লঞ্চ ও বড় বড় বোট আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি তাতিদের কাছে সুতা পৌঁছে দাও। এই কাজে তোমার যত লাভ হবে, তা দিয়ে তুমি জনহিতকর কাজ করতে পারবে।’ আরপি সাহা বললেন, ‘স্যার, আমি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো।’ এই কাজের লাভ থেকেই আরপি সাহা তার মায়ের নামে মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৪ সালে হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন গভর্নর লর্ড কেসি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় আরপি সাহা টাঙ্গাইলে অনেকগুলো লঙ্গরখানা খুলেছিলেন। দুর্ভিক্ষ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই লঙ্গরখানা চালু ছিল।
তার ভাড়া বাড়ির অস্থাবর সম্পত্তি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হলো।
‘কুমুদিনী হাসপাতালের ব্যয় নির্বাহের জন্য সোহরাওয়ার্দীর অন্য একটি সহযোগিতার কথা স্মরণীয়। একটি বিখ্যাত বিদেশি পাট ব্যবসার কোম্পানি কেনার ব্যাপারে তিনি আরপি সাহাকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিলেন।’
খুব কাছ থেকে দেখা সোহরাওয়ার্দীর দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্পর্কে নূরুল হুদা লিখেছেন, ‘আমি যখন সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে কাছ থেকে প্রথম দেখি, তখন তিনি (কলকাতার) তিন নম্বর ওয়েলেসলি ফার্স্ট লেনে থাকতেন। এরপর তিনি ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডে আসেন। কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী পরিবারের একমাত্র লে. কর্নেল স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দী (শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মামা) ছাড়া আর কারও নিজস্ব বাড়ি ছিল না। তাই তারা সবাই ভাড়াটে বাড়িতে থাকতেন। থিয়েটার রোডের বাড়িটি ছিল দোতলা। পেছনে বিরাট লন। লনের চারধার বাগান। নিচের তলায় তার বাবা জাস্টিস স্যার জাহেদ সোহরাওয়ার্দী থাকতেন। এ সময় তিনি অবসর জীবন-যাপন করছিলেন। তার দেখাশুনার জন্য একজন মধ্যবয়সী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলা নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়া বয়, বেয়াড়া, বাবুর্চি তো ছিলই। তার খাওয়া-দাওয়ার স্বতন্ত্র ব্যবস্থা ছিল। স্যার জাহেদের বিখ্যাত লাইব্রেরিটি ছিল নিচতলায়।
ওপরতলার মাঝখানে একটি বড় ড্রইং রুম। দু’পাশে দু’টি আলাদা সুট ছিল। একপাশে থাকতেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, অন্যপাশে তার বড় ভাই শাহেদ সোহরাওয়ার্দী। শাহেদ অবিবাহিত ছিলেন। শোয়ার ঘরেই ছিল তার লাইব্রেরি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী ক্লাব লাইফ পছন্দ করতেন। প্রায়ই তিনি রাতের খাবার ক্লাবে খেতেন। দুপুরের খাবার সাধারণত ‘ফাপো’ বা ‘ফেলেটিস’ হোটেল খেতেন। …তিনি বিখ্যাত থ্রি হান্ড্রেড ক্লাবের সদস্য ছিলেন। এই ক্লাবে রাতে উঁচু ধরনের ইংলিশ মিউজিক চলতো এবং মাঝে মাঝে মিউজিকের সঙ্গে নাচও হতো। সোহরাওয়ার্দী সাহেব নিজেও পাশ্চাত্য নাচ ভালো নাচতে পারতেন। …সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সমস্ত শরীর ম্যাসাজ করাতেন। যখন যেখানে যেতেন শরীর ম্যাসাজ করার ব্যবস্থা করতেন। তিনি ঢাকায় এলে নোয়াখালীর মকবুল তার শরীর ম্যাসাজ করতেন। তার এই অভ্যাসের কথা আওয়ামী লীগে তার ঘনিষ্ঠ কর্মীদের জানা ছিল। আর কাউকে না পেলে তাদেরই একজন তার অনুমতি নিয়ে এই কাজে লেগে পড়তো। …সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বাথরুমের কর্মকাণ্ড খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কমোডের দু’পাশে দুটি মোড়া থাকতো। এক মোড়ায় খবরের কাগজ, জরুরি ফাইল ও চিঠিপত্র রাখা হতো। অন্য মোড়ায় টেলিফোন, নোটবুক ও কলম থাকতো। সময় দেখার জন্য কমোডের উল্টোদিকে ঘড়ি রাখা ছিল। …বিলেত থেকে ফেরার পর ১৯২০ সালে ২৮ বছর বয়সে স্যার আবদুর রহিমের মেয়ে নিয়াজ ফাতেমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের দুই বছর পর স্ত্রী মারা যান। এর প্রায় ১৮ বছর পর ১৯৪০ সালে তিনি ভেরা টিসেস্কো নামে এক রুশ মহিলাকে বিয়ে করেন। ১৯৪৬ সালে এই বিয়ে ভেঙে যায়। এ সময় তার বয়স ছিল ৫৪ বছর। এরপর তিনি আর বিয়ে করেননি। মৃত্যুকালে তার বিশেষ কোনও সম্পত্তি বা ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল না। … মন্ত্রিত্বের ১০ বছর এবং আইন পেশার ৩৪ বছরে তার উপার্জিত আয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, রাজনৈতিক কর্মী, আত্মীয় স্বজন ও আশ্রিত লোকজনরে জন্য ব্যয় করতেন।
…যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সোহরাওয়ার্দী সাহেবের অবদান ছিল মৗলিক এবং প্রারম্ভিক, সেই পাকিস্তানে নিজের অংশেই (পূর্ববঙ্গ) তাঁকে যখন অবাঞ্ছিত বিবেচনা করা হলো, তখন খণ্ডিত ভারতের কাছেইবা তিনি কতটা ভালো ব্যবহার প্রত্যাশা করতে পারেন? ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে তার প্রতি ভারত সরকার বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ তোলে। তাঁকে পাকিস্তানের চর হিসেবে চিন্তিত করা হয়। ভারত ছাড়তে বাধ্য করার কৌশল হিসেবে তার ওপরে বিরাট অঙ্কের কর চাপিয়ে দেওয়া হয়, যা পরিশোধ করা ছিল আয়ত্তের বাইরে। তার ভাড়া বাড়ির অস্থাবর সম্পত্তি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হলো। পূর্ববঙ্গে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ১৯৪৯ সালের ৫ মার্চে তিনি রিক্ত হাতে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।
…১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সকাল ৩টা ২০ মিনিটে বৈরুতের হোটেল ইন্টারন্যাশনালে সোহরাওয়ার্দী মারা যান। ৭ ডিসেম্বর সকালে প্রথমে করাচি এবং পরে সকাল ১০টা ১৭ মিনিটে সোহরাওয়ার্দীর লাশ তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। …আমি বিমানে উঠি। ক্রুদের সহযোগিতায় তার কফিন প্লেনের দরজার কাছে এনে অপেক্ষমান ট্রাকে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের কাছে হস্তান্তর করি। লাশ গ্রহণের সময় শেখ মুজিব যে আর্তনাদ করে উঠলেন, তা উপস্থিত জনতাকে উদ্বেলিত করে তোলে। এক সময় তাকিয়ে দেখি, মওলানা ভাসানী গালে হাত দিয়ে রানওয়েতে বসে কাঁদছেন। রেসকোর্স ময়দানে তার জানাজায় ইমামতি করেছিলেন পীর মোহসীন উদ্দীন সাহেব (দুদু মিয়া), জানাজায় আনুমানিক পাঁচ লাখ লোক অংশ নেয়। …ভিড় ঠেলে কবরে নেমে পড়লাম। ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী, জামাতা সোলায়মান ও ড. কামাল হোসেনও আমার সঙ্গে কবরে নেমেছিলেন। (আমার আত্মজীবনী: মাহমুদ নূরুল হুদা)
তাদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের কোনো সংঘাত ছিল না। তবে তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল।
শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শবযাত্রায় শরিক হয়েছিলেন পলিটিক্যাল ইকোনমিস্ট রেহমান সোবহান। সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘পুরনো বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স অবধি মোটরগাড়ির শোভাযাত্রার পুরোভাগে তার ছেলে রাশেদের সঙ্গে খোলা জিপে বসেছিলাম আমি। রেসকোর্সে পৌঁছাতে আমাদের কয়েকঘণ্টা লেগে যায়। সেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন গভীর শোকাচ্ছন্ন বঙ্গবন্ধু। সোহরাওয়ার্দীকে সমাধিস্থ করা হলো বাংলার রাজনীতিতে তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী শেরেবাংলার পাশে, যেখানে পরের বছর সমাধিস্থ হলেন তার আরেক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আমার নানা খাজা নাজিমুদ্দিন। (নাজিমুদ্দিন ছিলেন রেহমান সোবহানের মা হাসমাত আরা বেগমের মামা)।
রেহমান সোবহান আরও লিখেছেন, ‘প্রায় একযুগ বাদে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিন পালনের সময় অগণিত শুভার্থী তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ঢেকে দেয়। সেই সন্ধ্যায় জনতা বিদায় নিলে বঙ্গবন্ধু ওই ফুলের পাহাড় তিন নেতার মাজারে নিয়ে গিয়ে তার ‘বস’ (সোহরাওয়ার্দী)-এর সমাধিতে রেখে আসেন। সম্প্রতি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর কিছু ডায়েরিতে দেখা যায়, তিনি ‘বস’-এর প্রতি তার ঋণের কথা স্বীকার করেছেন। (রেহমান সোবহান, আনট্রানকুইল রিকালেকশনস: দ্য ইয়ার্স অব ফুলফিলমেন্ট, দিল্লি)
প্রসঙ্গত, মাহমুদ নূরুল হদা তার ভাষ্যে বলেছেন, বিমানবন্দরে প্লেনের দরজায় সোহরাওয়ার্দীর লাশের কফিন বঙ্গবন্ধুর কাছে হস্তান্তর করেন। তার মানে বঙ্গবন্ধু ওই সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে রেহমান সোবহানের বক্তব্য ঠিক তার উল্টো। তিনি জানান, ‘সেখানে (রেসকোর্স ময়দানে) আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন গভীর শোকাচ্ছন্ন বঙ্গবন্ধু।’ রেহমান সোবহানের দাবি, তিনি খোলা গাড়িতে শবযাত্রায় শরিক হয়েছিলেন। রেহমান সে সময় বয়সে ছিলেন তরুণ। সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার তেমন একটা ঘনিষ্ঠতাও ছিল না। আর নূরুল হুদার বয়স তখন সাত চল্লিশ, তিনি বয়সে বঙ্গবন্ধুর বড় ছিলেন। যেহেতু তিনি ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক সচিব, তাই প্লেনে উঠে নেতার লাশের কফিন নামানোর মতো গ্রহণযোগ্যতা তার ছিল। সুতরাং, তিনি যে বঙ্গবন্ধুর কাছে কফিন হস্তান্তর করেছেন এবং বঙ্গবন্ধু সে সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন— এই বক্তব্যকে আমরা সঠিক বলে ধরে নিতে পারি।
শিশু একাডেমির পশ্চিম পাশে অনেকটাই অযত্ন আর অবহেলায় ইতিহাসের স্মারক হয়ে শুয়ে আছেন তিন নেতা— এ কে ফজুলল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর খাজা নাজিমুদ্দিন। এদের মধ্যে শেষের জন ছিলেন রাজনীতিতে প্রথম দু’জনের বিপরীত মেরুর। তারপরও কী করে এই তিন নেতার কবর একই জায়গায় এবং খাজা নাজিমুদ্দিন অপর দু’জনের ঠিক মাঝখানে ঠাঁই পেলেন, তা নিয়ে আজও অনেকের মনে প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় রাজনীতিক ও কূটনীতিক কামরুদ্দীন আহমদের লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৬২ সালে এ কে ফজলুল হকের মৃত্যু হয়, ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যু এবং ১৯৬৪ সালে নাজিমুদ্দিন সাহেবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবিভক্ত বাংলার তিন প্রধানমন্ত্রীর জীবনাবসান ঘটলো। হক সাহেব ও সোহরাওয়ার্দী সাহেব দু’জনই ঢাকা হাইকোর্টের বিখ্যাত উকিল ছিলেন। তাই হাইকোর্টের কর্নারে তাদের দাফন করার ব্যবস্থা হলো। দুটো কবরের মাঝখানে কোরআন তেলাওয়াত করার জন্য ঘর তৈরি করা হলো। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর দশ মাস পরে খাজা সাহেব ইন্তেকাল করেন এবং মুসলিম লীগ কর্মীরা তার মরদেহ দাফনের জন্য হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে নিয়ে আসেন। শেখ মুজিব খবর পেয়ে হক সাহেব ও সোহরাওয়ার্দীর কবর দু’টোর মাঝে তাকে দাফন করার বিরোধিতা করেন। শেখ সাহেবের বক্তব্য ছিল যে, শহীদ মিনারের এত কাছে তাকে দাফন করতে দেওয়া হবে না। খাজা সাহেবের ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দিন সাহেব বললেন যে, তিনি তার ভাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে যেতে চান তাদের খান্দানের গোরস্তান পরিবাগে। কারণ, সেখানে মসজিদ আছে এবং সেখানে সর্বক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত ও দরূদ পাঠ করা হয়। কিন্তু মুসলিম লীগের কর্তারা ও কর্মীরা দাবি করলেন যে, অবিভক্ত বাংলার তিন প্রধানমন্ত্রীকে একই গোরস্তানে দাফন করতে হবে। মুসলিম লীগের কর্মীরা ইতোমধ্যে কোদাল হাতে, গোর খুঁড়তে শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত খাজা সাহেবকে প্রধান বিচারপতির অনিচ্ছা সত্ত্বেও দু’টো কবরের মাঝখানের খালি জায়গায় দাফন করা হলো। এই জায়গাটা এখন তিন নেতার মাজার নামে পরিচিত।
এরা তিনজনই দীর্ঘকাল রাজনীতি করেছেন। তিন জনই ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত একই মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের কোনো সংঘাত ছিল না। তবে তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল।’ (স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর: কামরুদ্দীন আহমদ)
চলবে…